বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ এই লেখায় ব্যোমকেশের কাহিনী বিবৃত করা হবে না, আলোচনা করা হবে না এই ব্যোমকেশ ব্যোমকেশ হিসেবে সফল না অসফল তা নিয়ে, তুলনা করা হবে না পূর্ববর্তী নানা ব্যোমকেশের সঙ্গে, কে কেমন অভিনয় করেছেন তা নিয়ে একটি শব্দও থাকবে না কেননা সেটা নিতান্তই গৌণ বলে মনে করছেন প্রতিবেদক। বরং এই ব্যোমকেশকে যেভাবে পড়া যায় সেভাবেই পড়ার চেষ্টা এখানে করা হল। মনে হয় না প্রচলিত ছবি আলোচনার পদ্ধতিতে দিবাকরবাবুর ব্যোমকেশকে ধরা যাবে।
দিবাকর ব্যানার্জি ইতিপূর্বে প্রমাণ করেছেন যে তাঁর আন্তর্জাতিক সিনেমার সঙ্গে মোটের ওপর পরিচিতি রয়েছে। কখনো আলেহান্দ্রো গনজালেজ ইনারিতু প্রতিম নেটওয়ার্ক ন্যারেটিভের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি (‘লাভ, সেক্স আউর ধোঁকা’), কখনো ভারতীয়করণ ঘটিয়েছেন কোস্তা গাভরাসের ‘জেড’ এর মত ক্লাসিক ছবির (‘সাংহাই’)। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ব্যোমকেশের জন্যে তাঁর দর্শকের মানসিক প্রস্তুতির অভাব ছিল বলেই মনে হচ্ছে চারপাশের প্রতিক্রিয়া দেখে। বাংলায় এ ছবি করলে তাঁর এমনকি প্রাণ সংশয় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমনটাই আমার অন্তত মনে হচ্ছে। একটা ওয়েল-ডিফাইনড লিটারারি টেক্সটকে চলচ্চিত্রের বয়ানের অন্তর্ভুক্ত করলে তার নানা ইন্টারপ্রিটেশন উঠে আসে স্বাভাবিক নিয়মেই, এবং দর্শকের কাছে সেটা সবসময় রুচিকর নাও ঠেকতে পারে। এজন্যেই অনেকে নিজের ছবি-করিয়ে হিসেবে স্বাধীনতাটা বজায় রাখার জন্য স্বল্পপরিচিত বা অপরিচিত টেক্সট বেছে নেন, ফলে তার পাঠের ধরন নিয়ে আর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু দিবাকর যে কাজটি করেছেন তার নজির অন্তত ভারতীয় মূলধারার ছবিতে খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যোমকেশের এমন (অ)বিনির্মাণ, গোটা ক্যাননকেই কার্যত হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া অথচ তাকে নিপুণভাবে ন্যারেটিভের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, ইতিপূর্বে দেখেছি বলে মনে করতে পারিনা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি দিবাকরবাবুর ব্যোমকেশ সম্ভবত শরদিন্দুর প্রতি বিশ্বস্ততম। চরণে চরণে তাঁর সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কেননা ছবির এস্থেটিক নানা পরিবর্তন ইতিমধ্যে ঘটে গেছে, ভারতীয় মূল ধারার সিনেমায় প্রভাব রেখেছেন যারা তাদের নামগুলো বদলেছে। ফিল্ম টেক্সটে সত্যান্বেষী, পথের কাঁটা, অর্থমনর্থম, উপসংহার, মগ্ন মৈনাক এবং চিড়িয়াখানা মাঝে মাঝেই অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ঢুকে পড়েছে, অথচ ছবির কোন ন্যারেটিভ ক্লোজার নেই। এই স্বচ্ছন্দগতি এবং স্বাধীনতা দিবাকরকে সাহায্য করেছে তাঁর ছবির অন্য দুই দিকের পুষ্টিসাধনে, যে দুই দিক এ ছবি প্রসঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়ার দাবী রাখে। এইবার সরাসরি সে প্রসঙ্গে যাই।
প্রথম হল সিনেমাটোগ্রাফি। গ্রীক চিত্রগ্রাহক নিকোস আন্দ্রিতসাকসিস ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানিয়েছেন কিভাবে চিরাচরিত সিপিয়া রঙে ছবিকে মুড়ে দিয়ে তাকে পিরিয়ড ফিল্ম করে তোলায় তিনি অনাগ্রহী ছিলেন, বরং আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে এক ধরনের রেট্রো দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করাই তাঁর কাম্য ছিল। হিন্দি ছবির নিজের অতীতের দিকে ফিরে দেখা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নয়, কিন্তু ব্যোমকেশ তাকে একটু বিশেষ মর্যাদা দান করে। আবার কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দি জনপ্রিয় ছবির যে কাঠামো তা থেকেও ব্যোমকেশ স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় বিশ্বাসী, এ যেন ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে চিরচেনা শহরকে দেখা, যেন ব্যোমকেশের প্রোজেক্টেড শহর রয়েছে একটা আস্তরণের আড়ালে আর তার এপাশ থেকে সেটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে ক্যামেরা আই। নিকোসের অস্ত্র ছিল দুটি। এক হল অতীতের সিনেমার মত হার্ড এবং ডিরেকশনাল লাইটিং আর নায়িকার, এই noir র ফাম ফাতালের, সিডাকট্রেসের উপরে সফট লাইটিং। দু ধরনের আলোকসম্পাতের বৈপরীত্য এখানে এক ধরনের বিরোধাভাস তৈরি করে, যা অতীতের সিনেমায় ছিল। দুই হল noir র উপযোগী আলো ছায়ার এক্সপ্রেশনিজম। এই জঁরের ছবি প্রসঙ্গে নিকোস বিশেষভাবে একটি নিও-নোয়া প্রসঙ্গ আনেন, সে ছবিটি হল সেই চিরকেলে রোমান পোলানস্কির ‘চায়নাটাউন’ (ইতিমধ্যেই এর একটি সফল adaptation হিন্দি ছবিতে হয়েওছে, আমি ‘মনোরমা সিক্স ফিট আন্ডার’ প্রসঙ্গে বলছি)। নিকোস নিজে গ্রীক এবং প্রথম জীবনে গ্রীক ছবিতে কাজ করতেন, পরে লন্ডন ফিল্ম স্কুলে পড়ার সূত্রে ইউরোপ জুড়েই কাজ করে বেড়াতেন তিনি, বুডাপেস্ট সহ পূর্ব ইউরোপের নানা অঞ্চলে চিত্রগ্রাহক হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এখানে উল্লেখ করা হয়ত অসমীচীন হবে না যে গ্রীক নব তরঙ্গ নামক যে চলচ্চিত্র আন্দোলন এখন নিকোসের নিজের দেশেই চলছে তার দুই প্রধান উপাদানের একটি সুররিয়ালিজম এবং অপরটি ফিল্ম নোয়া। Noir-ish উপাদানের বাহুল্য গ্রীসের সমসাময়িক সিনেমায় রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের পরিচালকদের (নিকোস প্যানাইয়োটোপুলস প্রমুখ) ছবিতেও তা উল্লেখ্য।
ব্যোমকেশ বকশির অপর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর নানা জঁর নিয়ে নিরন্তর খেলা করার প্রবণতা। এত বেশি ক্রস-জেনেরিক কাজ আমি জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। এ ছবি স্পষ্টভাবেই নোয়া বা নিও-নোয়া অনুসারী, অন্যদিকে এর মধ্যে রয়ে গেছে স্পুফ ছবির নানা উপাদান, পূর্ব এশীয় গ্যাংস্টার ছবি, যাকে আমরা বলি ইয়াকুজা ফিল্ম, তার নানা উপাদান। নোয়া জঁরের অতলান্তিক পেরোবার সময়কাল ব্যোমকেশের সময়কালেই, সেই চল্লিশের দশক। জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্মমেকাররা নাৎসি জার্মানির বেড়াজাল পেরিয়ে মার্কিন দেশে পৌঁছে যান আর সঙ্গে নিয়ে যান তাঁদের সিনে-এস্থেটিক, যা নোয়ার জন্ম দিতে সাহায্য করে। পরে আবার নোয়া ইউরোপে ফিরে আসে, কিন্তু সে এক অন্য কাহিনী। আবার জার্মান-মার্কিন নোয়া নির্মাতাদের ছবিতে পূর্ব এশীয় ড্রাগ চালানদাতা, জুয়ার আড্ডা মালিক, ক্যাসিনো কর্তা ভিলেনের মত স্টক চরিত্রের অভাব নেই, জোসেফ ফন স্টার্নবার্গের ১৯৪১ সালের বিখ্যাত ‘সাংহাই জেশ্চার’ মনে করে দেখা যেতে পারে। পূর্ব এশিয়া প্রসঙ্গে এক ধরনের orientalist দৃষ্টি এই জাতের ছবির পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে। হালফিলে দাবী উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পূর্ব এশিয়ার ডিকলোনাইজেশন, বৈপরীত্য হিসেবে পূর্ব এশিয়াতেই বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং সময়ে নতুন কলোনিয়াল সেন্টার হিসেবে টোকিওর উদ্ভব, পূর্ব এশিয়াকে এক নির্দিষ্ট বয়ানে আবদ্ধ করে ফেলার প্রবণতা, এবং ঠাণ্ডা লড়াই উত্তর দুনিয়ায় সে থেকে বেরিয়ে আসা বিষয়ক আলোচনায় এশিয়াকে একটি মেথড হিসেবে পড়তে হবে (তাইওয়ানের স্কলার কুয়ান সিং-চেন এ নিয়ে একটি বিখ্যাত বই লিখেছেন)। আমাদের দেশের পপুলার কালচার, সিনেমা আর পাল্প ফিকশনে পূর্ব এশিয়ার উপস্থিতি কিন্তু একইভাবে এসেছে, স্বপনকুমার থেকে কিরীটী রচয়িতার কালো ভ্রমর সিরিজ মনে করুন। বাংলা সিনেমায় নানাভাবে পূর্ব এশীয় চরিত্র এসেছে, সে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’র চীনা হোক বা সত্যজিতের ব্যোমকেশে জাপানি পর্যটকের ছদ্মবেশ। আর পথের দাবী অবলম্বনে ‘সব্যসাচী’র কথা তো বলাই বাহুল্য (বাংলা সিনেমায় পূর্ব এশিয়ার উপস্থাপন নিয়ে ফেলিসিয়া চ্যান, এঞ্জেলিনা কারপোভিচ ও জিন ঝ্যাং সম্পাদিত পূর্ব এশীয় সিনেমা ও টেলিভিশনে জঁর আলোচনার সংকলনে মধুজা মুখোপাধ্যায়ের রচনাটি দ্রষ্টব্য)। দিবাকর নিজেও সাক্ষাৎকারে পথের দাবী, কালো ভ্রমর প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর ছবি ব্যোমকেশকে পরিচিত করে এক পপুলার কালচারাল আইকন হিসেবে, অন্তত এই আইকনের মেকিং এর জায়গাটা স্পষ্ট করতে চায় ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’। ইচ্ছাকৃতভাবেই তাই এই ছবি এবং বিশেষ করে তার শেষাংশ পূর্ব এশীয় গ্যাংস্টার ছবি বা ইয়াকুজা ফিল্ম এবং সেই ছবির স্পুফকে মনে পড়ায়। তাকেশি মিকের ‘ফর লাভ’স সেক’ বা আপিচ্যাটপং উইরাসীথাকুলের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব দি আয়রন পুসি’ যেমন এক্সটেণ্ডেড স্পুফ। স্পুফের ক্ষেত্রে নানা আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা থাকা স্বাভাবিক, একধরনের সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ এজাতীয় ছবি দাবী করবেই। আর ইয়াকুজা ফিল্মের ক্ষেত্রে তাকেশি মিকে বা পেন-এক রাতানারুয়াংয়ের ছবি আজ ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করেছে। দিবাকরের কাজে এঁদের প্রভাব আছে বলেই আমার মনে হয়েছে।
এই ক্রস জেনেরিক মহাযজ্ঞের আয়োজনে ব্যোমকেশ এবং শরদিন্দু ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে রয়েছেন, কেননা ৪০ এর দশকের শহর তার নানা অনুপুঙ্খ বাস্তবতায় অন্য কোন গোয়েন্দা কাহিনীতে আসতে পারে না। আর নোয়ার উপাদান শরদিন্দুর রচনায় প্রভূত, ব্যোমকেশের কাহিনীর ডার্ক, সিনিস্টার চেহারায় তার ছাপ আছে, আছে যৌন ঈর্ষা আর এসপিওনেজের কাহিনীতে (মগ্ন মৈনাক মনে করুন)। এই প্রতিটি উপাদানই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী এশীয় উপনিবেশগুলির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত, এবং যুক্ত ফিল্ম নোয়ার সঙ্গে। হালফিলের ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নির্মাতারা নোয়ার মোড়কে তাই মুড়ে ফেলছেন উত্তর-ঔপনিবেশিক শহরের মিথ আর বাস্তবতা (হোয়াও পেদ্রো রডরিগেজ ও হোয়াও রুই গেরা দা মাতার সাম্প্রতিক ‘দ্য লাস্ট টাইম আই স ম্যাকাও’ উল্লেখ্য)।
দিবাকরের প্রচেষ্টা তাই সমকালীন (কোন তুলনার মধ্যে যাচ্ছি না, যাওয়াটা উচিত নয়) এবং তাঁর ব্যোমকেশ তাই দর্শককে সঙ্গে নিয়েই ইতিহাসে প্রবেশ করে।