এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • বাঙালি মুসলমান নারীর ইতিহাস

    জয়িতা বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৭ মার্চ ২০১১ | ৭৯০ বার পঠিত
  • আকিমুন রহমান: বিবি থেকে বেগম বাঙালি মুসলমান নারীর ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস; ( কলকাতা : গাঙচিল; প্রথম প্রকাশ : অঙ্কুর প্রকাশনী , ঢাকা , ২০০৬); পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩৬; মূল্য ১৫০ টাকা; ISBN 81 - 902823 60

    এ কথা সকলেরই জানা যে বই কখনও তার মলাট দেখে বিচার করতে নেই। কিন্তু অপরিচিত লেখক -লেখিকাদের ক্ষেত্রে, বইয়ের চেহারা কিংবা বড়জোর মলাটটি উল্টেপাল্টে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় সেটুকুই পাঠকের সম্বল। তার ওপর ভরসা করেই সাহসী পাঠক ক্রেতা হয়ে উঠবেন। সুন্দর বাঁধাই-ছাপাইয়ের মোড়ক বইকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। ইদানীংকালে গাঙচিল প্রকাশনা সংস্থা বেশ কিছু সুদৃশ্য বই বাংলা বইয়ের জগতে এনেছেন। তাদের প্রকাশিত বিবি থেকে বেগম বইটিও অতি সুদর্শন। নামটিও চমৎকার।

    লেখিকার ভূমিকা পড়ে জানতে পারি পাক্ষিক শৈলী পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখাটি বেরোনোর কালে বাংলাদেশের ছাপান্নজন প্রগতিশীল(?) বুদ্ধিজীবী এটির প্রকাশ বন্ধ করে দেন। তৎসত্ত্বেও বাংলাদেশের অঙ্কুর প্রকাশনী লেখাটিকে বই আকারে প্রকাশ করার সাহস করে এবং পরে এর ভারতীয় সংস্করণ হয়। অতএব এই বইতে কী আছে জানবার কৌতুহল সুতীব্র্র হওয়াই স্বাভাবিক।

    বইটির উপশিরোনামেই নির্দিষ্ট যে বইটি "বিবি থেকে বেগম' হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করবে এবং বিশ্লেষণ করবে। অথচ বইটিতে "হয়ে ওঠা'-র ইতিহাসকে নাকচ করাই লেখিকার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান পুরুষের শিক্ষিতা অর্থাৎ "উন্নতজাতের স্ত্রী'-র জন্য এক ধরণের নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ("উন্নতজাতের' অভিধাটা কি লেখিকারই দেওয়া?) তাঁদের চাহিদা মেটানোর তাগিদ থেকেই রচিত হয় মুসলমান শিক্ষিতার জন্য নৈতিকতার উপন্যাস। এ শ্রেণীর উপন্যাসে যে ধরণের বন্ধ অবস্থা আশা করা যায় সবই আছে সে সব গল্পে। মনে রাখা দরকার যে এ জাতীয় উপন্যাস তো কখনও সংস্কারমুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়নি। শিক্ষিতা মহিলাকে যাতে অশিক্ষিতার জগৎটি আত্মীকরণ করানো যায় সহজে তারই এক বিপুল প্রচেষ্টা এই উপন্যাসগুলি। নবযুগের চালক যে মুসলমান পুরুষেরা (লেখিকার ভাষায় "জ্ঞানপ্রাপ্ত আদম'' যাঁরা) তাঁরা শিক্ষিতা সহধর্মিণী যেমন চান তেমনই চান নিপুণ গৃহসেবিকা। এই দুয়ের মিলনেই তৈরি হবে তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত নতুন নারী।

    আকিমুন আলোচনা করেছেন যে উপন্যাসগুলো নিয়ে সেগুলো হল, "মোহাম্মদ নজিবর রহমন সাহিত্যরত্নের আনোয়ারা (১৯১৪); গরিবের মেয়ে (১৯২৩); মৌলভী আব্দুল ফাত্তাহা কোরেশীর সালেহা (১৯২৪);মোহম্মদ কোরবান আলীর মনোয়ারা (১৯৩২)'; কারণ "প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। অল্প সময়ের মধ্যে এক একটি সংস্করণ ফুরিয়ে যায় এবং এখনও এগুলোর পুনর্মুদ্রণ অব্যাহতই আছে।' সাহিত্যমূল্যের দিক থেকে নয়, কিন্তু সামাজিক ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এগুলো মূল্যবান। যে বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ে উপন্যাসগুলো প্রকাশিত তার প্রেক্ষিতে উপন্যাসের পঠন কি অবশ্যকর্তব্য নয়?

    নতুন নারী-নির্মাণের কাজটি বাঙালি হিন্দুরা এর একশো বছর আগে করেছিলেন। আকিমুন এই তথ্যটি দিলেও তার ইতিহাসটি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন। শিক্ষিত সহধর্মিণীর জন্য এক প্রজন্মের পুরুষের চাহিদা তৈরি হওয়া মাত্র হিন্দু পরিবারের গুরুজনেরা তাঁদের মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে, তাদের জন্য মেম গভর্নেস রেখে বিটোফেন সম্পর্কে শিখিয়ে, খোলা গাড়িতে স্বামীর পাশে বসে হাওয়া খাওয়ার উপযুক্ত করে তুলেছিলেন - এ চিত্র আদৌ ঐতিহাসিক নয়। একটু মনোযোগ দিয়ে ইতিহাস পাঠ করলেই আকিমুন বুঝতেন যে অন্দরমহল থেকে মহিলাদের সদরে আসার পথ তৈরি করার জন্য কয়েক প্রজন্মকে হিন্দু সমাজের নানান অর্গল ভাঙতে হয়েছে। সে লড়াই যে সব সময়ে পুরুষের উদারতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল, তাও নয়।

    অশিক্ষিত মুসলমান নারীর হাতে বই তুলে দিতে পারাটাই তো এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এ কথা কি কখনও মনে হয় না আকিমুনের? উপন্যাসগুলোর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বার বার দেখিয়েছেন সেগুলো কতটা পশ্চাদমুখী কিন্তু বাজারে টিকে থাকার তো একটা জোর চাই, সেটা যে কী, তার হদিশ আমাদের মিলল না। কেউ কেউ বিবি, কেউ কেউ বেগম। পদবিটা তাঁদের শ্রেণীর পরিচায়ক। কিন্তু বিবি থেকে বেগমে উত্তরণ হওয়ার গল্প তবে অনুপস্থিত?

    "স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভারা' শীর্ষক পরিচ্ছেদে আকিমুন আলোচনা করেছেন বেগম রোকেয়া, নুরন্নেছা খাতুন,মিসেস এম রহমান ও মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার জীবন নিয়ে। এখানেও ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে এঁদের উৎপাটিত করে তিনি দেখিয়েছেন যে এঁরা আসলে কতটা অপ্রগতিশীল। স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে প্রগতির সংজ্ঞাও তো বদলায়।

    শেষ পরিচ্ছেদে আকিমুন আলোচনা করেছেন আকিকুন্নেসা (এটাই সার্বিক নাম ধরে নিচ্ছি। পরিচ্ছেদের শিরোনামে চোখে পড়ার মতো বড় হরফে আকিমুন্নেসা ছাপা ) আহমদের কামসূত্র নিয়ে। বইটির নাম অবশ্য আধুনিকা স্ত্রী। বিষয়ে যতই রক্ষণশীল হোক না কেন, এটা মানতেই হবে যে মহিলাদের জন্য যৌনতার নির্দেশগ্রন্থ লেখাটাই তো একটা সাহসী কীর্তি। সে অর্থে আঙ্গিকগতভাবে বইটি অভিনবত্বের দাবি রাখে। ধন্যবাদ আকিমুন। এমন সব গ্রন্থের আলোচনায় পাঠকের সবচেয়ে বড় লাভ নতুন অনেক বইয়ের সন্ধান জানা। এপার বাংলার হিন্দু সমাজে বিশেষত: এই বইয়ে আলোচিত বইগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষ মেলা ভার। আকিমুনের বইটি পড়ে, বেশ কিছু লেখক -লেখিকার বই পড়তে একটা নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে পারে, যদিও লেখিকা নিজে সেগুলোর জন্য সুপারিশ করবেন বলে মনে হয় না। নারীবাদী আকিমুনের কাছে একটাই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আমরা সকলেই ইতিহাসের অংশীদার বলেই ইতিহাস বা ঐতিহাসিক জানাটাও কি আমাদের অবশ্যকর্তব্য নয়? কারণ লেখক-লেখিকা যত বিপ্লবী হন না কেন তিনি তো তাঁর সময়ের তাঁর পরিবেশ দ্বারাই সৃষ্ট।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৭ মার্চ ২০১১ | ৭৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন