৮ই মার্চ, ২০১৮
-------------------
প্রতিমাদির কথা মনে পড়ছে খুব, জানো।
নারীদিবসের গোলাপি শুভেচ্ছা, সুললিত শুভেচ্ছাবাণীতে ফেসবুক ভরপুর। গয়নার দোকানের বিজ্ঞাপন, দোকানে দোকানে নারীদিবসের ভর্তুকিতে দামি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, খুব আনন্দ করছে অনেকে, কেউ আবার বিরাগ পোষণ করছে, অনেক পুরুষরা লঘু রসিকতাও করছেন। আমার প্রতিনিয়ত মনে পড়ে দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখা অন্তরালের বিজয়িনীদের কথা। তখন তো এত কিছু ছিলো না, থাকলে হয়তো কেউ তাঁদের সম্বর্ধনা দিতো। সে তো অন্যরকম সময় ছিল। দেশভাগের ক্ষত, মুক্তিযুদ্ধ, সপ্নদর্শী আত্মঘাতীর দল চারদিকে, ক্ষুৎকাতর সাহিত্য, সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য গোধূলি, ভালো কি মন্দ বোঝা যায়না। তারই মধ্যে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে সংসারের হাল ধরতে, সবার বাড়িতেই পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু আত্মীয়, দিশাহারা সময়। সেই অলাতচক্র ভেদ করেছেন যে সব মেয়েরা, যাঁরা করতে পারেননি, সবার কথাই মনে পড়ে, এইসব দিনে আরো বেশি।
মেয়েরা যে কি লড়াই জিততে পারে তার এক উদাহরণ প্রতিমাদি। উদয়পুর থেকে আগরতলার দূরত্ব আর কতো। কিন্তু তখন পরিবহন অপ্রতুল, গোমতী নদীর ব্রীজ তৈরী হয়নি, গাড়ি পার হয় দিনের নির্দিষ্ট সময় ফেরী নৌকায়। প্রতিমাদি সরকারি কাজে আগরতলা যচ্ছিলেন জিপে, অন্য একটি গাড়ির ধাক্কায় ডান হাত কেটে পড়ে গেল কনুই এর ওপর থেকে। নিয়তির সঙ্গে লড়াই অবশ্য তাঁর আরো আগে থেকে। প্রাকস্বাধীনতা দাঙ্গার সঙ্গে লড়াই, নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাবার লড়াই, মাতৃত্বের লড়াই, প্রশাসক হিসেবে কর্মক্ষেত্রের লড়াই। সংক্ষেপেই বলি এই লড়াইয়ের গল্প, নীরব যুদ্ধে অবিচল বিজয়িনীর গল্প, যদিও লড়াই ছিল দীর্ঘ, হয়তো ক্লান্তিকরও।
প্রতিমা দাসের যুদ্ধ স্বাধীনতার সমসাময়িক। দেশভাগের আগে ভৈরবের ব্রীজের দাঙ্গায় প্রতিমাদির বাবা নিহত হন - সকালে বাজার করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। মেধাবিনী উদ্বাস্তু মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা শেষ করে ইউপিএসসির মুখোমুখি হয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজে যোগ দেন। সেইসময় প্রবল কর্মহীনতা, উদ্বাস্তুর স্রোত, ইন্টারভিউ বোর্ডে মেয়েদের কিছু অতিরিক্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো - পুরুষের চাকরিতে ভাগ বসানোর অধিকার মেয়েদের আছে কিনা তার যাচাই অনেক সময় হেনস্থার পর্যায়ে চলে যেত। উদয়পুর গার্লস স্কুল, মহকুমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্কুল তখন, বারোশো ছাত্রী, কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ, হস্টেল সব মিলিয়ে বড় কর্মযজ্ঞ। অল্পবয়সেই দক্ষ প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। জগন্নাথ দীঘির অন্যপাড়ে ছেলেদের স্কুল - রাধাকিশোর মাণিক্য ইন্স্টিটিউশন, সেখানে প্রতিমাদির স্বামী বংশীবাবু প্রধান শিক্ষক।তাঁরও নিশ্চয় নিজের সমস্যা ছিল, নিজের যুদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রতিমাদির সমস্যা অন্যরকম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তাঁদের চতুর্থ সন্তানের জন্ম, তখন সরকারের সুবিবেচনায় জন্মনিয়ন্ত্রন প্রকল্প সফল করার লক্ষ্যে তিনবারের বেশি মেটার্নিটি লীভ নেওয়া যায়না - প্রতিমাদি কাজে যোগ দিলেন অবিলম্বে এবং পরিচিত দক্ষতায় কর্তব্য পালন করে গেলেন।
যা বলছিলাম, দুর্ঘটনার কথা। দুর্ঘটনার পর প্রতিমাদির হাত কনুইএর ওপর থেকে বাদ দিতে হলো। ত্রিপুরার বাইরে চললো দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়া। মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে, দেশভাগের ফলে নিঃসম্বল বাস্তুচ্যূত। চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া, নির্ভরশীল পরিজনের খরচ দুঃসাধ্য। আমি উদয়পুর গার্ল্স স্কুলে কাজে যোগ দিই '৭১ সালে, কিছুদিন পর প্রতিমাদি চিকিৎসার মধ্যপথে কাজে যোগ দেন। কাটা হাত আঁচলে ঢেকে প্রেয়ারে দাঁড়ান। মুখ দেখে ট্রমা বোঝা যায় না। বাঁ হাতে নাম সই, লেখা অভ্যাস করে নিলেন। হায়ারসেকেন্ডা্রি স্কুলের ড্রয়িং ডিসবার্সিং অফিসার, কাজ অনেক, দায়িত্ব বিপুল। মাস খানেকের মধ্যে নিজের হাতে নোটিস লিখতে শুরু করলেন। আমরা নূতন সংসারী কিছু শিক্ষিকা, কত আমাদের অন্যায় আবদার। একাত্তরের উত্তাল ছাত্রসমাজ। প্রতিমাদি শাসনে সোহাগে শিক্ষক ছাত্রী অশিক্ষক কর্মচারীদের পরিচালনা করেন অবিচল ভাবে। স্কুল চলছে, নিজের ছেলেমেয়ে, ভাসুরপো, পরিচারিকা জ্যোতিদিকে নিয়ে সংসার চলছে। আত্মীয় সহকর্মীদের সহায়তা পেয়েছেন নিজগুণে। কর্মচারী আন্দোলনের জঙ্গী নেতা থেকে টিচার্স কাউনসিলের তাবড় ব্যক্তিত্ত্ব, অবুঝ অভিভাবক থেকে হঠকারী ছত্রনেতা - সবাই সমীহ করতো সাদাসিধে প্রতিমাদিকে। তখন দেশ জুড়ে ইমার্জেন্সির তাণ্ডব। সর্বস্তরের মানুষ, সরকারি কর্মচারী তো বটেই, তটস্থ। নানারকম গুজবে দেশ ছয়লাপ। রটে গেল টীকাকরণ কর্মসূচীর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ ছড়ানো হচ্ছে। উদয়পুরে প্রধানত মুসলিম ছাত্রীদের অভিভাবকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। প্রতিমাদি বললেন আমার নিজের মেয়েরা আগে টীকা নেবে, তারপর তোমরা নাও। সমস্যা সামাল দিলেন। নিয়তি তাঁর জন্য আরো পরীক্ষা নির্ধারণ করে রেখেছিল। ছিয়াত্তর সালের ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় স্কুলের মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে বংশীবাবু হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেলেন, চিকিৎসার সময়ও পেলেন না। এক সপ্তাহ পর টেস্ট পরীক্ষা এবং অ্যানুয়েল পরীক্ষার মিটিং - প্রতিমাদি স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর ভয়াবহ শোক বুকে নিয়েও রেজাল্ট মিটিংএর সমস্ত রিপোর্ট নিজে দেখলেন। তাঁদের বিয়েও কিন্তু স্বনির্বাচনেই ছিল। স্বামীস্ত্রী দু'জন পরামর্শ করে নিজের নিজের স্কুল চালাতেন। এখন একা প্রতিমাদি - স্কুল চললো। চারটি সন্তানই তখন ছাত্র। দু'টি মেয়ে আমাদেরই স্কুলে তখন। মায়ের নিপুণ অভিভাবকত্বে চারটি সন্তানই পরে যথাসময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অবসর নেওয়ার পর একবারই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, জানিনা মোটামুটি দীর্ঘজীবনের শেষটা তাঁর কেমন কেটেছিল।
প্রতিমাদি বিখ্যাত হতে চাননি; চাইলে হওয়ার মত মেধা তাঁর ছিল। শেষপর্যন্ত সময়ের আগে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছিলেন। এত বিপর্যয়ের পরেও তিনি কোনদিন কোন দৈববলের ওপর বিশ্বাস করার প্রয়োজন বোধ করেননি। প্রতিমাদিকে আমরা যারা কাছে থেকে চিনতাম, সেই সময় হয়তো তাঁর সংগ্রামকে সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে পারিনি। এখন তাঁকে নারী শক্তির অনমনীয় প্রতীক বলে মনে হয়।
আজকের দিনে প্রতিমাদির যুদ্ধকে নিতান্ত ব্যক্তিগত বলে মনে হতে পারে। প্রথাগত চাকরি, ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু ব্যক্তি তো তার সমকালবিচ্ছিন্ন নয়। কত মেয়ে সেই দুঃসময়ে কাঁটাতার পেরিয়ে হারিয়ে গেছে চোরাপথের বাঁকে। সেই অন্ধকার সময়ের অনির্বচনীয় হুণ্ডির হাত এড়িয়ে সুবাতাস খুঁজে নেওয়া প্রত্যেকেই কি মহীয়সী নয়? প্রতিমাদির প্রবল আশাবাদ, নিয়তির চোখে চোখ রেখে তাকানোর উদ্ধত সাহস, প্রবল প্রতিবন্ধ, শোক, বিপর্যয় সব সামলে নিয়ে সংসারের দায়িত্ত্ব ও কর্মভূমির আহ্বানে সাড়া দেওয়ার উদাহরণ আমাকে যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনই নিশ্চিত ভরসা দিয়েছে সেই উত্তাল সময়ের মফস্বলের হাজার হাজার মেয়েদের, যাদের মধ্যে কেউ পর্বতচারিনী প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, কেউ রিফিউজী ক্যাম্পের নরক থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে।
তাদেরই সন্ততি আজ আত্মবিশ্বাসী, প্রতিষ্ঠিত, তাদেরই জন্যে নারীদিবসের ফুল, তারাই ঝোড়ো হাওয়া বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিমাদি-দের জ্বালানো বর্তিকাখানি।