<< আগের পর্ব
পাওয়ার গ্রিড বনাম সাবস্টেশন
এই পর্ব শুরু করব 'পাওয়ার গ্রিড বনাম সাবস্টেশন' বিতর্ক দিয়ে। ভাঙড় চুক্তিতে খুব পরিষ্কার করে লেখা আছে ওখানে পাওয়ার গ্রিডের বদলে একটি আঞ্চলিক সাবস্টেশন হবে। এই বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে আন্দোলনকারীরা বলছেন তাঁরা কথা রেখেছেন। আন্দোলনের শুরু থেকে তাঁরা বলে আসছিলেন পাওয়ার গ্রিড হতে দেবেন না এবং তাঁরা সেটা দেন নি। অর্থাৎ দাবীদাওয়ার প্রশ্নে কোনও সমঝোতা তাঁরা করেন নি। লিখিত চুক্তিকে 'ফেস ভ্যালু'তে নিলে এই বক্তব্য ভুল নয়। যদিও এর মধ্যে একটু ফাঁক আছে। প্রযুক্তির চালু পরিভাষায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহণ এবং বিতরণের পুরো ব্যবস্থাকে একযোগে 'পাওয়ার গ্রিড' বলা হয়। যদিও এই সংজ্ঞা খুব কঠোর ভাবে মেনে চলা সংজ্ঞা - এমন নয়। অনেক সময় অনেকটা অঞ্চল জুড়ে অনেকগুলো সাবস্টেশন ও ট্রান্সমিশন লাইনকে মিলে আলগা ভাবে একটা 'ট্রান্সমিশন গ্রিড' বলা হয়ে থাকে। ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রেও এরকম 'ডিস্ট্রিবিউশন গ্রিড' কথাটার চল আছে। মোট কথা অনেকগুলো লাইনের একটা সংযুক্ত নেটওয়ার্ককেও কেউ যদি কথাচ্ছলে 'গ্রিড' বলে অভিহিত করে, বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। অন্যদিকে ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন হল সেই জায়গা যেখানে এক ভোল্টেজের ট্রান্সমিশন লাইন এক দূরবর্তী জায়গা থেকে এসে ট্রান্সফর্মারের মাধ্যমে অন্য ভোল্টেজে রূপন্তরিত হয়ে অন্য দূরবর্তী জায়্গায় পাড়ি দেয়। অর্থাৎ সাবস্টেশন হল পাওয়ার গ্রিডের একটা ক্ষুদ্র অংশ এবং সাবস্টেশন থাকলেই সেখানে অন্ততঃ দুটো (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারও বেশি) লাইনও যুক্ত থাকবে। একটা ঢুকবে এবং অন্যটা বেরোবে। এছাড়াও সাবস্টেশনে থাকে বাসবার, সার্কিট ব্রেকার ও অন্যান্য সুরক্ষা আর পরিমাপের যন্ত্রপাতি।
এবার যদি ভাঙড়ের দিকে তাকানো যায়, সেখানে কিন্তু প্রথম থেকেই যা হওয়ার কথা ছিল তা হল একটি ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন। তবে সেখানে দুটোর বদলে ১৬ টা লাইন যুক্ত হত (যদিও এটা অনেকখানি সুদূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ছিল বলেই মনে হয়) । এবং এর সাথে আরও অন্য কয়েকটা সাবস্টেশনের সংযোগ থাকত। প্রশ্ন হল - এই পরিকল্পনাকে কি 'পাওয়ার গ্রিড' বলে অভিহিত করা যায়? পরিভাষাগতভাবে একদম সঠিক থাকতে গেলে করা যায় না। কিন্তু আবার, যেহেতু আর পাঁচটা সাধারণ সাবস্টেশনের চেয়ে কিছু বেশিসংখ্যক লাইন ঢুকবে বেরোবে, তাই কেউ আলগা ভাবে 'ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড বসবে' - এই কথাটা বললে তাকে শূলে চড়ানোরও কোনও মানে নেই। আবার এরকমও হতে পারে, এই সাবস্টেশন যাদের পরিকল্পনা অর্থাৎ সেই 'পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন'এর নাম যুক্ত থাকার ফলেই ভাঙড়ের সাবস্টেশনকে প্রথম থেকে পাওয়ার গ্রিড বলা হচ্ছে। এখন এতদিন পরে এসে ঠিক কে বা কারা এই 'পাওয়ার গ্রিড' নামকরণের সূত্রপাত করল তা একশো শতাংশ নিশ্চয়তার সাথে বলা কঠিন। তবে আন্দোলন চলাকালীন এই বিভ্রান্তি বড় করে দেখা দেয় নি। দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল আন্দোলনকারীরা 'পাওয়ার গ্রিড চাইনা' বলতে ঐ সাবস্টেশন এবং সংলগ্ন ট্রান্সমিশন লাইনগুলি না চাওয়ার কথা বলছেন। যদিও আন্দোলন শুরুর দিকে আমাদের প্রতিবেদনে এই পরিভাষাজনিত বিভ্রান্তির কথা আমরা উল্লেখ করেছিলাম। দেখা গেল আন্দোলন সমাপ্তির পর্বে এই পরিভাষাই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাজিকা হয়ে গেল। সরকারের তরফে সমঝোতাকারীরা হয়তো ভাবলেন যে পাওয়ার গ্রিডের বদলে আঞ্চলিক সাবস্টেশন হচ্ছে - এই কথাটা চুক্তিতে স্পষ্ট করে লিখে দিলে তা হয়তো আন্দোলনকারী নেতৃত্বের পক্ষে গ্রামবাসীদের বোঝানোর জন্য সুবিধাজনক হবে। কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক থেকে আসলে যা হচ্ছে তা হল - বিভিন্ন সাবস্টেশনের সংযোগরক্ষাকারী বড় সাবস্টেশনের বদলে একটি ছোট সাবস্টেশন । এবং সেই সাবস্টেশনকে ঘিরে ১৬ টা ট্রান্সমিশন লাইনের বদলে চারটে লাইন। আন্দোলনে যখন পাওয়ার গ্রিড না চাওয়ার দাবী রাখা হত, তখন মোটেও একটি বড়র বদলে ছোট, বেশি লাইনের বদলে কম লাইন-অলা সাবস্টেশন চাওয়া হত - এমন নয়। পুরো সাবস্টেশন এবং লাইনগুলিকেই বাতিলের দাবী তোলা হত। কাজেই এটা পরিষ্কার যে আজ আন্দোলনের এই পর্বে এসে আন্দোলনকারীরা দুপক্ষেরই গ্রহণযোগ্য সমাধানের স্বার্থে এই নমনীয়তা দেখিয়েছেন, পুরোনো দাবী থেকে খানিকটা সরে এসেছেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। এবং এই সময়োপযোগী নমনীয়তা না দেখালে হয়তো এত সম্মানজনক একটা চুক্তি তাঁরা জিতে আনতে পারতেন না। সমস্যা হল, যে নমনীয়তা এবং বিবেচনাবোধের জন্য এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা জয় অর্জিত হল, সেই বিচক্ষণতার প্রশংসা হওয়া তো দূরের কথা উল্টে তাঁদের বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণের অভিযোগ ঊঠছে। এবং তাঁরাও এতে ডিফেন্সিভ হয়ে গিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন যে তাঁরা 'পাওয়ার গ্রিড হতে দেন নি', অর্থাৎ নিজেদের পুরোনো দাবী থেকে সরে আসেন নি। কিন্তু কেন এই অযাচিত আক্রমণ? কেনই বা তাতে ডিফেন্সিভ হয়ে পড়া? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার একটা চিহ্ন, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করব এর পরের অংশে।
কেন পাওয়ার গ্রিড বাতিলের প্রশ্নে এত সংবেদনশীলতা?
পাওয়ার গ্রিড প্রশ্নে নমনীয়তার বিষয়টায় এতটা অতি-সংবেদনশীলতার সম্ভাব্য কারণ হয়তো এটাই যে ভাঙড়ে অন্যান্য সমস্ত বিষয়কে ছাপিয়ে পাওয়ার গ্রিড যেনতেন বাতিল করার দাবীতেই আন্দোলনের মূল ফোকাস চলে গিয়েছিল। এবং বাতিল করার কারণ হিসেবে যত না উঠে আসছিল বে-আইনি অধিগ্রহণের প্রশ্ন, অগণতান্ত্রিক উপায়ে লোকজনকে অন্ধকারে রেখে একটা প্রজেক্টকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন, অথবা জনবহুল স্থানে এতগুলো লাইন একটা সাবস্টেশনে কেন্দ্রীভূত হলে তার যে বাস্তব সমস্যাগুলো হতে পারে সেগুলোর প্রশ্ন, তার চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্ব নিয়ে উঠে আসছিল যে কোনও মূল্যে হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন বিষয়টাকেই ভিলেন প্রতিপন্ন করার বিষয়টি। প্রথমে পরিবেশে দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেখানে একটা দূর অব্দি সামাজিক প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার পর অন্ততঃ ভাঙড়ের বাইরের মানুষের কাছে এই প্রচারের তীব্রতা কিছুটা কমানো হয়। কিন্তু ততদিনে এ বার্তা রটে গেছে যে সাবস্টেশন থেকে 'বিষাক্ত' SF6 গ্যাস লীক হয়ে এসে মাঠে চাষরত কৃষকের শ্বাসরোধ করে মৃত্যু অব্দি ঘটিয়ে দিতে পারে। আর ৪০০ কেভি লাইনের আশেপাশে বসবাস করলে ক্যান্সার, জমির ফসল বা ভেড়ীর মাছ ধ্বংস হওয়া তো জাস্ট সময়ের অপেক্ষা। ভবিষ্যতে কখনো ভাঙড় আন্দোলনের সমস্যার তালিকা তৈরী হলে সবার ওপরে থাকবেন এই আন্দোলনের সমর্থক 'পরিবেশবিদ'রা, যাঁরা প্রথম দিন থেকে এরকম কিছু আজগুবি বক্তব্য (কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যাচারও, সে বিষয়ে অন্য কোনও লেখায় লেখা যাবে) রেখে আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করেছেন।
বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। পরিবেশের প্রশ্নগুলো খানিকটা পিছু হঠার পর দ্বিতীয় যে বক্তব্যটি আন্দোলনের সাথে যুক্ত একাংশের পক্ষ থেকে রাখা হতে শুরু করে তা হল এই প্রজেক্ট কেবলমাত্র বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বেচে বিদেশী বিনিয়োগকারী পুঁজির লাভ করানোর উদ্দেশ্যে তৈরী হচ্ছে। সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এই বক্তব্যও বলাই বাহুল্য চূড়ান্ত অতিরঞ্জিত, এবং বৈদ্যুতিক পরিবহন ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞতাপ্রসূত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য বাংলাদেশের সাথে বিদ্যুৎ ট্রেডিং হয় বহরমপুর সাবস্টেশন থেকে। সেখানে ভাঙড় থেকে বিদ্যুৎ যাবে না। ফারাক্কা এবং পূর্ণিয়া থেকে সেই বিদ্যুৎ আসবে। পূর্ণিয়ার সাবস্টেশন যুক্ত থাকবে উত্তর-পূর্বের হাইড্রো পাওয়ারের সাথে। কিন্তু যেসময় উত্তরপূর্বের হাইড্রো পাওয়ার উৎপাদন কম থাকবে এবং জীরাট, সুভাষগ্রাম এই সাবস্টেশনগুলো সর্বোচ্চ লোডে থাকবে, সেই সময় বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতিমত বিদ্যুৎ দিতে গেলে গ্রিডে কিছু অস্থিতিশীলতা তৈরী হতে পারে। সেসময় ভাঙড়-পূর্ণিয়ার লাইনটি সেই স্থিতিশীলতাকে উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। ভাঙড়ের সাবস্টেশনের পরিকল্পনা হয় ২০১০ সালে। দক্ষিণবঙ্গের জীরাট সুভাষগ্রাম এসব অঞ্চলের শহরতলির লোড ভয়নকভবে বেড়ে যাওয়ায় এবং এই সাবস্টেশনগুলিকে বাড়িয়ে সেখানে নতুন লাইন ঢোকানো সম্ভব না হওয়ায় উত্তরবঙ্গের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী অঞ্চল থেকে দক্ষিণবঙ্গের বর্ধিত চাহিদার অঞ্চলে বিদ্যুতের নতুন ৪০০ কেভি লাইনের প্রয়োজনীয়তা এমনিতেই তৈরী হয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশকে বিক্রিরত অব্স্থায় গ্রিডের স্থিতিশীলতায় সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তাও। এই সম্পূর্ণ চিত্রটিকে না বুঝে যাঁরা কেবল বাংলাদেশকে বেচার চক্রান্ত বলছেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই ব্যাখ্যা দিতে পারেন না ভাঙড়ে যুক্ত হওয়া ২২০ কেভি লাইন গুলোর। কারণ ওগুলো সবকটি নিকটবর্তী অথবা কিছুটা দূরবর্তী ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশনে যাবে। এবং সেগুলি সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য বিদ্যুতের চাহিদাই পূরণ করবে।
কিন্তু ওপরের এই বক্তব্যটি আন্দোলনকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়, কারণ প্রথম থেকেই এই আন্দোলনকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সাথে এক সারিতে বসানোর একটা তাগিদ আন্দোলনকারীদের একাংশের মধ্যে কাজ করছিল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সাথে ভাঙড়ের আন্দোলনের কিছু মিল থাকলেও, সবচেয়ে বড় অমিলের জায়গা ছিল এটাই যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ছিল প্রধানতঃ ব্যক্তিপুঁজির লাভের উদ্দেশ্যে হওয়া প্রকল্প। সেখানে ভাঙড়ের সাবস্টেশনের সাথে সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের সরাসরি সম্পর্ক আছে। কাজেই কোনওভাবে এই সম্পর্ক দুর্বল এবং বদলে ব্যক্তি পুঁজির স্বার্থের বিষয়টা মুখ্য - এরকম প্রমাণ হলে ভাঙড় আন্দোলন ফিট করে যায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের রেটোরিকে। সবসময় এগুলো যে খুব সচেতনভাবে করা হয়েছে এমন নয়। বলা যায় সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সাথে এক সারিতে বসানোর মনোগত স্পৃহা তাঁদের এইভাবে ভাবিয়ে নিয়েছে।
তো ঘটনা হল, এরকম নানান দিক থেকে 'পাওয়ার গ্রিড' (পড়ুন হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন) বিষয়টাকেই ভয়ানক ক্ষতিকারক একটা কিছু বলে দিনের পর দিন প্রচার হয়েছে একাংশের পক্ষ থেকে। এর সূত্র ধরে অনেক মজার মজার বক্তব্যও এসেছে। একজন আন্দোলনের সমর্থক যেমন একবার বললেন যে এই প্রজেক্ট হচ্ছে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শস্তায় বিদ্যুৎ কিনে পাকিস্তানকে বেশি দামে বিক্রি করার চক্রান্ত। অর্থাৎ প্রেম চোপড়া (ভাঙড় সাবস্টেশন) নিজে তো ভিলেন বটেই, সে আরও বড় ভিলেন কারণ তার আমজাদ খানের (রামপাল) বাড়ীতে যাতায়াত আছে। তো এরকম আরও নানা চক্রান্তের তত্ত্ব ঘোরাফেরা করেছে, যার মূল অভিমুখ হল পুরো হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন বিষয়টাকেই অপ্রয়োজনীয়, চূড়ান্ত ক্ষতিকারক এবং কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদের মুনাফার স্বার্থে পরিচালিত বলে প্রতিষ্ঠা করা, grid strengthening বা পাওয়ার গ্রিডের নেটওয়ার্ককে আরও শক্তপোক্ত করা বিষয়টাকেই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর বলে প্রচার করা, ৪০০ কেভি লাইন মানেই তাকে প্রাণঘাতী বলে প্রজেক্ট করা, SF6 ব্যবহার হলেই যেন যে কোনও দিন আর একটি ভূপাল দুর্ঘটনা ঘটবে এরকম একটা আশংকার পরিবেশ তৈরী করা, ইত্যাদি।
এবার এটা তো সত্যিই যে পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিদ্যুৎকে পণ্য হিসেবেই ধরা হয়। এবং পণ্য হলে তার ট্রেডিংও হবে। সেখানে পুঁজি, বাজার ইত্যাদির প্রশ্ন আসবে। এবং তার সূত্র ধরে সাম্রাজ্যবাদও অতি অবশ্যই আলোচনায় আসবে। কিন্তু অতটা সরল ভাবে নয়। মাথায় রাখতে হবে অন্যান্য আর পাঁচটা পণ্যের সাথে বিদ্যুতের একটা গুণগত পার্থক্য আছে। তফাৎটা এটাই যে বিদ্যুতের উৎপাদন, পরিবহণ এবং বিতরণ বাজারের নিয়মে হলেও একই সাথে এর প্রত্যেকটা ধাপে তাকে পদার্থবিদ্যার নিয়মও মেনে চলতে হয়। অন্যান্য পণ্যের বেলায় সেটা হয় না। দুনম্বর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিদ্যুৎ অনেক বেশিমাত্রায় একসাথে সঞ্চয় করা যায় না। মূলতঃ এই দুটো কারণে বাজার বিদ্যুৎকে পণ্য হিসেবে যেমন ইচ্ছে তেমন করে চালাতে পারে না। তাকে বিদ্যুতের নিজস্ব ধর্মের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। সেই কারণেই গ্রিড সংযুক্তিকরণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ ট্রেডিং, গ্রিড শক্তিশালীকরণ - এসমস্ত কিছুই কেবল বাজারের বা সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে - এরকম ভাষ্য অত্যন্ত খর্বিত একটা চিত্রকে হাজির করে। এই প্রতিটা বিষয়েরই যে অনেক প্রযুক্তিগত সুবিধা আছে, যা আবার ঘুরে ফিরে সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা এবং পরিবেশের স্বার্থে রিনিউএবল এনার্জির সংযুক্তির সুবিধার সাথে যুক্ত, সেই দিকটা বোঝাপড়ার আড়ালে থেকে যায়।
প্রসঙ্গতঃ আরও একটা কথা বলার যে এগুলো নিয়ে কোনোরকম বিকল্প স্টাডি, গবেষণা, যাদবপুর, শিবপুর থেকে শুরু করে আইআইটি বা আইআইএসসির যেসমস্ত প্রফেসর পাওয়ার সিস্টেম নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কারুর কোনোরকমের কাজ বা দেশের এতগুলো সরকারি বেসরকারি পাওয়ার কোম্পানির এত এত প্রযুক্তিবিদদের অন্ততঃ একাংশেরও স্বীকৃতি - এসব কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই এইসব একপেশে থিওরি আসতে থেকেছে। কিন্তু দীর্ঘ দুবছরে এই নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের ডেকে একটিও প্রকাশ্য বিতর্ক বা সেমিনার করার প্রয়োজনীয়তাও কেউ অনুভব করেন নি। অথচ প্রচার কিন্তু তাই বলে থেমে থাকে নি। এই মনোগত একমাত্রিক 'বিশ্বাস'-এর ওপর ভর করে রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়াও আটকে থাকে নি।
অথচ এর বাইরেও এই প্রজেক্ট নিয়ে বিরোধিতার অনেক জায়গা ছিল। এমনকি 'পাওয়ার গ্রিড চাইনা' - এই কথা বলারও হক ভাঙড়ের মানুষের ছিল। তাঁরা দিনের পর দিন সরকারের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছেন। তার বদলে তাদের ওপর নামিয়ে আনা হয়েছে আরাবুলের সন্ত্রাস, অথবা ইউএপিএ। এই পরিস্থিতিতে ভাঙড়বাসী যদি বলেন যতদিন না সরকার বিনা শর্তে আলোচনার টেবিলে বসছে এবং যতদিন না সমস্ত আন্দোলনকারীকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে ততদিন পাওয়ার গ্রিডের কোনও কাজ তাঁরা হতে দেবেন না, তার মধ্যে অন্যায্য কিছু নেই। অথবা, তাঁরা বলতেই পারেন এরকম জনবহুল জায়গায় এতগুলো লাইন করলে সাবস্টেশনের আশেপাশে কখনই রাইট-অফ-ওয়ে ক্লীয়ারেন্স মানা সম্ভব হবে না এবং মানুষের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকখানি ব্যহত হবে, তাঁদের সবসময় কিছু বাধানিষেধ/সতর্কতা মেনে চলতে হবে, তাই তাঁরা এটা চান না। কারুর জমির ওপর দিয়ে লাইন গেলে তাঁর পূর্ণ অধিকার আছে সেটাকে পছন্দ না করার এবং সরিয়ে দেওয়ার দাবী করার। এমনকি তাঁরা এও বলতে পারেন যে এতে করে ঐ পুরো অঞ্চলে জমির দাম এবং বিক্রয়যোগ্যতা অনেকখানি কমে যাবে। অতএব এই প্রজেক্ট বাতিল করা হোক। ঘটনা হল এই সবকটা কথাই তাঁরা বলেছেন। আন্দোলনের 'ফর্মাল' দাবীদাওয়াও মোটামুটি এরকমই থেকেছে। এবং খেয়াল করলে দেখা যাবে এই বক্তব্যগুলো কোনোটাই আলাপ-আলোচনা, দরকষাকষি, ইত্যাদির ঊর্ধ্বে নয়। এগুলো সবই অঞ্চল নির্দিষ্ট সমস্যা, এবং দ্বিপাক্ষিক নমনীয়তার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।
কিন্তু এর পাশাপাশি দ্বিতীয় ভাবনাটার চোরাস্রোত সবসময় আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে করতে গেছে। ফর্মাল দাবীদাওয়ায় না হলেও ইনফর্মাল চর্চায়। যে ভাবনার ভরকেন্দ্রে থেকেছে পাওয়ার গ্রিড খারাপ কারণ তা বিষাক্ত গ্যাস ছাড়বে, অথবা পাওয়ার গ্রিড খারাপ কারণ তা থেকে বিদেশী পুঁজি মুনাফা করবে। এবং যে মুহূর্তে কেউ এই অবস্থানটি নিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি পাওয়ার গ্রিড সংক্রান্ত সমস্যাটিকে ভাঙড়ের বিশেষ সমস্যার ঊর্ধ্বে একটি সাধারণ সমস্যার বিষয়ে পরিণত করলেন। এর সাথে মতাদর্শের ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন এবং কোনোরকম দরকষাকষি মানেই মতাদর্শগত আত্মসমর্পণ - এই জায়গায় ব্যাপারটা নিয়ে গেলেন। কারণ যে জিনিস ‘প্রাণঘাতী’, তা নিয়ে কি আর দরকষাকষি হয়? সে তো আংশিক অবস্থাতেও 'প্রাণঘাতী'ই থাকে। যে জিনিস 'সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত' বলে কেউ মনে করবেন, তাঁর কাছে সে জিনিসকে আংশিক মেনে নেওয়াও তো আত্মসমর্পণই মনে হবে। জয় বলে তিনি কখনই এটাকে ভাবতে পারবেন না। অন্যদিকে যিনি বা যাঁরা পাওয়ার গ্রিডকে 'ভাঙড়ের মানুষের অসুবিধা' - এভাবে দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে সেই অসুবিধার অনেকখানি নিরসনকে জয় বলে ভাবতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অলীক চক্রবর্তীর এক কোটি টাকার ফ্ল্যাট এবং বাংলার বামেরা
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। মানে অলীকের এক কোটি টাকার ফ্ল্যাটটা কীরকম হতে পারে, তার বারান্দা, জাকুজি, ইন্টিরিয়র, এগুলো নিয়ে। বসার ঘরে একটা খয়েরি রংএর লেদারের সোফা রেখেছি। সেখানে অলীককে বসিয়েছি। ঠ্যাং এর ওপর ঠ্যাং তুলে। ঠোঁটে একটা চুরুট দিয়েছি, আর চোখে কালো চশমা। মানে টোটাল থাগ লাইফ যাকে বলে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বুঝে উঠতে পারি নি কোন যুক্তি কাঠামোয় এরকম ভাবা সম্ভব যে একটা লোক টানা দেড় বছর যেকোনও সময় আরাবুল বাহিনীর হাতে খুন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনের কেন্দ্রে জমি আঁকড়ে আত্মগোপন করে রইল, ঠিক সেই লোকটাই একমাস জেলে ঘুরে এসে এমনই মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে গেল যে মাত্র এক কোটি টাকায় 'বিকিয়ে' গেল! মানে প্যারানইয়ারও তো কিছু যুক্তিক্রম থাকবে! নইলে তো গল্পের গরুকে এবার এলন মাস্কের গাড়ীতে চাপিয়ে স্পেস থেকে নামিয়ে আনতে হবে।
কিন্তু ঘটনা হল এটা কেবল ভাঙড় আন্দোলনের সমস্যা এমন নয়। এই প্যারানইয়া খুব সম্ভবতঃ বাম রাজনীতির সাধারণ অঙ্গ হয়ে গেছে। যে কোনও আন্দোলনে যেখানেই কোনও রফাসূত্রে পৌঁছোনো হবে সেখানেই চোরা ক্যাম্পেন চলবে আন্দোলনের নেতৃত্ব বিকিয়ে গেছেন বলে। অর্থাৎ মনোগত বাসনাটা হল সব অন্দোলনই হবে এক একটি চলমান বিপ্লব। এবং সেখানে সকলকেই হতে হবে 'ভালো খেলিয়াও পরাজিত'। যে কোনও আংশিক জয় মানেই স্খলন, যে কোনও রফাসূত্র মানেই আত্মসমর্পণ। এবং আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হল - এগুলো সবই অন্যদের জন্য প্রযোজ্য। নিজেদের বেলায় নয়। একই সাথে নেতৃত্বকারী গোষ্ঠীর প্রতি অভিযোগ উঠবে অন্যান্য দলকে অবজ্ঞা করার, তাদের ওপর গরিষ্ঠতার জোরে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার। সিঙ্গুর আন্দোলন, নন্দীগ্রাম আন্দোলন, লালগড় আন্দোলন, হিন্দমোটরের আন্দোলন, নোনাডাঙার আন্দোলন, ভাঙড় আন্দোলন - কুশীলব বদলে যায়, কিন্তু পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহ বদলায় না। কে কত বেশি বিপ্লবী তার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে, আর সমাজজুড়ে 'বাম' ধারাটি শুকিয়ে যেতে থাকে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। অপরিসীম খাটাখাটনি করে, সন্ত্রাস মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বেশ কয়েক হাজার মানুষের জন্য খানিক স্বস্তি আদায় করেও তাকে উপভোগ করা আর হয়ে ওঠে না। একটি লোককেও সে উদযাপনে পাশে পাওয়া যায় না।
(সমাপ্ত)