লেখা হয়েছিল টইতে। ফেলে ছড়িয়ে। পরে ছাপা হয়েছিল কাগজে গুরুতেও। নেট গুরুই বা বাদ যায় কেন? রইল মূল লেখাটি, আর সঙ্গে উপরি হিসেবে একটি চিঠিও। সেটিও আসলে পূর্ণাঙ্গ একটি লেখাই।
ইন্দ্রনীল
এটা না, আসলে একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা। মানে ,ঠিক আড্ডাবাজির ফর্মে লেখা হয় নি। অর্থাৎ কিনা , হচ্ছে না। যেহেতু এখনো শেষ হয়নি। আরে শেষ কি, শুরুই হল বলা চলে। শেষ হতে তো দু-তিন মাস সময় লাগত, আমার স্বভাব ও সময় অনুযায়ী। এরই মধ্যে আপনারা ফস করে টই খুলে বসলেন। আপনাদের আর তর সইল না। তা, আমি লিখব না তা কি হয়? তাই অসময়ে ডিম ভেঙে দিয়েছি। লেখার ডিম। আর লেখার রাগী ভ্রুণ বেরিয়ে এসে আমাকে যারপরনাই বকছে। বাপ-মা তুলে বকছে। কেননা , সে তো আর পূর্ণাঙ্গ নয়। তার উপরিভাগ পরিণত, নিম্নাঙ্গ অপরিণত। তাড়াহুড়োর ফল।
আগেকার দিন হলে তা-ও একটা কথা ছিল। অপরিণামদর্শী বিনতাকে বকে-ঝকে খোঁড়া ল্যাং ল্যাং ল্যাং অরুণ দিব্য সূর্যের রথের সারথী হয়ে রথ চালাতে চলে গেল। খোঁড়া, তা-ও। কিন্তু এ তো ঘোর কলি। আমাদের কোনো সূর্য নেই। রথ নেই। আছে শুধু জয়পুর ফুট। আমার খঞ্জ লেখা। যা, এনিথিং বাট পূর্ণাঙ্গ।
আমি সিনেমার কেউ নই। তবুও যে এই ছবি নিয়ে দু-এক কলম লিখতে বসা, তার কারণ আর কী হতে পারে, কবিতা ছাড়া? এই যে আমি মানুষমুখে শুনতে পেলাম একটি সিনেমার কথা, যার হদয় ফুঁড়ে গাছ উঠেছে , আশামুকুল-তরু, তার নাম নাকি কবিতার অমলতাস। তাই দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে, ব্যস্ততা পেরিয়ে, সন্তান পেরিয়ে কবিতা দেখতে গেলাম, আমি আর আমার মানুষী।
--------------------------------------
না, আমি কবিতারও কেউ নই। কবিতা কস্মিনকালেও আমাকে ডাকেনি তার সাতমহলা নাটমহলে। অথচ হাভাতে, হাঘরে আমি তার হিমজানালায় গাল ঠেকিয়ে দেখেছি অন্দরের তারা ও তুবড়ি, পানপাত্রের ক্রিস্টাল আর কলস্বনা মেয়েদের; তাদের শাড়ির ভাঁজের খসখস, তাদের হাসির ঠমক যে রূপোর ঘন্টার কেলাসিত টুং টাং-এসবই হল জনশ্রুতি। জনশ্রুতিকে আমি সত্যি হতে জেনেছি, জানালার কাচে গাল ঠেকানো বোকাহাবা ছেলে । আর বাইরে অবিরাম ঝরে গেছে বরফ। সাদা হয়ে গেছে মাঠঘাট। জ্যোৎস্না ও তুষারে।
না, আমি রাজার বাড়ির বরাতি নই। সোনার জলে ছাপা নেমন্তন্নর চিঠি আমার জন্য আসেনি কখনো। তবু ঘুমের ঘোরে কখনো তো শুনেছি রাতের শেষ ট্রেনের বাঁশি; আমার বাড়ির পাশ দিয়ে, আমার জানালার ফাঁক দিয়ে, আমার মশারির চাল আর মনসার ঘট ছুঁয়ে সে আবার মিলিয়ে গেছে দূরে, দিগন্তের দিকে। একবার, শুধু একবার। এ বেঁচে থাকায় শুধু একটিবার।
দীপাংশুর সঙ্গে একবার খুব তর্ক হয়েছিল। আমি ভারতীয় সিনেমা, বলা ভালো বাংলা সিনেমা নিয়ে বড্ড অভিযোগ করছিলাম। কেন এত গল্প , গল্প ছাড়া কি সিনেমা হতে হয় না? আমি গল্পহীণতার সিনেমা দেখতে চাইছিলাম। আমি কবিতা দেখতে চেয়েছিলাম সিনেমায়। জীবনানন্দের কবিতা। তখনো আমি পড়িনি শঙ্খ ঘোষের "চলচ্চিত্র আর কবিতা', তখনো কেবলই আমার একা-একাই মনে হয়েছে ঃ হ্যাঁ,কোথাও কোথাও কবিতা অবশ্য এসে ছুঁয়ে গেছে ,হাত ধরাধরি করে হেঁটেওছে কয়েক'পা সিনেমার সঙ্গে,কিন্তু কত মোমেন্টারি সেই ছুঁয়ে থাকা। সারাটা রাস্তা, পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে পথে-অপথে, বেসক্যাম্প থেকে পিক পর্যন্ত পৌঁছে দেবে না কেন কবিতা, সিনেমাকে? (কিন্তু এসব তো বেশ বেসিক ভাবনাচিন্তা--তাও আমার মনে হয়েছে। দু-পাত্তর বিদ্যে পেটে পড়লেই যে কেউই ভুড়ভুড়িয়ে ভাববে এসব কথা, এতে আর এমন বিশাল কী হল--ভেবেছি। তা যে নয়, সেকথা আজ, এই এতদিন পরে বোঝা গেল সমরেশ মজুমদারের লেখা পড়ে)।
আরো পরে আমি পড়ে উঠব ঐ বইখানা শঙ্খ ঘোষের -"ইশারা অবিরত'-যেখানে আমারই মত অনুযোগ করবেন শঙ্খবাবু, ইতস্ততঃ জাগিয়ে তুলবেন বাংলা সিনেমায় তাঁর কবিতা দেখবার স্মৃতি, যেমন পথের পাঁচালী, যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা (আঃ, কাঞ্চনজঙ্ঘা! ), সেই যেখানে জগদীশ বলছেন -" -" এই যে tests হচ্ছে- nuclear tests -আকাশ সব বিন্দু বিন্দু বিষাক্ত radiation -এ ভরে যাচ্ছে ..... একবার হয়তো গিয়ে দেখব পাখিগুলো আর আসেনি।'আসেনি কেননা হয়তো মাথার গোলমালে তারা পথ ভুলে গেছে, কিংবা "what's even worse হয়তো মাঝরাস্তায় মরে গিয়ে টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মত ..... '(আমার গোপন শ্লাঘা জেগে ওঠে, আমি এই সিকোয়েন্সটিকে চিরকাল বিশুদ্ধতম কবিতা বলে জেনেছি বলে, আর আজ শঙ্খ ঘোষ যেন খুশী হয়ে পিঠ চাপড়েই দেন আমার) ..... '(আমার গোপন শ্লাঘা জেগে ওঠে, আমি এই সিকোয়েন্সটিকে চিরকাল বিশুদ্ধতম কবিতা বলে জেনেছি বলে, আর আজ শঙ্খ ঘোষ যেন খুশী হয়ে পিঠ চাপড়েই দেন আমার)।
অথবা যুক্তি-তক্কো আর গপ্পো,ঘোরের মধ্যে , স্বপ্নে-পাওয়া মানুষের মত বঙ্গবালার বলে ওঠা ঃ 'মুই নাচুম'- আর অমনি তার নেচে ওঠা সেই দানবদলনী ছৌ; কিংবা বঙ্গবালার মুখে "শুভঘট সারি সারি'-র মত গান শুনে নীলকণ্ঠ'র মনে হওয়া-"জীবনের নক্সাটা পাল্টাব।' কিংবা সুবর্ণরেখা'র সেই ভাঙা রানওয়ে, কালীমূর্তির মুখে পড়ে যাওয়া ছোট্ট সীতা, আর বসন্তের হা-হা হাওয়ায় উড়ে যাওয়া শালের পাতা--তাকে তো আমরা কবিতা বলে জানি সবাই।
কিন্তু সম্পূর্ণ একটা ছবি, কবিতা নিয়ে? হয়েছে কখনো, বাংলা সিনেমায়? (একটা তথ্য জানান শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথের "শিশুতীর্থ' কবিতাখানা লেখাই হয়েছিল এক জার্মান চলচ্চিত্র সংস্থার প্রেরণায়। না , একটু ভুল হল, আসলে 'ঝবন ইবভরধ' কবিতাটা, "শিশুতীর্থ' যার কবিকৃত বাংলা অনুবাদ। নানা কারণে সে কবিতা আর ছবি হয়ে ওঠেনি কখনো।) নাঃ, তেমন তো কোনো উদ্ধার খুঁজে পাওয়া যায় না।
উল্টোদিকে শঙ্খ ঘোষ তুলে আনেন ভিনদেশী সব ছবির কথা; বলেন আমারকর্ডের কথা, বুনুয়েলের 'ঝবন তফন ষপ ফষরধ' কিংবা কক্তোর 'আরষষধ ষপ ত সষনঢ়' -এর কথা; তারকোভ্স্কির সিনেমা, তার হদয়লীন কবিতা-- কবিতা সরাসরি, কবিতা ঘটনাহীন। রাগী নায়ক দোতলার জানালা থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সমস্ত আসবাব, আর "নিক্ষিপ্ত জিনিসগুলির মধ্যে হঠাৎ, প্রায় জীবনানন্দের কবিতার অলৌকিকতাকে মনে করিয়ে দিয়ে যেন ভেসে ওঠে মস্ত এক জিরাফের গলা, স্থির নিঃশব্দ হয়ে জানালায় তা জেগে থাকে অল্পসময়, তারপর সেটাও গড়িয়ে পড়ে বাইরে'(ঝবন তফন ষপ ফষরধ)।
ঈষৎ অন্যমনা আক্ষেপে শঙ্খ ঘোষ বলেন-"সেসব চর্চায় পৌঁছতে বাংলা ফিল্মের হয়তো আরো অনেকটা সময় লেগে যাবে বলে মনে হয়।'
হ্যাঁ, কেননা বাজার ছোট। কে পয়সা দেবে? কে-ই বা দেখবে? উঠবে পয়সা? সংক্ষেপে এই ছিল দীপাংশুর যুক্তি।
সেকথাই বলেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বলেছিলেন জীবনানন্দের "আট বছর আগের একদিন 'নিয়েও তো ছবি হতে পরে, এমনকী "রাত্রি' থেকেও। কিন্তু কে দেখবে?
--------------------------------------------------------------
ছেলেটি বি.ই কলেজ। মেয়েটি বিদেশে লালিত। বাংলা ভাষা থেকে যত দূরে হতে হয়। এমন বিয়ে হলে বাংলাভাষায় যাকে বলে রাজযোটক,হতে পারে তেমন। মর্মর, যতদূর ধবল হতে হয়, তাদের ঘিরে থাকে। ফুটন্ত দুধের ধবলতা, উথলে ওঠে। ধবলতায় মেয়েটির দুধে-আলতা পা। পায়ের নূপুর। এমন দৃশ্যে কবিতা মানায় ভালো, যদি সে কিশোরী হয়; রাইকিশোরী, অর্থাৎ কিনা সলাজ। ও ভীরু।
কিন্তু কবিতা তারও বেশী চেয়ে বসে কখনো, কদাচিৎ। রাক্ষসীর মত, সে তার বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে রক্তশোধ দাবী করেছে। আমার ভালো লাগেনা এমন ভুল ব্যবহার। তাকে তাড়াই দূরে দূরে , আমি। কেননা এমন দৃশ্যে মানায় না তাকে,ইক্কেবারে মানাইছে না রে। তুই দিগরিয়া বটের ছায়াতে ঘুরে মর বনবর্গী হাওয়ায় হাওয়ায়, ক্যানালের জলে যা, সেখানে বর্ষা হয়ে গেছে একপশলা, সাপের মুখ ছিঁড়ে পড়ে আছে ঘন সোনাঝুরিবনে। না, এখানে না। এই এইচ আই জি কসমোপলিটান বাঙ্গালী দাম্পত্যে না। বাস্তুনাশী, বাস্তুগ্রাসী কবিতা, এই ধবলে ধবল মর্মরে, এ বেহুলাবাসরে, পরবাসে তোমায় মানায় না।
কবিতা বলে ঃ আমি তো বজ্রকীট। আমি তো গোপন জীবাণুর মত ঢুকি পুষ্পের মৃণালে। জ্বরের মত,কোমলাঙ্গে। টাকাপয়সার সংসারে দু-একজন তো থাকেই, দেখোনি তাদের, ট্রামে-বাসে, অফিসে-বিষাদে? তারা সব মৃত্যুর প্রিয় সন্তানেরা। আমি দংশন করি তাদের।
""রাজা সে সকল উপহার নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন এবং অমাত্য-সুহৃদ্গণের সঙ্গে ফল খাবার উপক্রম করলেন। তাঁর ফলে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট দেখে রাজা তা হাতে ধরে সচিবদের বললেন, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার দুঃখ বা ভয় নেই, শৃঙ্গীর বাক্য সত্য হ'ক, এই কীট তক্ষক হয়ে আমাকে দংশন করুক। এই বলে তিনি নিজের কণ্ঠদেশে সেই কীট রেখে হাসতে লাগলেন। তখন কীটরূপী তক্ষক নিজ মূর্তি ধরে রাজাকে বেষ্টন করলে এবং সগর্জনে তাঁকে দংশন করলে... বিষের অনলে রাজার গৃহ আলোকিত হ'ল, তিনি বজ্রাহতের ন্যায় প'ড়ে গেলেন।''
আলোর ফলের মত সফলতা ছেলেটির ছিল। তা-ও সে হাসতে হাসতে খণ্ডিতজিহ্ব পোকাটিকে প্রশ্রয় দিল। এমন হয়। সবসময় হয় না। হাজারো সেফগার্ড থাকে জীবনে। তাই কলি মাথা নীচু করে ছায়ার চেয়ে ছায়া হয়ে নলের পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। ছিদ্রের সন্ধানে। যেন মৃত্যু ছুরি বের করে ঘুরছে মার্কেজের গদ্যে।
সিনেমার ইন্দ্রনীল জানত। তার পেছনে ঘুরতে লাগে নি। সে হাসতে হাসতে কলিকে ঢুকতে দিয়েছিল। কতরকম ফিকির জানে এরা, এইসব দুরূহ যুবারা। হয়তো হিসি করে পায়ে জল-ই দিল না একদিন।
ঋতুপর্ণ আস্ত একটি কবিতা লেখেন নি। সেরকম কোনো অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। কেননা, তিনি ঋতুপর্ণ, তাঁকে বাজার মেনে চলতে হয়। ছবিতে বলিউড-বালা কাস্ট করতে হয়, প্রসেনজিতকে রাখতে হয় লিড রোলে।
না, এসব কোনো গালাগালের কথা নয়। আমাদের সবাইকেই তো বেরোতে হয় দিনের শুরুতে, আটটা দশ কি ন'টা বাহান্ন-র গাড়ি ধরে, যা'র যা'র নিজস্ব মালের বস্তা কাঁধে নিয়ে। দিনের শেষে অন্ন আসে,তাকে খুঁজে-পেতে ধরে আনতে হয়,সে তো হাঁটতে হাঁটতে ঘরে এসে ঢোকে না! অতএব আমাদের ভাতের থালার কানায় লেগে থাকে অন্ন ও আপোষ। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যারা আভাঁ গার্দ করে বেড়াচ্ছি, তারাই বা কী এমন মহান কম্ম করছি !
আমার তো বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে,- এই যে সব দেওয়াল, সারি সারি হার্ডল পেতে রাখা, সেসব পেরিয়ে একটা ভালো ছবি বের করে আনা। চ্যালেঞ্জিং লাগে।
ঋতুপর্ণ যেটা করেছেন, সেটা হল কবিতাকে সিনেসামাজিক করে তোলার একটা চেষ্টা । এমন কোনো বাংলা ছবি তো সত্যি আজ অবধি তৈরী হয়ে ওঠেনি, বাংলা কবিতা যার প্রথম ও প্রধান চরিত্র। সেদিক থেকে ঋতুপর্ণ রাস্তা তৈরী করতে নামলেন। প্রথম ইঁট পাতলেন, বলা যায়। ঋতুপর্ণকে অভিনন্দন।
ছবির প্রিমিয়ার নিয়ে টেলিভিশনে ঋতুপর্ণ'র সাংবাদিক সম্মেলন আমি দেখেছি। প্রসেনজিতকে পাশে বসিয়ে দর্শকদের মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করলেন, এটা কোনো আঁতেল ছবি নয়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই; এটা একটা সেনসিটিভ ছবি, এতে অজস্র কবিতার মুহূর্ত আছে। বাংলা ভাষা ও কবিতাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আছে।
ছোট ছোট সব দৃশ্য। গল্প জমে উঠতে না উঠতেই দৃশ্যান্তরে চলে যাওয়া। ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের খেলায় সময় ও ন্যারেটিভকে ঈষৎ দুমড়ে দেওয়া। তাই বলে পুরোপুরি অস্বীকার করাও নয়।
এর কোনোটাই নতুন নয়। দুঃসাহসিক কিছু নয়। একশ' বছরের কিছু বেশী সময় ধরে জাদুলণ্ঠন হাতে একদল খ্যাপাটে লোক যা'সব কান্ড করে চলেছে, সেসবের নিরিখে হয়তো কমনপ্লেস।
তবু, ঐ যে বললাম-কবিতার নিশিডাক। ফিডার রোডের মোড় ঘুরতেই জঞ্জালে মাখামাখি দেওয়ালের গায়ে ঐ যে একখানা বড়সড় পোস্টার - কবিতারচনাঃ জয় গোস্বামী /রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর /লালন ফকির--তাই দেখেই তো ফিদা হয়ে গেলাম। কবিতার লাইন দিয়ে বাংলা সিনেমার পোস্টার? সিনেমার প্রোমো ট্রেলারে জয় গোস্বামী কবিতা পড়ছেন অন্ধকার স্টেজে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র একখানা স্পটলাইট মুখে নিয়ে! এ আর থাকা যায় না।
তাই লম্বা পাঁচ বছর বাদে বড় পর্দায় আবার ছবি দেখতে গেলাম।
----------------------------------------------------------
আমি না, একটা কবিতা লিখছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে বসে। ঐ যে , একটা নদী ছিল। হাঁসকুঁড়ি নদী। তার পাশে বসে।
মেয়েটি ছেলেটিকে বলে।
-কই, সে কবিতাটা কোথায়? নিয়ে এসেছো তো, কবিতাটা? কিন্তু হাঁসকুঁড়ি? ইস্, কী বিশ্রী নাম ! ঠিক যেন ফুসকুড়ির মত শোনাচ্ছে।
-শোনো না! সেটাই তো গল্প। তারপর ফেরার সময় দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি। যেদিকে যাই, সেদিকেই একই রকম জঙ্গল। একই রকম গাছ।
-আর তারপর?
-তারপর তো কবিতাটা কাজে লাগল। কবিতার পাতাটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গাছের গায়ে মার্ক করতে করতে আসলাম ...
-তুমি আস্ত একটা কবিতা জঙ্গলকে দিয়ে এলে?
-হ্যাঁ-অ্যাঁ! কবিতাটাই তো আমাকে তোমার কাছে নিয়ে এলো ।
গর্বিতা মেয়েটি বলে। তখনো চিবুকে লেগে আছে। কবিতার শেষ টুকরো।
দুটো মানুষ। একজন বি.ই কলেজ। একজন ইংরেজি ভাষা। ছেলেটি কবিতা লেখে। মেয়েটি প্রজেক্ট রিপোর্ট। মাঝদুয়ারে আয়না। অর্থাৎ কিনা আরশি নগর। এপারে-ঐপারে।
কবিতা তাকে খেয়ে ফেলে, অন্ধ ছেলেটিকে। কবিতার সাপের ছোবল খেতে খেতে সে পড়শীর খোঁজ নিতে ভুলে যায়। মেয়েটির মায়ের হার্ট অ্যাটাকের খবর আসে। সে জানাতে ভুলে যায়। বন্ধুদল নিয়ে হুল্লোড় করে, মদ খেয়ে সে আলমারিতে রাখা টাকা শেষ করে ফেলে। নন্দ'র মা কী খাবে, সে খোঁজ রাখেনা। রাধিকা বাড়ি ফিরে কী খাবে, সে খোঁজ রাখেনা। না, নিছক কবিতার দোষ নয়। সে চরিত্রগতভাবেই একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ।
আমি সঙ্গীতাকে জিগ্গেস করি-এই ইন্দ্রনীল, ও কি সেল্ফ-সেন্টার্ড নয়?
সঙ্গীতা বলে,- হ্যাঁ, ও সেল্ফ-সেন্টার্ড। অতি অবশ্যই সেল্ফ-সেন্টার্ড।
যদিও সে নন্দ'র মা'কে নিয়ে কবিতা লেখে। গণেশকে নিয়ে কবিতা লেখে। গণেশ ওদের ইস্ত্রিওলা। রাই সেকথা কোনোদিনও জানতে পারেনি।
কিন্তু কবিতা তাকে লাই দিয়েছে। শিল্প তাকে শেকল পরিয়েছে। যখন জীবন দেখে, শুধু কবিতাকেই খোঁজে সে। গাঢ় তেলে ভারীডানা উড়াল-অক্ষম পাখীটিকে দেখে সে কেবল একটি ব্যালের কথাই ভাবে। তার জীবনের সেরা কবিতা হবে মানুষের দুঃখ আর ভালবাসা, নীলিমা আর অপ্রেম। সে, শিল্পী, জীবনের মাসমজ্জা নিয়ে সে তার ছবিগাছে সার দেয়। কবিতাগাছে। তার কি দয়ামায়া নেই?
ভৃগু গর্জন করে বলেছিল--না, তার দয়া-মায়া, কিচ্ছু নেই। সে একটা স্কাউন্ড্রেল। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
সবাই একরকম একরোখা হয় না। সবাই গর্জন করতে পারেনা। এত নিশ্চিত থাকেনা। আমি সিনেমাশেষে মাথা নীচু করে ভাবতে ভাবতে ফিরি-সত্যি কি ও সেল্ফ-সেন্টার্ড? ঐ কবি-ছেলেটি,ইন্দ্রনীল? ( হা, ঋতুপর্ণকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল, উনি আর নাম পেলেন না?)
কিন্তু মেয়েটির প্রতি, জীবনের প্রতি আমার মায়া হয়। মানুষের দয়া নাই, তোমারি তরে।
যেমন নন্দিনী বলেছিল, অথবা রাধিকা--কবিতার সময়ের অভাব নেই, সে যুগযুগান্তর ধরে অপেক্ষা করতে পারে। মানুষের দুঃখ মানুষের নাগাল চায়। তার সময় অল্প।
রাধিকা একজন পাগল দেখেছিল। নতুন বিয়ে হয়েছে তখন। ট্যাক্সিতে বসে থাকতে থাকতে--কেননা ইন্দ্রনীল তাকে বসিয়ে রেখে প্রবীণ কবির বাড়িতে ঢুকে নিজের লেখা নতুন কবিতা পড়ে শোনাতে শোনাতে বেমালুম ভুলে যায় নতুন বৌয়ের কথা।
সে একজন প্রবাসী পাগল। এই শহরে কিভাবে যেন এসে পড়েছে সে, আর ফিরে যেতে পারছে না তার জন্মের মাটির কাছে। উলিডুলি ছেঁড়া নোংরা জামা, গলায় গাঁদা ফুলের মালা, প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে সে ট্যাক্সিওলাকে এসে জিগ্গেস করে--ঢাকা-বিক্রমপুর যাবা? ভয় পেয়েছিল তাকে দেখে, রাধিকা।
ভয় ঘুমিয়ে থাকে শীতকাল জুড়ে। ভয় তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় কবিতা। যে মানুষটা তার বুকের কাছে আসে রাত্তিরে , আর সকালে বেরিয়ে যায় অন্নের খোঁজে, সে যদি একদিন আর ফিরে না আসে? যদি তার চেহারা নিয়ে ফিরে আসে অবিকল একরকম দেখতে অন্য একজন মানুষ, যে আসলে একটা পাগল--যে লুকিয়ে রেখেছে তার গাঁদা ফুলের মালা, দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল, উলিডুলি ছেঁড়া নোংরা জামা? তার বুকের কাছে এ কোন প্রবাসী মানুষ তবে, কোন ঢাকা-বিক্রমপুর? আর তার নিজের মানুষটাই বা এত রাত্তিরে ঘুরে মরছে কোন আঘাটায়, কোন প্রবাসে?
আর শব্দে শব্দে, ফুলে-অন্ধকারে প্রবাস, শুধু প্রবাসে ভরে যেতে থাকে আমার আশপাশ, ছোট হলঘর সিনেমার,বেঁচে থাকার সমস্ত অন্ধি-সন্ধি- আনাচ-কানাচ। রাত্রির সমুদ্র ঠেলে জেগে ওঠে পাগল, ওঠে ব্যাধিঘোরে জরজর কবি, তার সমাজ নেই-সন্তান নেই-শ্রীরাধিকা-চন্দ্রাবলী নেই; আছে শুধু দগ্ধ ডানা, নষ্টনীড়, প্রবাস, প্রবাস।
যাই বলুন না, বিপাশা কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছে। ঐ সাদাসিধে ধরনে শাড়ি-পরা, হাল্কা সাজ, ছোট্ট টিপ অথবা টিপহীনতা; ঐ মুখ! আহা! বুকে তীর খেয়ে গেলাম। নেহাত আদ্ধেক নম্বর কাটা গেল সোহিনী বাবদ। সোহাগ সেনও বড় ভাল। যীশুকে এতকাল ছ্যাবলা ছেলে বলে জানতাম , সে-ও কত মাপা অভিনয় করে চলে গেল।
কিন্তু প্রসেনজিত এটা কী করলেন? ওঁকে সরিয়ে নিন, আমার লাগছে। না-কামানো দাড়িতে লাগছে না, ভারভার্তিক মুখে লাগছে। শালগ্রাম শিলার মত লাগছে। সুখ জমে জমে পাথর হয়। আর সে¾ট্রাল ওবেসিটি। আর কোহলকারণে প্যারোটিড স্ফীতি। ঐ ইন্দ্রনীল, ও কস্মিনকালেও কবিতা লেখেনি। কবিতা ওর চোখেমুখে-আচারে-উদ্গারে কোনো পদচ্ছাপ রেখে যায় নি, শুধু একটি পস্থুমাস ব্লো-আপ ছাড়া, একমাত্র পার্টিং কিক। আর কে-উ ছিলেন না, এ বিশ্বচরাচরে? প্রসেনজিত ছাড়া?
কিম্বা হলেও-হতে-পারে আমাদের চোখের দোষ, অভ্যাসের। আর দোষ পরিচালকের। তেমন করে ভাবা হয়নি; যত্ন করে। ডিম ভাঙা হয়ে গেছে কাঁচা থাকতে, খোঁড়া হয়ে গেছে চরিত্রটা। খারাপ প্রোটোটাইপ। হায়, আরেকটু ভাবনাচিন্তা, আরেকটু বিবেচনা-সে কোথায়?
ততক্ষণে ছবি প্রায় আদ্ধেক গড়িয়ে গেছে, যখন আমার বোরিং লাগতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে অন্য যে কোনো ঋতুপর্ণ-ছবির মত, অর্থাৎ কিনা বছরবিয়োনি মায়ের সর্বশেষ প্রোডাকশন। কিন্তু ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলে উঠে নিভে গেলে পরে, পপকর্ণ আর চিপস'এর কচরমচর থেমে গেলে পরে, ও হ্যাঁ, পাশের সিটগুলি থেকে অনবরত মোবাইলের টুং-টাং বাজানো ছেলেপিলেরা উঠে গেলে পরে ঋতুপর্ণও একটু যেন ভরসা পেয়ে সান্দ্র হয়ে উঠতে পারেন। মনে হয় যেন এই বিরতির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন পরিচালক, যখন বিপাশার খোলা পিঠ ইত্যাদি'র খোঁজে আসা লোকজন হল থেকে বেরিয়ে গিয়ে কবিতাকে একটা কাঙ্খিত পরিসর দেবে একা হবার; অর্থাৎ কিনা রাধিকাকে।
এই সিনেমা রাধিকার। এই সিনেমা হলেও-হতে -পারতো লাবণ্য দাশ অথবা সুরমা ঘটকের। এঁদের ভাষা আমরা কোনোদিন পড়ে দেখিনি। অবলুপ্ত প্রাকৃতের মত,শহীদের দেশের প্রান্তিকের মত এঁদের আমরা ছুঁয়ে দেখিনি কখনো। ঋতুপর্ণ এঁদের ভাষা দিলেন অনুবাদের কল্পনায়। সেই অর্থে, এই সিনেমার ""সব চরিত্র'' যদি দিনের শেষে কবির "স্বার্থপর বৌ'-এর ভাবনার ভাষা হয়, তবে তা কাল্পনিক তো বটেই !
বেঁচে থাকতে জানাশোনা হয় নি তেমন। মরে যাওয়ার পর ইন্দ্রনীলকে খুঁজতে বেরোতে হল রাধিকাকে। ইন্দ্রনীলের ফেলে যাওয়া ট্রেইল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া। যেন জীবনের ট্রেন থেমে গেছে অবরোধের জন্য, কী আর করার আছে, চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে অচেনা স্টেশনে নেমে যাওয়া ছাড়া; আর স্টেশনের পাশ দিয়ে যে ছায়ায় ঢাকা রাস্তা চলে গেছে, তার মায়ায় পড়ে যাওয়া ছাড়া। এই রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়াই যায় অজানা কোনো বনের মধ্যে,অচেনা কোনো নদীর ধারে; শহরে আর ফিরে না গেলেও চলে। ফিরতেই হবে , এমন মাথার দিব্যি কে-ই বা দিয়েছে!
এমনি করে থেকে গেল রাধিকা। আর জীবন আর মৃত্যু আর নিয়তি মিউজিক্যাল চেয়ার খেলতে লাগল তার ছোট্ট বাগানের সবুজে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে সৌন্দর্য দেখে রাধিকা, স্নেহে ঝুঁটি নেড়ে দেয় খেলাপাগল ফ্রকবালিকাদের। অর্থাৎ কিনা পর্যায়ক্রমে জীবন আর মৃত্যু আর নিয়তি। অ্যাজ ইফ মিউজিক্যাল চেয়ারে কোনো পর্যায় থাকতে আছে।
কিন্তু ট্রেইলের কথা হচ্ছিল। যে শুঁড়িপথে রাধিকা হাঁটল না কোনোদিন। আর আজ হঠাৎ করে যে রাস্তায় তাকে নামিয়ে দিল জীবনের ট্রেন। সেই পথ ধরে হাঁটলে দিনান্তে কী উপার্জন হয়-- ভালোবাসা? সরলতা, তুমি ভাবো এমন?
ভালোবাসা আসুক-না আসুক, অবাক হয়ে যাওয়া তো আসতেই পারে , তাতে তো দোষ নেই ! এই যে রাধিকা জানল, নন্দ'র মা'র সঙ্গে বসে বসে কত গল্প করত ইন্দ্রনীল, যেন দুই বন্ধু; কবিতা লিখেছিল নন্দ'র মা'কে নিয়ে। কবিতা লিখেছিল তো গণেশকে নিয়েও, গণেশ ওদের ইস্ত্রিওলা। জ্বরকে নিয়ে লিখেছিল কবিতা। জ্বর একবার রাধিকাকে জাপটে ধরেছিল। ইন্দ্রনীলের সামনেই। দুজনের মাঝখানে জ্বর, জ্বর তৈরী করে পাঁচিল, জ্বরকে ভালোবেসে কী প্রত্যাখ্যানটাই না করেছিল রাধিকা, ইন্দ্রনীলকে।
আর আসতে পারে কাঁচের টুকরো। অচেনা রাস্তায় হাঁটতে গেলে, কেননা মাতলামোর মধ্যে অনেকগুলো বোতল ভেঙে-ছড়িয়ে ফেলেছে ইন্দ্রনীল। তাই দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে রাস্তা, ঐ কৌণিক কাঁচখন্ড দিয়ে,রাস্তার কিছুটা অন্ততঃ । কাঁচ ফুটে যায় পায়ে,মর্মরের ধবলে রক্ত লাগে, সাদায় ও লালে , রাধিকার দুধে-আলতা পা।
একটা কবিতা লিখেছিল রাধিকা। অচেনা এক পাগলকে নিয়ে। রাধিকার কবিতার সেই পাগলকে ইন্দ্রনীল তুলে নিয়েছিল তার নিজের গল্পে; নন্দ'র মা-কে পড়ে শুনিয়েছিল সে গল্প। রাধিকা জানতেও পারেনি।
এইরকম সব কাঁচ। ইন্দ্রনীলের কবিতা'র "কাজরী'-রাধিকা জানতে চেয়েছিল-"সে কী আমি'? "না' -বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ইন্দ্রনীল। এমনি সব।
বেঁচে থাকার এইসব মাসমজ্জা নিয়ে কবিতাগাছ লেখে ওরা। লিখে চলেছে তো চলেছেই। আর পাঁউরুটির নীল ছাতকুড়োর মত, ভেজা ডালের অর্কিডের মত, পরজীবী সবুজের মত জল পেয়ে লকলকিয়ে কবিতার শিখা লাফ দিয়েছে অনন্তে। পেছনে জীবনের কালো অসীমতা।
"গয়া যাবে?'-বলে রাস্তার মাঝখানে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায় একটি বাসকে, রাধিকা। হাতে একটি স্যুটকেস সম্বল। গয়ায় পিন্ড দিতে যাবে ইন্দ্রনীলের।
আর ঐ সজলতা, সোহিনীর গলার ঐ অলৌকিক আর্তিকে চাকায় মাড়িয়ে গাঢ় হংকিংয়ে গলা পরিষ্কার করে চলে যায় দিনের বাস। শিল্যুয়েটের রাধিকাকে সন্ধ্যার নীলকাজল অন্ধকারের ব্যাকড্রপে একা দাঁড় করিয়ে রেখে। হাতে একটি স্যুটকেস সম্বল। দিনেরই বাস। সন্ধ্যার ছায়া লাগলে পারত না।
আহ্, কী করুণা, কী অপরিসীম করুণা দিয়ে এই দৃশ্যখানি রচনা করেছেন ঋতুপর্ণ! আমার কান্নার বোধ জাগে, কাঁদতে আমি লজ্জা পাইনা, কেননা হলঘরের অন্ধকার, কেউ তো আর দেখতে পাচ্ছে না।
একা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। ইন্দ্রনীলকে নিয়ে, শেখরকে নিয়ে, কবিতার পাগল আর পাগলের কবিতাকে নিয়ে চলে গেল দিনের শেষ বাসটি। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, ঐ নীলকাজল দিগন্তের একটু নীচে। হাতে শুধু তার একখানা স্যুটকেস। বেঁচে থাকার বাদবাকি সম্বল তার মধ্যে। হলঘরের অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
"দেখ, নিল না'- বলে বালিকার মত অভিমান করে রাধিকা। কাজরীর কাছে।
কবিতার ক্লাশ শেষ, এবারের মত।
পরিশিষ্টঃ যে চিঠিটি ছাড়া লেখাটি অসম্পূর্ণ। লিখেছেন, ইন্দ্রাণী।
ইন্দ্রনীল,
তোকে এচিঠি লেখা ডিউ ছিল আমার বহুদিন। তোকে বলার ছিল অনেক।
সিনেমা দেখার আগেই পড়ে ফেলেছি তোর এই প্রগাঢ় মায়াময় গদ্য। পড়লাম প্রতিভাসের 'কবিতা প্রতিমাসে'-সেপ্টেম্বর ২০০৯ সংখ্যায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ ধর, হিরণ মিত্র। ঋতুপর্ণ ঘোষের সাক্ষাৎকার। জয় গোস্বামীরও। সংক্ষিপ্ত যদিও। ঐ একই সংখ্যায়। শঙ্করলাল স্পষ্টই জানিয়েছেন তিনি দেখেননি সিনেমাটি। আলোচনা করেছেন সিনেমা কখন কবিতা হয়ে যায়।গোদারের কথা এসেছে, এসেছে 'পিয়েরো লা ফ্যু'।আলোচনার সূত্রে, অবশ্যই। গল্প শুনিয়েছেন,উদাহরণ স্বরূপ। ইতালীয় ছবি ইল পোস্তিনোর গল্প- যেখানে নেরুদার অজ্ঞাতবাসে তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিতে আসছে এক ডাকপিয়ন। জানতে পারছে, কবির পরিচয়। গড়ে উঠছে আশ্চর্য সম্পর্ক-ডাকপিয়ন অধীর অপএক্ষায় থাকে চিঠি দিতে গিয়ে কবির থেকে কবিতা শুনবে কখন। একসময় সে নিজেই কবি হয়ে যায়।রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা শুরুই করেছেন, 'কবি ও কবিতা নিয়ে জগতে সিনেমা নেই বললেই চলে'।হিরণ মিত্র ধন্ধে পড়লেন 'ঘূর্ণির মতো সময়, যার আগুপিছু ধরা যায় না। যে ঘুরে চলে, অতীত বর্তমান মাখামাখি। ধাঁধা লাগানো, সময় খেলা, সম্পর্ক খেলা।'চন্ডী মুখোপাধ্যায় বলছেন-কল্পনা নয়, স্মৃতে আত্ম অণ্বেষণ।অনিরুদ্ধ ধর অন্তকথনে স্পষ্টই লিখলেন, 'আসলে শেষ পর্যন্ত সিনেমা হ'ল সিনেমাই, এবং কবিতা হল কবিতা।সিনেমার যেমন কবিতা হয়ে ওঠার দায় নেই, তেমন কবিতারও সিনেমার গা ঘেঁষে থাকার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।'
দেখার আগেই এত কিছু পড়ে ফেলা আমার। বন্ধুজনের দর্শনপ্রতিক্রিয়া, কবির সাক্ষাৎকার, পরিচালক -কবির কথোপকথন। ফলত: নিজে থেকেই ভেবে নেওয়া এটা সেটা। সাত পাঁচ। দেখার আগেই।
অবশেষে দেখলাম। লিখতে দেরী হ'ল। তোকে কিছু বলার ছিল ...
কাগজে আঁচড় দিতে পারি না আজকাল। শাদা কাগজ। কলম ছোঁয়াচ্ছি। শাদা কাগজ, লেখার কাগজ কি করে হয়ে যাচ্ছে ব্লটিং পেপার। শুষে নিচ্ছে কলমের কালি। একটা গাঢ় নীল বিন্দু প্রথমে । তারপর বড় হচ্ছে বড় হচ্ছে .. সমস্ত কাগজটাই নীল হয়ে যাচ্ছে একটা সময়। ব্যস্ততা, বিষাদ, ক্লান্তি। পারিপার্শ্বিক।প্রবাস। পৌন:পুনিকতা।দৈনন্দিনের অ্যাকোয়ারিয়াম।
তলদেশে নীলচে বেগুণী নুড়ি, নয়নশোভন জলজ গুল্ম, শেকড়বিহীন। সাঁতরে চলে বাহারি মাছ।শ্যাওলাহীন তার পৃষ্ঠদেশ। রঙীন চকচকে আঁশ। দানা গিলে নেয় এক দুই তিন। সাঁতার কাটে। অগভীর ক্লোরিন জল। এদিক থেকে ওদিক,ওদিক থেকে এদিক। এ দেওয়াল থেকে সে দেওয়াল তক। ও দেওয়াল থেকে এ দেওয়াল। কাচ দেওয়াল।বুড়বুড়ি কাটে । ভালো থাকে। একদিন চিৎ হয়ে ভেসে উঠবে বলে।
মেয়েটিও ঢুকে গেছিল বাহারি জলপাত্রে সেই কবে। ছবির একদম গোড়ায়। মনে আছে?
সেই যে নিরবলম্ব কাঠপুতুলসমূহ -বন্ধ জানলা। আধো অন্ধকার ঘরে যেদিন লিখল- A littlr river/Twists and Turns ইংরিজিতেই বলল আলিস্যি করে ওরিজিনাল কিছু লেখে নি ক্রিয়েটিভ রাইটিংএর ক্লাসে। বাংলা কবিতা একটা। তর্জমা করে তুলে দিয়েছে খাতায়।
চিনে নিলাম ঝাঁকের কইটিকে। এ মেয়ে অতল দীঘিতে স্বচ্ছন্দ হবে না। শ্যাওলায় দমবন্ধ হবে, লতাগুল্ম পথ আটকাবে। এ মেয়ে ক্ষণতরে পা ডোবাবে দুধ আলতায়। ক্ষণতরেই।সিঁথিমৌর থাকবে, কনে চন্দন, ঘিরে থাকবে এয়োতীকুল, উলু, শাঁখ। খলবলে জীয়ল মাছ হাতে নেবে। মুহূর্তকাল। পরমুহূর্তেই তাকে দেখব রঙ্হীন চারদেওয়ালের মধ্যে। ফ্যাটফ্যাটে সাদা আধুনিক বাথরুম, ফসেট, সোপ, নির্দাগ টাইলস। জীয়ল মাছের গন্ধ মুছে নিচ্ছে সালংকারা। চৌকাঠে তার নতুন বর। ঐ ব্যবধানটুকু থেকেই যাবে।
মেয়েটির যে নতুন বর। কবিতা লেখে। আপিস যেতে অনীহা। নতুন বৌকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে রেখে সেই যে গেল কোথায়। ক্রিকেট, আড্ডা, বন্ধুসঙ্গ। সাংসারিক বোধবিহীন মানুষ। কবি না হলেও হ'ত।এরকম মানুষ দেখি নি আমরা? অ কবি?
মসৃণ গাল নয় তার, ইংরিজিতে অস্বচ্ছন্দ, 'মাগী' শব্দটি উচ্চারণ করে নির্দ্বিধায়। নন্দর মা, ইস্ত্রিওলার সঙ্গে তুমুল স্বচ্চন্দ অথচ। কথোপকথনে। আলপচারিতায়। অ্যাকোয়ারিয়ামে বসত করে না সে যে। পিঠে তার শ্যাওলা। জানা কথাই, তার সঙ্গে একত্র যাপন হবে না আমাদের। গভীর জল সইবে না। শিকড়বাকড়ে দম আঁটকে মরব। এই যে আমরা। বাহারি মাছ। জলপাত্রে বাস। জানা কথাই আমরা পাগল দেখলে ভয় পাব আর সেই শ্যাওলা পিঠ সোহাগ করলে তীক্ষ্ণকন্ঠ হবো-ঘোষো না, ইট হার্টস।
মেয়েটির যে সখা, তারও বাস ঐ বাহারি জলাধারেই। ত্রুটিহীন। স্মার্ট। মোবাইল। আচ্ছা, একটা পূর্ণ বাংলা বাক্যগঠনও কি শুনলাম তার মুখে? জানা কথাই, এ মেয়ে এই ছেলের সঙ্গে ঘুরবে ফিরবে, সাঁতরাবে। অগভীর জলে স্বচ্ছন্দ সাঁতার। জানাই তো। এ মেয়ে অনিশ্চয়তাকে ভয় পাবে, ইন্সিকিউরিটিকে কাছে আসতে দেবে না। স্বামীর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার খবরে আতংকিত , ক্রুদ্ধ, বিষাদগ্রস্ত হবে। এ সব জানা ছিল।
জানা ছিল না এ মাছের চোরা টান। জানা ছিল না এ মেয়ে পাগল দেখে ভয় পায় আপাত:। পাগল তাকে হন্ট করে। লিখিয়ে নেয় কবিতা। সে কবিতার ছত্রে ছত্রে শ্যাওলা পিঠের কথা। সে ভালোবাসে অগাধ জলাশয়। অথচ তা গোপন রেখে দানা গেলা, এ দেওয়াল ও দেওয়াল সাঁতরানো।
শ্যাওলা পিঠের সে একদিন ফিরে যায়।প্রাচীন কোন দীঘিতেই হয়তো। এই যে বাহারি মাছ মেয়েটি-এতদিন গোপন রেখেছিল চোরাটান-এতদিন পরে জীবনে প্রথমবার ঘাই দেয়। খান খান হয়ে যায় জলপাত্র। বেরিয়ে পড়ে সে। সেই নদী-প্রথম দৃশ্যে যা ছিল টুইস্ট অ্যান্ড টার্নের লিটল রিভার ... জানলার কাচে সালংকারা হাত রেখেছিল সে, হাতের পাশে হাত ছিল না কোনো ... শেষ দৃশ্যে পরিষ্কার উচ্চারিত বাংলা-আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে ... হাতের পাশে হাত রয়েছে এবার।
তুই যেমন দেখলি। আমি দেখলাম অন্যরকম।
ঘাই দিতে ইচ্ছে হ'ল। ভয় পেলাম। জলপাত্র বিচূর্ণ হওয়ার ভয়। শ্যাওলার ভয়, শিকড়ের ভয়।
চোরাটান, ভালোবাসা বুকে চেপে দানা খাই। ব্লটিং শুষে নেয় কলমের কালি।
এই তো। এই বলার ছিল তোকে।
খুব ভালো থাক।
ইন্দ্রাণীদি।