এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • ছত্তিশগড়ে মাওবাদঃ এক বিহঙ্গম দৃষ্টি -- তৃতীয় পর্ব

    রঞ্জন রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ | ১৬০৭ বার পঠিত
  • বারুদগন্ধের মাঝে বর্ণপরিচয়

    [ বর্তমান প্রতিবেদকের সুযোগ হয়েছিল  ন্যাশনাল লিটারেসি মিশনের হাই-পাওয়ার দলটির বস্তারের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় তিনদিনের ঝটিকাসফরের সময় 'রাজ্য সংসাধন কেন্দ্র' এর প্রতিনিধি হিসেবে ল্যাংবোট হয়ে ঘুরে আসার। এই কিস্তিটি তারই  ফলশ্রুতি।
    টেলিফোনে খবর এল যে বস্তার এলাকার জগদলপুর, কেশকাল পাহাড়, কোন্ডাগাঁও, দন্তেওয়াড়া এইসব এলাকায় কেন্দ্র সরকারের 'সাক্ষর ভারত' প্রোগ্রামের হাল সরেজমিনে দেখতে দিল্লি থেকে যে হাইপাওয়ার টিম আসছে তাদের কনভয়ে ছত্তিশগড় রাজ্য সংসাধন কেন্দ্র বা স্টেট রিসোর্স সেন্টারের গ্রুপটির সঙ্গে জ্যাঠামশায় হয়ে যেতে রাজি কি না। তারিখ ১ থেকে ৩ অক্টোবর। অর্থাৎ মহাসপ্তমীর রাতে বাড়ি ফেরা যাবে। পাগলা খাবি, না আঁচাবো কোথায়!
    কিন্তু মাওবাদীরা যে সরকারি কনভয় দেখলে হামলা করে! গাড়ির মাথায় লালবাতি-হলুদবাতি থাকলে ওদের হাত নিশপিশ করে শুনেছি? না, না, আমরা তো শিক্ষামিশনের আমলাদের সঙ্গে যাচ্ছি। অর্থাৎ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সবচেয়ে নির্বিষ অংশ। আর এটা কোন সিক্রেট মিশন নয়। দস্তুর মত আগেভাগে পাব্লিককে জানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার টাঙিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয় বেশকিছু এনজিও দের সঙ্গে নিয়ে তবে যাওয়া হবে। বেশির ভাগ সফর, মানে গাঁয়ে-টাঁয়ে যাওয়া, সলওয়া জুড়ুম শিবির দেখা সব দিনের বেলায় হবে। রাতের বেলায় ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে যাওয়া হবে। এরপরেও যতটুকু কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা, সেটা হরির ইচ্ছে। আজকাল দিল্লিতেও তো ভূমিকম্প হচ্ছে। ]


    প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোঃ সেপ্টেমবর-অক্টোবর মাসের ব্যালান্সশীট

    এখানে এখন শরতকাল আসার অনেক মানে। যেমন,  ইন্দ্রাবতী-শঙ্খিনী-ডঙ্কিনী নদীগুলোর জল কমে পারাপারের যোগ্য হয়ে ওঠা, পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে পাকদন্ডী পায়েচলা-পথগুলোর আস্তে আস্তে ফুটে ওঠা, ক্ষেতের কাজ শেষ হয়ে পালপার্বণের দিনগুলোর, নবরাত্রি-দীপাবলী ইত্যাদির ঝাঁপিয়ে পড়া।

    কিন্তু ২০১১ সালে এসব ছাপিয়ে একটাই মানে, --ধর্মক্ষেত্রে-কুরুক্ষেত্রে দুই যুযুধান পক্ষের সামরিক শক্তি পরীক্ষণ, পাঞ্জা লড়া। ভারত ও রাজ্য সরকারের তরফে রাজ্য পুলিশ, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, টেরিটোরিয়াল আর্মি ও নানান আধা-সামরিক বাহিনী। ওদিকে মাওবাদীদের বিভিন্ন দলম বা গেরিলা স্কোয়াড, আর তথাকথিত  লিবারেশন আর্মি।

    বর্ষাকালে ফুলে ওঠা নদীঘেরা অগম্য জঙ্গলপাহাড়ে মাওবাদীদের প্রচার, প্রশিক্ষণ, বৈঠকের দিন শেষ। এবার অ্যাকশন। কারণ, এখন সরকারি বাহিনী অপারেশন গ্রীনহান্টের অন্তর্গত "এরিয়া ডমিনেশন' স্ট্র্যাটেজির হিসেবে মার্চ করে বিভিন্ন এলাকায় ঢুকবে। পেনাল্টি এরিয়া এখনো অনেক দূরে হলেও মাঝমাঠের দখল নেবে।

    খেলা শুরুর বাঁশি বাজার আগে দু'পক্ষের শক্তি কেমন দেখা যাক।

    প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী অবুঝমাড়ে মাওবাদীরা  এই বর্ষার সময় তিনশ' যোদ্ধার আরো একটি ব্যাটেলিয়ন গঠন করেছে। তাহলে আগের বস্তার ব্যাটেলিয়নকে ধরলে ওদের লিবারেশন আর্মির দুই ব্যাটেলিয়ন হল। এছাড়া আছে এগার"টি কোম্পানি এবং গোটা ত্রিশেক গেরিলা দলম। সামরিক সংঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা ইদানীং বেড়ে যাওয়ায় মাওবাদীদের মেডিক্যাল স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। মহারাষ্ট্র সীমান্তের   গড়চিরোলী এলাকা থেকে সাগর নামের কোন ডাক্তার ত্রিশ-ত্রিশজনের গ্রুপ  বানিয়ে ফার্স্ট এড ও অন্যান্য ব্যাপারে ট্রেনিং দিচ্ছেন।                         

    সরকারি নারায়ণী সেনাদের শক্তির বিশদ ছবি পাওয়া কঠিন। তবু রাজ্য পুলিশের আর্মড ফোর্স (ছ্‌ত্তিশগ্‌ড় আর্মড ফোর্স বা সি এ এফ), সিআরপির অন্তত: কয়েক হাজার, বিএসএফ এর  পাঁচ ব্যাটেলিয়ন বস্তারের কাঁকের এ, বাকি পাঁচ উড়িষ্যা বর্ডারে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায়। এ'ছাড়া আরও দুই ব্যাটেলিয়ন এ মাসে বস্তারে আসছে।

    তারপর আছে বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর থেকে পাঠ নিয়ে বস্তারের আদিবাসী যুবকদের পুলিশে ভর্তির বিশাল প্রচেষ্টা। স্পেশাল টাস্ক ফোর্সে ৫০০০, ছত্তিশগড় আর্মড ফোর্সে ২০০০ এবং রাজ্য পুলিশে ৫০০০, মোট বারোহাজার।  আর্মিতেও এবার রায়পুরের পর বস্তারের রাজধানী জগদলপুরের  রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প লাগিয়ে কাঁকের, দন্তেওয়াড়া, নারায়ণপুর, বীজাপুর, জগদলপুরের আদিবাসী যুবকদের মধ্যে থেকে ভর্তি করা। এছাড়া জাঙ্গল ওয়ারফেয়ারের ট্রেনিং কলেজ খুলেছে বস্তার এলাকার কাঁকের এ, রায়পুর-জগদলপুর হাইওয়ের ঠিক মঝখানে। সেখানে প্রশিক্ষণ দিতে এসেছে ভারতীয় স্থলবাহিনীর নাগাল্যান্ড-মিজোরাম  অপারেশনে পোড়খাওয়া ডিভিশন। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে কি করে জঙ্গি হামলা প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণে শত্রুনিকেশ করা যায়।   এমনিধারা কাজের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হয় শত্রুপক্ষের এলাকায় স্কাউটিং করে অ্যাডভান্স ক্যাম্প লাগিয়ে যার লোকেশন মিডিয়ার থেকে সযত্নে গোপন রাখা হয়। তবে সেনাধ্যক্ষরা বারবার বলছেন যে আর্মি শুধু লজিস্টিক সাপোর্ট ও ট্রেনিং দিতেই এসেছে, ডায়রেক্ট অপারেশনে কখনোই অংশ নেবে না। কিন্তু যদি মাওবাদীরা খোদ আর্মির ইউনিটের ওপরই হামলা চালায়? তাহলে অন্য কথা। কারণ, আত্মরক্ষার অধিকার সবারই আছে, আইনও তাই বলে। এছাড়া ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরের ১৪ কিমি দূরের মানা এয়ারপোর্ট অদূর ভবিষ্যতে শুধু সিভিলিয়ান উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে। মিলিটারির জন্যে আলাদা এয়ারপোর্ট তৈরি হবে ন্যাশনাল হাইওয়ে ২০০ এবং বস্তার জেলার কোন্ডাগাঁও ও ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের কাছে নন্দিনীতে। এ নিয়ে রাজ্যসরকারের  পক্ষ থেকে জমি নির্বাচন ও মিলিটারিকে হস্তান্তরণের কাজকর্ম অনেকটা এগিয়ে গেছে।

    এবার প্রচার ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের বিচারে রণনীতিগত অ্যাডভান্টেজ কার কেমন দেখা যাক।

    সিডিশনের চার্জে আজীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত শিশুচিকিৎসক ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ডঃ বিনায়ক সেনের সুপ্রীম কোর্ট থেকে সহজে জামানত পাওয়া,ওনার দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে পুরস্কার পাওয়া, ছত্তিশগড় সরকার ও অন্যান্য মাওবাদ দমনে হার্ডলাইনের প্রবক্তাদের বেশ  অসুবিধায় ফেলেছে সন্দেহ নেই। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ভারত সরকার শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারক উপদেষ্টাদের কমিটিতে ডঃ বিনায়ককে মনোনীত সদস্য করেছে। আর বিনায়ক সেনের সঙ্গে মাওবাদী পলিটব্যুরোর তথাকথিত দূতের কাজ করার অভিযোগে আজীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত পীযুষ গুহও জামিন পেয়ে কোলকাতায় ফিরে গেছেন। এদিকে সিপিআই(মাওবাদী)দের পলিট ব্যুরো সদস্য নারায়ণ সান্যাল, যাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আজীবন কারাবাসের শাস্তি পেয়ে ছত্তিশগড়ের জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাঁর  বিরুদ্ধে  কোন্টা জনপদের অধ্যক্ষ হুঁগারাম মরকাম হত্যা মামলায় ছত্তিশগড় পুলিশের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ১২০ বি ধারায় আনা ক্রিমিনাল কনস্পিরেসির চার্জ দন্তেওয়াড়ার অতিরিক্ত সেশন জজ খারিজ করে দিয়েছেন। দু'মাস আগে সরগুজা জেলায়, যেখানে অন্ধ্র প্রদেশের গ্রে-হাউন্ডের অপারেশনের কায়দায় মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বলে  প্রশাসন বলে আসছে, একটি  গাঁয়ে  একটি কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে গাঁয়ের লোকজন রাস্তায় নামে।  পুলিশের কথা অনুযায়ী মাওবাদীদের সাহায্যকারী মেয়েটি এনকাউন্টারের সময় মারা যায়। কিন্তু জনতার কথা অনুযায়ী এসব বাজে কথা, কাছের ক্যাম্পের সেপাইয়েরা মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মেরেছে। সরকারি তদন্তে গ্রামবাসীদের বক্তব্যটিই বাস্তব ঘটনার কাছাকাছি প্রতীত হয়। ফলে এতবছর ধরে  মাওবাদী দমনের পুরোধা রাজ্যপুলিশের ডায়রেক্টর জেনারেল বিশ্বরনজনকে সরিয়ে হোমগার্ডের বড়কর্তা করে দেয়া হয়।

    এছাড়া অখিল ভারতীয় আদিবাসী মহাসভার তিনদিনের সম্মেলনের পর রায়পুর ঘোষণাপত্রে অপারেশন গ্রীনহান্ট বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। ওই সম্মেলনে সিপিআই এর অখিল ভারতীয় জেনারেল সেক্রেটারি এ বি বর্ধন, লোকসভার প্রাক্তন স্পীকার পি এ সাংগমা ও বস্তারের প্রাক্তন বিধায়ক মনীশ কুঞ্জাম মাওবাদী দমনের নামে বস্তারে সিপিআই কর্মীদের ওপর পুলিশি দমনের নিন্দা করেন। এঁরা সংবিধানের ষষ্ঠ অনুসূচীর অন্তর্গত  ৫০ প্রতিশতের বেশি আদিবাসী বহুল ক্ষেত্রে  স্বায়ত্তশাসনের দাবিও তুলেছেন। মাওবাদীদের দক্ষিণ বস্তার জোনাল কমিটিও বেশ কয় বছর আগে থেকেই  ছত্তিশগড় থেকে আলাদা স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত বস্তারের দাবি নিয়ে প্রচার করছে।

    কিন্তু এর ফলে মাওবাদীদের বিশেষ রণনীতিগত সুবিধে হবে মনে হয় না।

    মাওবাদীদের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনা এবং ব্যাপক প্রচার অভিযান চালানোর জন্যে নিয়মিত অর্থসরবারেহের একটি প্রধান উৎস হল ঝাড়খন্ড-মেদিনীপুর সীমান্ত এলাকা থেকে বস্তারের বিস্তীর্ণ এলাকায় খনিজ সম্পদ এর খনন ও পরিবহনের কাজে যে সব কোম্পানী ও কন্ট্যাক্টর কাজ করছে তাদের থেকে ট্যাক্সো আদায় করা। বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল যে এর বিনিময়ে মাওবাদীরা এইসব কোম্পানীগুলোকে ওদের ট্রান্‌স্‌পোর্টের সেফ প্যাসেজ ও বাধাহীন ব্যবসায় চালিয়ে দেবার গ্যারান্টি দেয়। তাই মাওবাদীদের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পুলিশের গুপ্তচর অভিযোগে গাঁয়ের আদিবাসীর গলা কাটা হয়, কিন্তু মাইনিং এর সঙ্গে যুক্ত কারো ওপর কোন আক্রমণ হয় না। ছোট স্কেলে করলে যাকে আমরা তোলাবাজি বলি, সেটাই বড় মাপে করলে হয় ট্যাক্সো, সেই ডাকাত আর আলেকজেন্ডারের গল্প আজো প্রাসংগিক।

    বস্তারের কিরন্দুল এলাকায় এস্‌সার স্টীল ইন্ডিয়ার ব্যাপারে বাজারে খবর ছিল, কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ৯ সেপ্টেমবরে দন্তেওয়াড়ার পালনার বাজারে এস্‌সর কোম্পানির ঠিকেদার বি কে লালা মাওবাদীদের প্রতিনিধি লিঙ্গারাম কোড়োপির হাতে ১৫ লক্ষ টাকা তুলে দেবার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। লিঙ্গারামের অন্য সাথী কাছের একটি সরকারি আশ্রমের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মহিলা সোনী সোঢ়ী পালিয়ে যায়। এরপর পুলিশ কিরন্দুলের এস্‌সর এর বেনিফিকেশন প্ল্যান্টের জেনারেল ম্যানেজার মি: বর্মাকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ, ইনি কোম্পানির কর্পোরেট সোশ্যাল লায়াবিলিটি( সি এস আর) প্রোগ্রামের পার্টনার 'জয় জোহার' বলে এনজিও এবং অন্যান্য ঠিকেদারদের মাধ্যমে  মাওবাদীদের নিয়মিত অর্থের যোগান দিয়ে যাচ্ছে।

    মিঃ মনীশ কেডিয়া, কোম্পানির সিনিয়র  ভাইস প্রেসিডেন্ট ( কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স), বল্লেন-- বাজে কথা, এগুলো আমাদের বদনাম করার ষড়যন্ত্র। সাথে সাথে এও বল্লেন যে অধিকাংশ কোম্পানি বস্তার এলাকায় রিস্ক নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, ওদের সিকিউরিটির কোন ব্যবস্থা নেই। তারপর পুলিশ  কোম্পানির জনাকয়েক  হোমরাচোমরাকে ডেকে পাঠাল, তদন্তের জন্যে দরকার। অমনি এসসারের সিইও সমেত আধাডজন অফিসার অসুস্থ হয়ে পড়লেন।  দিল্লি, ভাইজাগ ও চেন্নাইয়ের নামীদামী হাসপাতালের সার্টিফিকেট ও পুলিশকে দেখিয়ে দেয়া হল।

    সোনী সোড়ীর খোঁজে পুলিশ জয়পুরে গিয়ে  পিপল্‌স ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ্‌ এর জেনারেল সেক্রেটারি কবিতা শ্রীবাস্তবের বাড়ি রেইড করল, কিছু পেল না। কবিতা শ্রীবাস্তব প্রেস স্টেটমেন্ট দিয়ে ছত্তিশগড় পুলিশকে একহাত নিলেন।  কিন্তু পরের দিন সোনী সোড়ী দিল্লিতে গ্রেফতার হল। পুলিশ কাস্টডিতে থাকার সময় ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। দন্তেওয়াড়ার কোর্টে তোলার সময় মাথায় ও কোমরে চোট এবং ব্যথার ফলে ও প্রিজন ভ্যান থেকে নামতে না পারায় ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং ভ্যানের সামনে এসে সোনীকে দেখে তৎকাল সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বল্লেন।

    পুলিশের বক্তব্য বাথরুমে পড়ে গিয়ে লেগেছে, সোনী অস্বীকার করে। ব্যথা সত্ত্বেও পায়ে শেকল পরিয়ে রাখার বিরুদ্ধে ও ভুখ হরতাল শুরু করে, শেকল খুলে দেয়া হয়। ওর অবস্থা দেখে প্রথমে দন্তেওয়াড়ার মহারানী হাসপাতাল, তারপর জগদলপুর ও রায়পুরের হাসপাতালে রেফার করা হয়। কোন উপকার না হওয়াতে ওকে, সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে, কোলকাতায় চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়েছে। ওকে সরকারি মহিলা আশ্রম থেকে বিনা অনুমতি গত একমাস ধরে ছুটিতে থাকার অপরাধে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ও জোর গলায় মাওবাদীদের টাকা পৌঁছনোর সঙ্গে ওর কোন সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছে।  গত  ১৪ জুন, সোনীদের বড়ে বেরমা গাঁয়ের বাড়িতে মাওবাদীদের একটি দলম ওর বাবা  মুন্দরুরাম সোড়ীকে গুলি করে। পায়ে গুলি লাগা মুন্দরুরাম আজও হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায়। সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, কর্পোরেটের পয়সায় মাওবাদীদের কথিত বিপ্লব প্রচেষ্টার কথা প্রকাশ হওয়ায়  ওদের শোষিত জনগণের কল্কি অবতার গোছের ভাবমূর্তি অনেকটা ম্লান হয়েছে।

    পড়না-লিখনা শিখো, অ্যায় ভুখ সে মরনেওয়ালো

    ন্যাশনাল লিটারেসি মিশনের নতুন প্রোগ্রাম 'সাক্ষর ভারত' শুরু হয়েছিল ২ অক্টোবর, ২০০৯এ, চলবে  ৩১ মার্চ, ২০১২ অব্দি। এর জন্যে ছত্তিশগড়ের বেছে নেয়া ১৪টি জেলার মধ্যে মাওবাদী এলাকার ৪ জেলা, অর্থাৎ জগদলপুর, দন্তেওয়াড়া, নারায়ণপুর ও বীজাপুর আছে। এই চারটে জেলার  ২৫টি ব্লকের ১০৬২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩,৩৪,৯৯২ নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করে তুলতে হবে। মেইনস্ট্রীম শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এই ক্যাম্পেনের লক্ষ্য গ্রামের মহিলা, কিশোর-কিশোরী,বিশেষ করে ১৫বছর বা তার বেশি বয়সের নিরক্ষর মানুষ যার ৮৫% মহিলা। এখানে সাক্ষরতা  আগের মত শুধু অক্ষর পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়, এবারের উদ্দেশ্য বুনিয়াদী সাক্ষরতার পর নব-সাক্ষরদের পরিবেশকে চিনে  পেশাগত দক্ষতার ট্রেনিং পাওয়া, পোস্ট-লিটারেসি স্তরে অ্যাডাল্ট এডুকেশন সেন্টারে খবরের কাগজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার ইত্যাদির মাধ্যমে আজকের দুনিয়ার কোথায় কি হচ্ছে জেনে সচেতন নাগরিক হয়ে সমাজের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এর মধ্যে রয়েছে অনুসূচিত জাতি , জনজাতি, ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটি(মুসলিম আদি)কে এই প্রোগ্রামে প্রাথমিকতা দেয়া, সাক্ষরদের মধ্যে জেন্ডার গ্যাপ কমিয়ে  ১০ প্রতিশত বা তার চেয়ে কম করা। এই ক্যাম্পেনের মধ্যে হেল্‌থ ও হাইজিনের ব্যাপারে চেতনা বাড়ানো, অন্ধবিশ্বাস ও অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, রোজগারমুখী দক্ষতার বিকাশ কি নেই?

    প্রোগ্রামের শুরুতে টার্গেট এরিয়ায় নিরক্ষর জনতার সার্ভে করে সূচী বানানো, তাদের লোক-শিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনমাসে অন্ততঃ ৩০০ ঘন্টা পড়ানো , তারপর তাদের মধ্যে চিঠি লেখা, ছোট-ছোট হিসেব, গুণ-ভাগ করতে শেখানো। ক্লাস কখন হবে, কোথায় হবে তা ছাত্রদের সুবিধের হিসেবে ঠিক করতে হবে। এতে  পঞ্চায়েতের বিশেষ ভূমিকা থাকবে। অ্যাকাডেমিক ও টেকনিক্যাল সাহায্যের জন্যে স্টেট রিসোর্স সেন্টারের অধীনে   স্থানীয় ভাষায় প্রাইমার তৈরি করে তৃণমূল স্তরে ভলান্টিয়ারদের ট্রেনিং দিয়ে রিসোর্স পার্সন বানাতে হবে। আমরা এখন দৌড়ের লাস্ট ল্যাপে আছি। তাই দিল্লী থেকে সরেজমিনে বস্তার জেলায় এই প্রোগ্রামের হাল-হকিকত দেখতে  ডায়রেক্টর জেনারেল জগমোহন সিং রাজুর নেতৃত্বে চারজনের বিশেষজ্ঞ দলটি তিনদিনের ঝটিকা সফরে এসেছে।  

    প্রথমদিনের বেশির ভাগ সময় গেল শিক্ষাবিভাগ এবং রাজ্য এবং জেলাস্তরের লোকশিক্ষা সমিতির প্রতিনিধি, সরকারি আমলাদের সঙ্গে বৈঠকে। বিকেলের শেষে রওয়ানা হল দশটি গাড়ির কাফিলা, তার মধ্যে দুটো বোলেরোতে স্টেট রিসোর্স সেন্টারের আমরা আটজন, গাড়ির মধ্যে বস্তাবন্দী কিছু প্রাইমার, পোস্টার ইত্যাদি। রায়পুর থেকে জগদলপুর , তিনশ' কিলোমিটার লম্বা ন্যাশনাল হাইওয়েটি ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে ভাল রাস্তা। ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে আমরা ধমতরি ছাড়িয়ে বস্তার জেলার চারামা পৌঁছে গেলাম। এখানেও একটি দলম সক্রিয়, বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু   এখন আলো-ঝলমল চারামা বাজারে লোকজনের কেনাকাটার ভীড়; নবরাত্রি পর্ব চলছে,আজ পঞ্চমী।  

    কিন্তু চারামা টাউনশিপ পেরোতেই ঝটকা লাগল। রাস্তায় ব্যারিকেড করে আর্মড্‌ পুলিশের জনাদশেক। আটকা পড়েছে আমাদের কনভয়। তল্লাশি, আই-কার্ড সব দেখানো হচ্ছে। ডায়রেকটর জেনারেলের গাড়ি এবং পরের দুটো বেরিয়ে গেল। আমাদের একজন অফিসার দাঁত খিঁচোতে লাগলেন। অনেক কষ্টে বোঝাতে পারলাম যে আমরা দিল্লি থেকে পরিদর্শনে আসা দলটির কনভয়েরই অংশ। ভাগ্যিস্‌ সামনের উইন্ডশিল্ডে সাক্ষরতা প্রচারের পোস্টার সাঁটা ছিল। কিছুদুর গিয়ে বুঝলাম কনভয়ের থেকে প্রায় তিনশ মিটার আগে আগে চলছে ছত্তিশগড় আর্মড্‌  ফোর্সের জওয়ানদের দুটো গাড়ি, তাতে জনাদশেক জওয়ানের হাতে ইন্‌শাস রাইফেল, কম্যান্ডারের হাতে কালাশনিকভ গোছের কিছু। এবার কাঁকের এর সার্কিট হাউসে চা-পান। ডিজি ভদ্রলোক নবরাত্রির উপোস করেছেন, ডাবের জল খাবেন। তারপর দশ কিলোমিটার আগে হাইওয়ের ওপরই একটি গাঁয়ের কমিউনিটি হলে অ্যাডাল্ট এডুকেশন সেন্টারের উদ্বোধন। যথারীতি আবীর-চাল-চন্দন ইত্যাদি দিয়ে প্রধান অতিথিদের তিলক লাগানো, স্থানীয় হল্বী ভাষায় গান, বাচ্চাদের হাতে ফুলের স্তবক সবই হল।  ডায়রেক্টর জেনারেল সর্দারজি ধৈর্য্য ধরে স্থানীয় অ্যানিমেটরদের সঙ্গে কথা বলে ওদের ওরিয়েন্টেশন লেভেল মাপলেন। প্রাইমার পৌঁছিয়েছে সেন্টারটিতে। রাস্তার দুপাশে পজিশন নিয়ে সি এ এফ এর জওয়ানের দল। এরপর পাহাড়ের ওপর কেশকাল ঘাটি পৌঁছোতেই গাড়ির গতি শ্লথ হল। মুসৌরির মত একদিকে খাদ, অন্যদিকে পাহাড়। কারো মুখে কথা নেই। দুপাশের উঁচু টিলার থেকে অন্ধকারে অ্যামবুশ কি সোজা! কেশকাল দলম এরও নাম হয়েছে। মাওবাদীরা  শিক্ষা প্রসারের বিরোধী নয়, আমাদের কিছু করবে না! আরে অক্ষর-পরিচয় না থাকলে মাওয়ের রেডবুক কে পড়বে? এইসব কেঠো রসিকতায় একে অন্যের ভরসা জোগাচ্ছে আর কি। সমতলে নামার পর আবার সেই  প্রশস্ত মসৃণ হাইওয়ে, কারো গালের মত কি?  তাই গাড়ি ছুটছে নব্বই-একশ কিলোমিটার স্পীডে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুপাশে ঘন জঙ্গল, কদাচিৎ ক্ষেত, তবে জনপদের দেখা নেই। সাধারণতঃ জগদলপুর-রায়পুরের মধ্যে হাইওয়েতে মাইনস্‌, বুবি ট্র্যাপের ঘটনা আজ অব্দি ঘটে নি, সেটাই ভরসা। হটাৎ আলোঝলমল কোন্ডাগাঁও, এখানে একসময় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কিছু বাঙালী উদ্বাস্তুদের বছর পঞ্চাশ আগে বসানো হয়েছিল। রাস্তার মাঝে মাঝে তোরণ দ্বার। না, আমাদের জন্যে নয়, নবরাত্রির পর্বে যাঁরা সাতদিন ধরে পায়ে হেঁটে জগদলপুরের মন্দির বা দন্তেওয়াড়ার দন্তেশ্বরীর  মন্দিরে দর্শন করতে আসছে সেই তীর্থযাত্রীদের জন্যে নি:শুল্ক বিশ্রাম, অন্ন-জল-শয্যার ব্যবস্থা। শেষ হবে বিজয়াদশমীর সন্ধ্যেয়। রাত সাড়ে এগারটায় জগদলপুর সার্কিট হাউসে পৌঁছে খাওয়াদাওয়া সেরে বড়কত্তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা আমাদের নির্দিষ্ট হোটেলে ফিরে গেলাম। হোটেলের কাছেই একটি পার্কে শিল্পমেলা। আমার ছোটবেলায় পার্কসার্কাসের দূর্গাপূজোর সময় ময়দানের একজিবিশনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এত রাতেও লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় হোটেল, দোকানপাট চৌরাস্তার মোড়ে আদিবাসী ছেলেমেয়ের কালোপাথরে কোঁদা স্ট্যাচু। কে বলবে আমরা রণক্ষেত্রে আছি! কাল সকালে খুঁটিয়ে দেখব ভেবে নিয়ে ঘুমোতে যাই।

    সকাল ন'টা নাগাদ কনভয় আবার রওনা হল, লক্ষ্য দন্তেওয়াড়া। আমার ভেতরে ছটফটানি। জগদলপুর থেকে একটি রাস্তা গেছে দক্ষিণ পশ্‌চিমে মহারাষ্ট্র সীমান্তে গড়চিরৌলির দিকে। মহারাষ্ট্র রাজ্যে ওটাই নকশালপন্থীদের গড়। আবার পশ্‌চিমে আর একটা রাস্তা গেছে বীজাপুর-কোন্টার দিকে । ওটা অন্ধ্র প্রদেশের বেজওয়াড়ার দিকে গেছে। আমরা নব্বই ডিগ্রি ঘুরে চল্লাম দক্ষিণ বস্তারে গীদম হয়ে দন্তেওয়াড়ায়। রায়পুর থেকে বস্তারের রাজধানী জগদলপুর হল তিনশ' কিলোমিটার। আর জগদলপুর থেকে গীদম সত্তর, দন্তেওয়াড়া আরও দশ। কাঁকের-চারামা-কেশকাল-কোন্ডাগাঁও- জগদলপুর হল উত্তর বস্তার, আর গীদম-দন্তেওয়াড়া হল দক্ষিণ বস্তার। ওদের মাঝখানে বিভাজিকা হল ইন্দ্রাবতী নদী আর তার দুই উপনদী শঙ্খিনী-ডঙ্কিনী। দন্তেওয়াড়া এলাকা থেকে হাইওয়েও  নিরাপদ নয়, দিনের বেলায়ও ঘটনা ঘটে  আজকাল। আর নদীদুটির ওপারে বিশাল পাহাড় ও বনাঞ্চলে অবুঝমাড় এলাকাতেই ডেরা বেঁধেছেন আজকের মাওবাদীদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। ওখানে আছেন মূপাল্লা লক্ষণ রাও গণপতি, কিষণজীরা, সপরিবারে। একদশক আগে পড়শি রাজ্যের থেকে গ্রে-হাউন্ডের তাড়া খেয়ে এখানে ঘাঁটি গেড়ে আবার শক্তিবিস্তার করেছেন। একেবারে মাও জে দং এর ইয়েনানের গুহার পুরাণকথার পুনরাভিনয় যেন! কিন্তু সময়ের চাকা পেছনে ঘোরানো যায় না। ষাট বছর আগের চিন আর আজকের ভারত কোথাও মেলে না।

    গাড়ির জানলা দিয়ে চোখে পড়ছিল 'কচি ধানগাছে ক্ষেত ভরে আছে, হাওয়া দোলা দেয় তারে'। হঠাৎ চেঁচামেচি, গাড়িগুলো থেমে গেছে। কী হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। ডিজির টাটা-সফারি অনেকটা আগে ছিল, প্রায় তিনশ' মিটার দূরে রাস্তার পাশে একটি খেজুর গাছের পাশে কেমন কেৎরে দাঁড় করানো। কি হয়েছে? সাঁ করে সাইরেন বাজিয়ে সিকিউরিটির একটা গাড়ি আমাদের পাশে থামল। ক'জন জোয়ান লাফিয়ে নামল।  খানিকক্ষণ পরে সব স্বাভাবিক। ডিজিকে দেখতে পেলাম রাস্তার ধারে মোবাইলে  কার সঙ্গে কথা বলছেন।

    আবার কনভয় চলতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা হল ডিজি প্রাকৃতিক তাড়নায়  গাড়ি থামিয়ে আলপথে নেমে গিয়ে ছিলেন। সেখানে ধানের ক্ষেতে হাওয়ার দোলা দেখে কাব্যি জেগে ওঠায় মোবাইলে ছবি তুলতে থাকেন। তারপর ফোনে দিল্লিতে বাড়িতে এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের বর্ণনায় বিভোর হয়ে যান। কিন্তু এসব থেকে বেখবর সি এ পি'র দুটো গাড়ি সাঁ সাঁ করে প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে টের পেল যে পেছনে কেউ আসছে না। ওদের প্রায় নাড়ি ছেড়ে যাবার মত অবস্থা। এদিকে কাল রাত থেকেই সব সরকারি গাড়ির লাল-হলুদ বাতিগুলো নামিয়ে নেয়া হয়েছিল। ওগুলো আজকের বস্তারে ষাঁড়কে লাল কাপড় দেখানোর সমান। এখন আরো বলা হল বিনা সূচনা হুটহাট না নামতে, অন্ততঃ সিকিউরিটির গাড়ি থামার পর নামতে।

    খানিকক্ষণ পরে পৌঁছে গেলাম গীদম, একটি ব্লক হেড্‌কোয়ার্টার। গাড়ি থেকে দেখতে পাচ্ছি দোকানপাট, স্টেট ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারি অফিস, সিভিল লাইনস্‌। এবার বাজার,  লোকজনের ভীড়, পূজো-পূজো ভাব, আজ মহাষষ্ঠী। পথ আটকেছে বস্তারের লোকনর্তক দল। লাল জামা, গলায় কড়ির মালা, মাথায় বাইসনের  নকল শিং লাগানো মুকুট। হাতে  মাদল। দশটি মাদল একসাথে বাজছে --ধিতাং তাং, ধিতাং তাং, ধিতাং ধিতাং ধিতাং তাং। এইসব কলাজাত্থা ( আমাদের ছোটবেলায় গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক জাঠা?) নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে লিটারেসি ক্যাম্পেন হ্‌চ্ছে, বা আজ দিল্লি থেকে আসা বড়কত্তাকে সাক্ষরতার ভারপ্রাপ্ত সরকারি আমলা  ও কিছু এনজিও মিলে  স্বাগতম্‌- সুস্বাগতম্‌ করছে।

    ভীড় থেকে আলাদা হয়ে খুঁজে বেড়াই সব্জিগলিটা কোথায়, জিগ্যেস করে পৌঁছে যাই তেমাথার একটি অপেক্ষাকৃত সরু গলি। কেনাবেচা চলছে - শাকসব্জি, তরিতরকারি। বছর দুই আগে এইখানেই, হয়ত এই ডানদিকের দোকানটার পাশে সকালবেলায় লুঙ্গি পরে বাজার করতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলেন ইনস্পেক্টর মিঃ খান। তিনটে ছেলে কাছে এসে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে সেমি অটোমেটিক থেকে মিনিটখানেক গুলি চালিয়ে বুক-পেট ঝাঁঝরা করে দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাশের গলিতে দাঁড় করানো মোটরবাইকে করে হাওয়ায় মিশে গিয়েছিল। চারদিকের দোকানপাট দুদ্দাড় করে বন্ধ হয়ে যায়। থকথকে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকে খানের নিশ্চল শরীর। ঘন্টাখানেক পরে যখন অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগে পৌঁছে দেয় তখন উপস্থিত ডাক্তার মেডিক্যাল রিপোর্টে লেখেন 'ব্রট ডেড্‌'। প্রয়াত শ্রীখান ছিলেন বিলাসপুর শহরে শান্তিনগর মোহল্লায় আমার পড়শি, গায়ে লাগা বাড়ি। স্ত্রী পেশায় উকিল। নিঃসন্তান দম্পতি,দু'বছর আগে ঈদের দিনে বাটিভরে সেমাইয়ের পায়েস পাঠিয়েছিলেন। যখন বিলাসপুরে  এলেন জানলাম মিঃ খান সাসপেন্ড হয়েছেন। মাঝে মাঝে টেলিফোনে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনতাম। তারপর বহাল হলেন চাকরিতে, পানিশমেন্ট পোস্টিং মাওবাদী বেল্টে, গীদম টাউনে, বছরও ঘোরে নি, তাতেই--। জানতে পারলাম যে উনি গীদম থানায় থানেদার হিসেবে এনকাউন্টারে বেশ কিছু কথিত মাওবাদীকে মেরেছিলেন। ওরা ওনার নাম হিট্‌লিস্টে তুলেছিল। সাবধানে থাকতেন, সাদা পোষাকে বাজারে গিয়েছিলেন। ওনার সার্চ পার্টি যেত দূরের জঙ্গলে, ওরা যে থানার কাছে টাউনের মধ্যে হামলা করবে আন্দাজ করতে পারেন নি।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ | ১৬০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ম্যাক্সিমিন | ***:*** | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:১০89383
  • ভালো লাগছে।
  • aranya | ***:*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৫৮89384
  • সুন্দর লেখা।
  • আবির | ***:*** | ০১ অক্টোবর ২০১২ ০৫:৩৪89385
  • টানটান লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। চোখের সামনে ভেসে ওঠার মত ভৌগোলিক ও সামাজিক বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে, যাই এক্ষুনি ঘুরে আসি গিয়ে।
  • শুদ্ধ | ***:*** | ০৪ অক্টোবর ২০১২ ০৪:৪১89386
  • পড়ে চলেছি রঞ্জনদা। শেষ হবার পরে কিছু কথা বলার ইচ্ছে রইলো। কিছু প্রশ্ন আসছে মনে, কিন্তু এখনো বাকী অংশ না পড়ে তা করতে চাইনে। উত্তর যদি সেখানেই পেয়ে যাই তাহলে আর আপনাকে জ্বালাতে হবে না। :)
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ০৯ অক্টোবর ২০১২ ০৫:২৩89387
  • রঞ্জন, কাল সাক্ষাতে বলেছি, কিন্তু না লিখলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। গত তিন চার দিন ধরে কমেন্ট করতে দিচ্ছিলনা। আজ সম্পাদক মশাই ( সৈকত) বললেন, বেসুরো গলায় হলেও ভাটিয়া৯ গাইতে হবে, তবে ঢুকতে দেবে। তাই ভাট বকে গেটপাস নিয়ে ঢুকলাম। অন্যগুলোও ভাল, তবে এই পর্বটি ভীষণ ভাল হয়েছে। আজ বলতে পেরে শান্তি। জয়গুরু।
  • ranjan roy | ***:*** | ০৯ অক্টোবর ২০১২ ০৫:৩৯89388
  • রূপংকরদা,
    লজ্জা দেবেন না। চেষ্টা করি নিজের বোধবুদ্ধি মত কথামালা লিখতে।
    শুদ্ধ,
    শেষ হোক, আমারও তোমার সঙ্গে বলার জন্যে কিছু কথা জমে আছে। পিঠের ব্যথা কেমন?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন