এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • উন্নয়ন ?

    পার্থ সারথি রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ৩০ মে ২০১০ | ৫৫৫ বার পঠিত
  • ১৯৯০-এর দশকে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার নয়াউদারনৈতিক পথ অবলম্বনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশী-বিদেশী পুঁজির লোলুপ নজর যে রাজ্যের উপর সবচেয়ে বেশী পড়ে সেটি হল উড়িষ্যা। এই বিশেষ নজরের পিছনে রয়েছে উড়িষ্যার ভৌগলিক অবস্থান এবং ভূপ্রকৃতি ও আর্থসামাজিক অবস্থা। উড়িষ্যার একদিকে যেমন রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূলরেখা, তেমন অন্যদিকে রয়েছে পাহাড়-জঙ্গলঘেরা অঞ্চলের বিশাল খনিজ সম্পদ, যার মধ্যে রয়েছে আকরিক লোহা, বক্সাইট, ম্যাঙ্গানীজ, ক্রোমিয়াম, নিকেল, কয়লা ইত্যাদি, ও ভারতের সবচেয়ে বিস্তীর্ণ মূল্যবান রত্নের ভাণ্ডার। মহানদী এবং তার বিভিন্ন শাখানদী উড়িষ্যার মধ্যে দিয়ে বয়ে এসে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হচ্ছে, এবং এই বিশাল পরিমাণ জলরাশি যেমন একদিকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযোগী, তেমনই বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এই নদীগুলির মোহনা একাধিক প্রাকৃতিক বন্দর স্থাপনের জন্য আদর্শ জায়গা। এবং উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বাস করেন সাধাসিধে আদিবাসী ও অনাদিবাসী মানুষ, যাঁরা হয় কৃষিজীবি বা মৎস্যজীবি বা জীবিকা নির্বাহের জন্য বনজ সম্পদ আহরণের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী কর্পোরেট সংস্থা এবং তাদের আজ্ঞাবাহী উড়িষ্যা তথা ভারতের শাসকশ্রেণীর কাছে উড়িষ্যা এক সুবর্ণসুযোগ হিসাবে দেখা দেয়, এবং "উন্নয়নের' এবং "দারিদ্র্য দূরীকরণ'-এর নাম করে এই সরল, দরিদ্র মানুষগুলির থেকে তাদের জল, জঙ্গল, জমি কেড়ে নিয়ে, সেখান থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করে বিদেশে রপ্তানী করে বিরাট মুনাফা অর্জনের পথ প্রশস্ত করতে তারা বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়।

    উন্নয়নের নামে উড়িষ্যার আদিবাসীদের এর আগেও নিজেদের বাস্তু, গ্রাম, জীবন জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হতে চেয়েছে, যদিও তখন এই উচ্ছেদ হয়েছে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের নামে। হিরাকুঁদ বাঁধ বা রাউরকেলা ইস্পাত কারখানা স্থাপনের জন্য যে কয়েক লক্ষ আদিবাসী মানুষ তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন, তারা কিন্তু সেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উদ্ভুত বিদ্যুৎ বা সেই শিল্পায়নের কোন সুফল লাভ করতে পারেননি। বরঞ্চ, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁরা আজ নি:স্ব। স্বাধীনোত্তর ভারতে উচ্ছেদের উপর যিনি সবচেয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন, সেই নৃতত্ববিদ ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজের মতে স্বাধীনতার পরবর্তী ৪০ বছরে ভারতে বিভিন্ন ছোট-বড় প্রকল্পের কারণে প্রায় ৬কোটি মানুষ উচ্ছেদ হন, কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র ২কোটি মানুষের জন্য কোনরকমের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ উচ্ছেদ হওয়া মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের প্রতি ভারত রাষ্ট্র কোনরকম দায়বদ্ধতা দেখায়নি, "উজ্জ্বল ভারতের' ঔজ্জ্বল্যের নিচে জমে থাকা অন্ধকারে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। এই অবস্থায় যখন ভারতের শাসকশ্রেণী উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও বিশ্বায়নের নামে নয়া-উদারনীতির মনমোহনী পথ অবলম্বন করল, তখন এই জল, জঙ্গল, জমি লুন্ঠনের ক্ষেত্রে "জাতীয় স্বার্থের' আব্রুও খসে পড়ল, তখন তা হয়ে উঠল মুনাফার জন্য পুঁজির নগ্ন আগ্রাসন। এবং এই আগ্রাসী থাবা প্রথম আঁচড় বসানোর চেষ্টা করল উড়িষ্যার বুকে। নব্বইয়ের দশকের মধ্যে থেকেই উড়িষ্যা হয়ে উঠল দেশী-বিদেশী বৃহৎ পুঁজির মৃগয়াক্ষেত্র। কিন্তু পুঁজিপতিরা, এবং তাদের পথ প্রশস্ত করা উড়িষ্যার কংগ্রেস - বিজেডি প্রভৃতি সকল দলের সরকার, যা আশা করেছিল, ঘটনাবলী তার অনুরূপ হল না। উড়িষ্যার সহজ সরল আদিবাসী-অনাদিবাসী মেহনতী মানুষ তাদের জল, জমি, জঙ্গল, জীবিকা রক্ষার জন্য, তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলল, যেখানেই পুঁজি আর রাষ্ট্রের সম্মীলিত আক্রমণ নেমে এল সেখানেই মানুষের প্রতিরোধ দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়াল। গত একদশক থেকে কাশীপুর থেকে কলিঙ্গনগর, ঢিনকিয়া থেকে নিয়মগিরি এই প্রতিরোধেরই ইতিহাস।

    উড়িষ্যার বিপুল খনিজ সম্পদ ও জমির উপর দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা পোহাং স্টীল কোম্পানির (পস্কো) নজর পড়ে ২০০৪ সালে, যখন থেকে উড়িষ্যায় একটি ১২০ লক্ষ টন ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার বিষয়ে উড়িষ্যা সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তাদের আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু যখন দেখা যায় যে পস্কোর প্রকল্পের মধ্যে ভারত থেকে আকরিক লোহা রপ্তানীর পরিকল্পনা রয়েছে, তখন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের বিরোধীতার কারণে ২০০৫ সালে আলোচনা ভেস্তে যায়। সেই সময় পস্কোর পরিত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম, যিনি এখন গৃহমন্ত্রীরূপে নব অবতারে অপারেশন গ্রিন হান্টের নামে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের খনিজ সম্পদ দেশী-বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পথ সুগম করতে ব্যস্ত রয়েছেন। ২০০৫ সালের ১৬ মে, চিদাম্বরম উড়িষ্যা সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের এবং পস্কোর আধিকারিকদের সাথে আলোচনায় বসে একটি রফা করেন। যার পরিণতিতে ২০০৫ সালের ২২ জুন উড়িষ্যা সরকার এবং পস্কোর মধ্যে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয় যার অনুযায়ী পস্কো ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উড়িষ্যার জগৎসিংহপুর জেলায় একটি ১২০ লক্ষ টনের ইস্পাত কারখানা ও নিজস্ব মালিকানার বন্দর ( captive port ) স্থাপন করবে। এর জন্য উড়িষ্যা সরকার তাদের জগৎসিংহপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এরসামা ব্লকের ঢিনকিয়া, নয়াগাঁ ও গড়কুজঙ্গ পঞ্চায়েত এলাকায় ৪০০৪ একর জমি দেবে। এই অঞ্চলে অবস্থিত জটাধর নদীর মোহনাও পস্কোকে দেওয়া হবে যেখানন পস্কো তার নিজস্ব মালিকানার বন্দর স্থাপন করবে। এছাড়া পস্কো পাবে সুন্দরগড় জেলায় ১৩০০০ একরের উপর বিস্তৃত খণ্ডধর খনিতে আকরিক লোহা ও কয়লা উৎখননের একছত্র অধিকার, এবং সরকারের কাছ থেকে ২৪ টাকা প্রতি টন দামে বছরে ৬০০০ লক্ষ টন আকরিক লোহা কেনার অধিকার (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আন্তর্জাতিক বাজারে আকরিক লোহার দাম প্রায় ২০০০ টাকা প্রতি টন)। সমঝোতাপত্রে পস্কোকী ই আকরিক লোহা রপ্তানী করার অধিকার দেওয়া হয় ore-swapping বলে এক নতুন প্রক্রিয়ার আওতায়, যাতে বলা হয় যে পস্কো ভারত থেকে নিম্ন মানের আকরিক লোহা রপ্তানী করতে পারবে যদি তারা সমপরিমাণেরছ উচ্চ মানের আকরিক লোহা তাদের কারখানার জন্য আমদানী করে। এছাড়াও খনি থেকে তাদের বন্দর অবধি একটি ব্যক্তিগত রেললাইন, মহানদীর উপর জোবরা বাঁধ থেকে বছরে ১২০০০ থেকে ১৫০০০ কোটি লিটার জল, ভুবনেশ্বরে কর্পোরেট অফিসের জন্য ২৫ একর জমি ও টাউনশিপ স্থাপনের জন্য ২০০০ একর জমি, এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের ছাড়পত্র এই সবই এই সমঝোতাপত্রের মাধ্যমে পস্কোকে দেওয়া হয়। সরকারী মদতে বৃহৎ পুঁজির দ্বারা দেশের জল জমি খনিজ অবাধ লুন্ঠনের প্রক্রিয়ায় এই চুক্তিপত্রটি একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার টাটার সাথে সিঙ্গুরে এবং সালিমের সাথে নন্দীগ্রামেহ হয়ত এই চুক্তিটির আদর্শকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিল।

    যখন এই চুক্তিটির কথা জানাজানি হয় তখন সারা ভারতবর্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এর সমালোচনায় এবং বিরোধীতায় মুখর হন। এবং একই সাথে এর বিরোধীতায় নামেন এরসামা ব্লকের সেই মানুষগুলি, যারা পস্কোর প্রকল্পের জন্য তাঁদের ভিটেমাটি, জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হবেন, যাঁদের জমি পস্কোকে লিখে দেওয়ার আগে উড়িষ্যা সরকার একবারও জানাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। এরসামা ব্লকের তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত ঢিনকিয়া, নুয়াগাঁ ও গড়কুজঙ্গ মিলিয়ে ওই অঞ্চলে প্রায় ২২০০০ কৃষিজীবি ও মৎস্যজীবি মানুষের বসবাস। মিঠে বালি ও মিঠে জলের ওই অঞ্চলে এইসব মানুষ ধান, পান ও মাছ চাষভিত্তিক এক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে সংযুক্ত। এছাড়াও হয় প্রচুর কাজুবাদাম চাষ। যে ৪০০৪ একর জমি পস্কোকে দেওয়ার কথা হয় তার মধ্যে ৪৩৮ একর জমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ও ৩৫৬৬ একর জমি সরকারী নথিভুক্ত অরণ্যভূমি, যাতে এইসব মানুষেরা বহু প্রজন্ম ধরে কৃষিকাজ করছেন। এইসব জমি চলে গেলে এই হাজার হাজার মানুষ তাঁদের জীবিকার সংস্থান হারাবেন। একই সাথে জটাধর মোহনায় বন্দর স্থাপিত হলে সমস্ত মাছ ও চিংড়ি চাষের ভেড়ি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে এবং ওই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলের মানুষ পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতির নামে নিজেদের সংগঠিত করে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের শুরু থেকেই তাঁদের উপর নেমে আসে একদিকে উড়িষ্যা পুলিশ ও অন্যদিকে উড়িষ্যার শাসক দল বি জে ডি - র গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণ। প্রতিরোধকারী গ্রামবাসীরা বহুবার আক্রান্ত হন, পুলিশের গুলিতে তপন মণ্ডল নামে এক গ্রামবাসীর মৃত্যুও ঘটে। ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতির নেতা অভয় সাহুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং দশ মাস কারাবাসের পর ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু এইসব আক্রমণ, অত্যাচার ও বুয়ো মামলায় গ্রেপ্তার সত্ত্বেও পস্কো বিরোধী আন্দোলনকে সরকার ভাঙতে পারেনি। গ্রামবাসীরা ঢিনকিয়া, গোবিন্দপুর ও নুয়াগাঁ গ্রামগুলিকে ব্যারিকেড করে, পুলিস ও পস্কোর ভাড়া করা গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে থাকে।

    যে সাড়ে তিন হাজার একর অরণ্যভূমি পস্কো প্রকল্পের মধ্যে পড়ছে, এবং যার উপর ওই অঞ্চলের মানুষ বহুদিন ধরে চাষবাস করে আসছেন, ২০০৬ সালে সংসদে পাশ হওয়া অরণ্য অধিকার আইনের বলে সেই জমির উপরেও এইসব মানুষের আইনসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রাস্তা খুলে যায়। কিন্তু উড়িষ্যা সরকার ওই অঞ্চলের মানুষের এই দাবী মেনে না নিয়ে তাদের ওই জমি হস্তান্তর করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারী থেকে পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি বালিতুতা বলে একটি জায়গায় লাগাতার ধর্ণায় বসে। ২৬ জানুয়ারী দিল্লীতে প্রজাতন্ত্র দিবসের সভায় বিশেষ অতিথি হিসাবে আগত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতিকে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক কথা দেন যে তিনি পস্কোর জন্য প্রতিশ্রুত জমির ব্যবস্থা করে দেবেন। নবীন পট্টনায়েক সারা দেশ জুড়ে চলা অপারেশন গ্রিন হান্টের নামে গণপ্রতিরোধকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে উড়িষ্যা যে সব উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন চলছে সেগুলিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। চার মাস ধরে ধর্ণা চলার পর গত এপ্রিল মাসে উড়িষ্যা সরকার পস্কোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারীদের তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য শেষ হুঁশিয়ারী দেয়। এই সময়েই উড়িষ্যার জাজপুর জেলার কলিঙ্গনগরে টাটার কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের উপরেও নির্মম পুলিশী আক্রমণ শুরু হয়। পস্কোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারীরাও বুঝতে পারেন যে এর পর আক্রমণ নেমে আসবে তাঁদের উপর। মে মাসের শুরু থেকে ওই অঞ্চলে বিরাট পুলিশী প্রস্তুতি শুরু হয়। অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত পঁচিশ প্লাটুন পুলিশ সমবেত করা হয়। এরপর ১৫ মে নেমে আসে নির্মম আক্রমণ। ওই দিন বালিতুতে ধর্ণার জায়গায় প্রায় চার হাজার মানুষ, বিশেষত মহিলারা, শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হয়েছিলেন। পুলিশ তাদেরকে সেখান থেকে হঠে যেতে বলে। কিছুক্ষণ পর যখন তাঁরা সবে উঠতে আরম্ভ করেছেন, তখন তাদের উপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ও ছড়রা গুলি দিয়ে বর্বরোচিত আক্রমণ করে। যখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করেন, তখন পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং যাকেই হাতের মধ্যে পায় তাকেই চুলের মুঠি ধরে ভীষণ প্রহার করে। এরপর পুলিশ ধর্ণার মঞ্চে এবং কাছাকাছি অবস্থিত চা, খাবারের দোকান ও খড়ে ছাওয়া বাড়িগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুঁজির সেবায় উড়িষ্যা পুলিশের এই বর্বর ব্যবহার উড়িষ্যার মানুষ তাদের টেলিভিশন পর্দায় সেদিন প্রত্যক্ষ করে। ওই অঞ্চলের মানুষের কাছেই পুলিশ ও একটি প্রতিহিংসাপ্রবণ গুণ্ডাবাহিনীর মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই।

    এই ঘটনার দুদিন পর ঢিনকিয়া, গোবিন্দপুর ও নুয়াগাঁ গ্রামগুলিতে গিয়ে দেখা যায় যে সেখানে মানুষের অবস্থা শোচনীয়। ১৫মে নির্মম পুলিশী আক্রমণের ফলে গ্রামগুলিতে আহত মানুষের ভিড়। এবং যেহেতু ১৫মের পর থেকে পুলিশ কারুকে গ্রামগুলিতে ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না, সেহেতু এই আহত মানুষেরা প্রায় কেউই কোন চিকিৎসার সুযোগ পাননি। রক্তাক্ত ক্ষতস্থান ও ভাঙা হাত পা নিয়ে বহু মানুষ, বিশেষত বয়স্ক মানুষেরা, বাড়িতে বাড়িতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পুলিশ সেদিন কারুকেই নিষ্কৃতি দেয়নি। এইসব মানুষের শরীরের ক্ষত দেখে ও তাঁদের কাছে ১৫মের ঘটনার বর্ণনা শুনে বোঝা যায় যে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে পুলিশ নিরস্ত্র জনতার প্রতি কী ব্যবহার করতে পারে। তিনটি গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন মানুষ আহত হয়েছেন। ক্ষতগুলি হয়েছে রবার বুলেট থেকে, লাঠির ঘায়ে এবং ছড়রা গুলি থেকে, যার ব্যবহার ভারতে অপেক্ষাকৃত নতুন। বাইসাইকেলের বল-বেয়ারিং এর মত দেখতে এই গুলি হাজারে হাজারে ছোঁড়া হয়েছে, এবং এক একজন মানুষের শরীরে পাঁচটি-ছটি করে এই গুলি বিঁধে আছে। কোন চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে না যেতে পারার জন্য বহু মানুষ বাড়িতে ছুরি বা ব্লেড দিয়ে এই গুলি শরীর থেকে বার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অমানবিক অস্ত্রটি ইজরায়েল বা অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণবিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, এখন বিশ্বায়নের যুগে বোঝা যাচ্ছে যে এই অস্ত্রটি ভারতেও আমদানী করা হয়েছে। বহুল সংখ্যাক আহত মহিলাদের দেখে বোঝা যায় যে পুলিশ মহিলাদের, যাঁরা এই ভিটে-মাটি রক্ষার আন্দোলনে একদম প্রথম সারিতে থেকেছেন, আক্রমণ ও অসম্মান করার জন্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিল। পঞ্চাশোর্ধ্বা মৌনাবতি দাশ, যিনি পায়ে রবার বুলেটের আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে যান, জানান যে তিনি পড়ে যাওয়ার পর কিভাবে পুলিশ এসে তাঁর চুলের মুঠি ধরে টানতে থাকে এবং জঘন্য ভাষায় তাঁকে বলে যে সরকার বিরোধীতার এই ফল। তাঁর আঘাতের জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে এবং তাঁর পক্ষে হাঁটাচলাই এখন কষ্টসাধ্য। টিক্কি বর্ধন, যাঁর পায়ের পাতায় রবার বুলেট লেগে সম্ভবত ভেঙে গেছে, একদমই হাঁটাচলা করতে পারছেন না। কোন চিকিৎসককে দিয়ে তিনি তাঁর আহত পা পরীক্ষা বা প্লাস্টার করানোর সুযোগ পাননি। তাঁর স্বামী ভরত বর্ধনের মুখে একটি রাবার বুলেট ও ছড়রা গুলি লেগেছিল। অল্পের জন্য চোখটি বেঁচে গেলেও, বুলেটটি তাঁর দাঁত ও নাকের মধ্যে কোন ধমনী ভেঙে দেয় যার জন্য তাঁর নাক থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ছড়রা গুলিটি তাঁর ডান গালে বিঁধে ছিল। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা গুজুরি মোহান্তি মাথার পিছনে, পিঠে ও কোমরে তিনটি রাবার বুলেট থেকে আঘাত পেয়েছেন। তাঁর পক্ষে বসা বা কাত হয়ে ছাড়া শোয়াও যন্ত্রণাদায়ক। তিনি জানালেন যে কিভাবে সেদিন পুলিশ মহিলাদের উপর আক্রমণ চালায়। মহিলারা সেদিন বালিতুতে খালের উপর ব্রিজের সামনের রাস্তা অবরোধ করে বসে ছিলেন। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ তাদের ওই রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে থাকে। দু ঘন্টা পর, যখন তাঁরা সবে ওখান থেকে সরে যেতে আরম্ভ করেছেন, তখন পুলিশ হঠাৎ কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ও ছড়রা গুলি দিয়ে আক্রমণ চালায়। তিনি এবং অন্য অনেক বয়স্ক মহিলা কোনক্রমে ওইখান থেকে সরে গিয়ে কিছুটা দূরে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন, যেখানে তাঁরা ভাবেন যে পুলিশ তাঁদের আক্রমণ করবে না। কিন্তু পুলিশ তখন সেখানে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে, এবং যখন তাঁরা পালাতে থাকেন তখন তাঁদের পিঠের উপর গুলি চালাতে থাকে। তাঁর শরীরের পিছনের দিকে লাগা তিনটি বুলেটই এর প্রমাণ। পুলিশরা, যারা ব্রিজের উপর অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল, ব্রিজের একদিকে নিচু জমিতে জড়ো হওয়া নিরস্ত্র মানুষের উপর যথেচ্ছ গুলি ও কাঁদানে গ্যাস চালায়। মহিলারা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, পুলিশ তখন ব্রিজ থেকে নেমে এসে তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করে ও চুলের মুঠি ধরে মারতে থাকে। এঁদের মধ্যে পাঁচজনকে, যাঁদের মধ্যে এক ষাটোর্ধ্বা মহিলাও আছেন, পুলিশ টানতে টানতে তাদের গাড়িতে নিয়ে তোলে। এদের পরিণতি সম্পর্কে এদের পরিবারের লোকেরা এখনও কিছু জানেন না।

    এই সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রায় সব বাড়িতেই শোনা যায়। পস্কো বিরোধী মানুষ এখন তাঁদের উপর পুলিশী আক্রমণের প্রতীক্ষা করছেন, এবং উড়িষ্যা সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে তা যে কোনদিন ঘটতে পারে। কিন্তু এই খেটে খাওয়া প্রতিরোধী মানুষগুলি জানিয়েছেন যে তাঁদের উপর আক্রমণ তাদের প্রতিরোধ করার সংকল্পকে বাড়িয়ে দিয়েছে, এবং পুলিশ গ্রামে ঢুকলে তাঁরা জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবেন। নবীন পট্টনায়েক এই প্রতিরোধকে ভাঙতে ২০মে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে উড়িষ্যা সরকার বিবেচনা করে দেখবে যে ঢিনকিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩০০ একর "ব্যক্তিগত মালিকানার' জমি পস্কো প্রকল্পের আওতার বাইরে নিয়ে আসা যায় কিনা। কিন্তু পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি এই প্রস্তাবকে মানতে রাজী হয় নি, কারণ মানুষের দাবী যে জমিতে তাঁরা বহুদিন ধরে চাষবাস করে আসছেন, যেই জমি আইনসম্মতভাবে তাঁদের প্রাপ্য, সেই সাড়ে তিন হাজার একর জমিও তাঁরা কোনভাবেই পস্কোর হাতে তুলে দেবেন না। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা গুজুরি মোহান্তি তাই নবীন পট্টনায়কের দিকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন "পুলিশ আমার সাথে যে ব্যবহার করেছে, নবীন পট্টনায়েক কি তাঁর নিজের মা-র সাথে সেই ব্যবহার করবেন?' ভিটে মাটি, জীবন জীবিকা বাঁচানোর সংগ্রামরত উড়িষ্যার গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে নবীন পট্টনায়েককে, এবং টাটা, পস্কো ইত্যাদি বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধারদের, যারা রবার বুলেট ও ছড়রা গুলির সাহায্যে উড়িষ্যায় "উন্নয়ন' নিয়ে আসতে মনস্থ করেছে।

    ৩০শে মে, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ মে ২০১০ | ৫৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন