যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না
সদ্য জয়েন করেছি স্কুলে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন। স্কুল থেকে তিন কিলোমিটার আগে এক ব্যাটা বেবুনপাজিহতচ্ছাড়া মুরগি আমার চলন্ত বাইকের সামনের চাকা আর পেছনের চাকার মাঝের ফাঁকটাতে ঝাঁপ দিলো। একদম ডেলিবারেটলি। উইদাউট এনি প্রোভোকেশন। ডিপ্রেশন এ্যান্ড ওয়ার্কপ্লেস স্ট্রেস ছিলো মনে হয়। দীর্ঘদিন ধরে কেউ ওকে রান্নার চেষ্টা করেনি। তাই হয়তো ঝাঁপ।
পেটের ওপর দিয়ে চাকা গেলে কি আর মুরগি বাঁচে ? মুহূর্তে হৈ হৈ। দেড় মিনিটে ভিড়। সাড়ে চার মিনিটের মধ্যে আমি ঘেরাও।
ড্রোন দিয়ে ভিডিও তুললে সে যে কি অসাধারণ হতো, লং শটে অজস্র কালো কালো মাথার ভিড় দিয়ে শুরু করে মুরগির শবদেহের ক্লোজআপে শেষ।
ওতদঞ্চলে প্রচলিত ব্যবস্থা হলো কয়েক জেনারেশনের দাম নেওয়া ('এই এলাকা' এতদঞ্চল, 'ঐ এলাকা' তেমনি ওতদঞ্চল)।
ওতদঞ্চলের প্রথা মেনে ততক্ষণে হিসেব শুরু হয়ে গেছে।
এই একটা মুরগি পাঁচটা ডিম পাড়তো। যদিও মুরগিটাকে দেখে আমার স্পিনস্টার মনে হয়েছিলো, নেহাৎ বেপাড়া বলে মুখ খুললাম না। হিসেবের কড়ি ওদিকে বাড়ছে কমপ্ল্যান খাওয়া বাচ্চার মতো।
এর ডিম ফুটে বাচ্চা হলে তার মধ্যে অন্তত দুটো ডিম্ববতী মুরগি পাওয়া যেতো। তারা ডিম দিতো, সেগুলো ফুটে বাচ্চা হলে... মোট উনিশটা মুরগির সবশুদ্ধ দাম দাঁড়ালো উনিশ ইনটু দেড়শো ইজিক্যাল্টু সাড়ে সাতাশ শো। বার্গেনিং টার্গেনিং করে শেষে "দ্যান তবে দু'হাজার।"
ভিড়াক্রান্ত আমি তখন নার্ভাস। সদ্য জয়েন করেছি, সার্ভিসের এ্যাপ্রুভ্যাল হয়নি, এটিয়েম কার্ড ফার্ড নেই। মানে কার্ড আছে, কিন্তু সে বাবার কার্ড। স্যালারি হতে আরো দেড় মাস। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তিল, কালোজিরে আর সর্ষে তিনটে ফুলই একসাথে দেখতে পাচ্ছি চোখে।
যথাসময়ে ডেলিবারেশন শুরু হলো। কর্পোরেট দুনিয়ার ভাষায় ডিউ ডিলিজেন্স। মুরগির তিন পুরুষের দাম ভার্সেস মাস্টার কতো টাকা দেবে, দীর্ঘ আলোচনা।
আমি ভয়ে ভয়ে বলার চেষ্টা করলাম, "না, ইয়ে মানে... দেখুন, ছাগল এত্তো বড় একটা প্রাণী, ছাগল হলে তো খুব বাজে ব্যাপার হতো। এ তো ছোট একটা মুরগি, মানে যদি কিছু কমসম করে..."
ভাগ্যবানের বোঝা বলে কথা। ভগবান মনে হয় ফ্রি ছিলেন সেদিন, যথাযথ কনসেনট্রেট করলেন আমার কেসে।
প্রকৃত ভক্ত হলে যা হয়, আমি ভগবানের কথা ভেবে একটু বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। জ্ঞান ফিরলো চারপাশে গুণগুণ ধ্বনি কানে আসায়। ভিড়ের মধ্যে সবাই ঘুষ নিয়ে আলোচনা করছে।
ঘুষের ট্যাকার কি হবে ? ঘুষের ট্যাকাটা পাওয়া যাবে না?
কথাগুলো কেমন যেন লাগলো, বারবার কেন ঘুষের টাকার কথা ? আমি এখন প্রাণীসম্পদ দপ্তরের অধীনে। অন্য অনেক দপ্তরে ঘুষ টুষ চলে শুনতে পাই। প্রাণীসম্পদ দপ্তরের এ বদনাম কখনো শুনিনি।
তাহলে কি মুরগিটা সুইডেন থেকে আনা ? বোফর্স চিকেনস্ লিঃ ? ফোনওয়ালা সামসুঙ জাহাজ বানায়, কামানওয়ালা বোফর্সের মুরগি বেচতে অসুবিধা কোথায় ? আপাতত মুরগির সাথে ঘুষের এছাড়া আর কোনো সম্পর্ক মাথায় আসছে না।
লোকজন এদিকে শিবে নামে কাকে যেন ডাকাডাকি করতে শুরু করেছে। চুড়িদার পরা বছর দশেকের একটা ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে ভুঁড়িদার একজন প্রৌঢ় এসে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন।
মুরগির সমব্যথীরা জানালেন ইনিই মুরগির মালিক, এঁর বাড়িতে চল্লিশটা মুরগির ঘোরাঘুরি ওড়াউড়ি নিত্য। তারই একটা কোনোভাবে ছিটকে এসে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। এবং প্রৌঢ়ের নাম শিবনাথ ঘোষ।
প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত লোকদের মনে যা-ই থাক, কাজে এবং কলমে, মুখেও, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। নৈহাটির ওদিকের এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সেই দেড়শো বছর আগে লিখে গেছেন "ঘোষকে ঘোষ না দেখিলে দেখিবে কে ?"
মানে এটাই লিখতে চেয়েছিলেন আর কি। পোস্টিং ছিলো বহরমপুরে, আমিও বহরমপুরের ছেলে, তাই জানি ওনার লেখালিখির পেছনে আসল গল্পগুলো। স্রেফ প্রশানিক নিরপেক্ষতার দায়ে ওঁর পাব্লিশার "বাঙালিকে বাঙালি না দেখিলে..." করে দিয়েছিলো লাইনটাকে।
শিবনাথ ঘোষের সাথে আমার ইন্ট্রো পর্ব মিটলো। মুরগিনাথের নাম শিবনাথ ঘোষ, আমিও ঘোষ। অতএব আমার ভাগ্যাকাশে নবারুণ একদম লালে লাল হয়ে উদিবে আবার, এ আশা করাই যায়।
কিন্তু লোকটার মুখজুড়ে বিরক্তি, অকারণ বিরক্তি মুখে কেমন একটা ছাপ ফেলে রেখেছে। ইনি পদবীসূত্রে 'ঘুষ' হলেও মুরগির অকালপ্রয়াণের খবর পাব্লিকের কাছে শুনে নিশ্চয়ই ক্ষিপ্ত। হেলমেটটা খুলে ফেলে ভালো করিনি, প্রথম চোটটা শিওর মাথার ওপর দিয়ে যাবে।
আর পাব্লিকের যা মুড দেখছি, প্রথমে এখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে, "ঘুষের মুরগি আজ আর আমাদের মধ্যে নাই।" তার একঘন্টা পরে আমার স্কুলে নীরবতা পালন করা হবে, "কৌশিক স্যার আজ আর আমাদের মধ্যে নাই।" গণপ্রহারে হত ১, দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি।
হায় মূর্খ মানুষ, দিব্যদৃষ্টিতে যা দেখতে পাইনি তা হলো ভগবান ততক্ষণে আমার মাথার ওপরে ফাঁকা জায়গাটায় ফুট দুয়েকের দূরত্বে চলে এসেছেন এবং পুরো চেইন অভ্ ইভেন্টস্ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন।
উত্তেজিত জনতা শিবনাথকে জানালো যে জিরো জিরো সেভেনের বাচ্চা এই নতুন মাস্টারটা সাউন্ড ব্যারিয়ার ভেঙে বাইক চালাচ্ছিলো আর স্রেফ সনিক বুমের ধাক্কায় মুরগিটা মারা গেছে।
বৃদ্ধ শিবনাথ আধবোঁজা চোখে সব শুনে হাত তুললেন। চেঁচামেচি বন্ধ এক মুহূর্তে। একবার সবার মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শিবনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন আমার দিকে।
তারপর বললেন, "শুনো নতুন মাস্টার, ছাগল আর হাঁস উইত্তি পারে নাআআ। ইয়ারা পশু। ইয়াদের চাপা দিলিই ফাইন লাইগবে। কিন্তু মুরগিইই, উ তো উইত্তি পারে, উ পশু না, উ তো পাখিইই। চাপা পইল্লি কুনো ফাইন নাই, ট্যাকা লাইগবে না। যাও নতুন মাস্টার, যাও। ইশকুলে চইলি যাও।"
আমি একবার একটু আমতা আমতা করে বলতে গেলাম... কি বলতে গেলাম কে জানে। শিবনাথ আবার বললেন, "তুমাকে তো বইল্লাম,নতুন মাস্টার, হাঁস হইচ্ছে পশু, উইত্তি পারে না। ফাইন লাইগবে। মুরগি উইত্তি পারে, মুরগি হইছে পাখিইই। চাপা পইল্লি ফাইন নাই।"
পুনশ্চ :
গুরুচন্ডালীতে অনেক ক'টা নাস্তিক আছে। তাদেরকে কিছু বিশ্বাস করানো খুব কঠিন। মুরগিবৃত্তান্ত পড়ে প্রথমেই বলবে সবই ঢপ, পুরো গ্যাস খাওয়ালাম। এদের মতো পাব্লিকই টীকো ব্রাহেকে পুড়িয়ে মেরেছিলো পৃথিবী ঘোরে বলার জন্য। টীকোর কাছে আমি বাচ্চা ছেলে। কাজেই যতোই সত্যি বলি না কেন... যাকগে।
ভয় একদম পাইনা, তা না অবশ্য। শুভম একদিন বাড়ি ফেরার সময় চুড়িদার পরা একটা মেয়েকে চাঁদের উপরে পা তুলে বসে থাকতে দেখে এসে আমাদের কাছে গল্প করেছিলো। দময়ন্তী এসে গল্প শুনে যা ঝাড় দিলো রে। বললো শুভম গাধামো করছে, মেয়েটার গায়ের, হ্যাঁ, গায়ের, পোষাকটার নাম নাকি চুড়িদার নয়। তা বাবু আমি কিন্তু শিবনাথের নাতনিকে গায়ে চুড়িদার পরেই আসতে দেখলুম। ও পোষাকের ঐ চুড়িদার নামটাই জানি।
তা এখন যদি গাধামো বলে তো বলবে। সত্যের পথ, হুঁ হুঁ বাবা, কোনোদিনই কি কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো ?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।