দীর্ঘ দুবছর ধরে চলে আসা ভাঙ্গড় আন্দোলনে সম্প্রতি (১১ই আগস্ট) সরকার ও পাওয়ার গ্রিড কতৃপক্ষের সাথে আন্দোলনকারীদের একটি চুক্তি সই হয় এবং এর মধ্যে দিয়ে জঙ্গি প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে গ্রামবাসীরা সরে আসেন। আপাততঃ দেখা যাচ্ছে চুক্তির প্রতিশ্রুতিমত সরকার ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করেছেন এবং ভাঙ্গড় সাবস্টেশনের কাজও গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় নতুন করে চালু হয়েছে। কিন্তু একটু কান পাতলেই শোনা যাবে এই চুক্তি নিয়ে নানারকম বক্তব্য হাওয়ায় ভাসছে। একদিকে যেমন ভাঙ্গড়ের কিছু গ্রামে বিজয় মিছিল, আবির খেলা, ইত্যাদি উৎসবের ছবি এবং ভিডিও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, তেমনি তার সাথেই বাজারে (ফেসবুক/হোয়াটসঅ্যাপে) ঘুরছে এপিডিআর এর একটি চিঠি, ভাঙ্গড় সংহতি কমিটির নামে একটি বিবৃতি, পিডিএসের সমীর পুততুন্ডের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস, আনন্দবাজারে বেরোনো একটি প্রতিবেদন ইত্যাদি। যেগুলোতে মূল বক্তব্য দুটো - এক, আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রামবাসীদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই চুক্তি করেছেন এবং এটা আসলে আত্মসমর্পণ। গ্রামবাসীদের অধিকাংশই এখনও 'পাওয়ার গ্রিড চাই না' এই অবস্থানেই অনড় আছেন। এই বক্তব্যকে টেনে নিয়ে গিয়ে কেউ কেউ এমনও বলছেন যে আন্দোলনের নেতা অলীক চক্রবর্তীকে টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছে। যাঁদের কল্পনার জোর বেশি, তাঁরা এও বলছেন অলীক চক্রবর্তীকে নাকি এক কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে রাজারহাটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দুই নম্বর যে বিষয়টা আলোচিত হচ্ছে সেটা হল পাওয়ার গ্রিড না হয়ে সাবস্টেশন হওয়ার মধ্যে মৌলিক কোনও তফাৎ হল কি? নাকি এটা টেকনিকাল কথার জাগলারিতে আসলে সাধারণ মানুষকে ভাঁওতা দেওয়া হল? সব মিলিয়ে 'বাম' শিবির (সিপিএম, লিবারেশন, পিডিএস থেকে শুরু করে মাওবাদী এবং তৃতীয় ধারার বামেরা), যারা ভাঙড় আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে অলীকদের নিজের দল রেড স্টার বাদে আর কেউই প্রকাশ্যে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। চারদিকেই একটা সংশয় এবং সন্দেহের আবহ। এই পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে আমরা এই লেখায় চুক্তিটা নিয়ে যতদূর সম্ভব বস্তুনিষ্ঠ একটা মূল্যায়নের চেষ্টা করব। সঙ্গে সামগ্রিক আন্দোলন সম্পর্কেও দু একটা বাচাল মন্তব্য করা থেকেও বিরত থাকব না।
চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টঃ
সবার বোঝার সুবিধের জন্য চুক্তিপত্রের পাতার ছবিগুলো এখানে (লেখার নিচে) তুলে দেওয়া হল। খুব সংক্ষেপে মূল পয়েন্টগুলো সহজভাষায় বললে দাঁড়ায় এরকমঃ
১) চুক্তির লিখিত ভাষ্য অনুযায়ী এটা 'পাওয়ার গ্রিড' নয়, আঞ্চলিক সাব্স্টেশন। যেখানে দুটো ৪০০ কেভি লাইন ঢুকবে এবং দুটো ২২০ কেভি লাইন বেরোবে, যার মধ্যে একটি মাটির তলা দিয়ে, অন্যটি উপর দিয়ে।
২) ভারতীয় বিদ্যুৎ আইন মেনে লাইন নিয়ে যাওয়া হবে।
৩) SF6 ব্যবহার হবে।
৪) ইএমএফ মাপা হবে। কোথাও সমস্যা হলে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৫) আন্দোলনকারীদের ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
৬) নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়াও সাবস্টেশনের মধ্যে যাঁদের জমি গেছে অথচ ক্ষতিপূরণ পান নি, টাওয়ার যাদের জমির ওপর বসবে ও বিদ্যুৎবাহী তার যাঁদের জমির ওপর দিয়ে যাবে তাঁরা সবাই বিভিন্ন হারে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
৭) এর সঙ্গে এলাকায় বেশ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হবে। সেব্যাপারে প্রশাসন আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা করবেন।
এর বইরে দুটি বিষয় চুক্তিতে অনুল্লিখিত। ১) গ্রামবাসীরা যে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন, তার মোট মূল্য ১২ কোটি টাকা। ২) প্রশাসনের তরফে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে আরাবুল ইসলাম বা তার অনুগামীরা আন্দোলনের এলাকায় ভবিষ্যতে আর কোনও ঝামেলা পাকাবে না।
চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো কী কী?
এটা সর্বজনবিদিত যে ভাঙড় আন্দোলন তার শুরুর সময় থেকে কিছু বক্তব্যের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিষয়ে বিতর্কে বিদ্ধ হয়েছে। সেইসব বিতর্ক এবং তার ধারাবাহিকতায় আজকের 'পাওয়ার গ্রিড বনাম সাবস্টেশন' - এই বিতর্ককে যদি আপাততঃ মুলতুবি রেখে কেবলমাত্র লিখিত চুক্তিতে মনোনিবেশ করা যায়, দেখা যাবে এই চুক্তির কতক্গুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের জায়গা রয়েছে যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
প্রথমতঃ, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে প্রথম থেকেই ওখানে সাবস্টেশন হওয়ারই কথা ছিল এবং শেষতঃ ওখানে সাবস্টেশনই হবে ঠিক হল, তা হলেও পিজিসিআইএলের প্রাথমিক সাবস্টেশন পরিকল্পনায় ওখানে মোট ১৬ টি লাইনের কথা ছিল। আন্দোলন পরবর্তীতে সেই ভাবনায় পরিবর্তন এনে তারা কেবল চারটি লাইন করবে বলে ঠিক করে। অর্থাৎ, সাবস্টেশনের বহর কেটে ছেঁটে প্রায় এক চতুর্থাংশ করে ফেলা হল। এটা কিন্তু মোটেই কম কথা নয়। ঘুরে ফিরে ভাঙড় আন্দোলনের সাথে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের তুলনা উঠছে। সেভাবে ভাবলে ভাঙড়ে যা হল তা কিন্তু সিঙ্গুরে ৪০০ একর ফিরিয়ে দিয়ে ৬০০ একরে কারখানা করার যে প্রস্তাব এসেছিল, সরকার সেটা মেনে নিলে যে অর্জন হত তার চেয়েও অনেকখানি বড় অর্জন। কাজেই একে খাটো করে দেখলে সত্য থেকে দূরে সরে যাওয়া হবে বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়তঃ, ভাঙড়ে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, তার পরিমাণ দৃষ্টান্তযোগ্য। টাওয়ার বসানোর জমিতে এবং যেসব জমির ওপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ তার যাবে তাদের মালিকদেরও সর্বভারতীয় রেটের চেয়ে অনেক বেশি হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। জমির ওপর দিয়ে হাই টেনশন তার গেলে শারীরিক ক্ষতিটা বড় সমস্যা নয়, বড় সমস্যা হল জমির দাম কমে যাওয়া। বিক্রয়যোগ্যতা কমে যাওয়া। এ সমস্যা শুধু ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর। কাজেই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবী এক্ষেত্রে অত্যন্ত সঙ্গত দাবী এবং তা মেনে নেওয়াও অত্যন্ত সঠিক সমাধান। ভাঙড়ের ক্ষতিপূরণের হার এক্ষেত্রে একটা সর্বভারতীয় দৃষ্টান্ত তৈরী করল এবং ভারতের সমস্ত জায়গায় যেখানে যেখানে আগামীদিনে ট্রান্সমিশন লাইন তৈরী হবে, সেখানেই মানুষের হাতে অনেকটা বেশি দরকষাকষির ক্ষমতা তুলে দিল ভাঙড়ের এই চুক্তি।
তৃতীয়তঃ, আজকের দিনে উন্নত দেশে এধরণের ট্রান্সমিশন প্রজেক্টে বিতর্ক, সমস্যা, স্থানীয় প্রতিরোধ বহু জায়গায় থাকে। কিন্তু সেসব জায়গায় প্রতিরোধ হলেই মাসলম্যান লেলিয়ে দেওয়া হয় না প্রতিরোধকারীদের ওপর। স্থানীয় লোককে অন্ধকারে রেখে, কী করতে চাওয়া হচ্ছে সে নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা/কনভেনশন/বিতর্ক না করেই পুলিশ/গুণ্ডা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা পদ্ধতি হিসেবে কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই প্রজেক্টে যত 'জনস্বার্থ'ই জড়িত থাকুক না কেন। ভাঙড় চুক্তির আগের পর্যায়ে দুবছর ধরে সরকারের হাই হ্যান্ডেড আচরণ, আরাবুল এবং ইউএপিএ দিয়ে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার অপচেষ্টা এবং তার প্রতিক্রিয়ার আন্দোলনকারীদেরও প্রতিদিনই আরও অনমনীয় হয়ে ওঠা - এসব দেখে মনে হচ্ছিল না যে এই সমস্যার কোনও গণতান্ত্রিক সমাধান আদৌ হতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বরফ গলতে শুরু করার পর চুক্তিপ্রক্রিয়া যেভাবে এগিয়েছে তাও কিন্তু অনেকগুলো দিক থেকে দৃষ্টান্ত তৈরী করেছে। যেমন - ১) চুক্তির মীটিংগুলোয় কেবলমাত্র আন্দোলনের 'বহিরাগত' নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন এমন নয়। আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন গ্রামের প্রতিনিধি নিয়ে প্রায় ৫০ জনের একটি দল আলোচনা করেছেন প্রশাসন এবং পিজিসিআইএলের প্রতিনিধিদের সাথে। ২) চুক্তিতে আছে সাব্স্টেশনের কাজ শুরু হওয়ার পর ইএমএফ মাপা এবং লাইনের দুপাশের রাইট-অফ-ওয়ে দূরত্ব - ইত্যাদি বিষয়ে কোনও সমস্যা হলে সেসবের সমাধান গ্রামবাসীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়েই হবে। এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রথম থেকেই এইসব বিষয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে কিছু আশংকা এবং সংশয় রয়েছে। তাঁদের সাথে নিয়ে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেলেই একমাত্র সেই সংশয় দূর হতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাধানের জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ৩) একই ভাবে চুক্তিতে গ্রামবাসী, প্রশাসন এবং পিজিসিআইলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সাবকমিটি তৈরীর কথা আছে, যা চুক্তির রূপায়ণের ব্যাপারটা তত্ত্বাবধান করবে। উপরের তিনটে বিষয়েই স্থানীয় প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণকে চুক্তির মাধ্যমে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। যা আগামী যে কোনও এধরণের সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।
চতুর্থতঃ, আন্দোলনকারীদের ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহার নিয়েও চুক্তিতে সামগ্রিকভাবে সদর্থক বক্তব্যই রয়েছে। যদিও প্রতি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট আইনানুগ পদ্ধতি মেনেই মামলা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে এবং রূপায়ণ না হওয়া অব্দি এ নিয়ে সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও মামলা প্রত্যাহার করা বিষয়ক নীতিগত সিদ্ধান্ত যে হয়েছে - সেটা খুবই স্পষ্টভাবে চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে। এরপরে আইনি অজুহাত দিয়ে মামলা প্রত্যাহার না করলে যে সেটা সার্বিক প্রতারণা হবে সে নিয়ে কোনও সংশয় কারুরই থাকার কথা নয়। এতটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মামলা প্রত্যাহারের লিখিত প্রতিশ্রুতি সাম্প্রতিক অতীতে কোনও আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা আদায় করতে পেরেছেন বলে লেখকের জানা নেই। কাজেই সেই দিক থেকেও ভাঙড় চুক্তি একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
পঞ্চমতঃ, কেবলমাত্র সাবস্টেশন সংক্রান্ত বা ক্ষতিপূরণ এবং মামলা প্রত্যাহারের মত আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বিষয় ছাড়াও এই চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে ভাঙড়বাসীর জন্য একাধিক স্থানীয়স্তরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকারি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। সেগুলোর কতটা রূপায়িত হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু গ্রামবাসীদের দিক থেকে আসা উন্নয়ন প্রস্তাব প্রায় হুবহু লিখিত চুক্তিপত্রে স্থান পাওয়ার এরকম নজির প্রায় নেই বললেই চলে।
ষষ্ঠ এবং শেষতম যে অর্জন তা মূলতঃ রাজনৈতিক। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখনও অব্দি ট্র্যাক রেকর্ড যদি দেখা যায়, সে জঙ্গল মহলই হোক কি গোর্খাল্যান্ডর আন্দোলন, অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে সেগুলোকে মোকাবিলা করা হয়েছে। প্রয়োজনে টাকা/সুবিধা দিয়ে নেতৃত্বকে হাত করে, অথবা পুলিশ এবং পেশীশক্তি প্রয়োগ করে - সব ক্ষেত্রেই ফয়সালা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়েছে মমতা ব্যানার্জীর শর্তে। আন্দোলনকারীদের শর্তে নয়। এর মধ্যে 'হোক কলরব' আন্দোলন বা সাম্প্রতিক অতীতে মেডিক্যালের আন্দোলনকে ধরছি না। কারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের চাপে নতিস্বীকার করলেও শাসকের রাজনৈতিক প্রতিপত্তিতে তেমন আঁচড় পড়ে না। কিন্তু ভাঙড়ই এযাবৎকালের মধ্যে প্রথম সেই জায়গা যেখানে সমাধান কেবলমাত্র শাসকের শর্ত মেনে হয় নি। দুবছর ধরে পরে হলেও আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হতে হয়েছে সরকার পক্ষকে। কথা বলতে বাধ্য হতে হয়েছে গ্রামবাসীদের পাশাপাশি 'বহিরাগত' নেতৃত্বর সঙ্গেও। প্রকৃতপক্ষে নমনীয়তা দেখাতে হয়েছে দুপক্ষকেই। তবেই মাঝামাঝি একটা সমাধানসূত্র বেরিয়েছে। যেকোনও গণতান্ত্রিক এবং 'সুস্থ' দরকষাকষির যা অন্যতম শর্ত। এর পাশাপাশি তৃণমূলকে মেনে নিতে হয়েছে যে ভাঙড়ে একটি অঞ্চলে অন্য একটি রাজনৈতিক শক্তি এখন আগামী কিছুদিন থাকবে, তারা নির্বাচনে লড়বে, কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পাবে। এই মানতে বাধ্য করানোর রাজনৈতিক অর্জনও খুব কম গুরুত্বের বলে মনে হয় না।
উপরের সবকটা বিষয়কে মাথায় রাখলে আন্দোলনের অতি বড় সমালোচকও মানতে বাধ্য হবেন এই চুক্তিকে গ্রামবাসীরা যদি 'জয়' বলে মনে করেন তাহলে তাঁরা খুব ভুল কিছু করবেন না। অলীক চক্রবর্তী যদি তর্কের খাতিরে সরকারের কাছে সম্পূর্ণ বিকিয়ে গিয়েও থাকেন এবং বিকিয়ে গিয়েও গ্রামবাসীকে এইরকম একটি লিখিত চুক্তি আদায় করে দিতে পারেন, যা কিনা এযাবৎকালের কোনও গণ আন্দোলনে ঘটে নি, তাহলেও তাঁকে গ্রামবাসীরা মাথায় তুলে কেন রাখবেন না তা পরিষ্কার নয়।
উল্টোদিকে সরকার বা পিজিসিআইএলের দিক থেকে দেখলেও এই চুক্তি যথেষ্ট ইতিবাচকই। একটা সাবস্টেশন এবং সংলগ্ন লাইনগুলো অতখানি তৈরী হয়ে যাওয়ার পর যদি পরিকল্পনা বাতিল করতে হত, তাতে শুধু যে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হত তাই নয়, সারা ভারত জুড়েই গ্রিডকে শক্তিশালী করার যে প্রক্রিয়া চলছে তা অনেকখানি ধাক্কা খেত। ২২০ কেভির যে লাইনগুলো ভাঙড় থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পরিবহন নিগম (WBSETCL) টানবে সেগুলো অতি অব্শ্যই নিকটবর্তী এবং একটু দূরবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের সাথে যুক্ত। সেগুলি না হলে সেই প্রক্রিয়াও ভালোরকম ব্যহত হত। গ্রিড সংযুক্তিকরণের জন্য যে ১৬ টি লাইনের পরিকল্পনা ছিল তার মধ্যে যেগুলো চুক্তি মোতাবেক বাতিল হল, সেগুলোকে পিজিসিআইএলকে অন্যভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। হয়তো একটি সাবস্টেশনে কেন্দ্রীভূত উপায়ে তাঁরা করতে পারবেন না, অন্ততঃ ভাঙড় নিকটবর্তী অঞ্চলে তো নয়ই। সেগুলো কিছুটা সুদূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হওয়ায় আশু ক্ষতির সম্ভবনা কম। তবু বিশুদ্ধ প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে দেখলে সেই ক্ষতি হয়তো ক্ষতিই। কিন্তু মাথায় রাখার বিষয় হল শুধু প্রযুক্তিগত যুক্তি দিয়ে সমাজ চলে না। মানুষ এবং তার ইচ্ছে অনিচ্ছে, সুবিধা অসুবিধা সমাজের প্রধানতম উপাদান। তাই গণতন্ত্রের শর্তেই প্রযুক্তিকে মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছের সাথে বোঝাপড়া করেই এগোতে হবে। এই নিয়ে কপাল চাপড়ে লাভ নেই। প্রযুক্তির সাথে যুক্ত লোকজন, পিজিসিআইএল, WBSETCL - ইত্যাদিরা এটা ভালোই জানেন। কাজেই এই চুক্তি তাঁদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে - এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সব মিলিয়ে তাঁদের দিক থেকেও ভাঙড়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই চুক্তিকে 'উইন-উইন' বলেই আন্দাজ করা যায়।
তবে এরকম একটা ভদ্রস্থ এবং সম্মানজনক চুক্তির পরেও এরকম অস্বস্তির এবং অবিশ্বাসের আবহাওয়া কেন? কী চলছে 'বাম' শিবিরের চোরাস্রোত? ব্যক্তি এবং দলগত মনোমালিন্য ও কুৎসার ঊর্ধ্বে এসব কি 'বাম' আন্দোলনের গভীরতর কোনও অসুখের প্রতি দিকনির্দেশ করছে? একটা চুক্তি ছাড়া আর কী রেখে গেল ভাঙড় আন্দোলন? তার সবটাই কি খুব ইতিবাচক? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব আমরা এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে।