সংকলন ও সম্পাদনা শমীক সরকার। টেকনিক্যাল সহায়তা পিনাকী মিত্র। পিনাকী হাই ভোল্টেজ ডিসি ট্রান্সমিশন সিস্টেম নিয়ে গবেষণারত।
পাওয়ার গ্রিড কী? খায় না মাথায় দেয়?
টেকনিকাল পরিভাষায় 'পাওয়ার গ্রিড' বলতে পাওয়ার (এখানে বৈদ্যুতিক ক্ষমতা অর্থে) উৎপাদন (জেনারেশন), পরিবহন (ট্রান্সমিশন) এবং বিতরণ (ডিস্ট্রিবিউশন) – এই পুরোটাকে একসঙ্গে বোঝায়। অর্থাৎ পুরো ইলেক্ট্রিকাল পাওয়ারের যে নেটওয়ার্ক – সেটা। এখানে ভাঙড়ে যা হচ্ছে– সেটা হল একটা ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন। এখানে ৪০০ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইন আসবে, সেটাকে কমিয়ে ২২০ কিলোভোল্টে পরিণত করা হবে ট্রান্সফর্মার দিয়ে, তারপর সেই ২২০ কিলোভোল্টের লাইন অন্যত্র যাবে। অর্থাৎ এটা হল বিদ্যুৎ পরিবহণের একটা গ্রন্থি। ভাঙড়ে অবশ্য প্রথম থেকেই এই সাবস্টেশনকে 'পাওয়ার গ্রিড' বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কনফিউশন এড়ানোর জন্য আমরাও তাই এই লেখায় একে 'পাওয়ার গ্রিড' বলেই ডাকব।
ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড হলে এবং ওভারহেড হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন গেলে এই বিদ্যুৎ ভাঙড়ের লোকের কী কাজে লাগবে?
প্রথমে বোঝা দরকার পাওয়ার সবসময় হাই ভোল্টেজে পরিবহন করা হয় কেন? মূল উদ্দেশ্য পাওয়ার লস কমানো। হাই ভোল্টেজে বিদ্যুৎ পরিবহণ করা হয় একসাথে অনেকটা বা বাল্ক লেভেলে অনেকটা দূরে (কয়েকশো থেকে শুরু করে হাজার কিলোমিটার রেঞ্জে) বিদ্যুৎ বা পাওয়ার পাঠানোর জন্য। নইলে সহজ কথায় বললে পড়তায় পোষাবে না। লস এত বেশী হবে যে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির দশা হবে। আর লস বেশী মানে কার্বন ফুট প্রিন্ট বাড়া, দূষণ বাড়া। যেহেতু শক্তি অনেক মাত্রায় একসাথে সঞ্চয় করা প্রযুক্তি এখনো মানুষের জানা নেই, আর ডিসেন্ট্রালাইজড (বিকেন্দ্রীকৃত) বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তিও এখনো অতটা এফিশিয়েন্ট বা কার্যকরী নয়, তাই হাই ভোল্টেজ ট্রান্স্মিশন আসলে সেভাবে দেখলে একমাত্র কার্যকরী পদ্ধতি বিদ্যুৎকে উৎপাদনের জায়গা থেকে ব্যবহারকারী অব্দি পৌঁছে দেওয়ার। এই মুহূর্তে এর কোনো বিকল্প মানুষের জানা নেই। ৪০০ কেভি লাইনে যে পরিমাণে পাওয়ার পাঠানো হয়, তা একটা বিশাল অঞ্চলের প্রয়োজন মেটায়। তার মধ্যে 'খেটে খাওয়া মানুষ'রাও আছে। আজকের দিনে বিদ্যুৎ সমস্ত মানুষের একটা মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। আর একটা বড় অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের পরিকাঠামো যখন তৈরি হয় তখন সেই বিদ্যুতের মধ্যে কতটা বড়লোকের প্রয়োজন মেটাবে আর কতটা গরীব লোকের প্রয়োজন মেটাবে – এভাবে আলাদা করা বাস্তবতঃ অসম্ভব। যে এলাকায় ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন হয়, সেখান থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ সেই এলাকায় ঢোকে না। মানে ধরুন একটা রেললাইন এলাকা দিয়ে গেলে আর সেখানে একটা স্টেশন হলে মানুষ যেভাবে উপকারটা সরাসরি দেখতে পান, এক্ষেত্রে সেটা ঠিক ঐভাবে হয় না। ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ প্রথমে আরও খানিক দূরত্ব পেরিয়ে যায় কোনো একটা ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশনে। সেখান থেকে কম ভোল্টেজে রূপান্তরিত হয়ে সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বাড়িতে পৌঁছোয়। ভাঙড়ের প্রস্তাবিত সাবস্টেশন থেকে যে ২২০ কেভি লাইনগুলো বেরোবে, সেগুলোও এরকম বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন সাব্স্টেশন পৌঁছোবে, সেখান থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে যাবে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন থেকে মানুষের উপকারটা ঘুর পথে আসে। ভাঙড়ের মানুষ যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে সেটাও এরকমই কোনো হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন বেয়ে চাষের জমির ওপর দিয়ে ভাঙড় অব্দি (প্রকৃতপক্ষে ভাঙড়ের কাছাকাছি কোনো ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশন অব্দি) এসে পৌঁছোচ্ছে। এবং সেই ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশনের সাথে যুক্ত ট্রান্সমিশন সাবস্টেশনটা হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কোনো এলাকায় রয়েছে। এই কারণে একটা ট্রান্সমিশন সাবস্টেশনের সাথে যে এলাকায় সেটা হচ্ছে সেই এলাকার মানুষের চাহিদাকে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত করা মুশকিল। পরোক্ষভাবে অবশ্যই তা সম্পর্কিত।
এটা তো বেশ ভয়ংকর একটা ব্যাপার বলে মনে হয়। দেখলেই ভয় লাগে। ব্যাপারটা কি সত্যিই ভয়ংকর?
৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইনের টাওয়ার যাঁরা কাছ থেকে দেখেন নি, অত বড় টাওয়ার চোখের সামনে দেখলে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার সাথে রয়েছে সাবস্টেশনে বিশাল বিশাল ট্রান্সফর্মার এবং অন্যান্য নানা হাই ভোল্টেজ যন্ত্রপাতি। প্রায় সবকটাই আয়তনে বিশাল। এর সাথেই রয়েছে হাই ভোল্টেজ লাইনের তলায় সোঁ সোঁ একটা শব্দ। তারের নিচে দাঁড়ালে আপনার গায়ের লোম সত্যি খাড়া হয়ে যাবে। আপনি যদি একটা তার ঝুলিয়ে টেস্টার দিয়ে টেস্ট করেন, আপনি দেখবেন টেস্টারে আলো জ্বলছে। একটা টিউবলাইট লম্বা করে ধরলে সেটা হাল্কাভাবে জ্বলতে দেখা যাবে। এগুলো দেখে সবারই প্রথমটায় মনে হওয়া স্বভাবিক যে হয়তো এটা ভয়ংকর ক্ষতিকারক কিছু। কিন্তু বাস্তবতঃ ব্যপারটা ঠিক তা নয়। এই প্রত্যেকটা জিনিসেরই ব্যাখ্যা আছে, আর এগুলো ঘটে মানেই মানুষের স্বাস্থ্যসমস্যা হবে – ব্যাপারটা তা নয়। যেমন ধরা যাক সোঁ সোঁ শব্দ যেটা শোনা যায় –সেটা সাধারণতঃ হয় করোনা এফেক্টের জন্য। খুব বেশি ভোল্টেজের পাওয়ার লাইনের একদম গায়ে যে তড়িৎক্ষেত্র তৈরি হয়, তা সন্নিহিত বায়ুকে আয়নাইজ করে দিতে সক্ষম। এই আয়নাইজ করার প্রক্রিয়ায় ঐ আওয়াজটা বেরোতে পারে। কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটে তারের একদম সন্নিহিত অঞ্চলে। তার থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, তড়িৎক্ষেত্র তত কমতে থাকে। ফলে তারের নিচে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে সেখানে তড়িৎক্ষেত্র এতটাই কম হয় যে তা মানুষের স্বাস্থ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু আবার সেই তড়িৎক্ষেত্র একটা তারের গায়ে টেস্টার ঠেকালে ধরা পড়ে বা একটা টিউব লাইটকে তা খুব কম তীব্রতায় জ্বালিয়ে দিতে পারে। (এখানে বলে রাখা ভালো টিউবলাইটের হাল্কাভাবে জ্বলে ওঠা মাত্র ২০ - ২০০ মাইক্রো অ্যাম্পিয়ার কারেন্টেই হতে পারে, যেটা হাই ভোল্টেজ লাইনের নিচে একজন মানুষের উচ্চতায় যে তড়িৎক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকে সেই তড়িৎক্ষেত্র দিয়ে তৈরি হওয়া সম্ভব)।
৪ লক্ষ ভোল্ট বিদ্যুৎ বহনকারী লাইনের নিচে একটা স্থির তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হয়, তা < ৯ কেভি/মিটার। এখানকার বিদ্যুৎ আইনে (১৯৫৬) আছে, এগুলো মাটি থেকে ৫-৯ মিটার উঁচু দিয়ে নিতে হবে (কত ভোল্টেজের পাওয়ার লাইন, সেই সাপেক্ষে)। এই উচ্চতা যথেষ্ট নিরাপদ। বিস্তারিত জানতে নিচের প্রশ্নের উত্তরটা দেখুন।
নিচের ছবিতে নদীয়া জেলায় মদনপুরে কৃষিজমির ওপর দিয়ে এবং জলাশয়ের ওপর দিয়ে যাওয়া ২২০ এবং ১৩২ কেভির লাইন। নিচে ভরপুর চাষবাস, জলে হাঁস খেলা করছে। এমনকি একটা কালীমন্দিরও আছে।
বিদ্যুৎ বহনকারী লাইনের নিচে সাবধানতার কথা তো পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষই ঘোষণা করে। সেগুলোর কারণ কী তাহলে?
বিদ্যুৎ বহনকারী লাইনের নিচে দুটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। তড়িৎ ক্ষেত্র এবং চৌম্বক ক্ষেত্র। এই দুটির ব্যাপারেই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। ইউরোপের সাম্প্রতিক গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে যে সতর্কীকরণ মাত্রা তৈরি করা হয়েছে ইংলন্ডে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জন্য সহনশীল তড়িৎ ক্ষেত্র সীমা প্রায় ৯ কেভি/মি। এবং সহনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র সীমা প্রায় ৩৬০ মাইক্রো টেসলা (যদিও ICNIRP (International Commission for Non-Ionizing Radiation Protection) এর রেকমেন্ড করা মাত্রা যথাক্রমে ৫ কেভি/মিটার এবং ১০০ মাইক্রোটেসলা। কিন্তু এই দুটি রেকমেন্ডেশনই দীর্ঘ সময় ওই তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রে থাকলে প্রযোজ্য, অর্থাৎ ওই তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রে যদি বাড়িঘর তৈরি করে থাকে কেউ, সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। এই দুটিই ৫০ হার্জ কম্পাঙ্কের পাওয়ার লাইনের জন্য, ভারতে পাওয়ার লাইনের কম্পাঙ্ক ওই ৫০ হার্জ।
নিচের টেবিলে এই বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে। সূত্র http://www.emfs.info/effects/induced/numerical/detailed-numerical-calculations/
তড়িৎ ক্ষেত্র
----------
প্রথমে আসা যাক, তড়িৎ ক্ষেত্র সম্পর্কে কথায়। মাথার ওপরে পাওয়ার লাইনের জন্য একটা তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হয়, এবং এই এক্সটার্নাল বা বাইরের তড়িৎ ক্ষেত্রর জন্য আমাদের শরীরের মধ্যে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হয়। মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গে (বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের একই মান-এ) বিভিন্ন মাত্রার আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গব্যবস্থার ক্ষেত্রে তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাবও ভিন্ন। যেমন, তড়িৎ ক্ষেত্রের কুপ্রভাব কেন্দ্রীয় বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে (CNS) এ যতটা, পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম (PNS) এ তার তুলনায় একের কুড়ি ভাগ। তাই সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের কোনো একটি অঙ্গে কী পরিমাণ তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, সেটাই বিবেচ্য। কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেমের মধ্যেও ব্রেন এ যতটা কু-প্রভাব, ততটা কু-প্রভাব শিরদাঁড়ায় নয়। এর ওপর পুরুষ ও মহিলা ভেদ-এ এই ক্ষতির পরিমাণ কম বেশি হয়। ব্রেন বা মস্তিষ্ক বিবেচনায় আনলে ২০ মিলিভোল্ট/মিটার আভ্যন্তরীণ তড়িৎক্ষেত্র হলো সহনশীল মাত্রা। এবং এই মাত্রা তৈরির সীমা মহিলাদের দিয়ে বিবেচ্য, যেহেতু (পুরুষের তুলনায়) মহিলাদের মস্তিষ্কে বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রর প্রভাবে আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরির হার বেশি। এবং এই আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরিতে যে পরিমাণ বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র প্রয়োজন, তা হলো ৯.৯ কেভি/মিটার বা প্রায় ১০ কেভি/মিটার। এবার যদি শিরদাঁড়াকে বিবেচনায় আনা হয়, এবং যদি শিরদাঁড়ার ক্ষেত্রেও আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্রের সহনশীল সীমা ২০ মিলিভোল্ট/মিটার রাখা হয় (ওই সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের অন্তর্গত বলে), তাহলে কিন্তু পুরুষদের কেস বিবেচনায় আগে রাখতে হবে, এবং সেক্ষেত্রে বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের সহনশীল মাত্রা কমে দাঁড়াবে ৫.৮ কেভি/মিটার। কিন্তু অঙ্গভেদ-এ যেহেতু ক্ষতির মাত্রার কমবেশি হয়, তাই মস্তিষ্ককেই আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্রের বিবেচনায় রাখা হয়। এবং সেই মোতাবেক, বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের সহনশীল মাত্রা প্রায় ১০ কেভি/মিটার।
বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রর প্রভাবে আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ঘনত্বও তৈরি হয়, এবং ওই আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ঘনত্বও আলাদাভাবে বিবেচনায় রাখা দরকার। কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেমের রেটিনা হলো এই তড়িৎ ঘনত্বের ফলে কু-প্রভাবের ক্ষেত্র, এবং এর সহনশীল মাত্রা ২ মিলিঅ্যামপিয়ার/বর্গ মিটার। এবং এই মাত্রার অাভ্যন্তরীণ তড়িৎ ঘনত্ব তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচ্য মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা, যেহেতু পুরুষের তুলনায় তার প্রতি কেভি/মিটার বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র-তে আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ঘনত্ব তৈরির মাত্রা বেশি। হৃৎপিন্ডে অবশ্য এই তড়িৎ ঘনত্ব তৈরির মাত্রা আরো বেশি, কিন্তু হৃৎপিণ্ড যেহেতু কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেমের মধ্যে পড়ে না, তাই তা বিবেচ্য হলো না এখানে। যাই হোক, এই পরিমাণ তড়িৎ ঘনত্ব তৈরিতে কতটা বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র লাগে? ৯.২২ কেভি/মিটার। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ঘনত্ব বিবেচনায় আনলে বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের সহনশীল সীমা ৯.২২ কেভি/মিটার। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ তড়িৎ ক্ষেত্র বিবেচনায় রাখলে যা, তার তুলনায় একটু কম।
এইবার আসা যাক, এই ৯ কেভি/মিটারের মধ্যের বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরিতে মাথার ওপরের ৪ লক্ষ ভোল্ট পাওয়ার কেবল-এর কতটা গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স (অর্থাৎ ভূমি থেকে উচ্চতা) থাকা দরকার, সেই প্রসঙ্গে।
এটা নির্ভর করে কী ধরনের পাওয়ার কেবল ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর, ট্রান্সপোজড না আনট্রানপোজড ফেজিং তার ওপর, এবং টাওয়ার কীভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে তার ওপর। নিচের টেবিলে, মাথার ওপর যদি ৪ লক্ষ ভোল্ট (মানে ৪০০ কেভি) পাওয়ার লাইন যায়, তাহলে তার জন্য ৯ কেভি/মিটার সহনশীল সীমার বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র যদি মাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স কতটা হবে তার একটা টেবিল দেওয়া হলো। এটিও ইংলন্ডে মান্য টেবিল। উল্লেখ্য, গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স মানে ভূমি থেকে উচ্চতা হলেও এক্ষেত্রে এই পরিমাপে তা ভূমি থেকে ১ মিটার উচ্চতাকে ভূমি হিসেবে ধরে মাপা ফিল্ড, যেহেতু মানুষের উচ্চতার কারণে মাটি থেকে ১ মিটার উচ্চতাকে গড় ভূমি ধরা হয়।
http://www.emfs.info/sources/overhead/factors/clearance/
তাহলে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স কত লাগছে? অর্থাৎ ৭.৪ থেকে ৯.৭ মিটার।
গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স বাড়া কমার ওপর এই বহিস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র কীভাবে বাড়ে কমে। নিচের গ্রাফে পাওয়া যাবে।
http://www.emfs.info/sources/overhead/factors/clearance/
অর্থাৎ, মোটামুটিভাবে ৪ লক্ষ ভোল্ট লাইনের ক্ষেত্রে ফেজিং, কেবল ডিজাইন ও টাওয়ার ডিজাইন সাপেক্ষে ৭ থেকে ৯ মিটার গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স রাখা নিরাপদ (ইংলন্ডে এবং মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে এই পরিমাপ একটা গড় ধরা হয় – ৭.৬ মিটার)। এটা ধরে নিয়ে, যে পাওয়ার লাইনের নিচে (অর্থাৎ, ওই গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্সের মধ্যে) কেউ বাড়ি বানিয়ে থাকছে না।
এবার আসা যাক, আমাদের দেশে কী করে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড বা PGCIL, সে প্রসঙ্গে। পিজিসিআইএল ভাঙড়ের ৪০০ কেভি লাইনের ক্ষেত্রে বলেছে (প্রেস-কে জানিয়েছে), ৯ মিটার গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স রাখে তারা, ১৯৫৬ সালের বিদ্যুৎ আইন মোতাবেক। ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিসিটি রুলস ১৯৫৬ অনুযায়ী এই ন্যুনতম গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স-এর পরিমাণ নিচের টেবিলে দেওয়া হলো। এই গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স ছাড়াও অন্যান্য ক্লিয়ারেন্স (যেমন রেললাইনের ওপর, রাইট অফ ওয়ে ইত্যাদি) কী হবে, সে বিষয়েও এই টেবিলের লিঙ্কে বিশদ দেওয়া আছে।
http://electrical-engineering-portal.com/electrical-safety-standards-for-lvmvhv-part-3#content
আমার মনে হয়, আমাদের বিদ্যুৎ আইন এই বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং ঠিকঠাক। তবে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা দেখা দরকার আছে। এছাড়াও তাপমাত্রার কারণে পাওয়ার লাইন ঝুলে যায় (সবচেয়ে বেশি ঝুল থাকে ঠিক মাঝখানটায়), এবং ক্লিয়ারেন্সগুলো ঠিক করার সময় এই ঝুলে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় রাখা হচ্ছে কি না (আইনে আছে, এটা মাথায় রাখা হয় খুব ভালোভাবেই) তাও দেখা দরকার।
রাইট অব ওয়ে হলো পাওয়ার কেবল-এর একদম নিচের কেন্দ্রীয় পয়েন্টটা থেকে আশেপাশের আনুভূমিক দূরত্ব। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী এই রাইট অব ওয়ে ক্লিয়ারেন্স টেবিলটি নিচে দেওয়া হলো। আর একটা ছবিতে রাইট-অব-ওয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।
অর্থাৎ ৪ লক্ষ ভোল্ট পাওয়ার লাইনের মধ্যবিন্দুর থেকে এদিক ওদিক ২৬ মিটার করে রাইট অব ওয়ে ক্লিয়ারেন্স (ডাবল সারকিটে একটু কম)।
চৌম্বক ক্ষেত্র
----------
মাথার ওপরের পাওয়ার লাইনের কারণে তড়িৎ ক্ষেত্র ছাড়াও তৈরি হয় চৌম্বক ক্ষেত্র। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের বিপদ জনিত দূরত্বসীমা অবশ্য তড়িৎ ক্ষেত্রের বিপদ জনিত দূরত্বসীমার চেয়ে অনেক বেশি। ওপরের ১ নম্বর টেবিলেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৬০০ মাইক্রোটেসলা চৌম্বক ক্ষেত্র স্ট্রেংথ-কে সহনশীল সীমা বলে ধরা হয়েছে। নিচের গ্রাফ-এ (৪০০ কেভি, এল১২ কেবল) বিভিন্ন গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স-এ চৌম্বক ক্ষেত্র এক্কেবারে নিচে এবং একটু আশেপাশে কতটা তৈরি হবে তা দেখা যাচ্ছে। এর সর্বোচ্চ সীমা ১১ মাইক্রোটেসলার মতো, একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। ২৪/২৬ মিটারের রাইট-অব-ওয়ের বাইরে যা ১ মাইক্রোটেসলার মতো। (এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভূ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র, যেটার মধ্যে আমরা থাকি, তার স্ট্রেংথ ২৫-৩০ মাইক্রোটেসলার মতো)।
http://www.emfs.info/sources/overhead/factors/clearance/
অর্থাৎ বলা যায়, তড়িৎ ক্ষেত্র বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করলে যে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স, রাইট অব ওয়ে মানতে হয়, তাতে চৌম্বক ক্ষেত্র গত ভাবে নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়ে যায়।
মাথার ওপর দিয়ে পাওয়ার কেবল গেলে সেখানে ও তার আশেপাশে বাড়ি ঘর দোর বানানো বা বাড়ানোর ব্যাপারে কি কোনো বিধিনিষেধ আছে?
বিদ্যুৎ আইন মোতাবেক, বাড়ি ঘর এর ওপর দিয়ে পাওয়ার লাইন নিয়ে যাওয়া যাবে না, নিলে ন্যুনতমের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতা দিয়ে নিতে হবে (মানে তখন ওই বাড়ির ছাদকে ভূমি ধরে হিসেব করতে হবে), এবং কত উচ্চতা দিয়ে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা আছে। এবং মাথার ওপর পাওয়ার কেবল লাইন গেলে সেখানে বাড়ি ঘর করাও মুশকিল। নিচে দেওয়া হলো বিদ্যুৎ আইনের (২০১০ সালের অ্যামেন্ডমেন্ট। এটাই সর্বশেষ। এর পর ২০১৬ সালে কিছু অ্যামেন্ডমেন্ট প্রস্তাবিত হয়ে আছে) লিঙ্ক, চ্যাপ্টার সেভেন বা সপ্তম পরিচ্ছদের (পৃষ্ঠা ২২৬) 'ওভারহেড লাইন ...' দ্রষ্টব্য (হরাইজনটাল, ভার্টিকাল ও গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স এর ছবি আছে শিডিউল এক্স-এ পৃষ্ঠা ৩৬৪ তে)। সরাসরি বাড়ি বানানো যাবে না একথা বলা না থাকলেও, যে উচ্চতার পরিমাপ দেওয়া আছে, তাতে যদি নিরাপদ উচ্চতা সীমার অনেক উঁচু দিয়ে পাওয়ার লাইন টানা না হয়, তাহলে বাড়ি করা সম্ভব নয়।
http://cea.nic.in/reports/regulation/regulation_elec_safety.pdf
ওভারহেড পাওয়ার লাইনের দু-পাশের এলাকা (৪০০ কেভি লাইনের কেন্দ্রীয় বিন্দুর দুপাশে ২৬/২৪ মিটার করে এলাকা) রাইট-অব-ওয়ে (Right-of-way)। সেখানে বাড়ি ঘর বানানো কঠিন। কিছু বানাতে গেলে ওই রাইট-অব-ওয়ের থেকে অন্তত ৬.২ মিটার দূরত্বে (৪০০ কেভি লাইনের ক্ষেত্রে) বানাতে হবে।
বিদ্যুৎ আইনে বলা আছে, যদি কেউ ওভারহেড পাওয়ার লাইনের নিচে রাইট-অব-ওয়ে (Right-of-way) তে বা তার পাশে বাড়ি ঘর দোর বানাতে চায় বা বাড়াতে চায়, তাহলে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখবে। এবং ওই খতিয়ে দেখার পর যদি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ মনে করে যে ওভারহেড পাওয়ার লাইন একটু এদিক ওদিক করে নিরাপদ সীমার মধ্যে এসে যাচ্ছে নকশায় প্রস্তাবিত বাড়ি, তাহলেই কেবল অনুমোদন দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। এবং তার জন্য যদি ওভারহেড লাইন আরো উঁচু করতে হয় বা সরাতে হয়, তার খরচ বহন করতে হবে যে ওই বাড়ি ঘর দোর বাড়াতে বা বানাতে চাইছে তাকে।
এই ব্যাপারে আইনের ৬৩ নম্বর ধারাটি নিচে দেওয়া হলো। এছাড়াও ৬৪ নম্বর ধারায় আছে, ওভারহেড লাইনের নিচে বা আশেপাশে বিভিন্ন সামগ্রী জড়ো করা বা গাছ লাগানোর ব্যাপারে বিধিনিষেধ। ৬৫ নম্বর ধারায় আছে ওভারহেড লাইনের টাওয়ারের আশেপাশে (১০ মিটার) মাটি কাটা বা (৫০০ মিটারের মধ্যে) ইঁট ভাটা ইত্যাদি তৈরি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা। এই তিনটে ধারা হুবহু নিচে দেওয়া হলো।
এছাড়াও শিডিউল-এক্স এ ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স, হরাইজনটাল ক্লিয়ারেন্স এবং গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স-এর একটি নকশা দেওয়া আছে। সেটি নিম্নরূপ।
শুনলাম নাকি খুব বিষাক্ত একটা গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে এই পাওয়ার গ্রিড তৈরিতে?
না, বরং উল্টো। যে গ্যাসটা ব্যবহার হয় ইনসুলেটর হিসেবে (তড়িৎ নিরোধক), তার নাম SF6। এই গ্যাসটা খুব সহজে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। এবং বৈদ্যুতিক আর্ককে খুব সহজে প্রশমিত করতে পারে। সেইজন্যেই এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এর অন্য বিকল্পটা হল বায়ুকে ইনসুলেটর হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু সেভাবে সাবস্টেশন বানাতে যা জমি লাগবে, SF6 দিয়ে সাবস্টেশন বানাতে জমি লাগে তার প্রায় আর্ধেক। এছাড়াও SF6 এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন কম, সাবস্টেশন বানাতে সময়ও অনেক কম লাগে। এর খারাপ দিকটা হল, এই গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের সময় লিক করে করে বায়ুমন্ডলে মিশে পৃথিবীর উষ্ণায়নে একটা খারাপ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সেই সমস্যাটা পৃথিবীর সামগ্রিক সমস্যা। ভাঙড়ের স্থানীয় এলাকার সমস্যার সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই। যেহেতু SF6 এর এই খারাপ দিকটা এখন মানুষ জানে, তাই লীকেজের পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করে অনেক কমিয়ে ফেলা গেছে, এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের নীচে এনে ফেলা গেছে।
কারুর কারুর এমন প্রশ্নও আছে যে কোনো কারণে ব্যাপকহারে SF6 লিক হলে (ভূপাল দুর্ঘটনার মত) সন্নিহিত অঞ্চলে তার কী প্রভাব পড়বে? এখানে বলার যে SF6 একমাত্র তখনই মানুষের ক্ষতি করতে পারে, যদি একটা বদ্ধ জায়গায় বায়ুতে অনেকখানি SF6 মেশে। যেহেতু এটা অক্সিজেনের থেকে ভারি, তাই একটা বদ্ধ জায়গায় অক্সিজেনকে ঠেলে উপরে পাঠিয়ে নিজে নিচেটা দখল করে নিতে পারে। সেরকম জায়গায় একজন মানুষ থাকলে তাঁর প্রয়োজনীয় অক্সিজেনে ঘাটতি হতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারটা কেবলমাত্র বদ্ধ জায়গাতে সম্ভব। একটা সাবস্টেশনে যে পরিমাণ SF6 ব্যবহার হয়, তার পুরোটা লিক হয়ে গেলেও সন্নিহিত খোলা জায়্গায় অক্সিজেনের পরিমাণে কোনো ঘাটতি তৈরী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, আর এই গ্যাস বিষাক্তও নয়। কাজেই ভূপালের মত ঘটনার আশংকা SF6 থেকে একেবারেই নেই।
হাই ভোল্টেজ লাইনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফীল্ড থেকে নাকি শিশুদের ক্যানসার হয়?
এই ব্যাপারটা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের সামগ্রিক মত হল – এরকম কোনো সিদ্ধান্তে আসার মত যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। হাই ভোল্টেজ লাইন পৃথিবীতে আছে পঞ্চাশেরও বেশী বছর ধরে। আশির দশকে আমেরিকাতে এরকম একটা ভীতি ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার, মানসিক অসুস্থতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, যৌন সক্ষমতা – এরকম বহু বিষয়কে নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন থাকায় এগুলো নিয়ে বহু গবেষণা হয়। ছোটো ছোটো অনেক স্টাডিকে একত্র করে মেটা স্টাডি করা হয়। ল্যাবরেটরিতে প্রাণীদের ওপরও পরীক্ষা করে দেখা হয়। সব মিলিয়ে যা যা দেখা গেছে সেগুলো এরকমঃ
১) বড়দের ক্ষেত্রে ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার, যৌন অক্ষমতা, মানসিক অসুস্থতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, যৌন সক্ষমতা, মিসক্যারেজ – এধরণের রোগের সাথে পাওয়ার লাইনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফীল্ডের কোনো সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় নি।
২) প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় এরকম কোনো প্রমাণ মেলে নি।
৩) গবাদি পশু, যারা এরকম হাই ভোল্টেজ লাইনের নিচে চরে বেড়ায়, তাদের ওপর কোনো প্রভাব দেখা যায় নি।
৪) কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ০.৩ – ০.৪ µT (মাইক্রো টেসলা) চৌম্বক ক্ষেত্রের থেকে বেশী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে সর্বক্ষণ আছে এরকম শিশুদের মধ্যে যারা পাওয়ার লাইন থেকে ৬০০ মিটারের বেশী দূরে আছে, তাদের তুলনায় যারা পাওয়ার লাইনের ২০০ মিটারের চেয়ে কম দূরে আছে তাদের মধ্যে লিউকেমিয়া (একধরণের ক্যান্সার) হওয়ার সম্ভবনা ৭০% বেশী (তথ্যসূত্রঃ Draper G, Vincent T, Kroll ME, Swanson J (2005) Childhood cancer in relation to distance from high voltage power lines in England and Wales: a case-control study. BMJ 330(7503): 1290–1294.)। এই তথ্যটা শুনে অনেকেই ঘাবড়ে যান। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে জানতে শুরু করলে বোঝা যায় অতটা ঘাবড়ানোর মত ব্যপার এটা নয়। কারণগুলো এরকমঃ
ক) ঐ গবেষণাপত্রেই গবেষকরা লেখেনঃ “There is no accepted biological mechanism to explain the epidemiological results; indeed, the relation may be due to chance or confounding.” অর্থাৎ, কি কারণে এবং কেমন করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফীল্ড লিউকেমিয়া ঘটাতে পারে – সেটা আমরা এখনও জানি না। হতেই পারে যে এই গাণিতিক সম্পর্ক যা পাওয়া গেছে, সেটা নেহাৎই কাকতালীয়। একজন নামজাদা গবেষক কেন এরকম 'অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ' মার্কা ডিসক্লেমার দিলেন? তার মূল কারণ হল শিশুদের লিউকেমিয়া খুবই দুর্লভ একটা অসুখ। সাধারণভাবে মানুষের ঘরে চৌম্বক ক্ষেত্র থেকে ০.১ মাইক্রোটেসলা (µT) এর কম। কাজেই যতগুলো ঘরে ওনারা ০.৩ – ০.৪ µT চৌম্বকক্ষেত্র এবং শিশু লিউকেমিয়া – এই দুটো ঘটনার সমাপতন খুঁজে পেয়েছেন - সেটা আরও দুর্লভ। ফলে ওনারা যেটুকু তথ্যভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে এই গাণিতিক সিদ্ধান্তে এসেছেন – সেটা খুবই ছোটো একটা স্যাম্পল। এর ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
খ) আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হল, এই একই গবেষক দল যখন ২০১৪ সালে আর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন (British Journal of Cancer (2014) 110, 1402–1408. doi:10.1038/bjc.2014.15 , Published online 6 February 2014, "Residential distance at birth from overhead high-voltage powerlines: childhood cancer risk in Britain 1962–2008", K J Bunch, T J Keegan, J Swanson, T J Vincent and M F G Murphy) সেখানে তাঁরা দেখান যখন তাঁরা আরও বড় স্যাম্পল নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের পূর্ববর্তী গবেষণার ফলাফল ভুল প্রমাণ হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাঁরা দেখান সময়ের সাথে এই বিপদ যেন ক্রমশঃ কম পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৬২ তে যতটা গাণিতিক সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে, ২০০০ এ পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম। এখান থেকে তাঁরা ধারণা করেন যে এমনটা হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয় যে আদৌ শিশুদের লিউকেমিয়ার সাথে পাওয়ার লাইনের সম্পর্ক নেই। হয়তো জনবসতির চরিত্র বদলে যাওয়ার সাথে আছে।
গ) পৃথিবীর যে চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আমরা সর্বক্ষণ আছি, তার মান ২৫ – ৩০ µT। সেক্ষেত্রে কেন মাত্র ০.৩ – ০.৪ µT চৌম্বক ক্ষেত্র ক্ষতিকারক হতে যাবে – সেটা বোঝা মুশকিল।
ঘ) আমাদের বাড়ীতে যে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আছে, টিভি, মোবাইল, ফ্রিজ সহ সমস্তকিছু থেকে এবং শুধু তাই নয়, আমাদের ঘরের পাশে পাড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া লো ভোল্টেজ বিদ্যুতের তার, এমনকি আমাদের ঘরের মধ্যের বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং থেকে যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরী হয়, বহু ক্ষেত্রেই তার মান ০.৩ – ০.৪ µT ছড়িয়ে যায়। যদিও তা হয়তো সবসময় থাকে না, বা দূরত্বের সাথে দ্রুত কমতে থাকে, তবুও, এটা বোঝা দরকার যে ০.৩ – ০.৪ µT চৌম্বক ক্ষেত্র শুধু হাই ভোল্টেজ লাইন থেকে আসে না। কাজেই লিউকেমিয়ার জন্য শুধু হাই ভোল্টেজ লাইনকেই দায়ী ভাবার খুব একটা যুক্তি নেই।
ঙ) এত কিছুর পরেও যদি ধরে নেওয়া যায় যে ২০০৫ এর গবেষণার ফলাফলটাই ঠিক এবং সত্যিই হাই ভোল্টেজ লাইনের কাছে থাকলে শিশুদের লিউকেমিয়া প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক হবে, সেক্ষেত্রেও বুঝতে হবে সেই সংখ্যাটা কত। এখন ২০০০০ শিশুতে যদি এক জনের লিউকেমিয়া হয়, ২০০৫ এর অনুমান সত্যি হলে সেই সংখ্যা বেড়ে হবে ২০০০০ এ ২ জন। এবার যদি এর সাথে রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সম্ভবনাকে তুলনা করা যায়, দেখা যাবে সেই গাণিতিক সম্ভবনা লিউকেমিয়ার চেয়ে বেশি।
মোটামুটি এইসব বিবেচনা করেই বিজ্ঞানীদের এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রেগুলেটরি বডি, হেলথ অর্গানাইজেশনগুলোর একটা সাধারণ অভিমত হল যে এব্যাপারে যতক্ষণ না আরও গবেষণালব্ধ নতুন তথ্য উঠে আসছে, ততক্ষন অব্দি হাই ভোল্টেজ লাইনকে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী করার মত অবস্থায় আমরা নেই।
পাওয়ার গ্রিড নিয়ে আপত্তিতে 'পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসকারী' কথাটা বারবার আসছে। সেটা কতটা সঠিক?
যেভাবে বারবার 'পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসকারী' ইত্যাদি হালকাভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে – সেটাও খুব তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। পাওয়ার গ্রিডের বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি রয়েছে, ডিটেলে ক্ষতির পরিমাণ লিপিবদ্ধও করা আছে। সেগুলো মূলতঃ যখন টাওয়ার বসানো আর তার লাগানো হচ্ছে, সেই সময়কার এককালীন ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু কোথাও এমন উদাহরণ নেই যে চাষের জমির ওপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ লাইন গেলে সেখানে আর চাষ করা যায় না। বা ফসলের উৎপাদন মারাত্মক ব্যহত হয়, মাছ মরে যায় – ইত্যাদি ইত্যাদি। বরং এই অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে একটাও প্রামাণ্য কেস স্টাডি নেই। সায়েন্টিফিক কমিউনিটির (যারা বিজ্ঞান গবেষণার কাজ করে) মধ্যে এরকম কোনো কনসেন্সাস বা ঐক্যমত্য তো দূরস্থান, 'একাংশের মধ্যে সিরিয়াস কনসার্ন' – এরকম কিছুও শোনা যায় না । গোটা পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার ব্যাপী হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন আছে। চাষের জমি, পুকুর, ভেড়ি – এসবের ওপর দিয়েই আছে বহু দশক ধরে। চাষ, মাছের ভেড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে – এরকম অভিযোগ শোনা যায়নি। সত্যিই যদি যেত, যদি একটা অঞ্চলেরও বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তিত হয়ে থাকতো গত পঞ্চাশ বছরে, তাহলে সেটার প্রমাণ থাকতো চোখের সামনেই। সেটা একটা উদাহরণ হয়ে যেত। কিন্তু শুধু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা প্রযুক্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তবে আমাদের চোখ কান সবসময় খোলা রাখা উচিৎ। পৃথিবীতে চাকা আবিষ্কারের সময় থেকে শুরু করে আজ অব্দি একটাও এমন প্রযুক্তি বোধহয় নেই যার কোনো পরিবেশগত কুপ্রভাব নেই। আর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি – এই কথাগুলো শুনলেই সেগুলোকে অন্ধভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করারও কিছু নেই। ভবিষ্যতে যদি কোনো ক্ষতি সত্যিই চোখে পড়ে সেগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই দেখতে হবে।
কিন্তু যারা পাওয়ার গ্রিডের টেকনিকাল বিষয়ে কিছু জানে না, এত সায়েন্টিফিক কচকচি বোঝে না, কিন্তু কৌতুহলী মন নিয়ে দেখতে চায়, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের বিবেচনা যাদের কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক অর্থনৈতিক লাভক্ষতির চেয়েও, তারা কীভাবে বুঝবে এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক নাকি নয়?
উল্টো দিক থেকে সমস্যাটা দেখা যেতে পারে। আমরা যারা সচেতন মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবি, তারা তো মোটামুটি পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে খোঁজখবর রাখি। আমরা যেভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে শুনেছি, আর্সেনিক নিয়ে শুনেছি, পেস্টিসাইড নিয়ে শুনেছি, জিএমও নিয়ে শুনেছি, নিউক্লিয়ার আর থার্মাল পাওয়ার নিয়ে শুনেছি, কখনও কি ভাঙড়ের আগে হাই টেনশন লাইনের ক্ষতির ব্যাপারে শুনেছি? অথচ এটা তো নতুন টেকনোলজি নয়, প্রায় ৫০ বছরের বেশী সময় ধরে আছে। কখনও শোনা গেছে কি সারা পৃথিবীতে কোনো পরিবেশ আন্দোলনে এটা গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়েছে? পৃথিবীতে একটাও কনফারেন্স হয় যার থিম হাই টেনশন লাইন জনিত স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি? এই ফিল্ডে গবেষণাতেও এরকম কিছু কিন্তু আজ অব্দি শোনা যায়নি। উল্টে দেখা যাচ্ছে, এই ফিল্ডে গবেষণার অভিমুখ আরও হাই ভোল্টেজের দিকে। ৭৬৫ কেভির এসি পাওয়ার লাইন ভারতেই রয়েছে। ৮০০ কেভি হাইভোল্টেজ ডিসি এরইমধ্যে চলে এসেছে। ১১০০ কেভি চীনে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এবং পুরোটাই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের বিপুল ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে কম দূষণ ঘটিয়ে কীভাবে মেটানো যায় – সেই লক্ষ্যে। অর্থাৎ আরও বেশি হাই ভোল্টেজের দিকে যাওয়া আসলে পরিবেশের কম ক্ষতির লক্ষ্যে। তো সেখান থেকেই প্রশ্নটা উল্টো দিক থেকে ফ্রেম করা যায়, যে এতই যদি ক্ষতিকারক তাহলে উপরে যেগুলো লিখলাম সেগুলো ঘটছে কী করে? ৮০০ কেভি প্রজেক্ট হচ্ছে আর পরিবেশবদী গ্রুপগুলো চুপচাপ বসে আছে এত ভয়ংকর ব্যাপার জেনেও? নিজের জানার ক্ষেত্রের বাইরের কোনো বিষয়ে অবস্থান নিতে গেলে এভাবে উল্টো দিক থেকে দেখা কখনও কখনও রিয়েলিটি চেকের কাজ করতে পারে।
তাহলে কি ভাঙড়বাসীর ক্ষোভ অমূলক? তাঁদের আন্দোলন অকারণ?
একেবারেই নয়। পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, ক্যান্সার – এগুলোকে বাদ দিলেও ভাঙড়বাসীর ক্ষোভের অন্য অনেক সিরিয়াস কারণ রয়েছে।
১) প্রথমতঃ এধরণের হাইভোল্টেজ লাইনের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য তা সবসময়ই এলাকায় একটা প্রাথমিক আতংক (প্যানিক) তৈরি করে। এটা শুধু ভাঙড় বলে নয়, বিদেশেও এর অন্যথা হয় না। কাজেই যদি কেউ মনে করেন যে ভাঙড়ের দরিদ্র মানুষ অজ্ঞ বলে বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে এমন প্যানিক হয়েছে – সেটা তাঁরা ভুল ভাবছেন। বিদেশে তথাকথিত 'সচেতন' জনতাও প্রথমে এই আতংকে ভোগেন। অনেক জায়গাতেই বাধাও দেন। আর এটা তো সত্যি যে এত হাই ভোল্টেজ লাইনের জন্য বেশ কিছু সাবধানতা মানার ব্যাপার চলে আসে। তাই এসব ক্ষেত্রে সাধারণ গাইডলাইনই হল যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে সেই অঞ্চলের জনতাকে ধৈর্য সহকারে বোঝাতে হবে কেন এটা দেখতে ভয়ংকর হলেও কিছু সাবধানতা মেনে চললে তেমন ক্ষতিকারক নয়। সাথে এটাও বোঝাতে হবে কীভাবে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এই সাবস্টেশন বা হাই ভোল্টেজ লাইন উন্নত বিদ্যুৎ পরিকাঠামো গড়ে তুলে আখেরে সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে। এই জনমত তৈরি ও ভয় কাটানোর প্রক্রিয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাওয়ার গ্রিডের ওয়েবসাইটেও এই কথাগুলো পাওয়া যাবেঃ The ESPP spells out POWERGRID’s environment and social policy, and its commitment to:
Ensure total transparency in dealing with all the stakeholders i.e. concerned government agencies, local communities, individual landowners and employees through a well-defined public consultation process as well as dissemination of relevant information about the project at every stage of implementation.
Maintain the highest standards of corporate responsibility not only towards its employees but also to the consumers and the civil society, social responsibility through various community development activities for promoting socio-economic development and most importantly through people’s participation.
To minimize adverse impacts on the natural environment by consciously economizing on the requirement of land for civil structures, reducing the width of the Right of Way (ROW), adopting multi circuit towers and state of the art technology in transmission etc.
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভাঙড়ে এই জনমত তৈরি বা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোনো – এগুলো একেবারেই হয় নি। তিন বছর আগে যখন জমি নেওয়া হয় তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একবারও কোনোরকম জনশুনানি হয়নি। মানুষ উদ্বেগ নিয়ে পাওয়ার গ্রিডের কাছে বারবার ছুটে গেছে, তাদের তরফ থেকে এগুলো মানুষকে বোঝানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। যাঁরা সাবস্টেশনের জন্য জমি দিয়েছিলেন তাঁদের ধারণা হয়েছিল ঐ জমিটুকুতে একটা 'পাওয়ার হাউস' হবে। 'আরাবুলের লোকজন' জমি নেওয়ার সময় তাঁদের এটাই বুঝিয়েছিল। পরে যখন তাঁরা দেখেন ঐ সাবস্টেশনে ২ টো ৪০০ কেভি লাইন ঢুকবে আর ৯ টা ২২০ কেভি বেরোবে, অর্থাৎ এত সংখ্যক বড় বড় টাওয়ার বসতে শুরু করল – তখন সেই কর্মযজ্ঞ দেখে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এবং পাওয়ারগ্রিডের দিক থেকে কোনো রকম জনসংযোগ না থাকায় বিভিন্ন গুজব ছড়াতে থাকে।
২) জনগণের সাথে আলোচনা করে এগোনোর কথা থাকলেও পাওয়ার গ্রিড যেমন তা মানে নি, সেইরকমই স্থানীয় লোকেদের অনেকেরই ধারণা সেফটি বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়মও না মানা হয়ে থাকতে পারে। বাসিন্দাদের অভিমত, যেখানে ৪০০ কেভির সাব্স্টেশনটা হচ্ছে – সেটা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। যেখানে মোট ১১ টা লাইন ঢুকছে বেরোচ্ছে, সেখানে সমস্ত লাইনের থেকে সন্নিহিত বাড়িগুলোর যে ন্যূনতম দূরত্ব সেফটি রুল অনুযায়ী থাকার কথা তা থাকছে কিনা সে নিয়ে অনেকেরই গুরুতর সংশয় রয়েছে। এটা খুবই সিরিয়াস অভিযোগ। অবিলম্বে নিরপেক্ষ এক্সপার্ট কমিটি বসিয়ে এর অনুসন্ধান করা উচিৎ। যদি নিয়ম মানা না হয়ে থাকে তাহলে ওখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে পাওয়ার গ্রিড সরাতেই হবে। মানুষের নিরাপত্তা বা সেফটি নিয়ে কোনোরকমের ছেলেখেলা চূড়ান্ত অপরাধ।
৩) ভবিষ্যতে পাওয়ার গ্রিডের আশেপাশের জমির দাম পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা, সেখানে কৃষিজমির চরিত্র ভবিষ্যতে বদল না করতে পারার আশঙ্কা, বাড়ি ঘর দোর করতে বা বাড়াতে না পারা, বা তার খরচ বেড়ে যাওয়া, এবং তা করতে পারা না পারাটা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে হয়ে যাওয়া – এই সম্ভবনাগুলো কিন্তু ঘোর বাস্তব। ভাঙড়ের গ্রামবাসীরা যে তিন বছর ধরে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের টালবাহানার কথা শুনিয়েছেন, তার মধ্যে এইগুলো রয়েছে। সেই দিক থেকে ভাঙড়ের গ্রামবাসীদের ক্ষোভের ন্যায্যতা স্পষ্ট। এবং এই ধরণের সমস্যা বিদেশেও যথেষ্ট দেখা যায়। সেখানে একটা কথাই চালু আছে, অন্য সর্বত্র পাওয়ার লাইন হোক, কিন্তু 'not in my backyard'। সমষ্টির ভালো হবে বলে ব্যক্তিকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সেই ত্যাগ স্বীকারের মূল্য নির্ধারণে ব্যক্তির মতামতের গুরুত্ব থাকতে হবে। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তি কোনোরকম দরকষাকষি বা নেগোশিয়েশনের সুযোগ পেল কিনা – সেটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ভাঙড়ের বেলায় দেখা যাবে সেসব তো হয়ই নি, উল্টে বন্দুকের নলের মুখে লোককে জমি বেচতে বাধ্য করা হয়েছে।
৪) এখান থেকেই চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষোভের জায়গাটা চলে আসে। জমি নেওয়ার পদ্ধতি। এটা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে 'আরাবুল ও তার সাঙ্গপাঙ্গ' সব ল্যান্ড মাফিয়ারা ভাঙড়ের লোককে ধমকে চমকে জোর করে পাওয়ার অফ এটর্নীর মারফৎ জমি ছিনিয়ে নিয়েছে। সাব্স্টেশনের জন্য হয়ত তাও কিছু টাকা চাষীরা পেয়েছেন, কিন্তু পরে টাওয়ার বসানোর সময় হয়ত জাস্ট পাঁচ-দশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ পুলিশে রিপোর্ট করতে গেলে উল্টে তাঁদের কেস দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
ভাঙড়ের গ্রামের পর গ্রামের মানুষ যেভাবে দলে দলে বেরিয়ে এসে পাওয়ার গ্রিডের বিরোধিতা করেছে, সেটা যে এমনি এমনি বা শুধু কিছু পরিবেশের গুজবের ওপর ভিত্তি করে হয় নি – এই কারণগুলো জানলে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
একথা ঠিক, যে সাধারণভাবে 'তিন-ফসলী জমির ওপর হাই ভোল্টেজ লাইন যেতে দেব না' – এরকম সাধারণীকৃত স্লোগানের একটা সমস্যা আছে। এর ব্যবহারিক অর্থ হল সাধারণভাবে হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশনের বিরোধী অবস্থান নিয়ে ফেলা। কারণ, হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইনকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র থেকে ব্যবহারকারী অব্দি পৌঁছোতে যে কয়েক্শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, তার মধ্যে কোথাও না কোথাও বহু ফসলী জমি তাকে পেরোতেই হবে। পৃথিবীর কোনো দেশেই এর অন্যথা হয় না, আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে তো আরোই হবে না। আর প্রকারান্তরে, যেহেতু মানুষের হাতে এখন হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন ব্যতিরেকে বিদ্যুৎ পরিবহনের অন্য কোনো প্রযুক্তি নেই (এবং বিকেন্দ্রীকৃত বিদ্যুৎ খুবই দুর্বল), তাই আসলে এর মধ্যে দিয়ে সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ পরিবহনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়ে যায়। মানুষের শক্তি বা বিদ্যুতের অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নেওয়া হয়ে যায়।
কিন্তু একই সাথে ভাঙড়ে যেভাবে অনৈতিক গা জোয়ারী জমি দখল হয়েছে জমি মাফিয়াদের মাধ্যমে, যেভাবে মানুষের মতামত নেওয়া, তাদের সংশয় দূর করার কোনো প্রক্রিয়াই নেওয়া হয় নি, উল্টে তাদের পুলিশ দিয়ে গুন্ডা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে, সবশেষে দু-জন আন্দোলনকারীকে গুলি চালিয়ে হত্যা আর বেছে বেছে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে – এই চরম নিন্দনীয় ঘটনাগুলোর বিরোধিতা করা খুবই ন্যয়সঙ্গত ও প্রয়োজনীয়। মানুষের জীবন আর তার মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো 'উন্নয়ন'ই শেষতঃ একটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু হয়ে উঠতে পারে না।
পরিশেষে নিচে পশ্চিমবঙ্গে এখনও অবদি পাওয়ার লাইন ও সাবস্টেশনের একটা ম্যাপ দেওয়া হলো – যা আছে, আর যা প্রস্তাবিত, সব মিলিয়ে। এখানে ৪০০ কেভি অব্দি পাওয়ার সাবস্টেশন ও লাইন আছে। সূত্র (হাই রেজোলিউশন ছবি) http://www.wbsetcl.in/docs/power%20map.pdf