আব্দুস সাত্তার সাহেবের জীবন যদি আমরা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো তিনি একজন সফল মানুষ। বর্তমান সমাজে সফল মানুষের যে সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়েছে তার সাথে খাপে খাপ মিলে যায় আব্দুস সাত্তার সাহেবের জীবন কিন্তু তবুও যদি খুব ভালোভাবে, একান্ত নিবিড়ভাবে সাত্তার সাহেবকে দেখা যায়, যেমন তিনি যখন খুব একা থাকেন এবং একা একা কোন কারনে হেসে উঠেন, সেই দুর্বল মুহুর্তে আমরা যদি হুট করে তার ভিতরে প্রবেশ করি তাহলে দেখতে পাবো যে হাসিখুশি চেহারার সফল মানুষ হিসেবে পরিচিত সাত্তার সাহেবের ভিতরে রয়েছে এক বিশাল শূন্যতা। সেই শূন্যতাকে সংজ্ঞায়িত করার মত কোন ভাষা আমাদের জানা নেই কিন্তু যেহেতু আমরা এখানে সাত্তার সাহেবকে নিয়ে কথা বলছি তাই তার ভেতরের যে শূন্যতা আমরা দেখতে পেয়েছি তা যেকোন ভাবে প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব এবং সে দায়িত্বের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে আমরা বলতে চাই যে সাত্তার সাহেবের ভিতরের যে শূন্যতা তাকে কেবল বেজোড় সংখ্যক সদস্য বিশিষ্ট পায়রার ঝাঁকের সাথে তুলনা দেয়া যায়। অথবা সাত্তার সাহেবের ভিতরের শূন্যতা হয়ত আরো বেশি যা এক পৃথিবী অথবা দুই পৃথিবী পায়রা দিয়েও পরিমাপ করা সম্ভব না।
কোন একটি জায়গায় গুপ্তধন পাওয়ার কথা থাকলে এবং সেখানে গুপ্তধন খুঁজে পেলে মানুষেরা বিস্মিত হয় না কিন্তু বিস্মিত হয় যদি এমন কোথাও গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে গুপ্তধন পাওয়ার কথা ছিল না। ঠিক তেমনি সাত্তার সাহেবের ভিতরে এই যে গাঢ় এবং আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল শূন্যতা তা আমাদের কাছে পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল সুতরাং আমরা এতে বিস্মিত হলাম এবং সাত্তার সাহেবকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলাম, “সাত্তার সাহেব, আপনার ভিতরে এই যে বিশাল শূন্যতা একে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?”
সাত্তার সাহেব আমাদের প্রশ্ন শোনে অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর সামান্য সময় নিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললেন, “আপনাদের কী মনে হয়?”
আমরা হতাশ মুখে সাত্তার সাহেবকে জানালাম যে আমাদের কোন কিছু মনে হয় না। এইরকম শূন্যতার সাথে আমরা পরিচিত নই। আমরা যেইসব আকাশ এবং রূপকথার গল্প বলি ও লিখি তাতে এত বিশাল শূন্যতা কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও কখনো থাকবে না এর বন্দোবস্ত করা আছে। সুতরাং এই শূন্যতা আমাদের অপরিচিত এবং এ সম্পর্কিত বিষয় আসয় বিষয়ে আমরা “আন ইজি” ফিল করি।
সাত্তার সাহেব সিগারেট ধরালেন। তার সিগারেট টানার দৃশ্য চমৎকার। তিনি ফিল্মে দেখা আল পাচিনো অথবা রবার্ট ডি নীরোর মত সিগারেটে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, “তাহলে তোমরা তো মূল জিনিসটাই জানো না!”
আমরা না জানায় লজ্জিত হলাম। আমরা বুঝতে পারলাম সাত্তার সাহেব আমাদের এই না জানায় আহত হয়েছেন এবং হয়ত সে কারনেই তিনি আমাদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে আপনি থেকে সরে এসে তুমি করে বলছেন। আমরা আমাদের আপনি অবস্থান হারানোতে দুঃখ পেলাম এবং বললাম, “আপনি ভুল করছেন। আমাদের কাছে এই জিনিসটা আসলে মূল ব্যাপার না। এটি আমাদের জীবনের সাথে সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিক।”
সাত্তার সাহেব বললেন, “হুম! আচ্ছা বল তো দেখি আমার ভেতরের শূন্যতাকে দেখে তোমাদের কী মনে হয়েছিল?”
আমরা বললাম, “আমাদের মনে হয়েছিল এ শূন্যতা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তবুও আমরা চেষ্টা করেছিলাম এই শূন্যতাকে বেজোড় সংখ্যক সদস্য বিশিষ্ট পায়রার ঝাঁকের সাথে তুলনা দিয়ে প্রকাশ করতে। তবে আমাদের পরক্ষনেই মনে হয়েছিল এক বা দুই পৃথিবী পায়রাতেও হয়ত আপনার শূন্যতার পরিমাপ হবে না।”
সাত্তার সাহেব সামান্য শব্দহীন হাসি হাসলেন। আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘পায়রা সম্পর্কিত তোমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা কী?”
আমরা হঠাৎ এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। আমরা কোন উত্তর দিতে পারলাম না। এবং এক পর্যায়ে বললাম,” ক্ষমা করবেন। আমাদের পায়রা সম্পর্কিত নিজস্ব কোন চিন্তাভাবনা নেই।”
সাত্তার সাহেব তার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তা ফেলে দিলেন এবং ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পায়রা হচ্ছে পৃথিবীর আত্মার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি পায়রা আসলে পৃথিবীর আত্মার এক একটি অংশ। মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে পায়রাদের জীবন। প্রতিটি মানুষের আত্মা আসলে এক একটি পায়রা অথবা কোন এক পায়রার প্রতিচ্ছবি যা পৃথিবীতে বসবাসরত এবং আকাশে উড্ডয়নরত অনেক অনেক পায়রার প্রভাবে প্রভাবান্বিত। এইসব পায়রাযুক্ত জীবন হয়ত যাপনকারী ব্যক্তি অনুভব করতে পারে না কিন্তু কারো অনুভব করা কিংবা না করার উপরে পৃথিবীর অমোঘ সত্যগুলোর কিছু আসে যায় না।”
“পায়রাসংশ্লিষ্ট জীবনের বিভিন্ন ফাঁক ফোকড়ে লুকিয়ে থাকা অজস্র গল্পমন্ডলী দিয়েই পৃথিবীর তাবত ইতিহাস।
তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পারলে?”
সাত্তার সাহেব আমাদের প্রশ্ন করলেন। কিন্তু আমরা তার কথায় পুরো বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। পায়রাদের ব্যাপারে তার কথাগুলো সত্য হলে আমরা তার ভিতরের শূন্যতাকে এক অর্থে পৃথিবীর শূন্যতাই বলেছি। কিন্তু আব্দুস সাত্তার একজন সামান্য মানুষ। তার ভিতরে কেন পৃথিবীর শূন্যতা জমা হবে? আমরা এর কোন ব্যাখ্যা খুজে পাচ্ছিলাম না। এই না পাওয়া ব্যাখ্যাতীত জিনিস আমাদের শরীর বেয়ে উঠছিল লাল পিপড়ার মত এবং তাদের তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে আমাদের বিদ্ধ করে যাচ্ছিল অবিরত। আমাদের কাছে ব্যাপারটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়াল এবং আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দেখতে চাইলাম আসলে সাত্তার সাহেবের ভিতরের এই যে বিশাল শুন্যতা এর কারণ কি এবং উৎসই বা কী।
আমরা যেহেতু আর কথাবার্তার দিকে যাচ্ছিলাম না সুতরাং সাত্তার সাহেব কোন কথা বললেন না। তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আসল। মনে হল যেকোন সময় তিনি পড়ে যাবেন। আমাদের শক্তিও কমে আসছিল। যেকোন সময় আমাদেরও চলে যেতে হবে সুতরাং সর্বশক্তি দিয়ে আমরা সাত্তার সাহেবের চোখের দিকে তাকালাম। তার ঘোলাটে চোখে একের পর এক দৃশ্য চলে আসছে। সাত্তার সাহেব তার গত জীবনকে দেখে নিচ্ছেন এক পলকে। আমরাও আমাদের শক্তি ব্যবহার করে দেখতে শুরু করলাম কারন আমাদের ভিতর তখন আগ্রহ প্রবল সাত্তার সাহেবের ভিতরের শূন্যতার কারন জানার।
আমরা দেখতে পেলাম ছোট একটি সাজানো বাড়ি, মানুষের হৈ হুল্লোড়,গরুর গাড়িতে বোঝাই করা হচ্ছে জিনিসপত্র এবং কাপড় চোপড়। আমরা বুঝতে পারলাম এই ঘরের লোকেরা এবং আশপাশের ঘরের লোকেরা অতি দ্রুত কোথাও চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিকেলের ম্লান আলো, অনেক অনেক মানুষ, কিন্তু আমাদের চোখ খুজতে লাগল সাত্তার সাহেব কে, কারণ তিনিই আমাদের সাবজেক্ট। আমাদের কৌশলী চোখ বিভিন্নভাবে প্রায় সব জায়গায় তার খোজ করতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমরা তাকে দেখতে পেলাম না এবং বুঝতে পারলাম যেসব মানুষ জড়ো হয়েছেন বাড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবার জন্য তারাও সাত্তার সাহেবকে খুঁজে পাচ্ছেন না। আমরা অবাক হলাম এই ভেবে যে সাত্তার সাহেব কি আমাদের বোকা বানালেন! খানিকক্ষণ পড়ে আমরা শুনতে পেলাম, বাড়ির কর্তা চিৎকার করে ডাকছেন, “সাত্তার, সাত্তার! ছেলেটা গেল কোথায়!”
আমরা তার কন্ঠ শোনে বুঝলাম তিনি সাত্তার সাহেবের বাবা। কন্ঠ শোনে এই বুঝার ক্ষমতা আমাদের দেয়া হয়েছে।
সাত্তার সাহেবের ভাইয়েরা, তার মা এবং বোনেরা সহ সবাই তার খোজ করতে লাগলেন। আমরাও ঘটনাক্রমে ঘটনার মধ্যে ঢুকে গেলাম এবং সাত্তার সাহেবের খোজ করতে লাগলাম।
আমরা এক পর্যায়ে কৌতুহলের বশে সাত্তার সাহেবকে খোজতে খোজতে তার ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”
সাত্তার সাহেবের ছোট বোন আমাদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “দাঙ্গা লেগেছে। আমরা বাংলাদেশে চলে যাচ্ছি। ওখান থেকে হিন্দুরা আসছে এখানে।”
ঠিক তখন আমরা দেখতে পেলাম সাত্তার সাহেবের বাবা একটা ঝাঁকড়া আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বলছেন, “নাম, বলছি, নাম।”
এক বালক নেমে এল একটু পড়ে।
আমরা চিনতে পারলাম ইনিই সাত্তার সাহেব। তবে তখন তার বাল্যকাল।
সাত্তার সাহেবের বাবা তাকে ঠাশ ঠাশ করে দুটি চড় মারলেন এবং হাত ধরে টেনে গাড়ির দিকে টেনে নিলেন।
আর সাত্তার সাহেব যেতে যেতে চোখভরা পানি নিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখছিলেন তার বাড়ির উঠানের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ ঝাঁকড়া আম গাছকে।
সেই চোখে জমে থাকা পানির দিকে তাকিয়েই আমরা সাত্তার সাহেবের ভেতরের শূন্যতার উৎস বা কারণ খুঁজে পেলাম। এই শুন্যতা আসলে সাত্তার সাহেব এবং একটি সবুজ ঝাঁকড়া আম গাছের নির্দিষ্ট কিছু দুঃখ।