অমিয়ভূষণ মজুমদারের জন্ম ১৯১৮ সালের ২২শে মার্চ। এ বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু এ কথাও আমাদের জানা এই বিরল প্রজাতির লেখকের জন্মশতবর্ষ সাহিত্যসংস্কৃতি জগতের প্রখর আলোর নীচে আসবে না। বিপণন কৌশলের অন্যতম শর্ত হয় সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্যতা। প্রতিষ্ঠান তাই চায়। জনচিত্তজয়ী লেখমালা, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া ও অন্যান্য বিনোদনের জন্য প্রচারের পাদপ্রদীপের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাকে আরও মহিমা দান করে কৌশলী প্রতিষ্ঠান। ব্যতিক্রমী স্রষ্টার জন্য থাকে কিছু মননশীল পাঠক, ব্যতিক্রমী সৃষ্টির গৌরবকে তাঁরা অনুধাবন করতে পারে, সেই রচনাকে তাঁরা কুর্নিশ জানায়। এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে নগণ্য। কিন্তু কালোত্তীর্ণ মহৎ সৃষ্টির তাতে কিছু আসে যায় না। সেখানেই অমিয়ভূষণ সৃষ্টি আলাদা হয়ে গেছে চলাচলের নিরাপদ পথ থেকে। আর এক মজুমদার, কমলকুমারের মতই তাকেও বিদগ্ধ পাঠক এবং সমালোচক ‘লেখকদের লেখক’ হিসেবে গণ্য করেছেন।
বাংলাভাষায় যারা ছোটগল্প এবং উপন্যাস লিখছেন বা গত ত্রিশ/চল্লিশ বছরে যা লেখা হয়েছে, সামান্য কয়েকজনকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকছে, সেগুলো পড়ে মনে হতেই পারে চলাচলের নিরাপদ, প্রথাগত পথকেই তারা বেছে নিয়েছেন। ব্যক্তিবিশেষের গল্প বলার ভঙ্গিতে একটু উনিশবিশ হচ্ছে, কিন্তু তুলনামূলক ভাবে অপ্রচলিত কোনও লিখনশৈলী, যার ব্যতিক্রমী প্রকরণ আন্দোলিত করতে পারত সনাতন কাঠামো, গল্পবলার প্রথাগত প্রকরণকে আক্রমণ করে খুঁজে আনতে পারত নতুন কৌশল – তেমন বারুদগন্ধী বিপজ্জনক পথে প্রায় কেউ নেই। হাতে গোণা দুচারজনের লেখায় সেই দুঃসাহসের ইশারাটুকু কখনও ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছবার জন্য একটা আকুতি বোধহয় লেখার সময় গোপনে কোথাও কাজ করে। লেখক-পাঠক communication- এর দায়, সেতুবন্ধনের গোপন প্রবৃত্তি পরোক্ষে কাজ করে। সেই দায় গল্প বলার দুঃসাহসী নতুন পথের খোঁজ না করে সহজভাবে শেষ পর্যন্ত পাঠককে একটা গল্প শোনাতে চায়। তখন সমঝোতার প্রশ্ন আসে। কেমন হবে আমার বলার ভঙ্গি, কাদের জন্য আমি গল্প লিখছি, সমাজের কোন শ্রেণীর মানুষের কাছে আমি আমার বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে চাই, emotional factor, নাকি cerebral factor – কাকে বেশি প্রাধান্য দেব।
তখন যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবে উঠে আসে, তা হল – সাহিত্য কি একধরণের বিনোদনের উপকরণ, নাকি আমাদের জীবনযাপনে অবিরত যে সংশয়, যে সংকট আমাদের বেঁচে থাকাকে বিপদগ্রস্ত করে রাখে, তাকে উন্মোচিত করা। আমাদের বেঁচে থাকার গ্রাফ তো কখনওই সরলরেখা নয়। অজস্র উঁচুনিচু রেখা। বিচিত্র, রহস্যময়। প্রেম, অপ্রেম, ঘৃণা, ভালোবাসা, পেটের খিদে এবং যৌনতা, কাম ও ঘাম, অশ্রু এবং রক্ত – এসব কিছুই একজন লেখকের কালির সঙ্গে মিশে থাকে। এর ভেতর কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ – সেটা নির্দেশ করার দায় লেখকের নয়। সে দায় সমাজসংস্কারকদের, সমাজসেবীর, গুরুদেবের, আচার্যদের, যুগাবতার মহাপুরুষদের। লেখক শুধু সত্ত্ব এবং তমঃ, আলো এবং আঁধারকে শিল্পসম্মতভাবে চিহ্ণিত করেন। যদি বিনোদন হয়, তবে সে লেখায় cerebral factor –এর কোনও প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে বাণিজ্যমুখিনতাই প্রধান বিচার্য বিষয়। পাঠকের ইচ্ছাপূরণের জন্য গল্প চাই। পাঠকের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়ার কয়েকটা সমীকরণ থাকে। সে সব পড়ার পর একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় শুধু। কিন্তু যে রসায়নে অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘অ্যাভলনের সরাই’ বা ‘সাইমিয়া ক্যাসিয়া’ চিরকালের জন্য সিরিয়াস পাঠকের মনে আসন পেতে বসে, সে রসায়ন এসব বাণিজ্যমুখী গল্পে থাকে না। সাহিত্যের একটি ধারা বিষয়, লিখনশৈলী ও বর্ণনকৌশলে জনমনোরঞ্জনের পথ অনুসরণ করে। পাঠকের মনে সাময়িক তৃপ্তি দেয়। এসব লেখায় লেখকের সবসময় একটা দায় থাকে পাঠকের সঙ্গে communicate করার। লেখকের চিন্তার স্বাধীনতা থাকলেও মনে হয় তিনি কোনও শর্তাধীন হয়ে লিখছেন। পাঠকের চাহিদার সঙ্গে সমঝোতার লক্ষণ সে সব লেখায় স্পষ্টই বুঝতে পারা যায়। বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের তীব্র, অপূর্ণ বাসনাপূরণের গল্প। এ সব কাহিনী দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা খুব সাময়িক। দু’দশ বছর গড়িয়ে গেলে সে লেখা সময়ের মহাঝঞ্ঝায় শুকনো, বিবর্ণ পাতার মত কোথায় উড়ে যায় – ভবিষ্যতের পাঠক বা সমালোচক তার কোনও হদিশ পায় না। কালগর্ভে লীন হয়ে যায় সেই সাহিত্যকর্ম। অমিয়ভূষণ খুব সচেতন ভাবেই সে পথে কোনও দিন হাঁটেননি।
লেখককে তো ইতিহাসসচেতন হতেই হয়। না হলে কীভাবে তিনি এই সভ্যতার, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার কথা লিখবেন। মানুষ কত দীর্ঘপথ দিল। কত ধর্মযুদ্ধের নামে অন্যায় যুদ্ধ, এখনও ডাইনির মাংসপোড়া গন্ধে উল্লাস শোনা যায়, কত সাম্রাজ্যের উত্থানপতন হল। এসব কিছু মন্থন করে জীবনের রহস্যময়তার কথা, কোনও এক সার সত্যের সন্ধান করে যান লেখক। পুরাণের নতুন পাঠ, মঙ্গলপাঠের নবনির্মাণ, যে পাশ্চাত্য লেখনরীতিকে মডেল করে একসময় আধুনিকতার সংজ্ঞা ঠিক করা হয়েছিল, তাকে অতিক্রম করে দেশজ পাঁচালি, ব্রতকথা, পুরাণ, মঙ্গলকাব্যের বিনির্মানের মধ্য দিয়ে,আমাদের লোককথা, উপকথাকে নতুন আঙ্গিকে লিখছেন অনেকেই। অমিয়ভূষণমনস্ক পাঠক অবশ্যই লক্ষ করে দেখেছেন ধূসর অতীত নয়, অমিয়ভূষণের লেখায় এসেছে অনতিঅতীত। গড় শ্রীখণ্ড, রাজনগর, মধু সাধুখাঁ উপন্যাসের পটভূমি মানবসভ্যতার সুদূর অতীত নয়, চাঁদ বেনে ব্যতিক্রম, কিন্তু সেখানেও অতীত এবং সমকাল পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যের তিন ব্যতিক্রমী গদ্যকার হিসেবে ধরা হয় কমলকুমার মজুমদার, জগদীশ গুপ্ত এবং অমিয়ভূষণ মজুমদারকে। লেখকদের লেখক হিসেবে অনেক সমালোচক তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী কালে নবারুণ ভট্টাচার্য, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, রবিশঙ্কর বল এবং আরও দু’একজনের লেখায় আমরা সেই লিখনের ব্যতিক্রমী শৈলী দেখেছি। জনমনোরঞ্জনের জন্য এরা কোনও দিনই লেখেননি। বাংলা সাহিত্যের সাধারণ পাঠকদের অনেকে এই লেখকদের নামও হয়তো শোনেননি। অমিয়ভূষণ এদের মধ্যে নিজস্ব মেজাজে অনন্য হয়ে উঠেছেন। সেটা তাঁর বিচিত্র বিষয় নির্বাচনের জন্য হতে পারে। হতে পারে তাঁর অননুকরণীয় লিখনশৈলীর জন্য। এবং অবশ্যই তাঁর লিখন সম্পর্কে নিজস্ব দর্শনের জন্য। তার নিজের কথাতেই ‘ হায়ার ফিজিক্স যেমন সর্বজনগ্রাহ্য করা যায় না, সাহিত্যকেও তেমনই সর্বগ্রাহ্য করা যায় না’। এই একটি কথাতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি যা বলতে চান, সেটি বুঝে নেবার দায় পাঠকের। যে কোনও বিষয়ের গভীরে যাওয়ার জন্য বিশেষ অভিনিবেশ এবং মননশীলতার যদি প্রয়োজন হতে পারে, তবে সাহিত্যকর্মটির অন্তরালে যে রসের সৃষ্টি লেখক তৈরি করলেন, তাকে বুঝে নেবার জনই বা পাঠকের বিশেষ ধীশক্তির প্রয়োজন কেন থাকবে না। এই যুক্তি থেকে অমিয়ভূষণ কোনও দিন সরে আসেননি। তাই, এ বঙ্গে অমিয়ভূষণের পাঠককুল সর্বার্থে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে লেখক কি পাঠকের সঙ্গে communication চাননি ? একজন স্রষ্টা অবশই চাইবেন। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু বিরল প্রজাতির লেখক থাকেন, তাঁরা তাঁদের উচ্চ অবস্থানেই থেকে যান অভিজাত একটা অহংবোধ বা দাপট নিয়ে। সেখান থেকে নীচে নেমে এসে জনচিত্তজয়ী বিনোদনমূলক লেখার প্রতি কোনও দিন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন না। অমিয়ভূষণ আপোষহীন ছিলেন নিজের লেখা নিয়ে।
আসলে সত্যকথন এবং সেই কথনভঙ্গী কেমন হবে, সেই রীতি একেবারেই লেখকের নিজস্ব দর্শনসঞ্জাত। অমিয়ভূষণের লিখনভঙ্গী এখনও অননুকরনীয় থেকে গেছে। তাঁর Text এবং Discourse নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় Text হয়তো এমন কিছু অভিনব নয়, কিন্তু সেই Text-কে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত, চলন এবং বর্ণনকৌশলে রয়েছে Discourse-এর ম্যাজিক। বিশেষ করে Text-প্রেক্ষিতে conversation, subject, object, statement-এর মাঝে যে semiotic ব্যঞ্জনা তিনি প্রয়োগ করেছেন, তার ফলে তাঁর গদ্য বিদগ্ধ পাঠকের কাছে প্রচলিত শব্দের আড়ালে অন্য চিত্রকল্প তৈরি করেছে। ব্যতিক্রমী গদ্যকার হিসেবে চিহ্নিত হ’ন অমিয়ভূষণ মজুমদার। চিন্তাভাবনায় ক্ল্যাসিকপন্থী, কখনও মনে হয় দাম্ভিক, অথচ ‘অতি বিরল প্রজাতি’র মত অতি আধুনিক, দুঃসাহসিক লেখাও তিনি লিখেছেন। এমন কথাও শোনা যায়, ব্যক্তিগত যাপনে রক্ষণশীল, সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন, অথচ তাঁর প্রচুর লেখায় পাচ্ছি প্রান্তিক মানুষের জীবনচর্যার কথা। তাঁদের সুখদুঃখের কথা, এমন কী কখনও তাঁদেরই Dialect-এ নিখুঁত ভাবে উঠে এসেছে।
অমিয়ভূষণের পরে যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে যাঁর লেখায় আমরা প্রথম বৌদ্ধিক চলন খুঁজে পেলাম, তিনি অমিয়ভূষণ মজুমদার। এবং যা হয়, এ ধরণের লেখা, cerebral factor যার প্রধান লক্ষণ, সে লেখা কখনই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য পায় না। গড় শ্রীখণ্ড, রাজনগর, মহিষকুড়ার উপকথা, মধু সাধুখাঁ, ফ্রাই ডে আইল্যান্ড, নরমাংসভক্ষণ এবং তাহার পর, চাঁদবেনে – বাংলা সাহিত্যের এ সব অসাধারণ সম্পদ প্রকাশিত হয়েছে অবাণিজ্যিক ছোট পত্রিকায়। কোনও বড় কাগজে নয়। কিন্তু নিরপেক্ষ সমালোচক এবং বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকের নজর এড়ায়নি, ক্ষমতাশালী লেখককে চিনে নিতে দেরি হয়নি।
ইংরেজি সাহিত্য ছিল প্রবল পছন্দের বিষয়। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া অন্য কোনও লেখকের দিকে তাঁর উদার দৃষ্টি ছিল না। বিতর্কিত ছিলেন নানা কারণে। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মোপাসনা, নিরাকার ঈশ্বরের কল্পনা অথচ তাঁকে সাকার হিসেবে কখনও স্বীকার করে উপস্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর ঈষৎ বঙ্কিম আপত্তি ছিল। সমসময়ের কোনও লেখাই তাঁকে আকৃষ্ট বা প্রভাবিত করতে পারেনি। শেক্সপিয়র, স্কট, ডিকেন্স, মান, টলস্টয়ে আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কখনও মনে হয় ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ওপর বোধ হয় তাঁর বেদনা এবং দুর্বলতা রয়েছে। অথচ তাঁর সমগ্র রচনা পাঠে এই প্রতীতিও জন্মায় সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, চিরকালের বঞ্চিত মানুষদের কথাই হয়তো চিরকাল বলতে চেয়েছেন। কিন্তু সে বলার ধরণই আলাদা। মানুষের মনের দুর্গম রহস্যকে ছুঁয়ে দেখা, ইতিহাস এবং সমকালকে জুড়ে দেবার magic discourse, কথাবুননের আশ্চর্য কুশলতা এবং ভাষার সেই অনিবার্য দার্ঢ্য তাঁকে আলাদা করে দেয়। তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্যক্তি অমিয়ভূষণ নয়, লেখকস্বত্তা এখানে ব্যক্তিকে অতিক্রম করে। নির্মোহ লেখক, ঘটনা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখেন। তারপর শুরু হয় মেধামন্থন। লেখা হয় গড় শ্রী খণ্ডের মত মহতী উপন্যাস। তাঁর সাইমিয়া ক্যাসিয়া থেকে এক টুকরো গদ্য তুলে আনছি। ‘ ...সামনে, যাকে স্কাইলাইন বলে, সেখানে একটা পাহাড়ের কাঁধ। ঠিক এখানেই কালো পাটকিলে পাহাড়টার গায়ে বেশ খানিকটা জায়গা শাদা, না জানা থাকলে ধস নামার চিহ্ন বলে মনে হবে। পেমার বাড়ি থেকে অন্য রকম দেখতে পাওয়া যায়। কিম্বা দেখতে পাওয়া যায় কথাটা ঠিক হলো না। পেমা জানে বলেই বলতে পারে তার বাড়ির বাইরের দিকের বারান্দা থেকে সোজা পথে দু’ফার্লং আর ঘোরা উৎরায়ের পথে হেঁটে দু’মাইল গেলে ওখানে একটা কোয়ার্টজ্ জাতীয় পাহাড়ের গুহা আছে। সোজা কথায় বলতে হবে ধূমল রঙের একটা চমরী বাছুরের শাদা কপাল, পাঁশুটে শাদা জিভ; জিভের সরু হয়ে আসা ডগাটা নিচের পথটার ধারে নেমে এসেছে। শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের এই নির্জন পাহাড়টাকে বাচ্চা-চমরী বলা হ’য়ে থাকে’।
এই যে একটা পাহাড়কে বিশেষ লক্ষণ দিয়ে পরিচিত করানো, এই উপমার জন্য শব্দের অপ্রচলিত Diction, স্থান-কাল-পাত্রের অভিনবত্ব – এই গল্পেই চরিত্রগুলো হচ্ছে পেমা, থেন্ডুপ, শাও চি, রিম্পোচে, গিয়াৎসো; এসেছে লালফৌজ, অতীশ দীপংকর, এসেছে গল্পের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষায় স্থানীয় প্রবাদ ( উত্তুরে কুকুর যখন চিল্লানী শূকরীকে মাতৃত্ব দেবে, তখন অমিতাভ আর থাকবে না পৃথিবীতে), সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে এই প্রেক্ষিত নতুন। আর গল্প বলার ভঙ্গিমা একেবারেই স্বতন্ত্র। চমক লাগে বই কী। অন্য লেখদের থেকে তিনি মুহূর্তেই আলাদা হয়ে যান শৈলীর স্বাতন্ত্র্যে। তাঁর অদ্ভুত বিষয় এবং Narrative-এ রয়েছে চতুর Diction. ফলে অনেক সময়েই মনে হয় গল্প বলার ঔপনিবেশিক ধারাটি তিনি গ্রহণ করেছেন। বিশেষ কোনও Imagery গঠনের জন্য তাঁর উপমাগুলি বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রয়োগ। এই গল্পেই দেখুন পাহাড়ের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন -- ধূমল রঙের একটা চমরী বাছুরের শাদা কপাল, পাঁশুটে শাদা জিভ; জিভের সরু হয়ে আসা ডগাটা নিচের পথটার ধারে নেমে এসেছে। শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের এই নির্জন পাহাড়টাকে বাচ্চা-চমরী বলা হ’য়ে থাকে’। হঠাৎ মনে হয় কোনও বিদেশি গল্পের অনুবাদ পড়ছি। এই ধারা তিনি দ্বিধা না করেই তাঁর লেখায় এনেছেন।
আর একটি বিষয় নিয়ে সম্ভবত তাঁর তীব্র প্যাশন ছিল। অনেক লেখাতেই ব্যাপারটা ঘুরে ফিরে এসেছে। সেটা হ’ল সংকরায়ণ। তাঁর জীবন কেটেছে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে পরিধি অঞ্চলে। এক সময়ের কোচ রাজাদের করদ রাজ্য, মহারাজার শহর কোচবিহারের ভারতভুক্তি হয় ১৯৪৯-এ। আজীবন এই শহরে বাস করে সাহিত্যসৃষ্টির কাজে মগ্ন থেকেছেন অমিয়ভূষণ। এ অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের বৃত্তান্ত তাঁর লেখায় এসেছে। এসেছে ডুয়ার্সের গাঢ় সবুজ অরণ্যের কথা, এসেছে মেচ-কোচ-খেন-রাভাদের কথা। এসেছে পাহাড়ের মানুষদের কথা। মহিষকুড়ার উপকথা তাঁর এক অসাধারণ উপন্যাস। দু’টি ভিন্ন প্রজাতির সংকরায়ণ এবং তার ফলে উন্নত বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতির কথা অদ্ভুত এক Metaphor-এর প্রয়োগে এই উপন্যাসকে ধ্রুপদী করে তুলেছে। অরণ্যসংলগ্ন গ্রামে কবে যেন এসেছিল বাইসন( Indian gaur), বুনো সেই প্রাণীর সঙ্গে মিলন হয়েছিল গ্রামের কোনও গৃহপালিত গাভীর। এই ইশারাটুকু নিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়। আবার সাইমিয়া ক্যাসিয়া, উরুণ্ডি বা অ্যাভলনের সরাই গল্পেও ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে সংকরায়ণের কথা রয়েছে। কৌমের শুদ্ধতা রক্ষা, আবার এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তর্মিলনের কথা তাঁর বিষয় ছিল। সাইমিয়া ক্যাসিয়া গল্পেও দেখি হান্ একজন লালফৌজের মেজর এবং অন্য গোষ্ঠীর যুবতী পেমার মধ্যে যৌন সংসর্গের আভাস। যুদ্ধের সময় যারা বাস্তুহারা হয়েছিল, তাদের অনেক পরিবারকেই পুনর্গঠিত ইয়োরোপের এ-নগরে ও-নগরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। সেই রকম একদল উদ্বাস্তুদের নিয়ে গল্প ‘অ্যাভলনের সরাই’। দলে কত রকমের মানুষ একসঙ্গে কতদিন ধরে হেঁটে চলেছে অ্যাভলের সরাই-এর খোঁজে। সেখানে পৌঁছতে পারলেই আর কোনও কষ্ট থাকবে না। দলে রয়েছে মুখোশ পরা সাইমন, গল্পের একদম শেষে জানা যায় যুদ্ধ তার নাক উড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে ভয়ঙ্কর দু’টি শূন্য গহ্বর। দলে ছিল নিনা, এক সুন্দরী যুবতী। শহরে পলিটেকনিকের ছাত্ররা ছিল তার শরীরের খরিদ্দার। সেই নিনার সঙ্গে সাইমনের সম্পর্কের ইশারা রয়েছে। এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল সরাই আর মাত্র বেয়াল্লিশ কিলোমিটার। শেষ পর্যন্ত ওরা একটা খাদের কিনারে এসে পোয়ঁছেছিল, যেটা একটা দড়ি ধরে পার হতে হয়। মুখোশ খুলে দড়ি ধরে প্রথম লাফ দিয়েছিল সাইমন। তখনই নিনা দেখেছিল সাইমনের নাকের ফুটোর জায়গায় অতল গহ্বর, নিনা পাগল হয়ে গিয়েছিল। আর বংশে যাতে সংকরায়ণ না ঘটে, রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য পুত্রবধূ এবং শ্বশুরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে দুঃসাহসিক লেখাটিও এক অতি বিরল উপন্যাস।
সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল – ‘দর্শনের জন্য দর্শন, বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান, তেমনি সাহিত্যের জন্যই সাহিত্য। শিল্পের জন্মটাই আসল কথা। এই শিল্পের ভেতরেই সব কিছু থাকতে পারে। মানুষের কান্নাঘামরক্ত, পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের প্রেম, ঘৃণা। তাঁর এই ‘সাহিত্যের জন্য সাহিত্য’ ধারণার জন্য তাঁর কিছু বামপন্থী লেখকবন্ধু তাঁর অনেক বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘লিখনে কী ঘটে’ বইতে তিনি লিখেছেন –‘ আমি কেন জন্মালাম ? পৃথিবীর চূড়ান্ত সুখ, চূড়ান্ত শান্তি থেকে বঞ্চিত হলাম। এইভাবেই ফ্রাস্ট্রেশন আসে। সাব্কনশাসে ঢুকে যায়। সাব্কনশাসে ঢুকে ভাবে এর থেকে বাইরে যাবার পথ কই। শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত সেই মুক্তির পথ খোঁজে’।