আশির দশকে এক বঙ্গ যুবা বোম্বেতে সহসা ঝড় তুলিলেন। তদবধি বোম্বে মুম্বাই অভিধা পায় নাই, কথায় কথায় এত বলিউড, বলিউড বলিবার ঘ্যাম চলও ছিল না। চক্রবর্তি পদবিধারী উক্ত হিরোর ম্যানলি চেহারা, স্বকীয় হাঁটাচলা ও সর্বোপরি অননুকরণীয় ডান্স আপামর বঙ্গ যুবসমাজকে উদ্বেল করিয়া তুলিল। সেই জোয়ার সুতানুটি, গোবিন্দপুর পার করিয়া আমাদের সুদূর লাজুক মফস্বলে আছড়াইয়া পড়িল।নব্যযুবাদের পোশাক, আশাক, হাবভাব বিলকুল পাল্টাইয়া গেল, তাহারা কথায় কথায় রাগিয়া যায়, কখনো বা উদাস নয়নে শূন্যপানে তাকাইয়া থাকে। কিন্তু, লক্ষণীয় বদল আসিল কেশবিন্যাসে। বিশেষত, যুবাসকল যে যাহার জুলফি উড়াইয়া দিল।
ইহার প্রভাব হইয়াছিল সূদূরপ্রসারী। ইহাতে বীরেনবাবু কিরূপে বিপন্ন হইয়াছিলেন তাহা অনন্তর বলিব, পূর্বে টুকুর বিবরণ দিই। টুকু ক্লাশ এইটের বালকদিগের সর্দার, পড়াশুনায় একেবারে মতি নাই এবং স্বভাবত প্ৰভাবপ্রবণ। যুগের হাওয়া তাহার গায়েও লাগিল। স্কুলের ব্রেক পিরিয়ডে সংগীদের লইয়া সে ডান্স করিতে করিতে গাহিতঃ 'আই য়াম আ ডিস্কো ড্যানসার', সেই সঙ্গে মুখ দিয়া 'ঢিচকিচ ক্যাও' -এইরূপ বিচিত্র শব্দ সমস্বরে বাহির করিত।
এক্ষণে বলা প্রয়োজন এই 'ঢিচকিচ ক্যাও' ছিল সেই ডিস্কো যুগের দ্যোতনাস্বরূপ।ইহার অনন্য স্রষ্টাও লাহিড়ী পদবীধারী আরেক বঙ্গতনয়। আশির দশকে ইনি কত না জানি স্বর্ণাভ চাকতি জিতিয়াছিলেন তাহার ইয়ত্তা নাই। লোকশ্রুতি এইরূপ যে তাহার সংগীত মধ্যপ্রাচ্য পার করিয়া সূদূর আজারবাইজান অবধি সমাদর পায়। বস্তুত, চক্রবর্তী-লাহিড়ী জুটি বঙ্গে নতুন রেনেসাঁ আনিয়াছিলেন, এইরূপ অনেকের অভিমত।
বীরেনবাবু ভূগোল পড়াইতেন। তিনি ম্যাপ লইয়া ক্লাসে আসিতেন। দেওয়ালে ম্যাপ টাঙ্গাইয়া তিনি একে একে ছাত্রদের ডাকিতেন এবং কোনো এক বিশেষ স্থান, নদী, রাজধানী, পর্বত ইত্যাদি খুঁজিতে বলিতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্ররা ব্যর্থ হইত। তখন বীরেনবাবু সস্নেহে সেই বিফল ছাত্রকে কাছে ডাকিতেন এবং শুধাইতেনঃ 'ফুচকা খাইবি?'বলাই বাহুল্য, ভীরু ছাত্র মাথা নাড়িত। অতপর, বীরেনবাবু সেই ছাত্রের জুলফিদ্বয় দুই হাতের আঙুলে ধরিয়া উপরের দিকে আকর্ষণ করিতেন। তখন, সেই অসহায় বালক দুই পায়ের আঙগুলে ভর দিয়া মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করিয়া দন্ডায়মান হইত। নীচে নামিলে অধিক ব্যথার উদ্রেক হইবে। জুলফির আকর্ষণে পদযুগল মাটি ছাড়িয়া উপরে যাইলে অধিকতর যাতনা! এইরূপ ত্রিশঙ্কু অবস্থায় শাস্তিপ্রাপ্ত বালক ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়িত। ইহাতে হাস্যরসের উপাদান থাকিলেও সহপাঠীরা ইহাতে আদৌ কৌতূক পাইত না। ঘুঁটে পুড়িয়া যাইত, কিন্তু গোবর হাসিত না। শরতের আমলকী বনের ন্যায় বালকদিগের বুক আশংকায় দুরুদুরু করিত। না জানি কখন কাহার ডাক পড়ে? কাস্পিয়ান সাগর বা রাইন নদী চিহ্নিত না করিতে পারিলে অদৃষ্টে বীরেনবাবুর ফুচকা রহিয়াছে।
সেদিন ভূগোল ক্লাশের পূর্বে যথারীতি টুকু দলবল লইয়া ক্লাশে ডান্স ও গীত করিতেছে, সহসা বীরেনবাবু ম্যাপ লইয়া ক্লাশে ঢুকিলেন। ডান্স ও গীতে বীরেনবাবুর বিশেষ অনীহা ছিলো, তায় আবার ইদানিং কালের 'ঢিচ কিচ ক্যাও'! বীরেনবাবুর গা জ্বলিয়া গেলো, কিন্তু তিনি কোনমতে ক্রোধ সংবরণ করিলেন। ক্লাশে আসিয়া তিনি সযত্নে য়ুরোপের ম্যাপ টাঙ্গাইলেন, এবং পালের গোদা টুকুকে আহ্বান করিলেন। টুকুকে বলিলেন ইংলিশ চ্যানেল চিহ্নিত করিতে। টুকু ভূমধ্যসাগরের দিক দিয়া শুরু করিয়া মহা ফাঁপরে পড়িল। আল্পস পর্বতমালা তাহার নজরে আসিল, কিন্তু ইংলিশ নালার হদিশ সে পাইল না। বস্তুত সে আদার ব্যাপারী, জাহাজ, সমুদ্র তথা ইংলিশ চ্যানেলের খবর সে কেমনে রাখিবে? পূর্বে তাহার অবসর কাটিত শ্রী স্বপনকুমার বিরচিত দীপক চ্যাটার্জি সিরিজের রোমাঞ্চগাথা পড়িয়া। অধুনা সে রকমারী ফিলিম-পত্রিকা মনোযোগ সহকারে পড়ে ও শ্রীচক্রবর্তির নানা ভংগীর ফোটো অপলকে নিরীক্ষণ করে।যখন সে মাইকে 'ইয়াদ আ রাহা হ্যায়, তেরা প্যার' এই লাহিড়ী-মেলোডি শুনিতে পায়, তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, বাঁশি হয় সংগীতহারা, দুচোখ জলে ভরিয়া উঠে, স্মরণে আসে প্রিয় নায়কের বিষণ্ণ, অথচ দৃপ্ত নৃত্যভঙ্গি। এই চঞ্চল, সুদূরের পিয়াসী বালক কিরূপে ইংলিশ চ্যানেল খুঁজিবে? ইহা কি তাহার কম্ম ?
যখন টুকু ইংলিশ প্ৰনালী খুঁজে পাইল না, হাল একেবারে ছাড়িয়া দিলো, বীরেনবাবু বলিলেন-' অনেক হইয়াছে, এইবার ফুচকা খাইবি আয়'। টুকু 'ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান' গাহিবার ভঙ্গিতে বীরেনবাবুর সম্মুখে হস্তদ্বয় পেছনে করিয়া, বুক চিতাইয়া দাঁড়াইল। বীরেনবাবু হাসিহাসি মুখে স্বীয় হস্তদ্বয় টুকুর কানের নীচে আনিলেন। কিন্তু, আঁতিপাঁতি খুঁজিয়াও জুলফি খুঁজে পাইলেন না। শেষে, 'হতভাগা, তোর জুলফি কোথায়?' এই বলিয়া তাহার পৃষ্ঠে মুষ্ট্যাঘাতে প্রহার করিতে লাগিলেন। ইহাতে টুকুর কিছু যাইল আসিল না, কারণ পূর্বেই বিভিন্ন শিক্ষক ও বাড়িতে পিতার নিকট নিয়মিত মার খাইয়া দুষ্ট বালকের সারা শরীরে, বিশেষত পৃষ্ঠে, কড়া পড়িয়া গিয়াছিল। মাঝখান হইতে মুষ্ট্যাঘাতে অপটু বীরেনবাবুর হাত অচিরেই ব্যথাপ্রাপ্ত হইল।
ইহার পরে একে একে টুকুর সঙ্গীদের ডাক পড়িল, ম্যাপে বিবিধ জায়গা খুঁজিতে তাহারা স্বাভাবিক ভাবেই অক্ষম হইল, কিন্তু প্রত্যেকবারই বীরেনবাবু ফুচকা খাওয়াইতে ব্যর্থ হইলেন। অপার বিস্ময়ে বীরেনবাবু দেখিলেন কাহারও জুলফি নাই। সকল জুলফিকার আলি ভুট্টোর দল রাতারাতি জুলফিহীন শ্রীচক্রবর্তীর মিনি সংস্করণে রূপান্তরিত হইয়াছে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হইয়া বীরেনবাবু ক্লাশ পরিত্যাগ করিলেন।