কলিম খানের কাজের জগতের সূচনাবিন্দু হয়ত বা আকস্মিক। প্রথাগত পড়ালেখার জগৎ থেকে বেশ কিছুটা দূরে একাকী অনুধ্যায়ের আশ্চর্য উদাহরণ, যা আজকের পৃথিবীতে বিরল হতে হতে প্রায় অবিশ্বাস্য হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যা জেনেছিলাম, বাজারচলতি মার্ক্সবাদী পাঠ্যক্রমের অসারতার জায়গা থেকেই তিনি খুঁজতে বসেছিলেন পুঁজির উৎপত্তির কাহিনি। আর তার অন্বেষণেই হাত বাড়ান প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যগুলির দিকে, মহাভারত-রামায়ণ-পুরাণ। পুরাণ-পাঠ এক জটিল পরিস্থিতির সূচনা করে, যেখানে আপতিক সরল অর্থে আখ্যানগুলিকে গাঁজাখুরি মনে হয়। অথচ শিশুপাঠ্য রূপকথা অবলম্বন করে কেন সহস্র বছর উপমহাদেশের তাবড় পন্ডিতরা স্মৃতিচর্চা করে চলবেন, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পান না। ফলে আরও নিবিষ্ট হন পাঠে। আর, এক পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করেন, শব্দ আসলে ইতিহাসও। শব্দের মধ্যে সূত্রায়িত আছে ইতিহাসপাঠের নির্দেশনাও। সেই চাবিটি ঘুরিয়ে তার পরের দু-তিন দশক আমাদের বায়োস্কোপ দেখিয়ে গেছেন কলিম খান। যেমন ধরুন ‘দিশা থেকে বিদিশায়’ গ্রন্থের লক্ষ্মীর পাঁচালিঃ ওয়েলফেয়ার ইকনমির ভূত ভবিষ্যৎ থেকে একটা অনুচ্ছেদ যদি দেখি-
“নারায়ণ, মৎস ও কূর্ম্মের পর বরাহ রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বরাহ শব্দের অর্থ ‘নিয়োগ করা হয় যাহাকে’। আমাদের পাঁজিতে বলা হয় যে ‘এখন বারাহ কল্প চলছে’। আধুনিকতাবাদীরা হাসেন। পাঁজিটি কতজন পন্ডিতের দ্বারা অনুমোদিত, তার তালিকা দেখেও তাঁরা ভয় পান না। এখন আমরা জেনেছি পাঁজির কথাটি সঠিক- এখনও নিয়োগ প্রথাভিত্তিক সামাজিক প্রকল্পই চলছে। ভূস্বামী মজুর নিয়োগ করেন, কারখানা-মালিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ করেন ......। নিয়োগ ছাড়া কোনও কাজই হয় না এযুগে এবং এই সমস্ত প্রকারের নিয়োগের পিছনে আর্থিক বিনিয়োগ একান্ত সঙ্গী। প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে, ঐ উভয় প্রকার বিনিয়োগকে একত্রে ‘বরাহ’ বলে। সেই বিনিয়োগের পরবর্তী যুগের রূপগুলিকে অর্থাৎ ‘বরাহের অপত্য’ বলে বারাহ।”
এই চাবির তিনি নাম রাখলেন ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বিধি। শব্দের মূল হলো ক্রিয়া। শিব শব্দের মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘শিখা বহন করা’র ক্রিয়া। ব্যাখ্যা করে ফেললেন কেন ভারতের জাতীয় নায়ক শিব। থেমে থাকলেন না তৎসম বাংলা শব্দেই। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির বিচ্ছেদের আগেই যে মানবযূথ অজস্র ক্রিয়া করে ফেলেছে। তাই কমোডিটি-ফেটিশ বুঝতে ‘কাম-উদিতি’ -যা থেকে কামনার উদয় হয়, তাই-ই পণ্য এই ধারণা খাপে বসে গেল। এরকম করে সূত্র মেনে ইতিহাস মেলাতে থাকলেন। ইতিহাস সর্বদাই কাহিনি। তাই কলিম খান যে কাহিনি আমাদের সামনে ন্যারেট করলেন, তা পাঠককে আবিষ্ট করে রাখল ঘটনাজালে। এখানে আরও একটা সূত্র এসে যায় যে, কলিম খান মার্ক্সিস্ট। বলতে গেলে ধ্রুপদী মার্ক্সিস্ট, যিনি ভারত-ইতিহাস লিখতে গেলেও সামন্ততন্ত্র শব্দটা লিখে ফেলেন। ফলে তিনি দেখালেন ইতিহাস আসলে অর্থনীতিও। আর, মহাভারত-রামায়ণ-পুরাণ ধরে তাঁর নির্মিত ইতিহাসব্যাখ্যা দেখাতে থাকল পুঁজি আর শ্রমসম্পর্কের বিবর্তনের একটি সম্ভাব্য ধারা। যা সচরাচর আমাদের পাঠে আসে না।
যিনি কলিম খান পাঠ করেছেন, তিনি ‘সচরাচর’ শব্দটি লেখার পর ভাবতে বসবেন আসলে তিনি কী লিখেছেন? শব্দের স্মৃতিতে যে ইতিহাস, তা ব্যবহারিক অর্থেই বক্তাকে সেই ইতিহাসের অংশ করে দেয়। যেমন ধরুন যে মানুষটা বলেন যে তিনি চাষবাস করে খান, তিনি আসলে এও বলে ফেলেন যে তিনি খাওয়ার জন্যে শুধু চাষ করেন না, বাসও করেন। কৃষি না করলে বনচারী যাযাবর উপজাতির লোক গৃহস্থ হত না। তার গৃহে স্থিত হওয়ার দরকারই ছিল না। শব্দের আলো এইভাবে লোকসমাজের স্মৃতির মধ্যে জ্বলে, সূর্যের মতই সারাদিন আলো দিয়ে যায়।
কলিম খান আরও কিছু দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছিলেন। প্রথম দুঃসাহস হল যে, তিনি এইসব লিখে ফেলেছিলেন। এইভাবে ইতিহাস পড়া, শাস্ত্র পড়ার মধ্যে প্রাথমিক ভাবে থাকে নিজের পুরোনো জানা-বোঝার জাড্যতাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার দুঃসাহস। তার ওপর সেগুলো পাঁচজনকে পড়ানো! এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পেরেছিলেন, তার একটা বড় কারণ তিনি প্রচন্ড শক্তিশালী লেখক। সমসাময়িক বাংলাভাষার ক্র্যাফটসম্যান-শিপ বিচার করলে তাঁর স্তরের প্রাবন্ধিক খুব বেশি পাওয়া যাবে না। প্রায় অসম্ভব মনে হবে এমন সব কথা, যেমন ধরুন, নারায়ণ আসলে পুঁজি, কৃষ্ণ আসলে ব্ল্যাক মানি, রাম হলেন সেই গণনায়ক যিনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ পুরোহিত রাবণকে দমন করে বৌদ্ধযুগের সূচনা করেন কিম্বা culture শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘কুলাচার’- এইসব যুক্তিপরম্পরা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে প্রাবন্ধিককে অসীম শক্তিমান হতেই হয়। আর দ্বিতীয় দুঃসাহসটা হল তিনি একজন বিরাট পাঠক, কিন্তু একদমই স্বশিক্ষিত পাঠক। স্মৃতি-শ্রুতি-ভারতীয় দর্শন থেকে শুরু করে মার্ক্সীয় সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য পাঠক ছিলেন তিনি। আজকের দিনে এই পাঠও বিরল। কিন্তু, দুঃসাহসের ব্যাপার হল, এই পঠনের সবটাই তিনি করেছেন অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডল বা সাংগঠনিক পাঠচক্রের বাইরে। সেই জীবনের সূচনাপর্বে তিনি রড কারখানার শ্রমিক, পরিণতির সময়ে ডিটিপি-কর্মী। অথচ সম্পূর্ণ নিজের উদ্যমে, নিজের তাগিদে ও নিজের নির্দেশনায় পড়ে যাচ্ছেন, ভাষ্য নির্মাণ করছেন আর তা লিখে ফেলছেন। কলিম খানের জীবনাবসানে সেই রূপকথারও শেষ হল।
তাঁর অবদানকে অ্যাকাডেমিক ওয়ার্ল্ড সেভাবে পাত্তা দেয় নি। রবি চক্রবর্তী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পন্ডিতও স্পৃহা দেখান নি তাঁর কাজকে অনুবাদ করে বাংলার বাইরে পৌঁছনোর। কলিম খানের বিশ্ববীক্ষা হয়ত প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু প্রশ্ন করার মতন হাতও বেশি ওঠে নি, এ দুর্ভাগ্যের। সৌভাগ্য যে এই আকালে তিনি ‘বিশ্ববীক্ষা’র জন্ম দিয়েছিলেন। সৌভাগ্য যে খোলাবাজারের হাওয়া লেগে বাংলাভাষা যখন শুকিয়ে আসছে তখন তিনি ‘শব্দার্থকোষ’ লিখে ফেলছেন। কিন্তু, আবারও দুর্ভাগ্য যে বিশ্ববীক্ষার জনক হলেও তাঁকে শুধু বাংলাভাষার সেবক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
আমরা জানি না ইতিহাসবেত্তা কলিম খান তাঁর যোগ্য সমালোচক পাবেন কী না- না কি তিনি শুধুই প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে আসা ‘লিটল ম্যাগাজিনের দার্শনিক’ হিসেবেই ইতিহাস হয়ে গেলেন- যিনি শব্দের শবদেহের উপর বসে সাধনা করেছিলেন, বুঝতে চেয়েছিলেন কীভাবে দক্ষ হইতে অদিতি জন্মে আর অদিতি হইতে দক্ষ!
@তাতিন link টা কাজ করছে না।