কাল দেখে এলাম কারুবাসনা। রাতে মিটিং ছিল তিনটে অবধি। তারপর ঘন্টা আষ্টেক ঘুমিয়ে ভোর এগারোটায় উঠে খেলাম-দেলাম, আধো জাগরণে লিখে ফেললাম এটা। তাতে ব্যাপারটা একটু অগোছালো হল, সে হোক। এমনিই এ তো রিভিউ হচ্ছেনা কিছু। বড়জোর এক দর্শকের প্রতিক্রিয়া। হয়তো অনেক কিছুই ভুল আছে, হয়তো পরে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে অনেক কিছুই বদলে যাবে। কিন্তু তাতে কী। প্রথম প্রতিক্রিয়ারও তো একটা মূল্য আছে। --------------------------------------------------------------
কাল নাটক দেখতে ঝপ করে চলে গেলাম মধূসুদন মঞ্চে। লোকে ভর্তি ছিল প্রেক্ষাগৃহ, চারুকেশীতে মৃদু আলাপ হচ্ছিল সেতারে। অভিনীত হবার কথা ছিল 'কারুবাসনা'। সুবেশ-সুবেশাদের ভিড় ছিল। আমারও একটু ভয় ছিল। এইরকম জমায়েতে ভয় থাকেই একটু। একে তো জীবনানন্দ, তদুপরি সেতার। চারদিকে মেঘ ও রৌদ্রের আনাগোনা, আর আমি আনপড় লোক, এই নবফাল্গুনের দিনে স্রেফ একখানা টিশার্ট বাগিয়ে হয়তো চলে এসেছি ভুল চরাচরে। এসব তো হয়। জ্যান্ত কবিরা ট্রামে চাপা পড়েন, আর বেতালা সওদাগর ওস্তাদি গানের আসরে, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে ভুল তাল দেয়।
সেতার অবশ্য থেমে গেল নাটকের শুরুতেই। কিন্তু তাতেই বা আশ্বাস কোথায়? নেহাৎই শুদ্ধস্বরে মোনোফনিক একটা সুর শুরু হল পরিবর্তে। শুনতে কীরকম ন্যাড়া লাগল। সঙ্গে কারুবাসনার সেই আইকনিক সংলাপ। দুধ খাওয়া নিয়ে। এক গ্লাস দুধ। কীভাবে জোগাড় হবে, স্বামী-স্ত্রী কে খাবে, সেই নিয়ে, নীরব, শীতল, নিষ্ঠুর একটা ব্যাপার, যাতে এই ভদ্রলোকীয় পরিবারের প্যান্টুল একটানে একদম খুলে যায়। শান্তভাবে। হিংস্রতা লুকিয়ে থাকে নিথর বাঘের মতো, ঝোপের আড়ালে। পচা-গলা লাশ সে খুঁটে খুঁটে খায়। কিন্তু ঝোপের ওদিক থেকে দেখা যায় শুধু তার শান্ত, সমাহিত ভঙ্গী।
তা, অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে মোটেই এরকম শান্ত ও নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিলনা। বরং একটু বেশিই চালাক মনে হচ্ছিল। মোনোফোনিক আবহও, একটু ন্যাড়া যেন। নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুজন, অনির্বাণ এবং সুজন মুখোপাধ্যায়। বোঝা যাচ্ছিল, চরিত্রকে দু-টুকরো করা হয়েছে। সুজন একটু আত্মমগ্ন, আর জগতের প্রহসনকে উন্মোচন করার দায়িত্ব অনির্বাণের। কিন্তু, মনে হচ্ছিল, প্রহসন উন্মোচন করতে গিয়ে নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতাটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, মেজকাকার সংলাপ, হুবহু উপন্যানুসারী, সেটা একটু ছেঁটেকেটে নিলে কীইবা ক্ষতি ছিল। ক্রুর, নির্লিপ্ত, সাটল হলে হয়তো নাটকে ভালো লাগত। এইসব মনে হচ্ছিল। শুরুর মিনিট দশ।
তখনও অবশ্য জানা নেই, এরপর কী হতে চলেছে। সেটা বোঝা শুরু হল, দৃশ্য এবং অভিনেতা বদলে যাবার তালে-তালে। দৃশ্যায়ন নিয়ে হলের বাইরে দুকথা বলছিলেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। কীভাবে দৃশ্যায়নটা মাথায় এল। কিন্তু ইতিহাসের চেয়েও মঞ্চের ভূগোলটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভূগোলে ঠিক কী-কী ছিল বলা কঠিন। ছবি তুলতে পারলে খুঁটিয়ে দেখে বলা যেত, কিন্তু ছবি তোলা বারণ। বাক্স-টুল-মই-সোপান-অদ্ভুত-দর্শন এক ইন্সটলেশন, এবং কিছু লেখার জায়গা, যাতে হরবখৎ কবিতার লাইন লেখা হচ্ছিল। খুবই এবড়োখেবড়ো একটা ব্যাপার, কিন্তু মুডের সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল তার উপরিতল, টেক্সচার, গঠন, প্রকার এবং প্রকরণ। এবং অধিকাংশ সময়ে, পুরোটাই চলতে চলতে হচ্ছিল, কখন যে ফুটপাথ বদলে গেল, টের পাবার উপায় নেই। আরও একবার দেখলে নির্ঘাত খেয়াল করে মনে রাখতে পারব। কিন্তু না মনে রাখতে পেরেও বিশেষ আফশোষ নেই। লোকে তো শিল্পের গঠন বুঝতে শিল্প দেখেনা, রসাস্বাদন করার জন্য দেখে। ওইটুকুই যথেষ্ট।
তো, এইভাবেই বদলে যাচ্ছিল মঞ্চ। একটু-একটু করে বদলে যাচ্ছিলেন অনির্বাণ। নায়কের বাবা-মা-পিসি-বৌ সবাই জড়িয়ে যাচ্ছিলেন নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতায়। সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল আবহ। শুরুর ওইটুকু কি তবে ইচ্ছাকৃত? কে জানে। এইটুকু খালি জানা আছে, যে, শুদ্ধস্বরের সঙ্গে এবার লাগছিল কোমল ধা এবং নি। বেহালা এবং সেতার বাজছিল পরপর। বোঝা যাচ্ছিল, শুরুর স্বর স্রেফ চোখে-ধুলো-দেওয়া উদ্যোগপর্ব ছিল। আসলে সেই শুদ্ধস্বর ছিল প্রস্তুতি, আসলে যা হয়ে উঠবে চারুকেশী। বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যায়ন। অনির্বাণ মাঝে-মাঝেই একটু-একটু সুজন হয়ে যাচ্ছিলেন, আর সুজন একটু-আধটু অনির্বাণ। আর নাটকের ঠিক মাঝখানে এসে, দেখা গেল, দুজন শারীরিক ভাবে জুড়ে গেলেন। পিছনে, যদ্দূর মনে করতে পারছি, সেই মুহূর্তেই বেহালা সিম্ফনী হয়ে গেল। সেও ভেঙে দেওয়া চারুকেশীতেই। পাশ্চাত্যে এই স্কেলটার নাম মেলডিক মাইনর। ঝপাঝপ মিলে গেল তারাও।
এরপর যা ঘটল তা আর মনেই নেই ঠিকঠাক। মানে, ঘটনাবলী, সংলাপ মনে আছে, কিন্তু কীসের পর কী হল, মনে নেই। কারণ, জলের মধ্যে মাছ খানিক বাদে আর জলকে টের পায়না। আমিও পাইনি। ওভাবেই চলল বাকিটা। আবেগ বাড়ল, কমল, মঞ্চ বদলে গেল, আবহ পুরো পশ্চিম থেকে আবার প্রাচ্যে ফিরে এল, নানা নড়াচড়া হল। কিন্তু সেগুলো জরুরি না। জিনিসটার মধ্যে যে পুরো ঢুকে গেলাম, সেটাই জরুরি। কেন ঢুকে গেলাম? জীবনানন্দের গদ্য নিয়ে সন্দীপনই বোধহয় লিখেছিলেন, যে, জিনিসটা অকারণে ফেঁপে ওঠে, যেখানে-সেখানে ফুলে, বেড়ে যায়, মশারির মতো, এবং কী আশ্চর্য, তারপরেও সেটা অসাধারণ গদ্যই থেকে যায়। সন্দীপন বোধহয় এই ভাষায় বলেননি, আমার ভাষা ঢুকে গেল। কিন্তু সে যাই হোক, এই নাটকে, জীবনানন্দের গদ্যের এই চলনটা চুপচাপ ফুটে উঠেছে। ফুলে ওঠাগুলো নিয়ে সবাই একমত নাও হতে পারেন। না হওয়াই স্বাভাবিক। আমিই সর্বক্ষেত্রে হইনি, প্রথমাংশে, সে তো লিখেইছি। এটা একটু কম চড়া হলে ভালো হত, ওটায় একটু নড়াচড়া বেশি থাকলে ভালো হত, এইটাই কী দরকার ছিল, এইসব খুচরো জিনিস মাথায় এসেছে। কিন্তু সে তো জীবনানন্দের গদ্য পড়েও আসে। বস্তুত, জীবনানন্দের কারুবাসনার প্রতি আমার একটি ব্যক্তিগত ট্রিবিউট আছে, যার নাম খেরোবাসনা, সেখানে আবেগের এই ফুলে ওঠাটা পুরোটাই বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেও একরকম দেখার ভঙ্গী। কিন্তু কথা হল, তারপরেও আপনি হাঁ করে এই জিনিসটা দেখবেন কিনা। আমি দেখেছি। হাঁ করেই। আমরা আনপড় লোক, সকালে ঘুগনি খাই, দুপুরে ডিমভাজা, রাতে ওয়েব-সিরিজ। আমাকে হাঁ করিয়ে যা রাখে, তার তো জোর আছেই।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।