এক
কুয়াশার আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাড়ি। আর সেই বাড়িতে একলা আছেন এক মহিলা।টুকনুর দিদা।সাদা থান।সাদা চুল।চোখে সোনালী আলোর রঙের চশমা।চুলগুলো সাদা ধপধপে।পরিপাটি করে খোঁপা বাঁধা।একবার করে বারান্দায় যাচ্ছেন আর রান্না ঘরে পাটিসাপটার চাটুর কাছে আসছেন। ওই বুঝি ধরে গেল তলাটা।নারকেলের পুরটা কাঁচাগোল্লা দিয়ে ঠিক পাক হলো কিনা।এলাচের গন্ধটা বড় বেশি হয়ে গেল না তো?ছেলে দুটো সেই বালী থেকে আসবে আড়বেলিয়ায়।বড়দিনের ছুটি।কৌটো কৌটো ভরে রাখা আছে নতুন চিঁড়ের মোওয়া। মুড়ির মোওয়া। বাদাম চাকতি। তিলের নাড়ু।আর কৌটো ভরে পাটিসাপটা।
ছ্যাঁক।
শেষ পিঠের চাটুর আওয়াজ মিলিয়ে যাবার আগেই বাড়ির সামনে সাইকেল ভ্যানের আওয়াজ শোনা গেল। যে দুটো দামাল ছেলে এরপর থেকে চরকি বাজির মতো এই বাড়িটায় ঘুরে ফিরে বেড়াবে তারাই এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে দেবে সব কৌটোর সব কিছু। টুকনু আর তার দাদার আনন্দ তাই আর ধরে না। রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। সবেতে ‘ক’ পায়নি টুকনু। তাতে কী? এবার সে ক্লাস থ্রি। আর দাদার নতুন স্কুল। ক্লাস ফাইভ।ওরা ঝাঁপিয়ে পড়লো সব কৌটোগুলোতে।এমন ঝাঁপালো যে সেখান থেকে উমনো ঝুমনো,দুষ্টু রাখাল,পাশের খানার ধারের ল্যাঙড়া আমগাছের দুঃখী পেত্নী কেউই কিছুই ভাগ পেল না।
সব কিছু শেষ করে দেবার পরে টুকনু খুঁজতে থাকে পাটালী। মৌ ঝোলাগুড়।চিট-সন্দেশ।তার সাথে রান্না ঘর থেকে আরও অনেক কিছু এলো।পুলি,গোকুলপিঠে। আর ভোরবেলায় রমজান কাকার পেড়ে আনা খেজুর রস।কুয়াশা মাখা সকালবেলায় খেজুর রস পাট কাঠি দিয়ে শোঁ শোঁ করে আওয়াজ করে খেল টুকনু।নবান্নের ঘোরলাগা আলোয় একদিন দুই ভাই আবার চলেও গেল।পড়ে রইলো একলা বাড়িটা। পড়ে রইলো দিদা।একদিন সজনে ফুল ঝরা সকাল বেলায় তিনিও আর চোখ খুললেন না একটি বারের জন্যেও।মুর্শিদাবাদের গঙ্গার পাড়ের মেয়ে ইছামতীর তীরের এক গ্রামে তার সব গল্প নিয়ে টুকনুকে টাটা করলেন।আর বেচারা টুকনু আর তার দাদার পাট উঠলো আড়বেলিয়া থেকে।মনকেমনগুলো শুধু থেকে গেল পোঁটলা করে। পিঠের ওপর। একের পিঠে দুই হয়ে।
দুই
বড় লম্বা উঁচু পাঁচিলটাকে দেখলে মনে হয় প্রেসিডেন্সি জেল। টুকনু প্রেসিডেন্সি জেলের কথা কী করে জেনেছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করো বরং। সেই পাঁচিলের গা বেয়ে যেটুকু রোদ এসে পড়েছে সেই রোদে একটু একটু করে বসার জায়গা করে নেবে ওপার থেকে আসা মানুষ গুলো।দিদা নেই কাজেই বড়দিনটা এই বালির বাড়িতেই কাটাতে হয়।টুকনুর এখন ক্লাস এইট। পাড়ার ছেলেদের সাথে ফিস্ট করতে যাওয়ার পারমিশান পাওয়া যায়নি বাড়ি থেকে।পাটিসাপটা নেই।একমাত্র ডাক্তার কাকিমা কিস্কু পাঠিয়েছেন বাড়িতে বানানো কেক।কয়েকটা চকলেট।সেই দিয়ে কিছুতেই মন ভরছে না।গোরা কাকুর চিলেকোঠায় গিয়ে বিস্তর নালিশ জানিয়েছে সে।এই নাকি তোমাদের সাম্যবাদী সমাজ? প্রত্যেকের সমান অধিকার?বাড়িতে আসলে টুকনুর কোন ভয়েজ নেই। কেউ শোনেনা তার কথা। “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...ভিয়েতসংগ্রামী পল রবসন...”।গোরাকাকু কিছু বলে না। মিটিমিটি হাসে।কি একটা বই পড়ছে।পাশের কারো দেওয়া একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে তুলে দেয়।চীনে একটা কান্ড ঘটেছে সেটা কি তুই জানিস?টুকনুর বয়ে গেছে জানতে। তার হাতে নলেনগুড়ের সন্দেশ।তাতে আবার বড় বড় করে লেখা ‘বড়দিন’।
বাড়ি ফিরে সে এক্কেবারে হাঁ।চেয়ারের ওপর চেয়ার দিয়ে কুলুঙ্গির কাছ থেকে প্রেশার কুকার পাড়ছে বাবা।নীচে চেয়ার ধরে আছে দাদা।এই বাড়িতে বছরে দুই একবার প্রেশার কুকার পাড়া হয়।আর তাকে ওই উঁচু থেকে নামানো মানে টুকনুর বাড়িতে আজ...। দাদা মিচকি হাসে।
মটন।
মা পাতকো তলায় বসে মাংস ধোয়। টুকনু আর দাদা ঝুঁকে পড়ে দেখে।ঠায় রান্না ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকে।মাংসের সিটি গোনা হয়।বড়দিনের সবচেয়ে অবাক করে দেওয়া এক দুপুরে চোদ্দ মানুষের পাত পড়ে।সারাদিন ধরে নাকের কাছে বারবার হাত এনে মাংস খাওয়ার গন্ধ শোঁকে টুকনু।সেদিন ভালো করে কেসি নাগের অঙ্ক হয়।দাদা প্রায় গোটা তিনেক রচনা লিখে ফেলে। সেদিন পাড়ায় যাত্রা হয়। শান্তিগোপাল নেতাজি সেজে বলেন “তোমরা আমায় রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”।
তিন
বাড়িতে এখন একটা ফোন এসেছে। তার নাম্বার এখন টুকনুর নিজের নাম্বার।টুকনু এখন যাদবপুরে ফিল্ম নিয়ে পড়ে।সে জানতে পেরেছে নিউ মার্কেট বলে একটা জায়গা আছে।নাহুমের কেক আছে।পার্ক স্ট্রিটে আছে দেদার মজা। কলকাতার বন্ধুরা আছে।সিনে ক্লাবের দাদারা আছে।ফূর্তির অলিগলি ঘুরতে তার ভালো লাগে। কলকাতা পাল্টে যাচ্ছে। তার আশেপাশের মানুষগুলো পাল্টেছে।নিজে পাল্টানো টুকনুর কাছে বড়দিন মানে নেশা।বড়দিন মানে ঝলমলে আকাশ।বড়দিন মানে বান্ধবীর সাথে রেঁস্তোরা।খাওয়াগুলোর মধ্যে কোথাও তার কাছে কেক ছাড়া আর কমন কিছু নেই।তার বদলে চাউমিন আছে।এইট- বির মোড়ের রোল আছে। কবিতা লেখার ইচ্ছে হলে প্রজাপতি বিস্কুট আছে।সোলানাসের ছবি আছে।ওকাম্পোর রবি আছে।উল্টোডাঙার স্টেশনের সিঁড়ির নীচে বট আছে।নিজামের কাবাব আছে।বন্ধুর মেসে রান্না করা শুয়োর আছে। প্রথম চাকরীর মাইনে পেয়ে আকন্ঠ গিলে চিল্লোনো আছে। ফুটপাতে টোকো কমলা আছে।এই সব এতো কিছু আছের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার নেশা আছে।টুকনুর ঋত্বিক আছে...সত্যজিত আছে...গদার আছে। মৃণাল সেনের সেমিনার আছে।
চার
ম্যাসেঞ্জারে পিঙ এলো। লেখাটা কি এখনও হয়নি? ঈপ্সিতা চিন্তিত লিখতে দেওয়া মানে একশোটা কুঁড়েকে কাজ করতে বলা এটা এখন সে জেনে গেছে।টুকনু অনেক দিন আমার সাথে আর নেই। চুলে পাক ধরেছে। আর আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো আমার চারপাশে কোথা থেকে যেন চলে এসেছে দিদার পাটিসাপটা।সৌজন্যে উত্তরপাড়ার শীতলামাতা ভান্ডার।বাদাম চাকতি, তিলের নাড়ু, চিড়ের মোওয়া সৌজন্যে দিদিদের দশকর্মার দোকান।তবে গোটা বাড়ি ম ম করছে মাংস করার গন্ধে নয় কেকের গন্ধে।যে বয়সে টুকনু আর তার দাদা ঝুঁকে পড়তো প্রেশার কুকারে। মায়ের রান্নাঘরে। সেই বয়সে আমার ভাইঝি শ্রী বাড়িতে ইউটিউব দেখে নিজেই বানাচ্ছে কেক।তার কত উপাদান।কত সরঞ্জাম।সুইগি থেকে এসেছে পাস্তা আরও কত সব কি কি। যাদের নাম টুকনু খুব কম শুনেছে।
কিন্তু একটা জায়গায় ঠিক কোন পরিবর্তন হয়নি। সেটা হল আনন্দ।আনন্দটা একইরকম থেকে গেছে চলার পথে।আর কে না জানে?আনন্দ ভাগ করে নিলে বাড়ে বই কমে না।
টুকনু্র তরফ থেকে বড়দিনের একটা বড় শুভেচ্ছা রইলো গুরুর সবাইকে।
কল্লোল লাহিরীর লেখাগুলোর মস্ত বড় ফ্যান...অনেকদিন উনি লেখেন না... ওনার বেশ কটা পর্ব ধারাবাহিক ভাবে পড়েছি, মন্তব্যও করেছিলাম।