আর কোনো রসকষহীন প্রবন্ধ লেখা সম্ভব নয়। লেখাটা শেষ পর্যন্ত নিজের হয়েই বেঁচে থাকে, বহুদিন বাদে খুঁজে পাওয়া গেলে অনেক কিছু আবিস্কার করা যায়। সেটাই সবচেয়ে জরুরী সম্ভবত। কারণ, আমি চাইলেও কোনো নির্দিষ্ট অর্থ পৌঁছে দিতে পারিনা কাউকেই। বার্ত ফার্ত ঝাড়ছিনা। বস্তুত বার্তের কথা সত্যি বলে মেনে নিতে হলে টেক্সটের শেষে ওই সমস্ত ব্যাখ্যাগুলোকে অস্বীকার করলেও চলে। অর্থাৎ, বার্ত যা বলতে চেয়েছেন, সরি স্যার, ওনার নিজের কথা অনুযায়ী সেটা আমার না জানলেও চলে। বইটা দিন, পড়ে ভুলে যেতে ইচ্ছা হলে তাই যাব। বার্ত কি নিজের ওই লেখাটা ফিরে পড়েছিলেন কোনদিন? প্যারাডক্সটা দেখে মজা পেয়েছিলেন? আদেও সুযোগ পেয়েছিলেন কি ভুলে যাওয়ার, ওই লেখাটার কথা? অর্থ আমি ভাবি, অর্থ আমি গড়ে দিই। কিন্তু অর্থ আমার দাস নয়, কারণ, পাঠক আমার দাস নয়। ক্ষমতা মাঝখানে এলে বিশ্বাবিদ্যালয়ের ছাত্র এমনিই শিখে যায় ফর্ম এর কোন কলামে কি লিখতে হবে। মুক্ত অঞ্চলে ভাষা অর্থহীন, অথবা তার বহু অর্থ, বিভিন্ন স্তরে। অর্থের এই ছেনালগিরিই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সহস্র তিক্ততার জন্ম দিয়েছে। অতএব, যা আমার হাতে নেই, পরীক্ষিতভাবেই, তার পিছনে অযথা দৌড়ে যেটুকু আমি পেতে পারি তার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে যাব কেন!
নো-বাজেট ফিল্ম বানানোর চিন্তাটা মাথায় আসার সময়ও এরকমই একটা মানসিকতা কাজ করেছিলো। আমাদের।
ফিল্ম নিয়ে আমাদের রাজ্যে যারা বড় বড় বাতেলা দেয়, তাদের মধ্যে স্পষ্টতই কতকগুলি শ্রেণি বর্তমান। এর বাইরে নেই আমি বলছিনা, তবে এইকটা তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঠিক এই জায়গাটাকেই দর্শককূল বা পাঠককূল মনে করে থাকেন অ্যারোগেন্স বলে। অ্যারোগেন্সটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনা। সেসব কথায় পরে আসছি। আপাতত বলা যাক যে, এই আমাদের গোষ্ঠীটার ভেতর আবার দুটো স্পষ্ট ভাগ রয়েছে। আমরা মোটামুটিভাবে বন্ধু হলেও আমাদের চিন্তাভাবনার পদ্ধতি আমাদের দুটো আলাদা কাজ করতে ঠেলে দেয়। আমরা যারা এই গোষ্ঠীর এবং মেইনস্ট্রীম সিনেমা নিয়ে খুশি নই, ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে কিছু করতে চাই; একদল মনে করি লোকে না দেখলে কাজ করে কি হবে, আরেকদলের মতানুযায়ী যে করে হোক কাজটা শুরু করা দরকার, তারপর লোকে নিশ্চয়ই দেখবে, না দেখে যাবে কোথায়! ঠিক এই পার্থক্যটাই আমাদের একসাথে কাজ করতে দেয়না, যদিও উদ্দেশ্য আসলে একই। আমি দ্বিতীয় দলের লোক হলেও প্রথম দল সম্পর্কে আগে বলে নেওয়া যাক। এরা বিশ্বাস করে আভাঁ-গার্দ এবং মেইনস্ট্রীম ফিল্ম এর মধ্যে আদানপ্রদানটা খুবই জরুরী। সেটা আমরাও যে করিনা তা নয়, তবে এদের ওই লোকে না দেখলে কিছুই হলো না জাতীয় মনোভাব থেকে এরা একটা কি দুটো শর্ট ফিল্ম বানানোর পরপরই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার পথ খুঁজতে শুরু করে। কেউ স্ক্রিপ্ট রাইটার তো কেউ এডি (সহকারী পরিচালক) হয়ে ঢুকেও পড়ে। আসল উদ্দেশ্য দশ কি পনেরো বছর ধরে আটঘাটগুলো জেনে নেওয়া, তারপর নিজে ছবি বানানো শুরু করা। কেউ পারে কেউ পারেনা। এরপর কোনোদিন দেখা হলে আলোচনার বিষয় হয়ে যায় তমুকের ক্যামেরাম্যান কেন ইচ্ছা থাকার পরও কোনদিন ইউনিট ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়ে নিজের ছবিটা করে উঠতে পারলোনা, অথবা অমুক পরিচালক আদতে কতটা সৎ কিংবা এই যে বড় বড় প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটর-হলমালিকদের আঁতাত, ইত্যাদি। দেখা না হলেও চলে, তবু এইসব সাক্ষাৎ এবং পরস্পর পরস্পরকে আমরা মনে রেখে দিই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় দুটো কারণ হল ১) একটা কমন ক্রাইসিস, যে, ছবিও করতে হবে আবার খেয়ে-পরে বাঁচতেও হবে আর ২) আত্মবিশ্বাসের অভাব। নিজেকে নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস না করতে পারলে অন্য কেউও তোমায় বিশ্বাস করতে পারে না এবং এতে তাদেরকে দোষ দেওয়ারও কিছু থাকে না। এই বিশ্বাসের অভাবই কি সেই ভয়ের জন্ম দেয়না যে দর্শক আমায় রিজেক্ট করতে পারে? আর সেই ভয়ই কি একটা সময়ের পর নিজস্ব সাফল্যের ফর্মুলা অনুযায়ী ছবি করতে বাধ্য করে না? এইভাবেই তো সত্যা-র সাফল্যের পর পাঁচ তৈরী করার কথা ভাবে একটা লোক অথবা ওম্যানিয়া আর চি-চা লেদারের সাফল্যের পর বোঝাই যায় যে ড্রিমাম ওয়েকাপ্পাম দর্শক ভালই ‘খাবে’। মাথার ভেতর কোথাও বোধহয় ওই বিশ্বাসের অভাব বা ওই ভয়টা ‘মশলা’টা মেশাতে শিখিয়ে দেয়। হলই বা নিজস্ব মশলা, মশলাই তো। তাছাড়া কম বয়সে কেই বা বিপ্লব করেনি বলতো! শয়তানের ভেতর মোরাভিয়া ঢুকে যায়, জনি গদ্দারের মধ্যে জেম্স্ হ্যাডলী চেজ। যাই হোক!
এবার আমাদের কথায় আসি, আমরা যারা সবকিছুর পরও ইন্ডাস্ট্রিতে গেলাম না, রয়ে গেলাম। আমরা হাতড়াতে থাকি। হাতড়াতে হাতড়াতে যার বাড়ির পয়সা আছে সে ফিল্ম স্কুলে চলে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যার বাড়ির পয়সা নেই সেরকম, সেও। যে তাও পারলো না সে প্রোজেক্ট পিচ করা শুরু করে এখানে ওখানে। কেউ কেউ পেয়েও যায় বিদেশী ফান্ড। মোদ্দা কথাটা সবাই-ই বুঝতে শুরু করে একটা সময়ের পর, যে এই বছরও কিছু না হলে এরপর পাড়ার মোড়ে জেরক্সের দোকান দেওয়া ছাড়া গতি নেই। কেউ কম খরচে ডকুমেন্টারি বানিয়ে বিদেশে বেচার পথ দেখতে থাকে।
আমি যখন কাজ শুরু করেছিলাম, এই সময়টা আসতে তখনও খানিকটা দেরি ছিল। শ্রীপর্ণা-র একটা সেকেন্ড হ্যান্ড হ্যান্ডিক্যাম ছিল। সেটা দিয়ে টুকটাক শুট করা, সেগুলো এডিট করা, এসব করতাম। ছবি বানানোর জন্য তৈরী ছিলাম না পুরোপুরি। শ্রীপর্ণার ছবি আঁকার মতো আমারও লেখার শখ ছিল, বা জেদও বলা চলে সেটাকে, শখের চেয়ে বেশি কিছু। একটা ‘অদ্ভুত টাইপের’ বই করে কিছু কপি এদিক ওদিক ছড়িয়ে দিতেও সমর্থ হয়েছিলাম। সেটা নিয়ে সন্দীপ দত্ত দা সানডে ইন্ডিয়ান-এ একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমি স্পষ্টতই বেশি কিছু ঘটবে বলে আশা করেছিলাম। হয়নি। ফলে বইটা স্ক্যান করে ব্লগ-এ আপলোড করে দিলাম একদিন। পরে বেশি কিছু ঘটল হঠাৎ করেই, জাস্ট ঘটে গেলো।
একদিন একজন লোক ফোন করে বলল বইটা বইমেলায় হাতে পেয়েছিল, দেখা করতে চায়। মাসদুয়েক পরে একদিন দেখাও করলাম লোকটার সাথে। বাংলা খেতে নিয়ে গেলো বারদুয়ারিতে। সেই লোকটাও নাকি কবিতা লেখে। বাংলা খেতে খেতে আরও মজা হলো এটা দেখে যে লোকটা সিনেমা নিয়েও অনেক কিছু জানে, মানে এমন কিছু ব্যাপার যেগুলো নিয়ে খুব কম লোকই অতক্ষন ধরে কথা বলতে পারে। লোকটার নাম অরূপরতন ঘোষ। এখন সে বাংলার প্রভাবেই হোক আর যাই হোক ওখানে বসেই ঠিক হয়ে গেলো শিগ্গিরি আমরা একসাথে একটা ছবি করব। শ্রীপর্ণার হ্যান্ডিক্যামটা দিয়ে শুট করা হবে। শ্রীপর্ণা এই প্রস্তাবে কোনো আপত্তি জানালোনা। পরে একদিন সেই লোকটা ফোন করে বলল ছবিটা সে পরিচালনা করবে আর আমায় এডিট করতে হবে। আমি আপত্তি করলাম না, তবে বললাম যে পরে আমিও একটা ছবি করব তখন তাকে পাশে থাকতে হবে সবরকম ভাবে। আর এই ছবিগুলোর যেহেতু কোনো বাজেট নেই সেভাবে তাই লোকজনকে বলার সময় আমরা বলব যে এগুলো নো-বাজেট ফিল্ম। একটা নাম দেওয়াও হলো আবার লোকজনকে বেশ চমকে দেওয়াও যাবে।
কি করছিলাম, কেন করছিলাম জানতাম না। পরে বুঝেছি সেসব, নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে নিয়েছি। তখন এই টার্মটাও আমাদের নিজেদের তৈরী করা বলেই মনে হয়েছিলো। তখনও গঙ্গা দিয়ে আরও অনেক জল বয়ে যাওয়া বাকি ছিলো। ঘটনা পরম্পরায় আজ এসব ঘটনা অবশেষে লিখে ফেলতে হচ্ছে, বাংলায়। নিঃসন্দেহে আশাতীত রকমের আশাপ্রদ ব্যাপার। এর পরের ঘটনা দরকার পড়লে কোনোদিন অন্য কোথাও বলা যাবে। আপাতত আমরা এই লেখার মূল উপজীব্যে এসে উপনীত হয়েছি।
তো, নো-বাজেট ফিল্ম শব্দবন্ধটি এইরকম ভাবেই আমাদের মধ্যে চালু হয়ে যায়। হ্যাঁ, কিছুটা মার্কেটিং স্টান্সই বলা যেতে পারে। হাতে পয়সা নেই, ছবি করতে চাই, ছবি দেখাতে চাই লোকজনকে। এমন কিছু একটা করার দরকার তো ছিলই যেটা একঝটকায় চোখ বা কানকে টেনে নিয়ে আসবে আমাদের কাজের দিকে। ঠিক এই জায়গা থেকেই আমরা আরো একটা কাজ করি। একটা ফোরাম বানিয়ে ফেলি। যে নামটা দেখানো হয়েছিলো অরূপদার ৬০০ টাকায় বানানো [শ্রীপর্নার হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে] ছবিটির শুরুতে, সেই নামটাই আমরা বহাল রেখে দিই; লিটিল ফিশ ইট বিগ ফিশ। আসলে রাস্তায় চিল্লাচিল্লি করতে গেলে একা চিল্লালে লোকে পাগল বলতে পারে তো, তাই আরও লোক ডেকে আনা, যাতে ব্যাপারটা মিছিল কিংবা আন্দোলনের মতো সিরিয়াস সিরিয়াস দেখায়। এমনিতেই আমাদের এখানে একটা বিগ বাজেট আর একটা লো বাজেট ছবি পাশাপাশি রিলিজ করলে, লোকে বাহবা যতই দিকনা কেন লো-বাজেটটিকে, টিকিট কাটার সময় কিন্তু বিগ বাজেটেরই কাটে, দেখে এসে খিস্তি করুক আর যাই করুক পয়সাটা কিন্তু ওখানেই যায়। আমাদের তো সেখানে হল্-ই নেই, আর প্রোমোশন ব্যাপারটা টাকা না থাকলে যে কতটা জটিল হতে পারে সেটা লেখালিখি করার সময়ই বোঝা গেস্লো। আমাদের স্ট্রাকচারটা শেষ অবধি এরকম দাঁড়ালো যে প্রতিবছর আমরা একটা করে ডিভিডি রিলিজ করবো। এইবার সমস্যা হল, এই যে মাঝের দশটা মাস, সেখানে রাজ চক্রবর্তীও ছবি করছে, মহেশ ভাটও, আবার স্পিলবার্গ সাহেবও। পাবলিক মেমোরি ইস টু শর্ট। প্রথম ডিভিডি বেরোনোর পর এটাই দাঁড়ালো মূল সমস্যা; কি গ্যারান্টী আছে যে পরের বছর আবার যখন আমরা নতুন ডিভিডি নিয়ে ফিরে আসব লোকে আমাদের চিনতে পারবে, বা মনে রাখবে? হাতে টাকা নেই, সারাবছর টিকে থাকতে পারবো তো ৫ খানা শর্ট ফিল্ম এর জোরে?
এইখান থেকেই তিক্ততার সুত্রপাত। ফোরামটা আর ডিভিডিকেন্দ্রিক থাকলোনা। যে ইচ্ছা এলো, হ্যান্ডিক্যাম কত দূরে ধরলে কতটা আসে ফ্রেমে আইডিয়া নেই, গোঁজামিল দিয়ে ছবি বানিয়ে ফেললো – এই ব্যাপারটাও আর রইলো না। তখনই খোঁজ পড়লো আর কেউ কি আছে পৃথিবীতে যারা আমাদের মতো করে কাজ করে? তারা কিভাবে টিকে আছে? আরও একটা জিনিষ স্পষ্ট হয়ে গেলো, ১৯৫০ এর দশকে দেড় লাখ টাকায় বানানো ছবি ১৫০ বছর বেঁচে থাকবে, কিন্তু ২০১০ এ দেড় হাজার টাকার ছবি, সে একদিনও নাও বাঁচতে পারে। হ্যাঁ, ইউটিউব আছে, কিন্তু ইউটিউবে আমার পাশাপাশি রিডলি স্কট এর বানানো মালও রয়েছে। মাস্টাররা কি করে গেছে দেখে নাকে পোঁটা চোখে জল, বললাম “স্সাল্লা! আম্মো বানাবো” – ব্যাস ভোগে! সত্যযুগে একুশ হাত মানুষ হতো বাবা, তুমি মেড়েকেটে সাড়ে তিনহাত! পা ফেলো, কিন্তু মেপে!
এখন এইটুকুই থাক,
পরের কিস্তিতে হাম্বা থেকে হলিউড হবে।
সে আরেক খেউড়!