একটি স্বল্প-দৈর্ঘ্যের পুস্তক-সমালোচনায় এই জাতীয় একটি বইয়ের প্রতি সুবিচার করা প্রায় অসম্ভব। চার বিভাগে বিভক্ত এই গ্রন্থটিতে শ্রী সেন নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বইটির কেন্দ্রে রয়েছে জন র্যলস্(John Rawls)-এর "A Theory of Justice' নামক কালজয়ী গ্রন্থের আলোচনা এবং জাস্টিস্(Justice) বা সুবিচার সংক্রান্ত একটি ভিন্ন তত্ত্ব পরিবেশন করার প্রচেষ্টা। র্যলস্ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটিতে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেমন করে সুবিচার করা সম্ভব তা বিস্তারিত আলোচনা করেন। শ্রী সেন-এর মতে র্যলস্ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে কিন্তু একটি আদর্শ সমাজব্যাবস্থার খোঁজ করা অপ্রয়োজনীয়। বরঞ্চ, তাঁর মতে, আমাদের উচিত কেমন করে অবিচার কমানো যায় এবং মানুষের সক্ষমতা(capability) বাড়িয়ে তাকে স্বাধীনতা(freedom)-এর স্বাদ বেশী করে দেওয়া যায় তার প্রচেষ্টা করা। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন যে যদি আমাদের একটি পিকাসোর ছবি কিংবা একটি সালভাদোর দালির ছবি-র মধ্যে কোন একটিকে পছন্দ করতে হয় তাহলে এটা জেনে লাভ নেই যে একটি আদর্শ ছবি হল মোনালিসা। মোনালিসা কেন আদর্শ ছবি সেটা নিয়ে পৃথক আলোচনা করা যেতেই পারে, কিন্তু বাস্তবে পিকাসো কিংবা দালি-র মধ্যে কোন একটিকে বেছে নেওয়ার কাজটিতে খুব একটা লাভ হয় না।
বইটি পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগছিলো শ্রী সেনের মতে "জাস্টিস্' বা সুবিচার তাহলে কী? বইটির তৃতীয় বিভাগ ""Materials of Justice'' পড়তে পড়তে তার কিছুটা হদিশ মিলল। শ্রী সেনের আগের বই-গুলোর সাথে যারা পরিচিত তাদের কাছে এই বইয়ে উপস্থাপিত চিন্তা-ভাবনা পরিচিত মনে হবে। শ্রী সেনের মতে একটি সমাজে সুবিচার আছে কিনা তার প্রমাণ মিলবে একজন ব্যক্তি(individual) কতটা স্বাধীনতা(freedom) উপভোগ করে তা পর্যালোচনা করে। সেই ব্যক্তি কি নিজের স্বপ্নগুলি সফল করার সুযোগ-সুবিধাগুলি পাচ্ছে? সেই স্বপ্নগুলি পূরণ করার মত যথেষ্ট সক্ষমতা (capability) কি সে সেই সমাজে পাচ্ছে? অতএব সমাজে সুবিচারের মাত্রাবৃদ্ধি করতে গেলে দেখতে হবে যাতে আরো বেশী সংখ্যাক মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি হয় এবং স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ তারা উপভোগ করতে পারে। উদাহরণ-স্বরূপ বলা যায় যে একটি সমাজে যদি প্রত্যেক শিশু সমান গুণগত মানের শিক্ষা পায় তাহলে সে সমাজে সুবিচারের মাত্রা অন্য একটি সমাজের তুলনায় বেশী হবে যেখানে অল্প কিছু শিশুই এই শিক্ষার সুযোগ পায়। অর্থাৎ যে সমাজে মানুষের সক্ষমতা যত বেশী সেই সমাজে সুবিচারের মাত্রা তত বেশী। শ্রী সেন বহুদিন ধরেই গণতন্ত্রের পূজারী এবং এই বইতেও তিনি বলেছেন যে গণতন্ত্র, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পরিবেশ আছে যে সমাজে সেই সমাজে সুবিচারের সম্ভাবনা বেশী। শ্রী সেনের মতে গণতন্ত্র সবসময়েই একনায়কতন্ত্রের চেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য যদিও কখনো কখনো একনায়কতন্ত্রে আর্থিক উন্নতি বেশী দেখতে পাওয়া যায়।
বইটি শেষ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। কিন্তু তার পর মনে কিছু প্রশ্ন জাগলো। প্রথমত: শ্রী সেন সুবিচারের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাকে বোধহয় একটু কম গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি সংবেদনশীল পঞ্চায়েত বা থানা গরীব মানুষের জীবনে অনেকটা উন্নতি এনে দিতে পারে, আবার একটি দুর্নীতিগ্রস্ত পঞ্চায়েত গরীব মানুষকে আরো অসহায় করে দিতে পারে। ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীর বহুদেশেই সাধারণ গরীব মানুষকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের দ্বারা অপদস্থ হতে হয় প্রতি পদে যদিও সেই রাষ্ট্রটি আপাতদৃষ্টিতে "গণতান্ত্রিক'। দ্বিতীয়ত: স্বাধীনতা(freedom), সক্ষমতা(capability) কিংবা গণতন্ত্র নিয়ে শ্রী সেন আগের বইগুলিতে যা বলেছেন তার চেয়ে নতুন কিছু এখানে উপস্থাপন করেছেন বলে মনে হল না। একটু অতৃপ্তি রয়ে গেল বলা যায়। বিশেষ করে গণতন্ত্র নিয়ে আরেকটু গভীর আলোচনা পেলে ভাল লাগত। গণতন্ত্রের মধ্যে কেমন করে পার্টিরাজ কিংবা গুন্ডারাজ চলতে পারে এবং কেমন করে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারে তা আমার-আপনার মত অনেক স্বাধীন নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে দেখার সুযোগ পেয়েছে। গণতান্ত্রিক বিহার আর অগণতান্ত্রিক সিঙ্গাপুরের মধ্যে অনেকেই হয়ত সুযোগ পেলে দ্বিতীয়টিকে বেছে নেবেন। একথাও হয়ত অনস্বীকার্য যে আধুনিক পৃথিবীতে গণতন্ত্র যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের উপর রাষ্ট্রের নজরদারি। এই নজরদারি কখনো আসে উন্নয়নের মুখোশ পরে, কখনো আসে বিভিন্নরকম সমীক্ষার মধ্যে দিয়ে, কখনো বা "স্মার্টকার্ড' জাতী ডেটাবেস-এর মধ্যে দিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখানে প্রত্যেকটি পরিবারের হাঁড়ির খবর রাষ্ট্রের কাছে থাকবে। আধুনিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নাগরিক মনে করবে সে স্বাধীন কিন্তু মিশেল ফুকো যাকে বলেন "Governmentality' তার জালের মধ্যে আসলে সে বন্দী থাকবে। সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সে কতটা নিজের ইচ্ছে মত সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে আর কতটা বিশ্বায়নের জোয়ারে ভেসে থাকার প্রচেষ্টায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে সেটা ভাবা দরকার।
আমাদের চারপাশের সুবিচারবিহীন দুনিয়া এবং সুবিচারের আকাঙ্ক্ষায় যে প্রতিবাদী আন্দোলনগুলি গড়ে উঠেছে সেগুলির দিকে তাকালে আরেকটি প্রশ্ন জেগে ওঠে যার উত্তর শ্রী সেনের আলোচনায় পাওয়া গেল না। যদি সুবিচার খুঁজতে গিয়ে কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি হিংসার পথ অবলম্বন করে তাহলে তা ন্যায়সঙ্গত কিনা। বাস্তব দুনিয়ায় "public sphere' বা "public reasoning' জাতীয় উদারনৈতিক(liberal) তত্ত্ব খুব বেশী দেখতে পাওয়া যায় না, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে। আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে হিংসার বিরুদ্ধে কিন্তু নিপীড়িত মানুষ যদি হিংসার পথ বেছে নেয় তাহলে তা সবসময় অনৈতিক এটাও বলতে পারব না। এখানেই আবার মনে হয় যে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম - মানুষের সুবিচার পাবার পথ যদি গ্রাম সংসদ খুলে দিতে পারে তাহলে হয়ত গরীব মানুষ হাতিয়ার তুলে নেবার কথা ভাববে না। কিন্তু যেখানে পঞ্চায়েত বা ব্লক অফিস বা রাষ্ট্রের বিচারালয় গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয় সেখানে হিংসার পথে গরীব মানুষ হাঁটতে বাধ্য হয়। অতএব সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সুবিচার যে প্রতিষ্ঠানগুলি দিতে পারে সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে উন্নত করা প্রয়োজন হতে পারে।
বইটি পড়ে অনেক কিছু শিখলাম, অনেক ভাবনা-চিন্তার উপাদান পেলাম। সেই জন্য শ্রী সেনের কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু জাস্টিস্ বা সুবিচার সংক্রান্ত একটি স্পষ্ট, নিটোল তত্ত্ব পেলাম বলে মনে হল না। তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বইটির বিষয়টি সহজ না হলেও বইটি সুখপাঠ্য - এটি পাঠকের উপরি পাওনা।
দেবরাজ ভট্টাচার্য
ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্সেস, দিল্লী