এক.
“ত্রিশ বছর আগে উত্তরবঙ্গের সেরা গল্প সম্ভারে যাঁর লেখা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল, লিটল ম্যাগাজিন বিশ্বের সেই পরিচিতমুখ প্রতিভা সরকার হঠাতই লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মধুপর্ণীর প্রয়াত সম্পাদক অজিতেশ ভট্টচার্য অনেক বলেও তাকে দিয়ে লেখাতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে কলমে মরচে পড়তে দেননি লেখক, ‘ফরিশতা ও মেয়েরা‘ বইটির গল্পগুলি তার প্রমান। গভীর মমতায় তিনি এঁকেছেন মূলত মেয়েদের, সাধারণ মানবী তারা, কিন্তু দিব্য বিভায় উদ্ভাসিত তাদের ঘামে ভেজা মুখ।“... ইত্যাদি।
এবার কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত প্রতিভা সরকারের গল্পগ্রন্থ ‘ফরিশতা ও মেয়েরা‘ বইয়ের শেষ ফ্ল্যাপে এরকম ছোট্ট পাঠ পরিচিতি তুলে ধরেছেন প্রকাশক। এটি একটি গুরুচণ্ডালির ‘বাংলা চটি সিরিজ‘ প্রকাশনা। হালকা-পাতলা গড়নের ছোটখাট পেপারব্যাক বইটির ঝকঝকে ছাপা, বিমূর্ত ছবিতে চমৎকার প্রচ্ছদ, ১০৮ পৃষ্ঠার নির্ভুল বানানে এর দামও পাঠকের হাতের নাগালে – ভারতে ৯০ টাকা, আর এপারে ১৩৫ টাকা (প্রায়)। প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, ভূমিকা লিখেছেন অমর মিত্র। সম্ভবত, এটি লেখিকার প্রথম বই।
প্রথমেই বলা ভাল, তার পাঠক মাত্র অচিরেই জানবেন, প্রতিভা সরকার পাঠ সহজ কথা নয়, ইজি চেয়ারে এলিয়ে চায়ের কাপে অলস বিকালে হালকা-পাতলা গড়নের বইটির ১৩টি গল্প একদমে পড়ে ফেলা আদৌ সম্ভব নয়। গল্প, চরিত্র ও কথনে একেকটি কাহিনী পাঠককে থমকে দেয়, চেনা জগত থেকে টেনে হিঁচড়ে নামায় নির্মম বাস্তবতায়, কোনো কোনো গল্পের পাঞ্চ লাইন, এমনকি পুরো গল্পও পাঠককে গভীর ভাবনায় ফেলে, মুখস্ত নীতি-নৈতিকতায় অস্ত্রপচার, কখনো রাহাজানিও করে। প্রতিটি গল্পের ধরণ, বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট, ইতিহাস-ভূগোল আলাদা। আর নিছকই এসব শুধু সাধারণ মেয়েদের গল্প নয়, যদিও তারাই প্রধান উপজীব্য, কিন্তু এগুলো মূলত প্রান্ত নারী, সমাজের ঊনমানুষ যারা, তাদের নিষ্পেষণ ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প; আবার একই সঙ্গে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম, দলিত, আদিবাসী বা ছিন্নমূল মানুষের নিত্যদিনের জীবন- ইনক্রেডেবল ইন্ডিয়ার গল্প।
ধারণা করি, বিস্তর লেখালেখি থেকে বিচিত্রতায় নজর রেখে ১৩ গল্পে করা হয়েছে এই অভিনব উপস্থাপন। ব্যক্তিগত পাঠ বিচারে ‘নাপক‘ (ফরিশতা ২), ‘দেবদাসী‘ ও ‘বিবাহ‘ নামক গল্প তিনটিকে ছুরির মতো ধারালো, মসৃণ, চকচকে ও পাঠকহন্তায় পারদর্শী বলে মনে হয়েছে। আবার কয়েকটি গল্পের বয়ানে ছোটখাট ফাঁক-ফোকর খটকা তৈরি করেছে। সে সবই ক্রমশ প্রকাশ্য, আগে বাইলাইনে দুটি মৃদু অস্বস্তি জানিয়ে রাখি।
একেকটি গল্পের শেষে থার্ড ব্রাকেটে ছোট করে গুরুচণ্ডালী, ঋতবাক, মহানগর, চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম, আবহমান – ইত্যাদি অনলাইন বা অফলাইন প্রকাশনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার হোঁচট খাওয়ায়। লেখিকার নিজস্ব একটি ছোট মুখবন্ধে ‘এই বইয়ের অধিকাংশ গল্প এরআগে অমুক অমুক স্থানে প্রকাশ হয়েছে‘ এইটুকু উল্লেখই বরং শোভন হতো।
এছাড়া শেষ ফ্ল্যাপে লেখিকার প্রোট্রেটটিও পেশাদারসূলভ নয়। আলোকচিত্রের নেপথ্যে উবার হেলমেট, কম্পিউটার স্ক্রিন ও তারের জটের কিয়দাংশে আন্দাজ হয়, এটি হয়তো পারিবারিক কোনো ছবি থেকে ক্রপ করে নেওয়া। একজন পেশাদার আলোকচিত্রীর তোলা লেখিকার ছবি বইয়ে যোগ করা খুব কী কঠিন ছিল? সে যাক, এসবই দর্শনদারি, বরং বিষয়ে আসা যাক।
দুই.
‘নাপাক‘ গল্পটি ইলিয়াসজাত, অতি মুন্সিয়ানায় লেখা গ্রাম্য মুসলিম নারীর জামাই সোহাগী গল্প, তবে নিছক ‘মিষ্টি প্রেমের গল্প‘ নয়। এটি অবলীলায় প্রতিভা সরকারের বদলে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অপ্রকাশিত রচনা‘ বলেও চালানো যায়, এমনই এর বিষয় বুনন, কথন শৈলী এবং গুপ্ত পাঞ্চ লাইন। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা‘সহ অন্যান্য মূল্যবান উপন্যাস ও গল্পে এইরকমভাবে ধর্মের বিশাল আলখেল্লার ময়নাতদন্ত হয়েছে অতি দক্ষতায়।
কিশোরী গ্রাম্যবধু রাবিনার শশুড় বাড়িতে ফজরের সকালের খানিকটা বর্ণনা দিয়েই লেখিকা আচমকা ফেলেন তুরুপের তাস, খাপছাড়া একটি বাক্য, ‘এই রকম সময়েই সে একদিন ল্যাংড়া টিটুকে খুঁজে পায়‘ (পৃষ্ঠা : ১১)। এ পর্যায়ে ল্যাংড়া টিটু রাবিনার গুপ্ত প্রেমিক কি না, পাঠক মনে এমন সন্দেহ উঁকি মারা মোটেই অমূলক নয়, বরং বদ্ধ পর্দানশিন গ্রামীণ পরিবেশে এমনটি খুব অসম্ভবও নয়, কিন্তু এটি নিছকই খোড়া, সারমেয় নেড়ি শাবক জেনে গল্পের বাঁক নেয় অন্য মোচড়ে।
রাবিনার প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক স্বামী সাবির ধার্মিক জোতদার পিতার কাছ থেকে রাবিনার পোষ্যটিকে প্রশ্রয় দেওয়া নিয়ে জটিলতায় পড়ে। বিশেষ করে মুসলিম ধর্মে কুকুরকে যখন স্পষ্ট নাপাক (অপবিত্র) প্রাণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাবিরের মনে পড়বে এপার থেকে ওপারে ওয়াজ নসিহত করতে আসা বুজুর্গ হুজুরে কেবলার ফতোয়া, ‘ -- আজকাল শহুরে ঢং হয়েছে, কুকুরের মুখে চুমা খাওয়া। সুন্দর সুন্দর নারীরা শুদু চুমা দিয়া খান্ত হয় না, কুত্তার গলায় চেইল লাইগাইয়া কতো ভঙ্গি কইরা হাঁইটা যাসসে।
হুজুর এই জায়গাটা সুর লাগিয়ে গান করেন। শোনায় যেন ‘হাঁইটাআআআ যাসসেএএএএ‘।
-- শুদু তো হাঁটা নয়, এই নারীরা পর্দা রাখেন না। বেপর্দা নারীরা খসমের চাইতে কুত্তা বেশি ভালবাসেন। এই নারীরা ঘরে থাকলে জান্নাতের পথ চিরকালের জন্য বন্ধ। কুত্তা থাকলে তাইইইই।‘ (পৃ. ১৬)
সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ উদ্বৃত করে বলি, যেখানে ‘শষ্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে ধর্মের আগাছা বেশি‘ সেখানে অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিতদের মনে দোজখের আগুন ও বেহেশতি হুরপরির খোয়াব খুবই জোরালো হয়। আর অর্ধ শিক্ষিত হুজুরেরা নেচেকুঁদে যৌনগন্ধিতে একেকটি মজমা এই রূপেই জমিয়ে মাত করেন বটে। ফেসবুক বা ইউটিউবে এর নজিরেও কম নেই।
তাই সাবিরের ভয়, আব্বার পারমিশন, আর অন্যদিকে সোহাগী স্ত্রীর পোষ্য রাখার দায়। শেষমেষ দুই কুল রক্ষায় ফজরের আজানের কালে কোলে টিটুসহ স্ত্রীকে বাইকে চাপিয়ে সে হাজির হয় ওঁরাও আদিবাসী বস্তিতে। সেখানে কুকুর প্রেমী এক আদিবাসীর জিম্মায় নেড়ি শাবক আপাতত বড় হবে। আর মাঝে সে কোরান ঘেঁটে আব্বাকে বোঝাবে, অতীতে মৃতপ্রায় একটি কুকুরকে পানি খাওয়ানোর জন্য পরমকরুণাময় একটি ভ্রষ্টা মেয়ের পাপ ক্ষমা করেছিলেন।... (পৃ.১৮)
‘দেবদাসী‘ গল্পে দলিতদের দারিদ্র আর অশিক্ষাকে পুঁজি করে কিভাবে ধর্মগুরুরা হাইকোর্টের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মন্দির পুরহিত আর পান্ডাদের ভোগ বিলাসের সামগ্রী করে তোলা হয়, তার একটি রিপোর্টাজ বর্ণনা আছে। গল্পের নোঙর অনি রিপোর্টারই বটে, সেদিক বিচারে এর এরকম গল্প বয়ান খুব যুতসই হয়েছে। অনায়াসে এই গল্পটি থেকে একটি ফিচার স্ক্রিপ্ট বা ডকু স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলা যায়, পরিস্থিতির বিবরণ এতটাই ইন ডিটেইল।
গল্পের কথক বালাশঙ্কর রিপোর্টার অনির গাইড ও তথ্যসূত্র। কর্নাটকে মন্দির ঘিরে জমেছে দেবদাসী করার বিভৎস উৎসব। হাজারে হাজারে হত দরিদ্র দলিত নারী-পুরুষ গিজগিজ করছে। আরো আসছে হাজারে হাজার। বালার ভাষায়, ‘ দে কান্ট আফোর্ড এনিথিং আদার দ্যান কিস কার্ট। খুব গরীব এরা জান? আর আসেও কতো দূর দূর থেকে। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া থেকে আসা দলিতেরা রয়েছে এই ভীড়ে। ঘরের কাছে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ তো আছেই।...‘ (পৃ.৩৪)
ভীড়ের আহার-বিহার-নিদ্রা-শৌচকর্ম-পূজা-মিথোলজি ইত্যাদির বর্ণনার পরে বালা আবার হত বিহব্বল-ক্ষুব্ধ সাংবাদিক অনিকে রোমান্স থেকে টেনে নামায় মাটির পৃথিবীতে, তারমুখে ব্যাঙ্গের হাসি। ‘(দেবদাসী প্রথা) উঠে যাওয়াটা এতো সহজ নয়। অপুষ্টিতে গরীবদের নানা অসুখ করবেই, ফলে দেবীর কাছে বাচ্চাকাচ্চা উৎসর্গ করার মানতও চলতে থাকবে। যোগাম্মা আর যোগাপ্পার সাপ্লাই অন্তহীন। এদের বিয়ে বারণ, কিন্তু লাইনে নামা বারণ নয়। ফলে অবৈধ ছানাপোনাও জন্মাবে আর ভবিষ্যতে হাজারটা দেবদাসী বড় হয়ে উঠবে ওদের মধ্যে। দিস ইজ আওয়ার ইন্ডিয়া – ইনক্রেডেবল ইন্ডিয়া‘। (পৃ. ৪১)
এই গল্পে পাঠক হয়তো ভেতরে ভেতরে চমকে উঠবেন পবিত্র মন্দিরে আদিভৌতিক পরিবেশে এক নগ্ন কিশোরীকে দেবদাসী করার প্রক্রিয়ায়। আনুসাংঙ্গিক বর্ণনাটুকু বাদে সার অংশটুকু এরকম:
‘মামাদের গ্রামের বাড়িতে বলির পাঁঠাকে হাঁড়িকাঠের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছে অনি। অনিচ্ছুক অথচ অনিবার্য সেই চলন সে আবার দেখল নিমপাতা ঘেরের নীচে রোগা কালো অপুষ্ট দুটি পায়ে। বাজনার তালে তালে তারা কোনো রকমে উঠছে নামছে। বিগ্রহকে এক চক্কর দিয়ে কর্মকর্তাদের সামনে আসতেই ইয়েলাম্মার জয়োধ্বনিতে ফেটে পড়েছে সবাই। আর কয়েকটি লোমশ কালো হাত মেয়েটির কপালে, মুখে, সারাগায়ে হলুদ ও সিঁদুর লেপে দিচ্ছে। প্রত্যেক পাক ঘোরা শেষ হলে মেয়েটি বিগ্রহের সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে প্রণিপাত করছে। তখন সরে যাচ্ছে পাতার আবরণ। অপুষ্ট অল্প উঁচু শ্রোণি দেখে ঢিমে আলোতেও চকচক করছে ভাঁজ করা লুংঙ্গিদের জোড়া জোড়া চোখ।‘ (পৃ.৪৩)
অনায়াসে এইটুকু ভিডিও ক্লিপিং ভাইরাল হতে পারে, এরপরে আর গল্পের জের টানার হয়তো দরকার ছিল না। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে অফিসে অনির কন্নড় ভাষার বোধোদয় ও ফিচার স্টোরি লিখতে না পারা সম্ভবত এই গল্পের খটকা, সেটি তিন নোক্তায় যথাসময়ে বিবৃত হবে। আপাতত পাঠ বিচারে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গল্প ‘বিবাহ‘ এ যাই। এ এক সুপ্ত প্রেমের সরল গল্প, অভাব তীব্র, জীবন তীব্র, আবার সরলও, আদিবাসী প্রেমও তাই, শুধু প্রকাশ গোপন।
আদিবাসী মাহাতোর জেলে, মাছের ঘেরের পাহারাদার কানুর নতুন বউকে নিয়ে মনে বড় অশান্তি, বউ ভাব-ভালবাসার কথা থাক, নরম সুরে দুটি বোল থাক, সাত চড়েও রা কাড়ে না। ‘পড়হাশুনা জানে বলে মেয়াটার কি অঙ্কার বেশি?‘ ওদিকে বিয়ের পরদিনই কানুর বউ পালায়। মাহাতো সমাজে এই প্রাচীন রীতি। ... ‘গাঁয়ের মেয়ে সীতা আর প্রিয়া প্রায় নাচতে নাচতে তার দিকে ছুটে আসে, কানুদাদা, নতুন বহু কথায় গেল, কথায় গেল?‘ (পৃ.৮৯ ও ৯১)
দিনভর কানু বউকে হেথায়-সেথায় খুঁজে ফেরে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে নিকেশ কালো রাত নামে, আর আসে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। ছাতা মাথায় কানু তখনও খুঁজে বেড়ায় ‘লতুন বহু‘। অবশেষে ভুতের তার দেখা মেলে মাছের ঘেরের কিনারে।
‘সে চোখ এখন কানুকে দেখে লাজুক হাসছে, লুকাইছিলাম। এখন এইদিগে দৌড়ে আইস। দমে মাছ আইটকে গেছে জালে। হাওয়াই জলের গন্ধ, আকাশে মেঘ। মনে হচ্ছে নদীর জল বাইড়তে চইলেছে। মাছ গিলা চটপট ঝুড়িতে ঝাইড়ে লে।‘
এইভাবে মধুর মিলন ঘটে মাহাতো বর-বউয়ের, রবীন্দ্রনাথের উচ্চ-মধ্যবিত্ত গৃহস্থালি ‘আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম‘ এর সাথে এই গল্পের ফারাক অনেক, এ অজ পাড়াগাঁয়ের কর্মময় অভাবী জীবনে প্রেমের রাত। ততোক্ষণে বৃষ্টি থেমে ঝলমলিয়ে উঠেছে চাঁদ। দৃশ্য বর্ণনা খুবই সিনেমাটিক।
তিন.
এইপর্বে প্রতিভার গল্পের বেশকিছু ফাঁকফোকর, আরোপিত বা দুর্বল অংশ নিয়ে আলোচনা করবো। সবই ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া, কোনো গূঢ় গবেষণা নয়, সে আকাঙ্খাও নাই।
প্রথম গল্প ‘ফরিশতা‘য় মূল উপজিব্য মুসলিম স্কুল ছাত্রী আয়েশা ও শিখ যুবক দলজিৎ সিং-এর অসম প্রেমের গল্প। আবার এটি একই সঙ্গে দিল্লির ঐতিহাসিক কবরস্থানের ভিস্তিওয়ালা (নাকি মালি? বা কেয়ারটেকার?) মতি মিয়ারও গল্প। আমির, পির, বীর সিপাহিদের কবরে ‘ভিস্তি‘ দিয়ে পানি ছেটানোই তার কাজ। (পৃ.১ ও ২)
কিন্তু ভিস্তিওয়ালা চরিত্রটি বৃদ্ধ মতি মিয়ার চরিত্রের উচ্ছিষ্ট মনে হয়েছে। লিটার ও টেলিফোনের যুগে খোদ দিল্লিতে ছাগ চামড়ায় নির্মিত জলাধার ‘ভিস্তি‘ অবান্তর, তাও কবরে কবরে পানি ছেটানোর জন্য ‘ভিস্তিওয়ালা‘ একটি পদের কেন প্রয়োজন, তা স্পষ্ট হয়নি, যতোটা স্পষ্ট হয়েছে বাদশা নামদার হুমায়ুনের কবর, কারবালার কিচ্ছা ও আয়েশ-দলজিৎ কিশোর প্রেম। সবচেয়ে বাস্তব হতো, মতি মিয়া যদি কবরস্থানের কেয়ারটেকার কাম মালি হতেন, কবরস্থানের দেখভাল ও কবরগুলো ঘিরে ফুলের গাছের পরিচর্যা করাই যার পেশা। বংশপরম্পরায় তারা এই কাজ করছেন, এখন হোস পাইপে বা টিনের ঝাঁঝরিতে পানি ছেটানো হলেও এক সময় পিতামহ, প্রো পিতামহ ভিস্তিতে করতেন এই কাজ, তখন ছিল কেরোসিন ল্যাম্প, জুড়ি গাড়ি আর মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমল, সাহেব-সুবাদের কারবার ...এমনও হতে পারতো, অবশ্য সবই লেখিকার অভিরুচি।
তৃতীয় গল্প ‘ক্ষত‘, একটি সদ্যজাত শিশুকন্যাকে তার পিতা সুমনের নিয়মিত ধর্ষনের গল্প। মা নিজেও কিশোরী বয়সে এক কাকুর মাধ্যমে নিয়মিত যৌন নিগৃহের শিকার হয়েছিলেন। তাকে সেবারও রক্ষা করেছিলেন কেয়ারটেকার প্রতিমাদি। এবারও প্রতিমাদিই চাকুরে মাকে খবর দেন পিতার শিশুকন্যাকে ধর্ষণ কাহিনীর। কিন্তু সুমন চরিত্রটি বড় দুর্বল, এ-ও যেন পেশাদার ধর্ষকের উচ্ছিষ্ট, ভিলেনত্ব আরোপ করতে স্বামী সুমনকে পর্ন প্রেমি ও গাঁজাখোর দেখানো হাস্যকর। তার পেশাও স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে দিনের বেলা নিয়মিত বাসায় থেকে নিজ শিশুকে ধর্ষনের বয়ান। আকছার না হলেও সমাজে এটি নিভৃতে ঘটতে পারে, হিংস্র চিতা নিজ শাবককে এক থাবায় ঘায়েল করছে, রূদ্ধশ্বাসে ডিসকভারিতে এই দৃশ্য তো দেখেছি!
কিন্তু ধর্ষনের বিজ্ঞান বলছে, ধর্ষকের মানসিক প্রশান্তি স্থালনে নয়, বরং ধর্ষমর্ষকামীতা, শিকার বধে, রক্তে ও চিৎকারে, শিৎকারে নয়। সেক্ষেত্রে শিশুকন্যাকে একদিন নিগৃহিত করে ক্ষতবিক্ষত করাই স্বাভাবিক ছিল, দিনের পর দিন সম্ভব নয়, ডেটল দিয়ে ক্ষতস্থান মুছেও সম্ভব নয়, অন্তত শরীরবিদ্যাও তাই বলছে, জানি না, অন্যরা কি বলবেন, কিন্তু বাস্তবতা এই। তাছাড়া অত ছোট শিশু ধর্ষন বা ধর্ষন চেষ্টা হলে চিকিৎসকের নজরে তা ধরা পড়বেই, ক্ষত দেখেই শিশু চিকিৎসক বুঝবেন, এটি এড়ানোর জো নেই।
‘আত্মজা‘ গল্পটি কাফকাজাত, জাদুবাস্তবতায় মাখা, বাস দুর্ঘটনায় নিহত দুই মৃতার কাহিনী, একজন তরুণী, আরেকজন পৌঢ়া। একজন প্রেমিকা, আরেকজন প্রেম বঞ্চিত, পড়ন্ত বেলার শব। কিন্তু পৌঢ়ার সন্দেহ হয় নৌকা নিয়ে উদ্ধারকারীরা হয়তো নোংরা হাতে উলঙ্গ তরুণীর বুক ছুঁয়ে দিতে পারে, যদিও তাদের শব সাদা চাদরে ঢাকা। মৃতা তরুণীর সম্ভ্রব বাঁচাতে পৌঢ়া নৌকা কাত করে ভেসে চলেন, সঙ্গে ভাসিয়ে নেন তরুণীটির শবও। এক মৃতা হয়ে ওঠেন আরেক মৃতার রক্ষক, পরস্পর আত্মজা। অতি সংক্ষেপে অনেকটা এই হচ্ছে কাহিনী।
কিন্তু দীর্ঘদিন ক্রাইম রিপোর্টিং করার কারণে এইসব উদ্ধারকর্মী, ডোম, ধাঙর, চণ্ডাল, শববাহক, গোরখোদক, মুর্দাফরাশ শ্রেণীটিকে খুব কাছ থেকে চেনা। প্রথমত, তারা নিজ পেশাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন। আর দ্বিতীয়ত, একারণেই তারা মৃত বা মৃতাকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন, বয়স ভেদে তাকে আপন বাবা, কাকু, মা, মাসি, বোন বা ভাই বলে মনে করেন। যদিও দিনশেষে সবাই ‘বডি‘ বা টুল, কেউ আর মানুষ নন। (গুগল করে দেখুন, অধমের লেখা ‘লাশকাটা ঘর‘।) তাই চমৎকার পাঠ সত্ত্বেও গল্পটি মেনে নিতে কষ্ট হয়।
‘বডিগার্ড‘ গল্পে সাঁতারু কিশোরী বুনুর সঙ্গে ফারুকের বন্ধুত্বে কাঁদা ছুঁড়তে চাওয়া, ও ফারুককে প্রহারকারী গেরুয়া বাহিনীর কবল থেকে তাকে উদ্ধার প্রচেষ্টায় বুনুর বক্তৃতা খুব আরোপিত, কৃত্রিম ও মুখস্ত ঘেঁষা মনে হয়েছে। (পৃ.৭৩)
বরং উদ্ধার পর্বে মেয়েটির ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে কিছু মার পিঠ পেতে নেওয়াই বাস্তব ছিল। তাছাড়া মেয়েদের সুইমিং পুলে সুইমিং কাস্টিউম পরা মেয়ে দেখার সুযোগ থাকে কী? ক্লাব মেম্বারশিপ, দেওয়াল, কড়া সিকিউরিটি ইত্যাদি থাকার কথা।
সবশেষ, আবার ‘দেবদাসী‘তে ফেরা যাক। গল্পটি বোধহয় দেবদাসী দীক্ষা পর্বেই (পৃ. ৪৩) শেষ হওয়া ভাল ছিল। অহেতুক সাংবাদিক অনিকে ব্যাঙ্গালোরে নিউজ রুমে ফিরিয়ে এনে গল্পের কথক বালাশঙ্করের মাতৃপরিচয় (দেবদাসী) উদঘাটন ও অনিকে সংবাদ শুন্য করে ফেলা বাহুল্য মনে হয়েছে। (পৃ. ৪৫)
বটমপয়েন্টে :
বাংলা সাহিত্য নিশ্চিত একদিন এই লেখিকার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে, শুধু অভিনব ও ভালমানের লেখার জন্য নয়, প্রান্তজনের অব্যক্ত কথনেও। আর একদিন অসংখ্য লেখনিতে তিনি নিশ্চয়ই হয়ে উঠবেন ঊন মানুষের কণ্ঠস্বর। আবারও স্বীকার করি, প্রতিভা সরকার সহজ লোক নন, পাঠে তো অবশ্যই।
খুব নিষ্ঠ রিভিউ - ধন্যবাদ বিপ্লবকে। দেবদাসী গল্পের শেষটুকু নিয়ে একমত নই - আমার মনে হয়েছে বালার এই আখ্যানটা প্রয়োজন ছিল। তবে তা পাঠকভেদে ভিন্ন হবেই।
@ প্রতিভা দি,
সমস্ত খর সমালোচনা সহজ করে নিয়েছো, শুধু মহৎ প্রাণ বলে নয়, তুমি সত্যিই উঁচু দরের লেখক বলে এটি সম্ভব। প্রায় সংগে সংগে তোমার প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভাল লাগলো।
কলেজ স্কোয়ারের খোলা সুইমিংপুল জানা ছিল না। এই সংক্রান্ত অতিশয় উক্তি মার্জনা করো। এপারের সুইমিংপুলের ইতিহাস বিচারে ওই মন্তব্য, দৃষ্টি সীমা।
অনেক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা।
@রৌহিন দা,
দ্বিমত হতেই পারে, আর বাকি পয়েন্টগুলোতেও তোমার পাল্টা প্রতিক্রিয়া পেলে আরো ভাল হতো। তাৎক্ষণিক পাঠ ও মন্তব্যে শুকরিয়া।
পাই দি,
প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভাল লাগলো, এমনকি দ্বিমতটুকুও। কিন্তু আপনার বিপরীত অবস্থানের পক্ষে কিছু যুক্তিতর্ক থাকলে আরো ভাল হতো।
শুভেচ্ছা
“পিতার দিনের পর দিন কন্যাধর্ষণ আর ভিশ্তিওয়ালা, দুয়েরই খবর পাওয়া যায়।“
পাই দি,
মাফ করবেন। বিনয় করে বলি, হয় আপনি তিন নম্বর নোক্তার “ক্ষত“ ও “ভিস্তিওয়ালা“ আপত্তির ওই বিষয়গুলো বোঝেননি, অথবা আমিই আপনাকে বোঝাতে অক্ষম, যাহোক, দায় আমারই।
প্রথমত, সদ্যজাত বা খুব ছোট শিশুকন্যাকে পিতার দিনের পর দিন ধর্ষন, তৎসংলগ্ন ডেটল দিয়ে ধামাচাপা, শিশু চিকিৎসকের সেটি বুঝতে না পারা – এটি শরীর বিদ্যায় অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, ধর্ষনের বিজ্ঞানে ধর্ষক যেহেতু ধর্ষমর্ষ+রক্ত+চিৎকার কামী হন, তাই শিশুটিকে (অথবা যে কোনো বয়সী শিকারকে) রক্তাক্ত+ক্ষত-বিক্ষত করাই স্বাভাবিক।
তৃতীয়ত, পিতা সুমনকে ধর্ষক প্রমানে চরিত্রটি আরোপিত মনে হয়েছে, তার পেশা উহ্য থাকে, মাতা যখন অফিসে তখন পিতা বাসায় অবস্থান করে দিনের পর দিন শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করেন, উপরন্তু তিনি পর্ন প্রেমিক ও গাঁজাখোর, খুব কী স্বাভাবিক লাগছে?
এমন “নিয়মিত শিশু ধর্ষক“ পিতার কথা খবরে পড়েছেন, যিনি আবার সহসাই ধরা পড়েননি, আপনি নিশ্চিত?
এবার ভিস্তিওয়ালা। দিল্লির বাদশাহ হুমায়ুনের ঐতিহাসিক কবরস্থানে কী আদৌ কোনো “ভিস্তিওয়ালা“ পদ আছে? থাকলে তার চাকরিটি ঠিক কী? লিটার ও টেলিফোনের যুগে ভিস্তিওয়ালা থাকতে হবে কেন? যার শুধু কবরে পানি ছেটানোই কাজ? নাকি ভিস্তিওয়ালা মতি মিয়াকে কবেরস্থানের কেয়ারটেকার কাম মালি করে দিয়ে ঝাঁজরি বা হোসপাইপে ফুল বাগানে পানি ছেটানো দেখানোই বাস্তব ছিল? খবরে কী আদৌ এরকম অস্পষ্ট চরিত্র মেলে?
ভেবে দেখবেন, অনুরোধ রইল। অবশ্য, লেখিকা অধমের এই সব আপত্তি মেনেই নিয়েছেন। সবই পাঠ অভিরুচি বা চোখের দেখা।
বিতর্কের জন্য অনেক ধন্যবাদ। উড়ুক।
r2h,
“পুরনো জায়গায় অনেকসময় পুরনো পদগুলি রেখে দেওয়া হয়।“
তাই? আমিও কিন্তু পদে আপত্তি তেমন করিনি, বরং খেয়াল করে দেখবেন চরিত্র গঠনে ও চাকরির কাজকর্মে সুনির্দিষ্টতার ওপরে জোর দিয়েছি মাত্র।
বিশেষ করে মতি মিয়া নোঙর চরিত্র যখন। দেখবেন, এমনও বলেছি,
“সবচেয়ে বাস্তব হতো, মতি মিয়া যদি কবরস্থানের কেয়ারটেকার কাম মালি হতেন, কবরস্থানের দেখভাল ও কবরগুলো ঘিরে ফুলের গাছের পরিচর্যা করাই যার পেশা। বংশপরম্পরায় তারা এই কাজ করছেন, এখন হোস পাইপে বা টিনের ঝাঁঝরিতে পানি ছেটানো হলেও এক সময় পিতামহ, প্রো পিতামহ ভিস্তিতে করতেন এই কাজ, তখন ছিল কেরোসিন ল্যাম্প, জুড়ি গাড়ি আর মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমল, সাহেব-সুবাদের কারবার ...এমনও হতে পারতো, অবশ্য সবই লেখিকার অভিরুচি।“
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।