বেশ কয়েকদিন আগে, একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগোর " Blindness" । উপন্যাসটি এক বিশেষ প্রকারের মহামারী নিয়ে। পর্তুগালের একটি শহরে আচমকাই এক মহামারীতে নাগরিকরা তাদের দৃষ্টি শক্তি হারাতে শুরু করে। এই অজানা রোগে সকলেই অন্ধ হয়ে যায়। এই মহামারীর মধ্যে, মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে নিয়েই তৈরি উপন্যাসটি। যখন পড়েছিলাম, তখন কি আর জানতাম, যে এই উপন্যাস কখনও বাস্তবে পরিণত হবে।
নিউ ইয়র্ক শহর এখন প্রায় সারামাগোর বর্ণিত পর্তুগালের সেই নামহীন শহরের মতন। উন্মাদনার শিখরে থাকা এই শহরে এখন যেন শ্মশানের শান্তি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকান ও ওষুধের দোকান বাদ দিয়ে প্রায় সবই বন্ধ। পাঁচ তারা ইতালীয় রেস্তোরাঁ হোক কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা কোন অভিবাসীর ঠেলা গাড়িতে করে বিক্রি করা হট ডগের দোকান, সবই অনির্দিষ্টি কালের জন্য বন্ধ। ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্ক থেকে সেন্ট্রাল পার্ক, জন এফ কেনেডি বুলেভার্ড থেকে ফিফথ এভিনিউ, সমস্ত রাজপথেই শুধু ধেয়ে চলেছে এম্বুলেন্স। গণপরিবাহন চললেও, যাদের কাজে যেতে হচ্ছে, তাঁরা অনেকেই রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকার দরুন গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছেন। কিন্তু সেও তুলনামূলক ভাবে নগন্যই বলা চলে। কোনদিন জনমানুষ শূন্য ম্যানহ্যাটানের ছবি দেখবো, ভাবিনি। যারা এই শহরে এসেছে, এই শহরকে চেনে, তাদের কাছে এই চিত্র অবিশ্বাস্য।
বর্তমানে (৬ই এপ্রিল) শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরে করোনাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭,৫৫১ ও মৃতের সংখ্যা ৩০৪৮। স্কুল, কলেজ মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে মার্চের ১২ তারিখ থেকে। আর সরকারি ভাবে লকডাউন শুরু হয়েছে ২০শে মার্চ থেকে। আসলে এরম পরিস্থিতি হতো না, যদি আর একটু আগে লকডাউনটা শুরু হতো। প্রায় ৫ দিন দেরি করে দিয়েছে নিউ ইয়র্ক সরকার। ১২ই মার্চ ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটন স্টেটের তুলনায় নিউ ইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু প্রায় সমান ছিলো, খুব বেশি তফাৎ ছিলো না। আর আজ, গোটা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫,১৫৮ ও মৃতের সংখ্যা ৩৫০। ক্যালিফোর্নিয়া সঠিক সময় লকডাউন করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, কিন্তু দেরি করে দেওয়ায় নিউ ইয়র্ক পারেনি।
নিউ ইয়র্ক শহরকে ৫টি বোরোতে ভাগ করা যায়। ম্যানহ্যাটান, ব্রুকলিন, কুইন্স, ব্রনক্স ও স্টেটেন আইল্যান্ড। এই ৫টি বোরোর মধ্যে, সব চাইতে বেশি করোনা আক্রান্ত মানুষ কুইন্স বোরোতে। আর একটু খতিয়ে দেখলে, কুইন্স এ আক্রান্তের সংখ্যা সব চাইতে বেশি জ্যাকসন হাইটস, ফ্লাসিং ও কাকতলীয় ভাবে করোনা নামক একটি অঞ্চলে। এই তিনটি অঞ্চলেই কিন্তু প্রচুর বাংলাদেশীদের বাস। বিশেষ করে জ্যাকসন হাইটস। করোনা ও ফ্ল্যাসিং এ বাংলাদেশি সহ চীনা ও ল্যাটিন আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি। কুইন্স বোরোর পরেই স্থান ব্রুকলিনের। ব্রুকলিনের ওইলিয়ামসবার্গ অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০০ র কাছাকাছি। ওইলিয়ামসবার্গ খুবই বিশ্বজনীন জায়গা, তাই সেখানে যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে, সেটা আশ্চর্যের নয়। এ ছাড়া ব্রুকলিনের যেই অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা সব চাইতে বেশি,যেমন বোরো পার্ক, সেখানে প্রায় ৮০% নিবাসী ইহুদি। আবার বেনসনহার্স্ট অঞ্চলের প্রায় ৪০% নিবাসী পূর্ব এশীয়।
সত্যি বলতে, প্রথম প্রথম যখন নিউ ইয়র্কে করোনা ধরা পড়ার কথা শুনি, বিশেষ পাত্তা দিইনি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি যে হতে পারে, তার আশঙ্কা টুকুও করিনি। মেট্রোতে, রাস্তা ঘাটে চাপা উৎকণ্ঠা খেয়াল করেছি ঠিকই, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল যে উন্নত দেশের লোকেরা অল্পতেই ভয় পায়। কিন্তু ক্রমশ এই ভয় ধীরে ধীরে সকলের মধ্যেই প্রবেশ করতে শুরু করলো, সকলেই আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পরতে লাগলো। কোথাউ কেউ হাঁচলে বা কাশলেই, লোকে একটু শিউরে উঠছে। ১২ই মার্চ কলেজ, ইউনিভার্সিটি ছুটি দেওয়ার আগে, আমার মতন অনেকেই চাইছিল যেন ছুটি দিয়ে দেয়। রোজ বাসে ট্রেনে করে উনিভার্সিটি যাওয়া, পড়াতে কলেজে যাওয়া যেন জীবন বাজি রেখে যাওয়ার মতন হয়ে গেছিল। তবুও এই সংক্রমণের ভয়াবহতা ঠাউরে উঠতে পারিনি। সারামগোর উপন্যাসের সাথে তুলনা করলে, মহামারীর শুরুতে যেমন থাকে, এক প্রকার ভয় মিশ্রিত অবিশ্বাস, তখন পরিস্থিতিটা তাই ছিলো।
সারামগোর উপন্যাসটিতে মহামারী ও তার সাথে সাথে মানুষের চিন্তন ও ব্যবহার বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রথমে আসে অবিশ্বাস, বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বীকার করবার এক করুন প্রচেষ্টা। তারপর আসে হতাশা, বিকারগ্রস্ততা। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার আদিম ইচ্ছার দরুন, তৈরি হয় কঠিন পরিস্থিতে সংবদ্ধ ভাবে লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা। হতাশার অধ্যায়ের পরের অধ্যায় এইটি। বিচার করে দেখলে, বর্তমানে, নিউ ইয়র্ক এই হতাশা ও সংবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকার, লড়াই করবার ইচ্ছার মাঝামাঝি একটি অধ্যায়তে রয়েছে। একদিকে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইসক্রিম ট্রাকে আর অন্য দিকে ৭৫০০০ অবসর প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একদিকে বসন্তের ফুলে ঢাকা সেন্ট্রাল পার্কে অস্থায়ী হাসপাতালের করুন চিত্র, অন্যদিকে দাঁতে দাঁত চেপে, নিদ্রাহীন অবস্থায় লড়াই করে যাচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। যথেষ্ট পরিমান মাস্ক নেই, পিপই নেই, স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে,পর্যাপ্ত পরিমান ভেন্টিলেটর নেই, তবুও এই শহর লড়ছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও লড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর কেমন চাপ পড়তে পারে, তাই নিয়ে একটি গণনা করেছে হার্ভার্ড গ্লোবাল হেল্থ ইনস্টিটিউট। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ম্যানহ্যাটানে বর্তমানে ১৪,৮৩৪ টি হাসপাতাল বেড আছে যার মধ্যে আপাতত ৩,০৫৯ টি বেড খালি আছে। আইসিইউ বেড আছে ১,৪২৭টি, যার মধ্যে ৬১৬টি বেড খালি আছে। হার্ভার্ড গ্লোবাল হেল্থ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ১২ মাসে, এই ১৪,৮৩৪টি বেডের মধ্যে, ৮,৯৪৬টি বেড খালি থাকতে পারে ও ১,৪২৭টি আইসিউ বেডের মধ্যে সম্ভাব্য ১,০২১ টি বেড খালিপাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই আগামী ১২ মাস যদি করোনা চলতে থাকে এবং তাতে ম্যানহ্যাটানে বসবাসকারী ২০% মানুষ যদি করোনাতে আক্রান্ত হয়, তাহলে ম্যানহ্যাটানে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৮,৩৪,৬৮৭ এবং এদের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পরবে ১,৭২,৩৩২ জনের ও আইসিইউ প্রয়োজন পরবে ৩৬, ৬৭৮ জনের। যদি ৪০% ম্যানহ্যাটান নিবাসী আক্রান্ত হন, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬,৬৯,৩৭৫, যাদের মধ্যে হাসপাতালে যেতে লাগবে ৩,৪৪,৭৪৪ জনের ও আইসিইউ লাগবে ৭৩,৩৫৭ জনের। এই পরিসংখ্যানগুলি দেখে বুঝতেই পারছেন কি ভয়াবহ আকার নিতে পারে করোনা এবং তার ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর কিধরণের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিস্থিতে যাতে না যায়, তাই মরণপণ লড়াই করে চলেছে স্বাস্থ্য কর্মীরা।
এত দূর অবধি সারামাগোর উপন্যাসের সাথে সাদৃশ্য পেলেও, আশা করবো ভবিষ্যতে যেন আর সাদৃশ্য না থাকে। কারণ উপন্যাস অনুযায়ী, মহামারীর পরের অধ্যায়গুলি ভয়ংকর। নিউ ইয়র্কের মতন শহরে লকডাউন করলে, তার অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় অকল্পনীয়। বহু সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে এই শহরের দৈনিক কার্যকলাপের উপর। এই মানুষগুলিও কিন্তু এক প্রকার, দিন আনি দিন খাই। আমেরিকার সরকার সকল আমেরিকার নাগরিকদের ১২০০ ডলার দেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু নিউ ইয়র্কের মতন শহরে $১২০০ ডলারে বাড়ি ভাড়াও মেটে না। তাই এই দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি কতদিন বাড়িতে বসে চালাতে পারবে তার ঠিক নেই। তাছাড়া প্রচুর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে প্রচুর মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। গত তিন সপ্তাহে, ৪,৫০,০০০ নিউ ইয়র্কবাসী বেকার ভাতার জন্য দরখাস্ত করেছে। অনেকেরই ধারণা নিউ ইয়র্ক মানেই ঝাঁ চকচকে ওয়াল স্ট্রিটে চাকরী করা সুট বুট পরাহিত কোন পুরুষ বা মহিলা। কিন্তু এই সংখ্যক মানুষ খুবই মুষ্টিমেয়। এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন ছোট খাটো ব্যবসা, বাণিজ্যের সাথে জড়িত। নিউ ইয়র্ক স্টেট, ডিপার্টমেন্ট অফলেবারের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে গোটা নিউ ইয়র্ক শহরে যতজন মোট কাজে নিযুক্ত, তাদের মধ্যে ১.১% নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত।প্রায় ৪% নিযুক্ত রেস্তোরাঁ ও পানশালার বিভিন্ন কাজে।৪% নিযুক্ত খুচরো ব্যবসায়, যাকে ইংরেজিতে বলে রিটেল ট্রেড। সব আর্থিক সংস্থান ধরলেও, তাতে নিযুক্ত ৫.৫%। শতাংশের হিসেবে কম হলেও, মন্দার কারণে, সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খুচরো ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ ও পানশালার ব্যবসায় নিযুক্ত যাঁরা। আর্থিক সংস্থায় চাকুরীরা কিন্তু সাধারণত মধ্যবিত্ত বা অবস্থাপন্ন খুচরো ব্যবসায় নিযুক্ত বা রেস্তোরাঁ-পানশালায় নিযুক্ত যাঁরা তাদের তুলনায়।আর্থিক সংস্থার চাকুরীদের চাকরির আশ্বাসন ও বেশি। খুচরো ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ- পানশালায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যার হিসেব ধরলে, প্রায় ৭,০০,০০০ মানুষ এই ব্যবসগুলিতে নিযুক্ত, আর ওদিকে আর্থিক সংস্থাগুলিতে নিযুক্ত ৪,০০,০০০ মতন। করোনার তৈরি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই ৭,০০,০০০ মানুষের কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা অনেকবেশি ৪,০০,০০০ আর্থিক সংস্থার কর্মীদের তুলনায়। এই ধরণের অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এক সময় নিউ ইয়র্ক ছিলো আমেরিকার সব চাইতে অপরাধ প্রবন শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। সেখান থেকে অনেকটাই উন্নতি করেছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সুযোগ থেকেই যায়। এই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া উপন্যাস অনুযায়ী চতুর্থ অধ্যায়। আইনের শাসন ভেঙে পরা। আশা করবো চতুর্থ অধ্যায়তে ঢোকার আগেই, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটবে।
বাংলাদেশী ভারতীয় বা আমেরিকানদের মধ্যে আক্রান্ত বা মৃতরা কি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণী বেশি? নাকি উপরের উদাঃ গুলির মত অবস্থাপন্ন ঘর বেশিরভাগ? হাসপাতালে গেলে চিকিতসা ফ্রি?