এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপার বাংলা

  • আসামের বাংলা কবিতা চর্চা- প্রথম কিস্তি

    অমিতাভ দেব চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ০৪ জুলাই ২০১১ | ২৮১৬ বার পঠিত
  • বাংলা তো শুধু এপার আর ওপার নয়। ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে বাংলা ভাষা, শহর কলকাতা থেকে যাকে অনেক সময়ই সুদূর উপগ্রহ মনে হয়। সেই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডের ইতিহাস-ভূগোল-কথা-উপকথা-বৃত্তান্ত নিয়েই শুরু হল আমাদের নতুন বিভাগ অপর বাংলা।

    ভাষাচর্চার কথা বললে, প্রথমেই সংবাদপত্র এবং গদ্যচর্চার কথা ওঠে লিটল ম্যাগাজিন কিংবা কাব্যচর্চার কথা ওঠে না। গদ্যচর্চার মধ্যেও প্রথমেই সাহিত্যচর্চার কথা ওঠে না। কারণ লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামান যে কোনও ভাষারই হাতেগোনা মানুষ আর সংবাদপত্র পড়েন সবাই। শিশুরা ছাড়া প্রায় সবাই।

    আসামে বসবাসকারী প্রায় আশি লক্ষ বাঙালির (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চল্লিশ লক্ষ অ বরাক উপত্যকার চল্লিশ লক্ষ) মধ্যে যদি লিটল ম্যাগাজিন করিয়ে-পড়িয়ে ও লিখিয়ের সমাজভুক্ত হন হাজার দুয়েক জন, তাহলে এঁদের মধ্যে কবিদের ধরে নিয়েও কবিতামনস্কর সংখ্যা কয়েকশোর বেশি হবে না। তবু আমি আসামের বাংলা-চর্চা প্রসঙ্গে একমাত্র কবিতার কথাই যে কেন টেনে আনলাম - এর বোধহয় একটু কৈফিয়ত দেওয়া দরকার।

    আসলে কবিতার একটা সুবিধে আছে। ভাষায় লিখিত হলেও, কবিতার ভাষায় কেউ কথা বলে না। কবিতার তাই বাস্তবের কাছে তেমন দায় নেই যে দায়টা গদ্যের আছে। কবিতা ঠিক এখানটাতেই সময়কে পেরিয়ে চলে যেতে পারে। ইতিহাস দিয়ে শুরু করলেও, কবিতা শেষ পর্যন্ত চলে যেতে পারে দর্শনের কাছে।

    তো কবিতার এই অন্তর্দৃষ্টি কিংবা ঊর্ধ্বদৃষ্টি আছে বলেই কবিতার ভাষা বাস্তবের ভাষা থেকে আলাদা হলেও তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় বাস্তবের দর্শনকে কিংবা ভাষার একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রূপকে।

    আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যদি কেউ কোথাও আসামের বাংলা কবিতা-চর্চা নিয়ে লিখতেন, তিনি ভাবতেও পারতেন না মেঘালয় বলে কোন আলাদা রাজ্যের অস্তিত্বকে, বিশ্বাসই করতে পারতেন না শিলং-কেন্দ্রহীন কোনও আসামের কথা। ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড এই তিন আলাদা রাজ্য ছাড়া, নেফা-মাথায় তখনকার আসাম ছিল উত্তর পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজ্য। আবার ১৯০৫ সালে আসাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল প্রভিন্সের। ১৮৭৪ সালে রাজস্ব-ঘাটতির ছুতোয় সিলেটকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল আসামের সঙ্গে।

    বারবার বারবার আসামের ভূগোল রাজনীতির শিকার হয়েছে। আবার আজকের রাজনীতিই তো আগামিদিনের কাছে ইতিহাস, তাই আমরা বলতে পারি যে এখানকার ভূগোল বারবার ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়েছে।

    এটা, সুতরাং, তেমন আশ্চর্যজনক কোনও ঘটনা নয় যে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আধুনিক বাংলা কবিতা-চর্চার একটি প্রধান ধারার পথপ্রদর্শক যিনি ছিলেন, তিনি মূলত ছিলেন এক ঐতিহাসিক। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত অমলেন্দু গুহর "লুইত পারের গাথা' দিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আধুনিক বাংলা কাব্যচর্চার সূত্রপাত, যদিও অমলেন্দুর "লুইত পারের গাথা'-র অন্যতম প্রেরণা ছিলেন এক গায়ক এবং বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের "সীমান্ত প্রহরী'র কবিতাগুলি আগে লিখিত হলেও ছাপা হয়েছিল "লুইত পারের গাথা'র পরে, ১৯৬১ সালে। পরবর্তীকালে এই ধারা যে সবসময় বামপন্থী-আদর্শে-বিশ্বাসী কবিদেরই কবিতায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তা কিন্তু মোটেই না। দেবাশিস তরফদারের মতো বরাক উপত্যকার নন্দনসচেতন কবিও যখন লেখেন:

    "চতু:সীমা বলা হল। হে পাঠক, ভ্রূ-কুঞ্চিত, সাম্রাজ্যবাদের চিহ্ন পেলে বুঝি?
    সত্য তাই। কবিমন সতত সাম্রাজ্য গড়ে, যেরকম বালকেরা অবিরত
    সম্পদ কুড়াতে থাকে, সিগারেট বাক্স, ভাঙা কাপের হাতল, কার্ড, পরিতক্ত
    ট্রামের টিকিট, ভরে ঝুলি তার অগণিত মহার্ঘ বাতিল পণ্যে, আমিও তো
    তেমনি সম্পদলোভী, পৃথিবীর পথে পথে যেখানে যা পড়েছিল সব চুরি করে
    গড়েছি ভাণ্ডার তার প্রতিটি মাটির ঢেলা সুবর্ণগহনাজ্ঞানে রাখি যত্ন-ভরে।

    যেমন হারাংগাজাও। সামান্য সে জনপদ। শ্যামল পর্বতে ঘেরা। ছোট নদী।
    কেউ বা সিলেটি, কেউ অসমীয়া, হিন্দিভাষী, ডিমাছা, নেপালি কিংবা আর কেউ।
    বন্দরে খালাসি যথা, ভিন্ন বুলি, ভিন্ন চাল, একত্রে বাজারে মেশে, চা দোকানে।
    পচা বান? খেতে খেতে মিষ্টির দোকানে বসে শুনি কতরূপ ভাষা, লাগে ঢেউ
    অকস্মাৎ মর্মদেশে, ওই যে কাছাড়ি নার্স, হিন্দুস্থানি ড্রাইভার, সিলেটি মাস্টার
    -সবাইকে মনে মনে চুরি করি, উহাদের কাউকে ছাড়িনা আমি, প্রত্যেকে আমার।'


    আমরা অবাক না হয়ে পারি না যে সেই কবেকার প্রেসিডেন্সি কলেজ জীবনে লেখা অমলেন্দু গুহর "লুইত পারের গাথা'-র কবিতাগুলি সরাসরি প্রভাবিত না করলেও, কত অনায়াসে ভবিষ্যৎ কবিদের হৃদয় স্পন্দনগুলি পূর্বানুমান করেছিল।

    স্বাভাবিকভাবেই, তাহলে এখন প্রশ্ন ওঠে কী ছিল "লুইত পারের গাথা'র কাব্যবীজ? কী ছিল তার সারাৎসার?

    "এখানে স্বপ্নের মত আমার সত্তার সাথে
    জড়ানো, ছড়ানো এক দেশ -
    আমি ভালোবাসি তার বনরাজিনীল পরিবেশ।
    কখনো শীতের সাঁঝে বুনো হাঁস ঝাঁক বেঁধে ওড়ে,
    কমলার কুঞ্জে কুঞ্জে রসলুব্ধ মৌমাছির ভিড়,
    রূপালি আশার মতো বরফ-নিবিড়
    ভুটান পাহাড়চূড়া ঝিলকিয়ে ওঠে!
    কখনো বা প্রথম বৈশাখে
    শিপিনী কুমারী সাজে আনকোরা রিহা-মেখেলায়
    ফাটা শিমুলের মতো কিষানের উড়ে চলে মন,
    বহাগীর আমন্ত্রণ
    ফুটে ওঠে নাহরের শাখায় শাখায়,
    অজানা লতার গন্ধে পথ চলা দায়!
    আষাঢ়ে শুনেছি আমি যৌবনের গান
    কলঙের কলোচ্ছ্বাসে, বিশপের মঞ্জুল গর্জনে,
    সিঁড়িকাটা জুমখেত বুক পেতে ধরে রাখে জল,
    ভৈয়ামের ভিজে মাটি মাখামাখি লাঙলের মুখে,
    লুইতের গতিবেগে ভেসে যায় স্থবির পাষাণ!
    এই তো আমার দেশ-
    শান্তির নিবিড় নীড় আমার আসাম
    আমার নাড়িতে জাগে এর যত নদীবন পাহাড়ভৈয়াম!'


    দীর্ঘ এই কবিতায় কবির বামপন্থী বিশ্বাস-সঞ্জাত আশাবাদ (যার সঙ্গে কাব্যবীজের কোনও যোগসূত্র নেই) ইত্যাদি ছাড়া যা আছে তা হল এক পরিব্যাপ্ত ভূগোলচেতনা। এই ভূগোলচেতনার বীজটুকুই কবি আহরণ করেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কবিতা থেকে।

    এই ভূগোলচেতনাকে যদি একটু বিশ্লেষণ করি, তাহলে কি পাই? পাই রক্তের সংস্কৃতির বাইরের এক দেশকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার রোমাঞ্চ। আসামের বাংলা কবিতার সেই অর্থে এই একটিই "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ', বাকিগুলি নীল পাহাড় আর লাল নদী কিংবা বরাক একটি নদীর নাম। এই দেশের খোঁজের পাশাপাশি অমলেন্দুর কবিতায় লুকিয়ে আছে এক প্রতিবেশ চেতনাও - এমনই সে চেতনা জাকে বাদ দিলে আত্মপরিচয়ই অসমাপ্ত থাকে।

    বিষয়টিকে একটু বিশদ করার প্রয়োজন মনে করি। যে কোনও বাঙালিরই মানসভুবন কলকাতা আর দেশভাগে বাস্তুচ্যুত বাঙালির শিকড়ভুবন পূর্ববঙ্গ। বাস্তুচ্যুত যে কোনও বাঙালি কবিরই নান্দনিক জগৎ কলকাতায়, সেখান থেকে ইশারা আসে, খবর আসে। সেখানকার আলো হাওয়ায় কেলাসিত হয়ে বহির্বিশ্বও তার কাছে এসে ধরা দেয়। আবার তার প্রাণের শিকড় তো, অন্তত গত শতাব্দী পর্যন্ত, চারিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের কোনও চোখে না দেখা-নাম শোনা কিংবা চোখের দেখা-প্রাণের-কথায়-ভরা গ্রামে। সেখান থেকে কি আসত? আসত স্মৃতি আর রূপকথা। কিন্তু তার বাস্তবের পৃথিবী? দেশভাগের পর বাস্তুচ্যুত বাঙালির বাসভুমি তো ছড়িয়ে আছে আবিশ্ব - নিউ ইয়র্কের পানশালা থেকে আসাম কিংবা মিজোরামের অনাবাদী জমির পাশের ঘাসবৃক্ষ পর্যন্ত।

    এখন, এই বাস্তবের পৃথিবীর শিশিরবিন্দুগুলিকে ভালো না বেসে, তার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কবি যদি শুধু ঘুরে বেড়ান এক অতৃপ্ত মানসলোকে কিংবা স্মৃতিপৃথিবীতে - তাঁর এই পর্যটন তো, পুরাণের ভাষায় বললে, গণেশের সেই মাতৃপ্রদক্ষিণ, যা আসলে কার্তিকের প্রকৃত ভ্রমণটিকে দাবিয়ে রাখার জন্য বানানো এক নিপুণ কথার ফাঁদ।

    তো একজন কবির তো আসল সত্যটা জানা চাই। কথার ফাঁদ কতদিন আটকে রাখবে তাঁর কবিত্বকে? আর এই কথার ফাঁদ থেকে মুক্তি পেয়েছে আসামের বাংলা কবিতা তার আশ্চর্য ভূগোল-সচেতনতায়। মূলত দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারনে বিগত শতাব্দীটি ছিল কাঁটাতারের আর উদ্বাস্তু প্রব্রজনের। তার ভূগোল-চেতনার মাধ্যমে আসামের বাংলা কবিতা সব মানস-কাঁটাতারকে অগ্রাহ্য করার শক্তি পেয়েছে।

    এই ভৌগোলিক দেশ যখন মনের দেশ হয়ে থাকেনি, যখন - বিশেষত আশির দশকে - তা নতুন করে উদ্বাস্তু হবার ভয় জাগিয়ে তুলেছে মনে, তখনই জেগে উঠেছেন একা ঊর্ধ্বেন্দু দাশ, তাঁর "বিষণ্ন পরবাস : নির্বাসন নয়' উপলব্ধি নিয়ে।

    "সব ছেড়ে চলে যাব-যেমন হাঁসেরা যায়-
    .........
    এইসব গিরি-নদী-অরণ্যের সীমানা ছাড়িয়ে
    দেহ থেকে দেহান্তরে, খুঁজে নিতে হেমপাত্র
    মৃত্যুজিৎ আত্মার আশ্রয়-
    বিষণ্ন পরবাস : নির্বাসন নয়।'...


    কিংবা জেগে আছেন ক্ষিতীশ রায় যিনি তাঁর "চির চেনেহী আশ্রয়দাত্রী/চির মরমর দেশ নতুন মাতৃভূমি'তে খুঁজে পেয়েছেন তাঁর "বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া/পুরনো সেই ঘর'। জেগে আছেন জীবন নাথও যাঁর "স্বদেশ! স্বদেশ কোথায়?' প্রশ্নটিই মানচিত্র নিয়ে ইতিহাসের নানা কাটাকুটি খেলার দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে যায়। এই ঘরানারই আরেকটু সম্প্রসারিত রূপ রবীন্দ্র সরকার আর বহমানতার স্রোত প্রমোদরঞ্জন সাহা যাঁর "বিহুরানি হয়েছিল বৈজয়ন্তী/যার পিতা এক প্রব্রজিত পুরুষ/যার ধমনীতে প্রজ্জ্বলিত পদ্মা-মেঘনার আদর'। আশির দশকে এসে এই ধারাটিই দেবীপ্রসাদ সিংহর কলমে "গ্রহণ' আর "নষ্টবেলা'র স্বর খুঁজে পায় কিংবা কিশোর ভট্টাচার্যের "বিহুগীতের বদলে একটি কবিতা'য় গান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, কিংবা সুব্রত চৌধুরীর "নীলাচল'-এ "রক্তের গান, পেঁপার শৃঙ্গার নাদ' ছুঁয়ে সঞ্জয় চক্রবর্তীতে এসে "একা, নির্জন বিষণ্ন এক ঘরে' পেতে নেয় "উৎসবের টেবিল'। আবার নিখিল তালুকদার যখন বলেন,

    "ঠিকানা আমার একটাই
    মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র।'


    তখন বোঝা যায় ভূগোল-কাতর আসামের কবিতার ঘর খোঁজা এখনও শেষ হয়নি। চিন্ময়কুমার দাসের, কল্লোল ভৌমিকের, শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের, তপন রায়ের আর তপন মহন্তের, দীপিকা বিশ্বাসের কিংবা সমর দেবের, রমানাথ ভট্টাচার্যের, সর্বোপরি পঞ্চাশের দশকের উজ্জ্বল কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কাব্যমর্মরগুলি হয়তো সরাসরি কোথাও এই ধারাটির প্রতি সচেতন পক্ষপাত দেখায় না - বরং ব্যক্তিপ্রতিভার নানারকমের শিলমোহর আবিষ্কারের প্রতি আধিকতর উন্মুখ থাকে, তবু এই ভূগোলের ডাকে কি স্বয়ং বীরেন্দ্রনাথও বারবার সাড়া দেননি? ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতার বইয়ের নামটিই স্বয়ং এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য: "পরবাসী'। আর বরাক উপত্যকা থেকে প্রকাশিত এক উজ্জ্বল কবিতা-সংকলনের নাম হিসেবেও তো বীরেন্দ্রনাথের কবিতারই একটি লাইন অমোঘ হয়ে উঠেছিল। "এই আলো হাওয়া রৌদ্রে' শব্দবন্ধটি কি কোথাও খুবই স্পষ্টভাবে লুকিয়ে রাখেনি এক ভূগোল-চেতনারই রৌদ্রালোককে?

    বরাক উপত্যকার কবিতা তার সূচনাপর্বে আনেক বেশি দায়বদ্ধতা দেখিয়েছিল নন্দনসচেতনতার প্রতি। ১৯৫৭ সালে হাইলাকান্দি শহর থেকে প্রকাশিত যে "স্বপ্নিল' কবিতাপত্রটিকে সারা আসামের প্রথম আধুনিক কাব্য-বিষয়ক-পত্রিকা বলে মেনে নেওয়া হয়ে থাকে, সেই "স্বপ্নিল' যুগের প্রধানতম কবি করুণাসিন্ধু দে-র অবিস্মরণীয় বইটির নামও কি তেমনি প্রবাদের মতো ছড়িয়ে দেয়নি সেই ভূগোল-চেতনা আর প্রতিবেশ-চেতনার বীজটিকে? "কণ্ঠে পারিপার্শ্বিকের মালা'র মতো নাম, মনে হয়, এই উত্তরপূর্বাঞ্চল ছাড়া আর কোনও বঙ্গভুবন থেকে উঠে আসতেই পারে না। আবার "অতন্দ্র' যুগের অন্যতম প্রবাদপুরুষ উদয়ন ঘোষ যে তাঁর সারাজীবনের কবিতা-সম্ভারের পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছড়িয়ে দেন সারা পৃথিবীর ভৌগলিক স্থাননামগুলি, তা-ও কি এই অসামান্য উচ্চাশায়ই নয় যে কবি চান তাঁর নিজের অবহেলিত, প্রান্তীয় ভূগোলটিকে বিশ্ব-ভূগোলের মানচিত্রে গেঁথে দিতে? উদয়ন যখন তাঁর এক ছড়ার সবশেষে উচ্চারণ করেন যে তাঁর বাড়ি আসলে মস্কোতেও নয়, প্যারিসেও নয়, তা "রাঙ্গিরখাড়িতে' তখন উদয়নের ভুবন-বিহার এক অন্য তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় আমাদের মনে। কিংবা ১৯৬৭ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হওয়া "সাহিত্য' নামক পত্রিকার সম্পাদক বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের কবিতায়ও এক ঘোর-লাগা ভূগোলভ্রমণ আছে : জটিঙ্গা থেকে বকরিহাওর সব ঠিকানাতেই তা বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতায়, অন্তত তাঁর কাব্যজীবনের মাঝামাঝি পর্ব থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত দেখি আরেক রকম ভূগোল ভ্রমণের হদিশ - যেখানে শক্তিপদ বারবার, বারবার ফিরে যাচ্ছেন সুদূর বাল্যে, সেই কবেকার ফেলে-আসা, ছেড়ে-আসতে-বাধ্য-হওয়া পূর্ববঙ্গীয় শৈশব কৈশোরে। সেই চাঁপায়, সেই বেলফুলে কিংবা সেই রূপকথায় আর স্মৃতিতে! সেই স্মৃতিকে নিয়ে দার্শনিকতায় -

    "আমরা কোথাও যাই না হাহাকার বুকে নিয়ে ফিরি
    তোমার পদ্মার পার আমার বরাক-জিরি-চিরি
    যখন যেভাবে হোক, পিতৃপুরুষেরা গেছে
    কলেরায় কিংবা কালাজ্বরে
    সুখের কুলকুচো আর দু:খের ঢেঁকুরে পেট ভরে
    আমাদের, আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসে থাকে যারা
    তাদের শরীর নেই, জিভ নেই, তবু এক তুমুল পাহারা
    কেবলি জাগিয়ে রাখে, কেবলি ভুলিয়ে রাখে মন
    কতক্ষণ? আর কতক্ষণ?'


    পরবর্তী যুগের দিলীপকান্তি লস্কর তো এই ভূগোলের ফাঁদকেই কবিতার বিষয় বানিয়ে নেন:

    "আমি কোত্থেকে এসছি, তার জবাবে যখন বললাম
    করিমগঞ্জ, আসাম
    .........
    বাংলাভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস।
    তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভিরমি
    খাইয়ে দিয়ে বললেন:
    ও! বাংলাদেশ? তা-ই বলুন।'



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপার বাংলা | ০৪ জুলাই ২০১১ | ২৮১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন