পীরদিদি, কায়রুবুড়া, ধীরজুদাদা তিনজন হেঁটে আসছিল। তিনজন হাসছিল। তিনজনের হাতেই পাঁপড়ভাজা। পাঁপড়ভাজাগুলো হাতের চাপে ভেঙ্গে পড়ছিল, কিছু কিছু চলে যাচ্ছিল জিভের ডগায় সুস্বাদ জানিয়ে, যেন জীবনের সুখের দিনগুলো। মচমচে সহজেই ভাঙ্গে, অচিরেই গুঁড়িয়ে যায়। আজকে তলব বার। ভাষাতত্বের কি নিয়মে কে জানে সাপ্তাহিক বেতনকে বলে তলব। যে বারে সপ্তাহের বেতন হয় সেটা তলববার। খুশির দিন, সেদিন হাট বসে চা বাগানের মাঠে। মহানিমের ছায়ায় ছোট ছোট চালার নীচে কত কি রূপোর গয়না, গালার চুড়ি, পুঁতির মালা, মাছ, মাংস, সবজির পসরা। সবাই কিছু কিছু কিনবে। তারপর রাত হলে চাঁদের নিচে বা অন্ধকারের আঁচলের তলায় ভাতের পচুই কি মহুয়া। প্রথম নাচগান, তারপর মারপিট, কান্না, বিলাপ, শাপশাপান্ত, তারপর একঘুম, সব গ্লানি হজম। পরেরদিন ভরে আবার পাত্তিতোলা, ফ্যাকট্রিতে মেশিনের আওয়াজে আগুনের তাপে বিরাট কর্মযজ্ঞ।
তা বিকেল শেষ হওয়ার একটু আগে পীরদিদি আমাদের বাড়ী আসবে। ঘনকালো মাংসল মুখের চ্যাপ্টা নাকে ততোধিক চ্যাপ্টা লালপাথর বসানো পিতলের নাকছাবিটি ঝিকিয়ে হাসবে, আমার জন্য কিনে আনবে কিছু ভাজাভুজি খাবার। আমি কিনা শহরে থেকে বি.এ. পড়ি, পীরদিদির মহাগর্ব- “মোর পিঠির বহিনটা। খুকুরে – বি.এ. পাস করি ভগবান হলা।” পীরদিদি আসামে দরংজেলার চা বাগানের কুলি, বাবা বলেন কুলি নয় লেবার। --- বাগানে যারা বাবুলোক তাঁরা বেশিরভাগ দাশগুপ্ত, চট্টোপাধ্যায়, ত্রিপাঠি, শইকিয়া কি বড়া। এঁরা লেবারদের সঙ্গে দুরত্ব রাখেন। কখনো কাজে কম্মে বাবু বাড়ি গেলে এরা আলাদা পাত্রে নুন চা খায়। আমাদের কথা আলাদা।আমার বাবা প্রাক্তন টেররিস্ট স্বদেশী। এককালের মেধাবী ছাত্র। আত্মগোপনকালে এদের কাছে হয়তো এমন কিছু পেয়েছেন তার জন্য এঁদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে আমাদের অবাধ প্রশ্রয় “যেখানে খুশি যাইতে পারি যা খুশি তাই খাইতে পারি ”। আর বই পড়ার ব্যাপারে মহাভারত থেকে শুরু করে বটতলার গোলেব কাওলী কথা সব। একটু পাকা বলে ভাষাতত্ব নিয়ে দুচারটে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধও লিখে ফেলেছি। ততদিনে পড়া হয়ে গেছে বিবর, তপস্বী ও তরঙ্গিনী আবার কল্লোল-এর কালের অনেক উপন্যাস। কাজেই আঠারো উনিশ বছর বয়েস হলে কি হবে অনেক কিছু ভাবতে চাই দেখতে চাই। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে চাই। পীরদিদি যোগেনদাদার সঙ্গে বাঁশবন কলাবন ঘুরতে যাই। গাব্রুননদীর ধীরে তেকোনা জালে ফলুই মাছ দেখতে যাই। রোদে পুড়ে ঘরে যখন ফিরি আগরতলার বন্ধুরা ওখানকার চেহারা দেখলে আমার সঙ্গে মিশবেইনা । তাদের কথা এখানে এলে আমার মনেও পড়েনা। বাগানের কুলি, বস্তির মুসলমান চাষী অসমীয়া গৃহস্ত- আজকে মাদল বাজিয়ে পরব, কাল বুক চাপড়ে মহরম, পরশু বিহুর নাচ। আমাদের বাড়িতে বারোমাস ফুলের চাষ—বাচ্চারা বলে ফুলের বাসা, ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার বাড়িতে সবার জন্য ভালোবাসা, শুধু মাঝেমাঝে ভাইবোনে কুরুক্ষেত্র। সেটা সামাল দেবার জন্য আমাদের শীর্ণাঙ্গী মা-ই যথেষ্ট। আমাদের সংসারে পীরদিদি, ধীরজুদাদা, যোগেনদাদারা নিত্যদিনের অতিথি, সকালবেলা পীরদিদি চায়ে ডুবিয়ে খাঁটি ক্ষীর ছাঁচে ঢেলে সন্দেশ খাবে এবং গরম চায়ে সন্দেশ ডুবে যায় বলে মাকে একটু শক্ত করে সন্দেশ করতে উপদেশ দেবে। যোগেনদাদা পদ্মপাতায় মুরগির মাংস কেটে কুটে রাখবে। কায়রুবুড়া গরু ঘর পরিস্কার করে গোবরগুলো ফেলবে পিছনের বাগানে, দুরের আকাশে ভেসে উঠবে হিমালয়ের সোনা। কদিন আগেই দলাই লামা নেমেছেন তিব্বত থেকে। সঙ্গে এসেছে অনেক তিব্বতের মানুষ। তারা বাজারে নাকি উইপোকা কিনে খায়। সেই গল্প শুনে পীরদিদি হেসে খুন। এর মধ্যে হঠাৎ কায়রু বুড়া আর পীরদিদি কামিনীফুল গাছের তলায় আলাদা হয়ে যায়।পীরদিদি কায়রু বুড়াকে বলে – কাল রাতে মোর পহেলা মেটোটাকে স্বপন দেখিলু। আমি নেপথ্যের শ্রোতা—ওমা, পীরদিদির প্রথম স্বামী? তেমন কেউ আছে নাকি? থাকলেও তাকে দেখে চোখে জল? ধীরজুদাদা পীরদিদির তো বেশ ভাবও আছে। তবে ধীরজুদাদার বয়েসটা কম। পীরদিদিতো প্রায় প্রৌঢ়াই । তা যাই হোক পীরদিদির গোপন ব্যথা বলার লোক কি কায়রুবুড়া? পীরদিদির ওই স্থুলদেহ ওই ভারী বুকের তলায় ওই সুক্ষ্ণতন্ত্রী? স্বপ্নের ঘায়ে চোখে জল এসে যায়? কেবল কি কায়রুবুড়ার কাছে এই বেদনার সান্ত্বনা আছে? পীরদিদির ফেলে আসা স্বামীর জন্য পীরদিদির গোপন মোহ। ধীরজুদাদার সঙ্গে পীরদিদির ঘরকন্নার কোথাও ভন্ডামির চিহ্ন তো দেখিনা। যাকগে, ব্যাপার আমাকে যে খুব বেশি ভাবলো তা নয় তবু ব্যাপারটা মনে থেকে গেলো। তবে ভারতপ্রেম কথায় এরা নেই। সমরেশ বসুতে না। শরত বঙ্কিমে তো নয়ই। দূর, মেলেনা।
পীরদিদির পাতি তোলার কাজে যাবার আগে আমাদের বাড়ী আসে। চা খায়, খৈনি খায়। কায়রু বুড়ার সঙ্গে বকবক করে। কায়রুবুড়া মাঠে নেড়ে সায় দেয় পীরদিদির সব কথায়। দুপুর এগারোটা নাগাদ ধীরজুদাদা ঘরে ফেরে। কোনদিন আগে আসে কোনদিন পেছনে। কাদার পুতুলের মতো পীরদিদি হেঁটে যায়। পৃথুল, সৃষ্টিকর্তার কাঁচা হাতে গড়া থপথপে মূর্তিটি, ধীরজুদাদার রং কালী মাখা কিন্তু ফর্সা চোখে নীল রহস্য। এদের চোখে কি চামড়ায় দুর সাগরপারের ছটা ঢেলে দেয়। তারা উপনিবেশের লজ্জা বয়ে বেড়ায় নিজের অঙ্গে। কবে কখন কাকে আড়কাঠি ধরে এনে ফেলেছে চা বাগানগুলোতে। কেউ হয়তো গয়ায় একমাত্র ছেলের পিন্ড দিয়ে শোকাচ্ছন্ন ক্লান্ত বসে ছিলো কোন কুয়োর ধারে। কেউ হয়তো ছাগল চরিয়ে ফিরছিলো। তারপর আড়কাঠির খপ্পরে পড়ে কুলি হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঠিকানা, পূর্ব পুরুষের পরিচয়। এরা বোধহয় অবচেতনের অপমান ভুলতে রাতের বেলা নেশা করে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে, বউ পেটায়। ধীরজুদাদাও বাদ যায়না। সকালেও নেশা কাটেনা। জোরে জোরে বলে পীরবতীকে ভাগিয়ে দিয়ে নুতন কচি বউ আনবে। পীরদিদি কি আর ধীরজুদাদাকে দু-চার ঘা দেয়না? বেশ করে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করবেই। আমি খুশিই হই। কিন্তু সকালে পীরদিদি কেঁদে ফেলে- পীরদিদি চলে যাবে টিউলিপ চা বাগানে। ওখানে পীরদিদির প্রথম স্বামী। সে তো খুব ভালো। তার দেওয়া লালপাথর বসানো নাকছাবি পীরদিদির গর্ব এবং প্রশস্ত নাসায় আলোছড়ায়। তারই নাম পীরদিদির বাহুতে উল্কি দিয়ে আঁকা।
পীরদিদি চাঘরে বসে বড় এলুমিনিয়ামের চালুনীতে চা পাতা চালতে থাকে। পাশে অন্য মেয়েরা । চারদিকে মেশিনের আওয়াজ। চা পাতা প্রসেসিং-এর মাদক গন্ধ। চালুনীর মত ছিদ্র দিয়ে ঝরে যায় সদ্যপ্রস্তুত উত্কৃষ্ট চাপাতা। কোনটা লীফ- মহামূল্য, কোনটা সি.টি.সি, কোনটা ডাস্ট কোনটা আরো কমদামী কিন্তু উড়ে যায় সূক্ষ্মতিসূক্ষ বাতাসে – বাতাসে বিকোয় না বাতাবরণে ছড়িয়ে যায় – গন্ধ রেখে যায় জীবনের ছাঁকনিতে ভালোবাসা ছেঁকে নেয়। কিছু প্রয়োজনে কিছু প্রয়োজনের বেশি কিছু অপ্রয়োজনের বেদনায় বা দুঃখে। আমি পাকা মেয়ে, আমি কবি মেয়ে। আমি তো অন্যদের মতো নই, আমি প্রেমের যে নিরিখ মানি তা সাদাসাপটা মানুষে কি বোঝে! কবির অহংকারে, কবির করুণায়, কবির সহৃদয়তায় পীরদিদির গোপন ব্যথার উপর আঙ্গুল বোলাই। পীরদিদি জেগে ওঠে বেদনায় ভালোবাসায় টিউলিপ চাবাগান- দরং জেলায় বেলসিড়ি নদীর পাড়ে বুনো সূর্যমুখীর ঝোপের পাশে পীরদিদির শাদী হয়েছিল তেল হলুদে মাখামাখি হয়ে। পয়লা স্বামী তার কিশোর প্রানের দরদে নুতন বৌকে নিয়ে মাদল বাজিয়েছিল, নেচেছিলো আগুনের ধারে, শীতের রাতে কোলে এসেছিলো ছোট্ট একরত্তি কন্যা সন্তান। বছর কয়েক পর পীরবতী যখন তিন সন্তানের মা, বড় মেয়ে যখন পনেরো, তখন সেই মেয়ের জন্য ধীরজুদাদা অগ্রিম কন্যাপণ দিয়েছিলো কিন্তু ধীরজুদাদার সেই ভাবী বউ বদলোকের পাল্লায় পড়ে হারিয়ে যায়। না থানা পুলিশ কিছু হয়নি। গরিবের ওখানে গিয়ে কি করবে । তবে গাঁওবুড়োরা মিটিন করে রায় দিয়েছিলো- দন্ড বিধান করেছিলো ধীরজুর টাকা ফেরত দিতে হবে। টাকা কি হাতে থাকে? উড়ে যায়। টাকা ফেরত অসম্ভব। তবে আর কি? পীরদিদিকে সামলাতে হবে ধীরজুর সংসার। টাকা জমিয়ে পীরদিদি যখন ধীরজুর পছন্দসই একটা বউ যোগার করে দিতে পারবে তখন পীরদিদি আবার ফিরে আসতে পারে নিজের সংসারে। ভূটানে চালান হয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়ের শোক পড়ে রইলো, পড়ে রইলো সংসার। তারপর থেকে পীরদিদি ধীরজুর ঘর সামলাচ্ছে। বউ নয় তবে ধীরজুদাদাই পীরদিদির মালিক। দুজন দুজনের উপর নির্ভরশীল। নিজেদের মতো করে একরকম ভালোবাসাও আছে। কিন্তু প্রথম স্বামীর জন্য চোখের জল- তাও আছে বই কি? “–...... জানে না করম, লজ্জা শরম, জানেনা জীবনে সতীর প্রথা, তা বলে নারীর নারীত্বটুকু ভুলে যাওয়া সে কি কথার কথা?” পীরদিদির প্রথম স্বামী এক নারী যোগাড় করে নিয়েছে। কিন্তু সেও পীরদিদিকে ভুলেছে? নিশ্চয় না। তার হাতের উল্কিতেও পীরদিদির নাম লেখা আছে। গল্প শুনে অবাক। সত্যই ভারতবর্ষ বড় বিচিত্র দেশ।
ধীরজু পীরদিদিকে ভালোবেসে ফেলেছে বইকি? নইলে এই প্রৌঢ়াকে কবেই সে বের করে দিতে পারতো। দেয়নি তো ? কিন্তু পীরবতী তবু প্রথম স্বামীকে স্বপ্নে দেখে, সেই গল্প আবার বলে কায়রুবুড়াকে। বুড়ো মাথা নাড়ে, গভীর সহানুভূতি জানায়- হ, হ, । পীরদিদির অতীত জুড়ে প্রথম স্বামী। বর্তমানের সঙ্গী ধীরজুদাদা, মনের কথা বলতে কাছের মানুষ কায়রুবুড়া। এই অদ্ভুত গল্প মেলানো আমার কাজ নয়।
চা-বাগানের গরীব দিন গড়িয়ে যায়।গরীব দিন, বৈচিত্রের অভাবে গরীব। বৈভবে রতন, অভাবে গরীব। চারদিকে চায়ের সবুজ,শিরিষের সবুজ, আম জাম অন্য গাছের সবুজ, নাগেশ্বর, ছাতিমের সুগন্ধ, নানা পাখপাখালির আওয়াজ, তার মধ্যে কিছু গরীব মানুষ, বাবুরা গরীব, কুলি বা গরীবধনী মালিক যেন রক্তকরবী কি শাপমোচনের রাজা। কোথায় আছেন অন্তরালে। গরীব মানুষগুলো নিজেদের দারিদ্রকে ও চেনেনা। কেমন যেন একটা সন্তোষের আবরণে জীবনের তাপ ভুলেই থাকে। ওই যে ধীরজুদাদা যার কিশোরী প্রেমিকা চালান হয়ে গেছে ভূটানে। ঘর সামলায় দ্বিগুন বয়েসী প্রৌঢ়া। তাতে যেন কিছু এসে যায়না। সে দুপুরবেলা তিনকোনা জাল নিয়ে চলে যায় তিনফুটিয়া মহাজনের তালপুকুরে, দুটো কুচোমাছ ধরে এনে পীরদিদিকে দেয়, আহ্লাদে আটখানা পীরদিদি। ....... দেখলে গা জ্বলে যায়, খোঁপায় আবার জংলা ফুলের মালা কি একটা সংক্রান্তি উপলক্ষে কায়রুবুড়া গরুর গলায় মালা পরিয়েছে তারই একটা পীরদিদির চুলে। দুটি অশিক্ষিত এলোমেলো পুরুষ একটি দুঃখী মেয়ের দুঃখ ভোলাতে চায়। ভোলাতে চায় প্রথম প্রেমের স্মৃতি। ইটচাপা ঘাসের মতো পীরদিদির ভালোবাসা বেঁচে থাকে বিবর্ণ কিন্তু মরে না ।
গ্রীষ্মের বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছি। পথেই পড়ে বড় চাতাল বাঁধানো কুয়ো। মেয়ে-মরদ একসঙ্গে চান করে। একজন অপরের পিঠে সাবান ঘষে, ধুন্দুল খোসা দিয়ে পিঠ ঘষে। নারী-পুরুষের সমবেত স্নান খোলা আকাশের নীচে। একটা কুয়া কাপড় কাচা, চান করা সব- খুব একটা অসুখ-বিসুখের কোথা শুনিও না। এই জলই সবাই খায়। মেয়ে পুরুষ একসঙ্গে ঝুপঝাপ বালতি দিয়ে জল ঢালে কিন্তু দৃশ্যটা ঠিক অশ্লীলও নয়। তবু এড়িয়ে যাই হাঁটতে থাকি, তবু দেখতে ভুল হয়না পীরদিদির কাপড়খানি ধীরজুদাদা উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। পীরদিদি এগুলো একটু আগে কেচে রেখেছে। পীরদিদির উলোঝুলো চুলে ধীরজুদাদা সাবান ঘষছে। আমরা এলে টিনের দরজা দেওয়া বাথরুমে চান করতে কাপড়-চোপর সম্বৃত রাখি- দূর, ওদের কান্ড ভাল্লাগেনা। আবার ওদের সহজ ভালোবাসা। ছোট বেলায় কত কত টুকটুকে লাল আম, কতো নিষিদ্ধ তেলে ভাজার স্মৃতি – না তাও ভোলা যায়না।
একদিন তো পীরদিদি কায়রুবুড়া ধীরজুদাদা মদ খেয়ে ফাটাফাটি ঝগড়া করে কি যে চিত্কারে বস্তি মাত করল। ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে উঠলো। বাবার কড়া নিষেধ জারি হল। এদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা বন্ধ। ছেলেমেয়েরা বড় হছে। এসব কুদৃষ্টান্ত থেকে দূরে থাকা উচিত। আমিও চলে এলাম। তিনবছর আর বাগানে যাইনি। শুনেছি পীরদিদি ভালই আছে।
ইতিমধ্যে আমার বিয়েও হয়ে গেছে। পীরবতীর কথা খুব একটা মনেও পড়েনি। তিন বছর পর বাগানে ফিরে দেখি অনেক কিছুই অল্পসল্প পাল্টে গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে আমারই মনে। কদিন খুব বেড়ানো হল, পিকনিক হল। শুনলাম আমাদের পীরদিদি খুব অসুস্থ। হয়ত আর বাঁচবে না । তাই তো, না হলে সেই লাল নাকছাবি ঝিকিয়ে কত আশির্বাণী উচ্চারণ করতে করতেই না আসতো – মর পীঠির বহিনরে ছোটবেলার কত স্মৃতি ভীড় করে এলো মনে। বললাম একদিন যাবো ওদের বস্তিতে। কিন্তু আমার শহুরে স্বামী, তিনি কিভাবে নেবেন ব্যাপারটা, বাবা চিন্তিত, মা আরো বেশি,-- আমি তো এখন ওদের নই, সম্প্রদান করে দিয়েছেন। মেয়ে এখন অন্যের আয়ত্তে। যা হোক একদিন গেলাম। শীতের সকালে কুয়াশা কাটছে। আকাশে জাগছে হিমালয়ের সোনা ঢালা বরফ চূড়া, মুরগী আর শুয়োর চড়ছে লেবার কোয়ার্টারের সামনে পরিস্কার উঠোনে। এপথ দিয়ে কতদিন পীরদিদি পাতি তুলতে গেছে। এই আলোতে ঝিকমিক করেছে পীরদিদির নাকছাবি। এই নাগকেশরের তলায় পীরদিদি মাদলের তালে কায়রুবুড়ার সাথে নেচেছে। এখানেই মদ খেয়ে ধীরজুদাদা পীরদিদি মারপিট করেছে।
লেবারদের কোয়ার্টার অপরিসর, টালির চাল, ইকড়ার উপর সিমেন্ট লেপা বেড়া। পাকা মেঝে। ধীরজুদাদা-যার কোনদিন বউ হয়নি, সন্তান হয়নি। সেই ধীরজুদাদা পরিস্কার উঠোনে পরিস্কার কাঁথা বিছিয়ে পীরদিদিকে শুইয়ে দিয়েছে। নাকে সেই প্রথম স্বামীর দেওয়া লালপাথর ছড়ানো নাকছাবি। ভেজা ন্যাকড়ায় ধীরজুদাদা পীরদিদির চোখের পিচুটি মোছায় কত যত্নে শীতের রোদে, আহা বুড়ি একটু আরাম করুক। কে একজন ঘর থেকে বলে – অ-ধীরজু বুড়ির মুখে একটু ব্রহ্মপুত্রের জল গঙ্গা নাম করে দিয়ে দে। ধীরজুদাদা একটা টুল এনে আমাকে বসতে দিল। বলল --- বহিন তর পীরদিদি এখন আর কোথা বলতে পারেনা। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে বারোবছর ঘর করলাম। জানি ওর মনটা পহেলা মরদের জন্য দুখায়। ---- আমি বুঝি। ভাবছি একবার যাব টিউলিপ বাগানে, কি খবরই পাঠাবো একটা। যদি হদিস পাই। আরতো বাঁচবেনা পীর। শেষ দেখাটা দেখুক এসে। আমি স্তম্ভিত। বলে কি ধীরজুদাদা। কত ভালবেসেছিল পীরদিদি তাকে। কি দিয়েছিল তাকে। আজকে পীরদিদির জীবনের শেষ দিনে তার প্রথম পুরুষটিকে ডাকার কথা সে ভাবছে।
তাকিয়ে আছি পীরদিদির অসুন্দর রুগ্ন মুখের দিকে। নির্জীব দৃষ্টি। ছোটবেলার মতো আর বলবেনা—মোর পিঠির বহিনরে বি.এ. পাশ করি ভগবান হলা। পীরদিদির চোখে মুখে ছোট ছোট পোকা এসে বসেছে। কায়রুবুড়া গরু চড়াতে বেরুচ্ছে। সবার পথে টুকুন দাঁড়ায় পুরনো দিনের সুখ দুঃখের কথা বলার সঙ্গী বান্ধবীটিকে দেখতে। ধীরজুদাদা এসে কায়রুবুড়ার হাত ধরে বলে—দাদা যাবেকটুকু টিউলিপ চা বাগানে? বুড়াটাকে টুকুন য়ান। পীরবতী এতদিন ওকে সপন দেখেছে। মরার আগে যদি চোখের দেখাটা দেখতে পায়। দেখুক অন্তত: । কায়রুবুড়া চুপ করে থাকে। ভাবে খানিক। ধীরজুদাদাকে বলল, তর ঘরনী তো বটে, নাইবা হল ছেলেপিলে। তাকে মরণকালে পুরানমরদ দেখতে আসবে, পাপ নাই লাগবে? লাগবে কি? ধীরজুদাদা বলে—পাপের হিসেব রাখ। তুই খবর দে। কায়রুবুড়া চোখ মুছে বলে- যাচ্ছি।
আমি আবারও স্তম্ভিত। ছকতো মেলেনা। শরত্চন্দ্র নয়, ভারতপ্রেমকথা নয়, সমরেশ বসু নয়, রামায়ন, মহাভারত কথাতো নয়, প্রেম কার তরফে? ধীরজুদাদা যে ঘর করলো, মন পেলনা। কায়রুবুড়া যে মনের কথা শুনল- প্রেম পেলনা। পীরদিদি কি প্রেমিকা? যে ঘর করল, ভালবাসল তবু মনে রেখে দিল পহেলা মরদকে। যার ঘর তাকে ছাড়তে হয়েছিল বাধ্য হয়ে কিন্তু মন তাকে ছাড়েনি। কায়রুবুড়া কি শুধুই সখাকৃষ্ণ? পীরদিদি তোমাদের এই ছক না মেলানো সহমর্মিতাকে কি প্রেম বলে? পীরদিদির হেঁচকি উঠছে, বুকে সাঁই সিঁ আওয়াজ। এক নারী তিন পুরুষের ভালোবাসা নিয়ে কোথায় যায়? কই যাও পীরদিদি? স্বর্গে না নরকে? দূরে শোনা যায় রেলগাড়ীর আওয়াজ।
কি আছে পথের শেষে? চাওয়া, পাওয়া এবং পেয়েও না পাওয়ার কুয়াশা। জীবনের ছক যা সত্যি, আবার মিথ্যেও। পীরদিদির মাথাটা কাৎ হয়ে হেলে পড়ে। পীরদিদির নাকছাবিতে পিতলের ওপর ছড়ানো লাল পাথরে কিছু কি থাকে চিরন্তনের মায়া- পীরদিদি- পীরদিদি।
চিত্রঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়