মুরগিবৃত্তান্ত পড়ে তিনজন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে হাঁসকে পশু আর একই সাথে মুরগিকে পাখি মনে করা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
তাঁদের মন ও মান রাখতে গেলে সত্যকে বিকৃত করতে হয়, শিক্ষক হয়ে সে কাজ করতে পারি না। আরো এইজন্য পারিনা যে আজকের ‘সত্য বৈ' শিক্ষকদের নিয়েই।
শিক্ষকদের নিয়ে যে অজস্র কাহিনী প্রচলিত আছে, সেইসব লোককথায় শিক্ষকদের বেশ জটিল ও হিসেবি চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়।
আদপে শিক্ষকরা সরল মানুষ। যাকে তাঁরা সত্যবাদী বলে জানেন, তার হাত ছাড়েন না কখনো। আর যা তাঁরা সত্য বলে জানেন, তা অন্ধভাবে অনুসরণ করেন। একজন শিক্ষকই পারেন সত্যবাদী ও সত্যকে এভাবে জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে।
আজকের সত্যভাষণের কেন্দ্রে কোনো নায়ক নেই, মানে আমি নেই। একজন নায়িকা আছেন, ঘটনাচক্রে তিনি আমার সংসারজীবনেরও নায়িকা। এমনকি নির্দেশনাও তাঁর। বাইশ বছর ধরে যে চিত্রনাট্য তিনি লিখছেন, সেখানে তিনি আমাকে ভিলেন বানিয়ে রেখেছেন।
মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেন যে তিনি না এসে অন্য কেউ এলে আমার জীবনতরী কোন্ না কোন্ অকুলে ভেসে যেতো, যেতোই। অন্য কেউ এলে কি হতো তা জানার আগ্রহ আমার খুবই আছে, কিন্তু ভদ্রমহিলার হাইট পুরো পাঁচ সাত। আর এক সময় ভলিবল টলিবল খেলে হাতের পাঞ্জাও বেশ শক্ত। আমার মতো নিরীহ মাস্টারের পক্ষে উক্ত অজানাকে জানবার চেষ্টা করা তাই কিঞ্চিৎ রিস্কি।
যখনকার কথা বলছি, ভদ্রমহিলা তখন বাড়ি থেকে আটষট্টি কিলোমিটার দূরের এক স্কুলে পড়াতে যেতেন। প্রতিদিন কষ্টকর বাসযাত্রা। এইরকম সময়ে সরকারি নির্দেশ অনুয়ায়ী সব শিক্ষকের বেতন দেবার ব্যবস্থা অনলাইন হয়ে গেলো। ডেটাবেস তৈরির জন্য সবাইকে ফর্ম ধরানো হলো।
ফর্মে যেমন থাকে, ঐ নেম, ফাদার্স/হাজব্যান্ডস নেম, এ্যাড্রেস... ব্লা ব্লা ব্লা... শেষের দিকে এসে হাইট, আইডেন্টিফিকেশন মার্ক... ইত্যাদি ইত্যাদি।
দিনটা মনে হয় রবিবার ছিলো, বা ঐরকমই কি একটা ছুটির দিন। সকাল থেকে দিদিমণির ফোন বেজে চলেছে। ফোন ধরে দিদিমণি বারবার বলছেন "মিটার-সেন্টিমিটার, মিটার-সেন্টিমিটার… হ্যাঁ হ্যাঁ... ফোনের ক্যালকুলেটর বের করে হিসেব করে নে।"
সাহস করে আমি একবার জিগ্যেস করলাম, "কে এতো ফোন করছে তোমাকে ?"
"তনিমা, বন্যা, ইয়াসমিন ওরা করেছে। কেন ?" শেষের কেন-র সাথে আগুনঝরা দৃষ্টিও যোগ হলো।
চাঁদ বললেই কেমন যেন শীতলতার অনুষঙ্গ আসে। ভদ্রমহিলার নাম কে যে চন্দ্রা রেখেছিলো, হওয়া উচিৎ ছিলো সূর্যা, ছ'হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকেন সব সময়।
উনি একটা 'কেন' ছুঁড়ে দিয়েছেন, আমাকেও সাফাই দিতে হয়। বললাম হঠাৎ সবাই এতো ফোন করছে দেখে আমার জানার ইচ্ছে হয়েছে।
জানা গেলো যে ঐ ফর্মটা সবাই ফিল আপ করছে, সেখানে যার যা অসুবিধা হচ্ছে, সবকিছুর মুশকিল আসান তাদের চন্দ্রাদির কাছে।
যথাসময়ে কিছু ফর্ম পূরণ হয়ে চলে এলো চন্দ্রাদির হাতে।
এবার দিদিমণি পড়লেন আমাকে নিয়ে, "ফর্মগুলো একবার চেক করা দরকার, বুঝলে ? প্রথমে আমি চেক করে তোমাকে দিই, তুমি আরেকবার খুঁটিয়ে দেখো।"
সব মিলিয়ে আটটা ফর্ম। তার মধ্যে পাঁচটায় দিদিমণিদের উচ্চতা দেখে চোখ উল্টে যাবার যোগাড়।
তনিমা দাস ৫ মিটার ২ সেন্টিমিটার
ইয়াসমিন্নেসা বেগম ৫ মিটার
বন্যা সরকার ৪ মিটার ১১ সেন্টিমিটার
সুমি খাতুন ৫ মিটার ১ সেন্টিমিটার
রজনী বসু ৪ মিটার ১০ সেন্টিমিটার
প্রসঙ্গত, আমার শোবার ঘরের ছাদ একটু উঁচু, মেজে থেকে চার মিটারের মতো।
চন্দ্রাদিকে এবং চন্দ্রাদির "ফুট ইঞ্চি দিস না, মিটার সেন্টিমিটারে কর," এই বাণীকে চিরসত্য ধরে নেওয়া, এরকম উচ্চ মানের সত্যানুরাগ দেখানো সাধারণ জীবের কর্ম নয়।
এর চেয়েও বেশি দুঃখের ঘটনার সাক্ষী হয়েছি চন্দ্রার সৌজন্যে। তবে সে ঘটনা শুধু দুঃখের নয়, করুণ। হৃদয়বিদারকও বলতে পারেন।
এই দ্বিতীয় ঘটনাও একই গোত্রের, মানে স্যালারিসম্পৃক্ত। যে ব্যাঙ্কে ওঁদের স্যালারি হতো তখন, তারা কে জানে কেন একাউন্ট ওপেনিং ফর্মের মতো একটা ফর্ম দিয়েছিলো ওঁদের স্কুলে। কেন দিয়েছিলো তখন জানতাম, এখন ভুলে গেছি। এ কাহিনীতে সে 'কেন' অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনীয় হচ্ছে ফর্মটা।
এই ফর্মও ধ্রুপদী কায়দায় নেম, ফাদার্স/হাজব্যান্ডস নেম, এ্যাড্রেস হয়ে সিগনেচার ইন ফুল পর্যন্ত বিস্তৃত।
হৃদয়বিদারক ঘটনার শুরু ফর্ম জমা দেবার দিন সন্ধ্যার পর থেকে।
ভিলেন আমি বাসস্ট্যান্ডে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে গৃহলক্ষ্মীর আগমন প্রতীক্ষায়। জ্যামের কারণে দু'ঘন্টার বাসজার্নি সাড়ে তিন ঘন্টায় পরিণত, ঘর্মাক্ত নায়িকা বাস থেকে নেমে বাইকে উঠতে যাচ্ছেন। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে, এপ্রিল মাস। জঘন্য গরম, হেলমেটবদ্ধ মাথা ঘাড়ের উপর থেকে খুলে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো দিদিমণির কাঁধব্যাগে।
ফোন করেছেন বড়দি, মানে প্রধান শিক্ষিকা। পরের দিন চন্দ্রা ম্যাডাম এবং অন্য দিদিমণিবৃন্দ যেন ফার্স্ট আওয়ারেই ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেন। ম্যানেজার নাকি ফোন করে বড়দির কাছে স্কুল রেকর্ড অনুযায়ী দিদিমণিদের সব্বার ম্যারিট্যাল স্ট্যাটাস অর্থাৎ বিয়ে হয়েছে কিনা এবং স্পাউসের নাম জানতে চেয়েছেন।
ঠিক এর পরে পরেই ম্যানেজারের ফোন। ম্যারেড না আনম্যারেড, সে প্রশ্ন তো করলেনই। আরো কিছু তথ্য ম্যানেজার চেয়েছিলেন সেদিন। কতোদিন বিয়ে হয়েছে, কোন বাড়িতে থাকেন, হাজব্যান্ডের বাড়িতে, নাকি আলাদা থাকেন, এইরকম সব।
ঘোর সন্দেহজনক এইসব প্রশ্নে চমকে গেলাম দুজনেই। গন্ডগোল কিছু হয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে, বড়দি বা ম্যানেজার স্পষ্ট করে বললেন না কিছু। সিদ্ধান্ত নিলাম পরের দিন দুজনে মিলে ব্যাঙ্কে যাবো।
পরের দিন গেলাম বাইক নিয়ে আটষট্টি কিলোমিটার দূরের ব্যাঙ্কে। এমনিতে দুশো আড়াইশো কিলোমিটার দূরত্বে বাইক চালিয়ে যেতে আমরা দুজনেই অভ্যস্ত। আজ বেশ চাপে আছি।
ব্যাঙ্কে পৌঁছলাম। ছোট্ট ব্র্যাঞ্চ। ভেতরে গিয়ে পরিচয় দিতেই একজন কর্মচারী "ওওও, তাহলে আপনিই চন্দ্রা দাস ঘোষ !!" বলে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেলেন।
যাবার পথে চোখের কোণ দিয়ে দেখছি অন্য ব্যাঙ্ককর্মীদের মাথা ঘুরে যাচ্ছে আমাদের দিকে। ওঁদের দৃষ্টি স্ক্যান করছে আমাদের।
ম্যানেজারের ঘরে তনিমা, ইয়াসমিন, কান্তা, রুবি, বন্যা, সুমি, রজনী, ঐশ্বর্য্য, ওরাও বসে আছে। অর্থাৎ ওদের কাছেও ফোন গেছিলো ব্যাঙ্ক থেকে।
সবার মুখ থমথমে। ম্যানেজার আগেই হয়তো অমিষ্টভাষণ করে থাকবেন।
আপাতত প্রথম এ্যাটাক আমাকে। "আপনি কে ভাই?"
আত্মপরিচয় দিলাম।
"ওঃ, আপনিই সেই কৌশিক ঘোষ," এখানে ‘সেই কৌশিক ঘোষ’ মানে কি কে জানে।
পরের বাক্যে ম্যানেজার আরেক ধাপ এগোলেন, "আপনি মশায় ভাগ্যবান পুরুষ।"
যাচ্চলে। লোকটা ফার্মা’জ লাস্ট থিওরেম নামাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি আবার ভাগ্যবান কেন ?
ম্যানেজার বোধহয় আমার চোখে অনুচ্চারিত প্রশ্ন ধরতে পারলেন। খুব পরিচিত ফর্মের একটা বান্ডিল নিয়ে ফেলে দিলেন সামনে।
"কৌশিকবাবু, আপনি নিজে একবার প্রতিটি ফর্ম খুঁটিয়ে দেখে নিন, প্লিজ।"
আগেই বলেছি হৃদয়বিদারক ঘটনা।
পূরণ করা ফর্মগুলোর কোনোটায় ক্যান্ডিডেটের নাম তনিমা দাস, পরেরটায় ইয়াসমিন্নেসা বেগম, আবার কোনোটায় রুবি রায়চৌধুরী। বাকিগুলোর প্রত্যেকটায় এরকম একেকজন দিদিমণির নাম লেখা।
প্রতিটিতেই ফাদার্স/হাজব্যান্ডস নেমের প্রথমটা, অর্থাৎ ফাদার্স, কেটে দেওয়া হয়েছে, এবং হাজব্যান্ডস নেম লেখা আছে কৌশিক ঘোষ। আর এ্যাড্রেসের পাশে যা লেখা আছে সে ঠিকানায় চন্দ্রা ম্যাডাম তাঁর ডোমেস্টিক হাজব্যান্ডটিকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন প্রায় দু’দশক ধরে।
তদন্তে প্রকাশ পেলো ওরা প্রত্যেকেই চন্দ্রাদির ফর্ম দেখে হুবহু কপি করে জমা দিয়েছে। শুধু প্রথমে নিজের নামটুকু লিখেছে। তারপরে আর কোন্ কলামে কি লিখতে হবে, তা না দেখে স্রেফ চন্দ্রাদির ডেটাগুলোকে কপি, এ্যান্ড দেন পেস্ট।
যৌবনে ছাত্ররাজনীতির পথে হেঁটে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলাম। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে জানলাম যে শুধু অন্যের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান নয়, অন্যের আরো অনেক কিছুই আমাদের বলে ঘোষণা করা যায়। ভুল করে হলেও করা যায়।
ফিরে আসার পথ ধরলাম। দুজনেই চুপ। বাইক চালাতে চালাতে আটষট্টি কিলোমিটার দূরত্ব আর কিছুতেই শেষ হয় না। মনে হচ্ছিলো আটশো কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছি।
ঐ যে বারবার বলছি না, বড়োই হৃদয়বিদারক? হৃদয়ঘটিত বিষয় বুঝতেন এমন এক কবি লিখে গেছেন ‘এমন কেন সত্যি হয় না আহা।’ অবশ্য তিনি লিখেছেন বীরপুরুষদের প্রসঙ্গে, আমি ক্ষীণজীবি মাস্টার মাত্র।
পুনশ্চ ২ :
সত্য বৈ ১-এর মতো ২-এর বেলাতেও আমার সংশয় আছে যে কেউ কেউ এসব ঘটনাকে অসম্ভবের তালিকায় রাখবেন। কিন্তু যা রটে, তার কিছু যেমন নিশ্চয়ই বটে, ঐরকমই, যা লেখে, তার সবটাই নিশ্চয়ই দেখে।
অবিশ্বাসীচমূর অবগতির জন্য জানাই যে দ্বিতীয় ঘটনার পরে কিন্তু প্রায় তিন সপ্তাহ দাম্পত্য চোখ রাঙানি দেখতে হয়নি। সহকর্মীদের কান্ডে চন্দ্রা লজ্জিত হয়েছিলেন হয়তো।
তবে হ্যাঁ, বাঘিনী যতোই নরম স্বরে ডাকুক না কেন, হালুম কি আর মিঁয়াও হয় ?