২৯ তারিখ, মাইনে দূর অস্ত l আদা ২৬ তারিখে কিনলাম ২৪০ টাকা কিলো দরে l মধ্যে শনি-রবিও নেই যে আপিস না গিয়ে পয়সা বাঁচানোর উপায় আছে! এরই মধ্যে আবার সাংস্কৃতিক সুড়সুড়ি – গৌতম হালদার (বড় নয়) আর দেবশংকর হালদারের নাটক l আর যাই হই – আজকালকার ‘নাট্যামোদী’ (সম্ভবত আর্ষপ্রয়োগ – একালের এক নাট্য চিন্তকের বয়ানে, যিনি নাটকের চেয়ে দর্শক তৈরির দিকে জোর দেন বেশি, তাঁর লিখনে এই বানানই পেয়েছি) নই, ফলে সব ইনফরমেশন আগে থেকে থাকে না l টাইমের আগে সহকর্মীদের বক্রচক্ষু উপেক্ষা করে ও নানাবিধ জ্যাম ঠেলে যখন একাডেমি পৌঁছলাম তখন ৬টা ২০ l কাউন্টারে গিয়ে চমক l টিকেটের মূল্য ১০০, ২০০ ও ৩০০ টাকা l গলা দিয়ে না চাইতেই ‘ইয়াআক্স’ করে একটা আওয়াজ বেরোলো l ভুল করবেন না, সেটা বাস্তবিকই আনন্দের l নিখাদ আনন্দ l এই বাজারে এই টিকিটের দাম করার জন্যে মন্ত্রী হতে হয়নি, বড় কোনো প্রডাকশন হাউস খুলতে হয়নি, ‘নয়ে নটুয়া’ খুব খ্যাতনামা দল নয়, তবে হ্যাঁ, বিক্রিযোগ্য ছিল বটে, সেটা দুটো নাম – দুই হালদার l বাস্তবিক হলধর বটে তাঁরা, কৃষিকাজটা লেপেপুঁছে শিখতে আর করতে হয়েছে, তারপর নাম এসেছিল, দল ভেঙ্গেছিল, খেয়োখেয়ির গালগল্প রটেছিল, যার সত্য-মিথ্যে জানি না, আর যাচাইয়ের রুচি হয় না, প্রকৃত ‘নাট্যামোদী’ নই বলেই বোধ হয় l
দুটো টিকেটের দাম ৪০০ l শেষ ৫০০ র নোটটা ভাঙ্গালাম l দুই হালদারকে দেখব বলে, একসাথে l অনেক, অ-নে-ক দিন পর l নাটকটা, তার অভিনয়, এসব নিয়ে আজ লেখার নয়, আজ আমার ৪০০ টাকা আর টিকেটের মূল্যমান নিয়েই শুধু l
অনেক আগে, থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে টিকেট কাটার জন্যে আমরা যখন রাত সাড়ে নটায় পৌঁছে দেখতাম যে আমার নম্বর ৬৫, আর সামনের দিকের লোক ফিট করতাম, সফলভাবেই... সেও অনেক বছর আগের কথা l তখন আমরা বলাবলি করতাম দেখিস, একদিন সালা নাটকের টিকেটের দাম ১০০ টাকা হবে l আমরা বিশ্বাস করতাম l আমরা জানতাম যে থিয়েটার যারা করে তারা খেয়েপরে বাঁচবে, চাইতামও তাই l এবং তখন আমরা ভাবতে পারিনি যে আদা ২৪০ টাকা কিলোয় বিকোবে l
একটা তর্ক উপস্থাপনা করেছিল আমার এক বন্ধু l সেটা আমাদের রাজনীতি-বেলা l তার বক্তব্য ছিল যে যারা ডাক্তারি পড়ে, তাদের উপর অনিবার্য ভাবে একটা onus তৈরি হয়, সমাজসেবা করার l যে ইনজিনিয়ারিং পড়ে, তার জ্ঞানকে সমাজ-উপযোগী করে কোনো প্রকল্প তৈরির কথা কেউ ভাবতে চায় না l তার কারণ ডাক্তারকে কাজে লাগানো অনেক সহজ l এখানে কথাটা তুললাম কারণ নাটক ও নাট্যকর্মীদের এরকম একটা দায় বহন করার অভিপ্রায় দেখি l চান বা না চান l টিকিটের দাম বেশি রাখা নিয়ে নানা কূট-কচালি হয় l কেউ কেউ আছেন যারা আবার টিকিটের ব্যাপারটাই তুলে দিতে চান l এরকম কারো সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা আছে-হয়েছে l একটি দলের কথা জানি, যারা একাডেমিতে শো করলো, টিকিট বিক্রি না করে, নাটক শেষে দর্শকদের থেকে আর্থিক সাহায্যের প্রত্যাশার কথা জানানো হলো, অভিমানী চালক বললেন “নাহলে আমাদের বঞ্চিত বাঞ্চোৎ হয়েই থেকে যেতে হবে” l মিথ্যে বলব না, বঞ্চিত বাঞ্চোৎ ওনাদের নাটকের সংলাপের মধ্যে ছিল বটে, সেখান থেকেই হয়তো ডায়লগটা এক্সটেম্পো উধার নেওয়া l নাটক শেষে শুধু আমরাই ভিতরে গিয়ে দুটো টিকেট বাবদ ২০০ টাকা দিয়ে এসেছিলাম l আর কাউকে যেতে দেখিনি l সেদিন খুব খুশি হয়ে দারুণ নাটক, এদের সাহায্য না করলে নাট্য-অপমান হবে এমন ভাবনা থেকে টাকা দিই নি, দিয়েছিলাম এই কারণেই যে, আমি টিকেট কেটেই তো নাটক দেখি... আর যে জায়গায় বসে দেখছি, তার দাম ১০০ টাকাই হওয়ার কথা l তবে শুনেছি, ওই নাটকের পরের শো-তে নাকি দলের অবস্থান বদলানো হয়েছে, ফ্ল্যাট টিকিটের ব্যবস্থা, দাম ৪০ টাকা l শুনে একবার মনে হলো, যাঃ... , তারপরেই মনে হলো যাগ্গে l
নাটকের টিকেটের দাম নিয়ে যে কথোপকথন চলে, তাতে মাঝে মাঝেই দেখি, যথাযথ দর্শকের অভাব l নাকি দর্শকের যথাযথ অভাব! নাটকে আজ আর লোক হয় না l এ দোষ লোকের ঘাড়ে বর্তায় নাকি নাটক-কর্মীদের সে নিয়ে তর্ক হতে পারে l কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা ইস্যু নয় l প্রাণিত নাট্যকর্মীদের অনেককেই এ ব্যাপারে দুটো পক্ষকে গাল দিতে শুনেছি, শুনেছি এসবের জন্যে দায়ী পূর্বতন নাট্যদলেরা, আবার শুনেছি দায়ী হলেন সফল নাটক কর্মীরা l
কিছুদিন পত্রিকা করা গিয়েছিল এই জীবনকালে l মনে আছে তার প্রথম সংখ্যার দাম হযেছিল ৫ টাকা, বিশুদ্ধ গাঁজা সিগরেটে ভরে পাতিরামে প্রথম সংখ্যা রেখে আমি আর আমাদের সম্পাদক সামনে দাঁড়িয়ে টান মারছিলাম, টেনশনে, কেউ কি আসবে, এলো কি কেউ, সোজা তাকাচ্ছিলাম না, থামের পাশে একটু আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে l আমার চাহিদা বাড়াবাড়ি, কেউ কিনুক, সম্পাদক মোর প্র্যাকটিকাল, সে চাইছিল কেউ দেখুক l দুজনের চাহিদাই সেদিন পূর্ণ হয়েছিল, তবে দাঁড়াতে হয়েছিল সোয়া তিন ঘন্টার মত l কাঙালপনা ছিল আমাদের, কিন্তু ছোটলোকোমি ছিল না, ছোট ছিলাম যদিও l সাবান মাখতাম রোজ, সস্তার হলেও, আত্মা সাফসুতরো রাখতে (তক্ক করার জন্যে আবার এখানে থেয়িস্ট-টেয়িস্ট নিয়ে কথা বলবেন শুরু করবেন না, ওটা উপমা, প্রয়োজনে বড় আমি ছোট আমি ইত্যাদি বসিয়ে নিয়েও ভাবতে পারেন), মলিন জামাই পরতাম, তবে উলঙ্গ হয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে মাগ্গি গন্ডার বাজারে খেমটা না নাচার পথকেই ঠিক বলে মনে করতাম l আমাদের অপ্রতুলতা ছিল না, তৈরি করতে পেরেছিলাম লেখকগোষ্ঠী l শিবের এ গীতের সূচনা করেছিলাম এই কথাটুকু বলতে যে, পাঠককে অপরিণত ভাবার মত ধৃষ্টতা ছিল না আমাদের l তবে এমন নয় যে আমাদের উন্নাসিকতা ছিল না, আমরা টার্গেট গ্রুপ ঠিক করে নিয়েছিলাম l যে পড়তে পারে সে কেন আমার পাঠক নয় বলে দুর্ভাবনা করতাম না l ৩০০ কাগজ ছাপা হলে ১৫০ উই-খাদ্য হলো বলে যাদের গাল পাড়তাম, তারা আমরাই l
আপনি নাটক করলে লোক না হলে, টিকেট না বিক্রি হলে দর্শক তৈরি নয় বলে গাল না দিয়ে আয়নার সামনে প্র্যাকটিস করে দেখুন, আপনার না মাইরি ওটা হচ্ছে না l মানে নাটকটা l ফিরে যান, টু দ্য বেসিক, ফিরের থেকে শুরু করুন, লেগে থাকুন, হাল চাষুন, হলধরদের মত, দলকে পাপড়ি হিসেবে দেখুন, দলবাজির ক্ষেত্র নয়, দেখবেন, আপনার সীমিত ক্ষমতা নিয়েও আপনি কিছুদূর যেতে পারবেন l কিছু্দূর, কেননা যদি আপনি বয়স্ক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি সেই সোনার সময়টা ফেলে এসেছেন, যখন দিনে ১৫০০ স্কিপিং করে নাট্যতত্ত্ব পড়ে মহলায় যাওয়া আর সম্ভব নয়, শরীর দেবে না, আপনিও তো জানেন যে দেহপট সনে নট সকলি হারায় l মন খারাপ করবেন না, মন ভালো করুন, ভালো নাটক করার চেষ্টা করুন, দেখবেন আপনার নাটকেও একটু একটু করে লোক হবে l টিকেট কেটেই লোকে নাটক দেখবে l খিস্তি করতে হবে না l
এই যে ১০০, ২০০, ৩০০ র টিকেট বিক্রি করে নাটক হলো, সেখানে তো হল প্রায় ভরাই ছিল l একটা কূট প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, যে যারা এ নাটক দেখেন, তারা আপনাদের টার্গেট গ্রুপ নন l হতে পারে, হতেই পারে, সে কারণেই তো আপনারা নতুন দর্শক তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন, কিন্তু সে নাটক হবে কোথায়? কার্জন পার্কে কি আর পারমিশন পাওয়া যাবে? নাকি ফিরে চল মাটির টানে বলে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা হবে? কী জানি, নাটকের কী কাজ? তবে নাটকের প্রথম কাজ বোধ হয় নাটক করা, আর নাটকটাই করা, কেউ সেটা সারাক্ষণের কাজ হিসেবে করতে পারেন, কেউ না-ই বা করতে পারেন l সারাক্ষণ হাল চাষ করলে গোলা ভরার সম্ভাবনা বেশি, তবে সেটা সম্ভাবনামাত্রই, কারণ হাল আপনি কেমন করে চাষ করতে জানেন তার উপরেই তো নির্ভর করে ফসলের গুণ ও মান l
তাহলে, শুরু করবে শুরু করো... উর্ভশী, উর্ভশী, টেক ইট ইজি উর্ভশী...