এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • হারানো হাঁস, ম্লান মুর্গী

    সামরান হুদা লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৫ ডিসেম্বর ২০০৯ | ১৩২০ বার পঠিত
  •                        হাঁস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া।

                           ভাল কইরা রাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।।

                                                                                   - মহুয়া, মৈমনসিংহ গীতিকা

    শীতকালটা সিলেটে বেশ লম্বা। অক্টোবরের প্রথম থেকে শুরু হয়ে টানা চলে একেবারে সেই মার্চ পর্যন্ত। সিলেটের আশে পাশে তামাবিল, জৈন্তা, জাফলংএ প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। আসে হয়তো শীতের সবগুলো দেশ থেকেই কিন্তু আমরা জানি সবই আসে সাইবেরিয়া থেকে। ছোট বড় নানা রকমের হাঁসই বেশি থাকে। সেগুলোর নাম এখন আর মনে নেই, বা হয়তো আমাদের হাঁস-মুর্গী আর পাখি সাপ্লাইকারী শরবত আলি জানতও না সব পাখির নাম। কালো, লম্বা আর পেটানো স্বাস্থ্যের শরবত আলি, সারা মুখে, গলায় আর হাতগুলোতে সাদা সাদা ছোপ ছোপ দাগ ধরা শরবত আলি সব হাঁসকেই "সাইবেরিয়ান ডাক' বলে চালিয়ে দিত। শরবত আলিকে সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি। কবে প্রথম দেখি, সে আর এখন মনে নেই। নির্দিষ্ট কোন দোকান ছিল না তার, লম্বা বাঁশের দু মাথায় দুটি হাঁস-মুর্গীর খাঁচা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করত সে ওই সাইবেরিয়ান ডাক। বালিহাঁসগুলো ছোটো সাইবেরিয়ান, আর বড়গুলো "আসল এবং অরজিনিয়াল সাইবেরিয়ান ডাক' । বালিহাঁসগুলো দেখিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞেস করতাম, এগুলো এত্ত ছোডো কিয়ের লাই? শরবত আলি তার পান খাওয়া ছোপ ছোপ দাঁত বত্রিশখানি বের করে জবাব দিত, "আফা, ইতানে এখুনো ছোডু আছুইন যে, বড় হইন নাই, হইলে ইতানেই হইয়া যইবাইন ""আসল, অরজিনিয়াল'' সাইবেরিয়ান ডাক।'

    প্রথম প্রথম শরবত আলি আব্বার অফিসে আসত। আব্বা অফিস থেকেই রকমারি হাঁস কিনে পায়ের দিক থেকে ধরে হাঁস ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতেন। পরে শরবত আলি আব্বার সাথে সাথে নিজেও এসে হাজির হত, আব্বার হাত থেকে যদি হাঁস পালিয়ে যায়! যদিও সেই হাঁসের পায়ের সাথে সাথে ডানা দুটিও শরবত আলি সরু সুতলি দিয়ে বেঁধে দিত, তবুও বলা তো যায় না, সাইবেরিয়ান ডাক তো, যে কোনো সময় আব্বার হাত ছাড়িয়ে উড়ে পালিয়ে যেতেই পারে! আর উড়ে যাওয়া মানে সটান সাইবেরিয়া, আর সে যদি গিয়ে সব খবর দিয়ে দেয় তাহলে সামনের বছর শরবত আলির ব্যবসাও বন্ধ আর আমাদের বিলাতি হাঁস খাওয়ারও ইতি। তো শরবত আলি সন্ধেবেলায় দু-দুটি ঝাঁকা সহ হাজির হত আব্বার সাথে। আর সেই হাঁসও সে নিজেই কেটে দিয়ে যেত, বলা তো যায় না, আব্বা বা অন্য কেউ সেই হাঁস জবাই করতে গেলে সেই সময়ে যদি হাঁস পালিয়ে যায়! আমরা ভাই বোনেরা, পর্দার ওপাশ থেকে আম্মা, দাদি আর পাড়ারও সব ছেলে মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিভে একরাশ জল নিয়ে দেখতাম আসল, অরজিনিয়াল সাইবেরিয়ান ডাকের জবাই হওয়া। গোটা কয়েক হাঁস পরপর সাফ করে ফেলে দিয়ে শরবত আলি আর তারপর হাঁসের দামের ডবল টাকা আসল নিয়ে,অরজিনিয়াল সাইবেরিয়ান ডাকের জন্যে, টাকা ট্যাঁকে গুঁজে দিন কতকের জন্য হাওয়া হত। বলে যেত, সে এখন আবার যাচ্ছে তামাবিল সুনামগঞ্জের হাওর থেকে হাঁস ধরে আনতে, ধরেই আবার নিয়ে আসবে।

    পর্দার ওপাশ থেকে মাঝে মধ্যেই আম্মা বলত, ওগুলো সব দেশী হাঁস, শরবত আলি ধান্দা করে সেগুলোকে সাইবেরিয়ান বলে চালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথেই শরবত আলি চার আঙুল জিভ কেটে কসম খেতে শুরু করত, আল্লাহ'র কসম, রসুলের কসম, বাবা "শাজলালের' (শাহজালাল) কসম আর আরও একশো ছত্তিরিশ জনের কসম খেয়ে শরবত আলি বলত, আম্মা, আমি মিছা কথা কই হাঁস বেচি গেলে আমার পুলা-পুরি ( ছেলে-মেয়ে) সব মরি যাইব! আম্মা সাথে সাথেই বলত, থাক থাক শরবত আলি, অত কসম খাইও না, অত মিছা কথা আল্লায় না সইলে পুলা পুরি না মরুক তুমি ঠিক মরি যাইবা।

    আমাদের ছোটবেলায় শরবত আলির ভূমিকা ছিল সেলিম আলির চাইতে কিছু বেশি। সে পাখির ছবি দেখানোর চেয়ে আসল জিনিস নিয়ে হাজির হত। বালিহাঁস দেখলেই চেনা যায়। হালকা বাদামি আর সাদায় চিত্রিত শরীর, পেটের দিকটা সাদা আর কালচে ছড়ানো পা । সেগুলো শরবত আলির কাছ থেকে কিনতে কোন আপত্তি বাড়ির কারোরই হত না কিন্তু একটু বড় যে অরজিনিয়াল সাইবেরিয়ান ডাকগুলি সে নিয়ে আসত সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ হাঁসই হত দেশী। আম্মা অবশ্য হাঁসের পা দেখেই বলে দিত, কোনটা উড়ে আসা পাখি আর কোনটা মাটিতে চরে বেড়ানো হাঁস। চরে বেড়ানো হাঁসেদের পা হলুদ হয়, উজ্জ্বল হলুদ আর পাখিদের পা হয় কালচে। যদিও শরবত আলি আম্মার এই মতবাদকে সবসময়েই উড়িয়ে দিত এক ফুৎকারে। সে বলত, "এই দেশে আসি পাখিরা তো পানিতই থাকইন, আর পানিত থাকতে থাকতে তাইনেগো পাও হইলদা হই গ্যাসে!' একটু বড় সাইজ দেখে, আর দেখতে ভাল এবং একটু আনকমন রঙের হাঁসগুলোকে ও সাইবেরিয়ান ডাক বলে চালাত। সব সময় সেগুলোকে দেখে বোঝা যেত না সেগুলো দেশী হাঁস নাকি আসল এবং অরজিনিয়াল সাইবেরিয়ান ডাক। কিন্তু ওই হাঁস পরিষ্কার করার সময়ও ধরা পড়ে যেত কোনটা দেশী হাঁস আর কোনটা সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়া আসা পরিযায়ী পাখি। উড়ে আসা পাখিগুলোর পেটের ভেতরকার ময়লা একদম সবুজ। গাঢ় সবুজ রঙের ঘাস-পাতা বেরুতো ওদের পেটের ভেতর থেকে আর ওদের পেটের ভেতরকার খাদ্য জমিয়ে রাখার থলেগুলিও হয় খুব ছোট। দাদি বলত, ওরা বিদেশী, সাহেবদের দেশের পাখি, ওরা কি আমাদের হাঁস-মুর্গীদের মতন খুঁদ-কুড়া খায় নাকি, ওরা হল গিয়ে ভদ্রপাখি!

    এই প্রক্রিয়া চলাকালীন (এই শরবত আলির "অরজিনিয়াল' পারফরমেন্স সহযোগে মাংস কাটাকাটি-বাছাবাছি'র সময়) সেখানে সবাই থাকত মুন্না ছাড়া। মুন্না হাঁস-মুর্গী মেরে ফেলতে চাইত না, সে সেগুলো পুষবে। কিন্তু এই হাঁসগুলো তো জবাই করা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই, শীত শেষ হলেই উড়ে যাবে যে! অগত্যা সেগুলো কাটাকাটি-বাছাবাছি'র সময় আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কান্নাকাটি খুব একটা করত না কিন্তু সেই জায়গায় থাকতোও না। আম্মার একটা ছোট্ট হাঁস-মুর্গীর খামার আছে বাড়ির পিছনদিকে। ছোট্ট দু'টি কাঠের ঘর, তার মাথায় দু'চালা টিনের চাল। ছোট্ট সেই ঘরে কাঠের দরজা। একটিতে থাকে হাঁসেরা অন্যটিতে মোরগ-মুর্গীরা। বাড়ির পিছনদিকের দেওয়ালের ওপাশে দু-তিনটি ডোবার মতন পুকুর আছে কচুরিপানায় ভর্তি, সকালে আম্মা হাঁস-মুর্গীর ঘরের দরজা খোলার সাথে সাথে পেছনদিককার দেওয়ালের ছোট গেটও খুলে দেয়, হাঁসেরা থপথপিয়ে গেট পেরিয়ে চলে যায় পুকুরে। সারাদিন ওখানেই থাকে শুধু যখন পুকুরের পানা আর শামুক খেয়ে বিরক্ত হয়ে যায় তখন আবার থপথপিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে কোয়্যাক কোয়্যাক করে পাড়া মাতিয়ে। বারান্দার নিচেই রাখা থাকে ওদের খাবার, পুরনো একটা হাঁড়িতে ধানের মিহি তুষ ভাতের ঘন মাড় দিয়ে মাখিয়ে রাখা, যাতে আম্মা আবার দিয়ে দেয় দু মুঠো চালও। ভরপেট খেয়ে দেয়ে তারা আবার ধীর পায়ে চলে জলের দিকে।

    ঐ ঘরদুটিতে আমি জন্মের পর থেকেই আসছি, এখন সেই ঘরের মালিক চার বছরের ছোট্ট মুন্না। সে এমনকি হাঁস-মুর্গীর খাবারও মাখিয়ে দেয়। হাঁসেদের খাবার আলাদা, মুর্গীর খাবার আলাদা। মুর্গীদের ঘরে "রাতা' ( ঝুঁটিওয়ালা বড় মোরগ) খুব বেশি রাখে না আম্মা। গোটা দশ-বারো মুর্গীর জন্যে একটা বড় রাতা হলেই নাকি চলে। ডিম ফুটিয়ে যে ছানাগুলো বেরোয়, তারা খানিক বড় হলে বেছে বেছে মোরগগুলিকে জবাই করে দিত আম্মা। ওরা নাকি বড্ড হাঙ্গামা করে, পাড়ায় অন্য মুর্গীদের পেছনে বেরিয়ে চলে যায়, আর বাড়ি ফেরার নাম করে না। সন্ধেবেলায় তাদের খুঁজে আনাটা প্রায় নিত্য ঘটনা আর একটা হুলুস্থুলু ব্যাপারও বটে। হাঁসেরা সেই তুলনায় অনেক ভাল, ওদেরকে যদি কেউ ধরে না নিয়ে যায় তাহলে ওরা ঠিক সন্ধে-সন্ধেয়ই বাড়ি ফিরে আসে, থপ থপিয়ে, কোয়্যাক কোয়্যাক করতে করতে। ছোট্ট মুন্না যখন তখন হাঁস মুর্গীদের ধরে ধরে কলতলায় গোসল করায়, ওদের সর্দি হবে, নাক দিয়ে পানি পড়বে, সে সব কথায় একদম কান না দিয়ে ও ওদেরকে গোসল করায়। নেহাত সাবানের তাক অব্দি ওর ছোট্ট হাত দুটি পৌঁছায় না তাই সাবানটা মাখাতে পারে না।

    আমাদের সৌভাগ্য যে শরবত আলির হাঁস খামারে ঢোকানোর চাইতে বাকি সকলেই প্লেটে দেখতেই বেশি ভালবাসত। তাই শরবত আলি বিদায় নেওয়ার পরও হুলুস্থুলুর কমতি পড়ত না। আমরা সব জিভে জল নিয়ে তখনো সার সার দাঁড়িয়ে। আর সন্ধেবেলায় বারান্দায় সেই হাঁস পরিস্কার করতে বসত আম্মা, মোড়ায় বসে থাকত দাদি, হাঁস ছাড়ানোর ডিরেকশন দিতে, আর আমরা ছোটরাও সেই জায়গা ছেড়ে নড়তাম না। হাঁসের পেটের দিকটা আগেই খানিকটা কেটে নিয়ে তার পেটের সব নাড়ি-ভুড়ি আর ময়লা বের করে নিতে বলত দাদি আর তারপর পাশে রাখা গামলায় ফুটন্ত গরম জলে সেই হাঁস ডুবিয়ে সাথে সাথেই তুলে নিত আম্মা। পেটের ময়লা সুদ্ধু গরম জলে ডোবালে হাঁসের মাংস "মাকরুহ' হয়ে যাবে আর কে না জানে, মাকরুহ হল হারামের অর্ধেক ষ্টেজ। ক্ষেতের কালোজিরে চালের পোলাও আর ভুনা সাইবেরিয়ান ডাকের মাংস। আহা

    ...
    কতকাল যে চোখেও দেখি না

    ...

    আব্বা যে শুধু খেতে ভালোবাসে তা নয়, খাওয়াতেও ভীষণ ভালোবাসে। এদিকে শরবত আলি হাঁস দিয়ে যায় ওদিকে একের পর ফোন চলে যায় আব্বার বন্ধুদের কাছে। সাতটা না বাজতে বাজতে এক এক জনা হাজির, হাজির দশ বারোজন মানুষ। কেউ আসেন সস্ত্রীক কেউ বা একা। কোথাও কিস্‌সু নেই হয়ে গেল একটা দাওয়াৎ। এরকম দাওয়াৎ মাঝে মধ্যেই হত, হয় আমাদের বাড়িতে। কম করে হলেও মাসে দু-তিনবার তো হয়ই।

    শরবত আলি যে শুধু সাইবেরিয়ান ডাক দিয়ে যেত তা নয়, সে দেশি হাঁস-মুর্গীও দিয়ে যেত। তার ঐ হাঁস, মুর্গী বিক্রি করাটা একটা দর্শনীয় ব্যাপার বটে। বারান্দায় বসে সে যখন তার খাঁচার পাখি বিক্রি করে তখন মাঝে মধ্যেই ভেতরবাড়ি থেকে বাইরের দিকে এসে পড়ে আম্মার পোষা মুর্গীরা। কোনটা আবার সাথে ডজনখানেক ছানা নিয়ে গর্‌র্‌ গর্‌ করতে করতে ঘুরে বেড়ায় রাগী ভঙ্গীতে। কাজেই শরবত আলির জানা হয়ে যায় যে এই বাড়িতে মুর্গী পোষা হয়। কখনো সে একটা বেশ রূপসী দেখতে মুর্গী খাঁচা থেকে বের করে আমাকে বলে, "আম্মা, মুর্গীডা ন্যান, নুয়ারি মুর্গী, একবারও ডিম পাড়ে নাই, কালি-পরশুর থনে আণ্ডা দেওন শুরু করব, আমার ঘরত তন আনছি আপনের লাই।' অন্য কেউ মুর্গীর দিকে হাত বাড়ালে সে কিছুতেই তার হাতে মুর্গী দেবে না, মুর্গীর পেটের ভেতরকার আণ্ডা ভেঙে যাবে বলে। আণ্ডা নাকি একদম পেটের বাইরের দিকেই আছে, হাত দিলেই আণ্ডার এমনকি সাইজও বোঝা যাচ্ছে আর সেই আণ্ডা সে আম্মাকে দেখিয়েও দেয়। আম্মার ঘোরতর সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও মুর্গীটি নেয়, তার চেহারা রং আর রূপ দেখে। কয়েকদিন মুর্গীকে একটু আটকে আটকে রাখে, যাতে বাইরে কোথাও গিয়ে হারিয়ে না যায়। মুর্গী বাড়ি চিনে যায় দু-চার দিনেই। সারাদিন যেখানেই থাকুক সে ঠিক সন্ধেবেলায় ছোট্ট ওই কাঠের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে হাজির হয়। মজার ব্যপার এই যে, মুর্গী ডিম আর পাড়ে না কিছুতেই! কালকেই ডিম পাড়বে বলে যে মুর্গী শরবত আলি দিয়ে গেছে সে মুর্গীর ডিম দেওয়া শেষ হওয়ার পরেই শরবত আলি সেই মুর্গী দিয়ে যায় কিংবা মুর্গীটি সবে বড় হয়েছে কিন্তু এখনও ডিম দিতে আরো মাস কয়েক লাগবে এমন মুর্গীই দিয়ে যায় আমাদের শরবত আলি।

    মাঝে মধ্যেই সে অবশ্য একেবারে বুড়ো মুর্গী গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের পা দেখে আম্মা চিনে ফেলে যে মুর্গীটি বুড়ো। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর শরবত আলি আর বুড়ো মুর্গী দেওয়ার চেষ্টা অন্তত করে না! একবার সে নিয়ে এলো চীনা হাঁস। সে হাঁস নাকি সাংহাই থেকে এসেছে। সাংহাই থেকে কী করে এলো জানতে চাইলে সে বলে, "ক্যামনে আবার, উড়ি উড়ি! পাঙ্খা দেখছইন নি হাঁসের? কি বড় বড় পাঙ্খা!' সাধারণ পোষা হাঁসের প্রায় দ্বিগুণ আকারের অসম্ভব সুন্দর সেই হাঁস দেখে যে কেউ মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে যাবে সেই হাঁসের। নানা রঙে চিত্রিত তার গোটা শরীর, কী রং নেই সেখানে! পেটের দিকটা একদম সাদা, যত রং তার ডানায় আর পিঠে। ময়ূরের উজ্জ্বল নীল রং থেকে নিয়ে সবুজ, কালো, হলুদ, লাল। সে এক রঙের মেলা। সবচেয়ে বেশি সুন্দর তার ঝুঁটি। ঠোঁটের উপর থেকে নিয়ে মাথার বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে টকটকে লাল ঝুঁটি কিন্তু সেই ঝুঁটি মোরগদের মত নয়। যেন বেশ অনেকখানি টকটকে লাল চামড়া এক জায়গায় লম্বা করে জড়ো করা আর সে একদমই এলোমেলো ভাবে। এত লাল যে মনে হয় টোকা দিলেই রক্ত ঝরে পড়বে।

    সেদিন রবিবার ছিল আর আব্বাও বাড়িতেই ছিল। তখনও সেখানে রবিবারই ছুটির দিন ছিল। শরবত আলি যেন শুনতে না পায় সেভাবে আব্বা আস্তে করে বলে, এগুলো কোথাকার হাঁস তা জানি না তবে এই হাঁসের চাষ হয় সরকারি ফার্মে। ব্যাটা কোনভাবে সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসেছে! সেই হাঁসের ডানা বাঁধা, শরবত আলির ভাষায় "পাঙ্খা'। আম্মা জানতে চায় এই হাঁস পোষা যাবে? কান মাথা চুলকে শরবত আলি বলে, "পাইলতে পাইরবেন তয় পাঙ্খা জানি খুলি দিয়েন না, উড়ি যাইব! পাঙ্খা সব সম বান্ধি রাইখবেন!' আম্মা বুঝে যায়, এ হাঁস উড়বে না, তাইলে শরবত আলি এগুলোকে জবাই করেই দিয়ে যেত। গোটা ছয় হাঁস ছিলো খাঁচায়, সব কটাই আম্মা রেখে দেয়। কয়েকদিন ডানা দুটি সত্যিই বেঁধে রাখে আম্মা তারপর একদিন একটা হাঁসকে খানিক ছেড়ে দিয়ে পরীক্ষা করা হল, সে কতটা উড়তে পারে বা আদৌ পারে কিনা। সেই হাঁস ওড়ে। তবে খুব বেশিদূর যেতে পারে না । সাত আট হাত দূরে গিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে আর উঁচুতে তো একদমই উড়তে পারে না। বড়জোর এক মানুষ সমান উচ্চতা পর্যন্ত ওড়ে সে। আরও কিছুদিন তাদের ওভাবেই রাখা হয়, কখনো ছেড়ে দিয়ে, কখনো বেঁধে রেখে। এক সময় ওরা চিনে যায়, এটাই এখন তাদের বাড়ি। সাংহাই এখান থেকে বহুদূর, অতদূর তারা যেতেই পারবে না উড়ি উড়ি!

    (চলবে)

    ৬ই ডিসেম্বর, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ ডিসেম্বর ২০০৯ | ১৩২০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    অদ-ভূত!.. - Kasturi Das
    আরও পড়ুন
    কবিতা - Aminul Islam
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন