যা বোঝা যাচ্ছে, অনুশাসনের সময় ক্রমে আসিতেছে। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই অনির্দিষ্টকালের জেলবাস। কার্টুন আঁকলেই একরাত্রি হাজতযাপন। পুলিশেরও রেহাই নেই। অনুমতি ব্যতিরেকে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, ধর্ষণকে ধর্ষণ বললেই সিধে ব্যারাকপুরে ট্রান্সফার। অনেক অকর্মণ্য অপোগন্ডোই কদিন আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় দুটো শিং এঁকে আর মুখে দুটো শ্বদন্ত এঁকে ফেসবুকে সেঁটে দিয়ে অপার আনন্দ লাভ করছিলেন, আর এতদ্বারা কী প্রমাণিত হইল, জিজ্ঞাসা করলেই বুক ঠুকে বলছিলেন "পেইড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েন"। তাঁদের ফুর্তির দিন শেষ। বিরোধীপক্ষকে গাল দিয়েছিলেন বেশ করেছিলেন, ওদের দিলে দোষ নেই। সে খাতা আর খোলা হবেনা। কিন্তু এখন আর এসব মামদোবাজি চলবেনা। চায়ের দোকানে গিয়ে যার নামে যা খুশি বলে এলাম, গাল দিতে ইচ্ছে হল আর ইন্টারনেটে উগরে দিলাম, মাথায় আইডিয়া এল আর মাউস বাগিয়ে বগল বাজাতে বাজাতে কার্টুন আঁকতে বসে গেলাম, ওসব মামার বাড়ির আব্দার শেষ। আগে যা হয়েছে হয়ে গেছে, এখন মনে রাখতে হবে, শৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। অনুশাসনেরও কোনো ছাড় নেই। সঙ্গে এও জেনে রাখবেন, যে, বাইরে থেকে যত কঠিন কঠোরই দেখাক না কেন, পাবলিক ফিগারদের অন্তর পালকের চেয়েও নরম। কটু কথা শুনলে তাঁদের মনে কষ্ট হয়। ব্যঙ্গচিত্র দেখলে চোখে জল আসে। মানুষের মনে দুঃখ দেওয়া মোটেও উচিত কাজ নয়। মনে অকারণে আঘাত দিলে তাকে সাইবার ক্রাইম বলে। অতএব এসব আর করা যাবেনা। করলেই লোকাল থানার আন্ডারে। প্রয়োজনে আইপি ট্র্যাক করা হবে। হাজতে এনে বাটাম দেওয়া হবে। আঁতলামি ছুটিয়ে দেওয়া হবে।
কী ভাবছেন, ঝুট ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই, খাবেন-দাবেন-ঘুরে বেড়াবেন, বান্ধবীর হাত ধরে মলে-মাল্টিপ্লেক্সে ফুর্তি করবেন, সিনেমা দেখবেন? সে গুড়েও বালি। অনুশাসন সেখানেও কঠোর। সিনেমা মানে তো খালি সেক্স আর ভায়োলেন্স। নারীমাংসের ফেস্টিভ্যাল। নতুন নিয়মে এইসব ফুর্তিফার্তা, অশালীনতা ঘুচিয়ে দেবার সুবন্দোবস্তো আছে। এবার শালীন হতে হবে। কালচারাল হতে হবে। এমনিতে হলে ভালো। না হলে ঘাড় ধরে করানো হবে। ইয়ার্কি নয়, সম্প্রতি পাওলি দাম অভিনীত একটি ছবির পোস্টারে অভিনেত্রীর খোলা শরীরে নাকি পোশাক পরিয়ে দেওয়ার ফরমান জারি হয়েছে। যুক্তিটি সিম্পল। হলের ভিতরে চুপি-চুপি যা দেখবে দেখো, বাইরে দিনের বা নিয়নের আলোয় সিনেমার নামে ওসব অভব্যতা চলবেনা।
সিনেমা নিয়ে হট্টগোল অবশ্য একেবারে নতুন কিছু না। এ থেকে অনেক কিছু শেখারও আছে। একদা একটি সিনেমায় লেনিনের নগ্ন পশ্চাদ্দেশ দেখানো নিয়ে খুবই হইচই হয়েছিল। আরেকটি সিনেমায় যীশুর মুখ দেখানো নিয়েও প্রবল হট্টগোল হয়েছিল এক সময়। সেসব বিতর্ক থেকে আমরা শিখেছিলাম, লেনিনের কোনো পাছা ছিলনা, থাকলেও তা দর্শনীয় ছিলনা। যীশুরও কোনো মুখ ছিলনা, থাকলেও তা দেখানোর অযোগ্য। এবার শিখলাম, পাওলির কোনো শরীর নাই। থাকলেও তা দেখা যাবেনা। ওসব অপসংস্কৃতি। এখন সংস্কৃতি চর্চার সময়। বাড়িতে বসে ব্রহ্মসঙ্গীত শুনুন, কথামৃত পড়ুন, সিনেমা দেখতে হলে "জয় বাবা তারকনাথ' আর "নদের নিমাই" দেখুন, পয়সা না থাকলে, ট্র্যাফিক লাইটে মাগনায় রবীন্দ্রগান শুনুন, এসব ফালতু জিনিস দেখবেন না। ফালতু কথা বলবেন না। ফালতু জিনিস আঁকবেন না।
এখানেই শেষ নয়। শুধু ফালতু জিনিস করবেন না বললেই তো হবেনা, এতদিন যা পাপ করেছেন তার ঠ্যালা কে নেবে? দস্যু রত্নাকরের পাপের বোঝা কেউ নেয়নি, আপনার ক্রুশও আপনাকেই বইতে হবে। নিজের কৃতকর্মকে শুদ্ধিকরণের আগুনে জ্বালিয়ে দিতে হবে। কবিগুরু বলেছেন, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। তাই আত্মশুদ্ধির জন্য এর উপরে নাকি আসছে বিবাহ বিষয়ক ফরমান। যাকে-তাকে বিয়ে করে বাঙালির পরিবারে এতদিন বদরক্ত ঢুকে পড়ছিল। রক্তের রাজনৈতিক বিশুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হওয়ায় যথার্থ রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলা যাচ্ছিলনা। এখন থেকে তাই বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষার বদলে রাজনৈতিক আনুগত্যের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। বিপরীত রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের মধ্যে বিবাহ-সম্পর্ক নিষিদ্ধ হবে। ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের ছায়া মাড়াবেন না। একই ধোপা ও নাপিত ব্যবহার করবেন না। এক ঘাটে জল এবং একই চায়ের দোকানে বসে চা খাবেন না। খেলেও চায়ের গ্লাস আগে গঙ্গাজলে ধুয়ে নেবেন। এইভাবে কঠিন ও কঠোর ভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ অভ্যাস করে প্রতিটি মানুষকে আত্মশুদ্ধির পরীক্ষা দিতে হবে। নইলে বিপদ। বাইচান্স বিরোধীপক্ষকে দেখে হেসে ফেললে, নেমন্তন্ন বাড়িতে পাশাপাশি বসে ফেললে বা বিরোধীদের সুন্দরী কন্যাকে দেখে গলে গেলেই মুশকিল। খেল খতম। একুশে আইনের তেরো নম্বর ধারায় সোপর্দ। জেল-হাজত অনিবার্য।
এসব শুনে কেউ যদি ভাবেন, এতদ্বারা ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তাঁকে সেই অতিপুরাতন গপ্পোটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক। গপ্পোটি এইরূপঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ হয়েছে কদিন আগে। ইউরোপ ভাগাভাগি সম্পুর্ণ। বার্লিনের পাঁচিল তোলা শেষ। সেই পাঁচিলের নিচে দাঁড়িয়ে এক আমেরিকান এবং এক রাশিয়ান সৈনিক কার দেশ ভালো সেই নিয়ে তর্ক করছে। রাশিয়ান বলল, "তোরা আর কথা বলিসনা। তিরিশের দশকে তো গাদা গাদা লোককে না খাইয়ে মেরে দিয়েছিস। আর তোদের নেতারা ফুর্তি করেছে।"
শুনে আমেরিকান বলল, "সে লোক মরেছে ঠিকই, নেতারা ফুর্তি করেছে তাও ঠিক। কিন্তু তাতেও আমরা স্বাধীন।"
-- কীরকম?
-- আমরা দরকার হলে হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার বলতে পারি, ট্রুম্যান একটা গাধা। কেউ কিচ্ছু বলবেনা। তোরা পারবি?
শুনে রাশিয়ানও বীরদর্পে বলল, "কেন পারবনা? আমিও ক্রেমলিনের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারি ট্রুম্যান একটা গাধা। কেউ কিচ্ছু বলবেনা।"
সোজা বাংলা এইটাই। অনুশাসনের জমানায় ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে অকারণে হল্লা করবেন না। ওই দেখুন আলো ক্রমে অসিতেছে। রক্তিমতা গত হইয়াছে, আমরা প্রাকৃতজনেরা পুষ্পের উষ্ণতায় চিহ্নিত। এ নভোমন্ডল ও সরকারি স্থাপত্যসকল মুক্তাফলের ছায়াবৎ নীলাভ। এই অভ্রংলিহ অট্টালিকারাজির সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে হলেই আপনি এখনও বিরোধীপক্ষের মুন্ডপাত করতে পারেন। কার্টুন আঁকতে পারেন। নোনাডাঙার অনশনকারীদের গালমন্দ করতে পারেন। কেউ কিচ্ছু বলবে না। কে বলে আপনার ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই?
পুঃ আমি, এই লেখার লেখক, নিয়মিতভাবে একটি সংবাদপত্রে কলাম লিখতাম। তাঁরা এই লেখাটি প্রকাশ করতে অক্ষম বলে জানিয়েছেন। ফলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, যে, অনুশাসনের দিন আসিতেছে। বলাবাহুল্য, কলামটিও আমি বন্ধ করে দিয়েছি।