২৫ বছর পূর্তি। আমাদের লজ্জার ২৫ বছর পূর্তি। আমাদের মূর্খতার ২৫ বছর পূর্তি। আমাদের চোখ বন্ধ করে রক্ত নিয়ে হোলি খেলার ২৫ বছর পূর্তি। আজকে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ২৫ বছর পূর্তি হল। ধর্মের নামে, ধর্মের লেবাস পরে অধর্ম সে দিন পৃথিবীর বুকে দারুণ ভাবে নেমে এসেছিল। হাজার মাইল দূরে কিছু মানুষ নামের অমানুষ হঠাৎ ধর্ম রক্ষার মিশনে নেমে গিয়েছিল সেদিন। আর তার মূল্য চুকাতে হয়েছিল বাংলাদেশ নামক গরিব এক দেশের পল্লিতে বাস করা হাজার হাজার হিন্দু পরিবারকে। আমরা আজকে জানি সেদিন কোন কিছুই হঠাৎ করে হয়নি। সুপরিকল্পিত দাঙ্গা তৈরি করা হয়েছিল সেদিন। বাবরি মসজিদের পাশে সমাবেশ করার কথা বলে মসজিদকেই গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের হিসাব ছিল ভিন্ন, তাদের হিসেবের বাহিরে ছিল ভারত বাংলাদেশের হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান পরিবার।
আমাদের শান্ত শীতল মফস্বল শহরেও সেদিন আলোড়ন তৈরি করেছিল দারুণ ভাবে। বয়স ছিল অল্প, কিন্তু দিব্যি মনে আছে শেরপুরের প্রায় সমস্ত মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা। সবার মুখে মুখে গল্প। কোন মন্দির কিভাবে ভাঙ্গা হলো। এ যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। দুই মিনিটে নুডুলস রান্নার মত। প্রাচীন মন্দির নিমিষে ফিনিশ। আজকে আমি নাম ধরে ধরে বলে দিতে পারব সেদিন কারা কারা জড়িত ছিল মন্দির ভাঙ্গার ঘটনায়। কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল এক অদ্ভুত একপেশে দাঙ্গার। মানুষরূপী পিশাচরা আজও সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে নদী পার হয়ে ওই পারে হিসেব দিচ্ছে হয়ত কৃত পাপের।
যে সব জায়গায় হিন্দু পরিবারগুলো একসাথে থাকে, হিন্দু পাড়াগুলো অনেক নিরাপদ ছিল সেদিন। তারা রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করে। পালা করে টহল দিয়ে পরিবার সমাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, রক্ষা করেছেও। আতঙ্ক কাকে বলে তা বুঝতে পেরেছিল যে হিন্দু পরিবারগুলো হিন্দু পাড়ার বাইরে থাকত, তারা। শেরপুরে তেমন কিছু হয়নি তবে দেশের অনেক জায়গায়ই এই রকম পরিবার গুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। মসজিদ ভাঙ্গার পরের দিন আমি যখন স্কুলে গেলাম তখন স্কুলের সামনের সুকুমারদার দোকানের সামনে জটলা দেখেছিলাম। কাছে যাওয়ার পরে শুনলাম সুকুমারদার ভাই হরিদাস দা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে সবার কাছে - “আসলে ভারতে তেমন কিছু হয়নি, বাবরি মসজিদের দুই একটা ইট টান দিয়েছে শুধু, না, এটা করাও ঠিক হয়নি, কিন্তু তার জন্য এই ভাবে সব মন্দির…. ” সেদিন বুঝিনি, ভাবছি এ্যাহ, মসজিদ ভাঙ্গছে আবার তার সাফাই গাইছে!! কিন্তু আজকে বুঝি উনি আসলে কি বলতে চাচ্ছিলেন। আজকে যখন দেখি সুকুমারদার দোকানটা আর সেই জায়গায় নাই তখন বুঝি, হরিদাসদা কেন সাফাই দিচ্ছিলেন আজকে বুঝি যখন দেখি তারা কেউই আর দেশে নাই, পুরো পরিবারই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে কোন এক তীব্র আতঙ্কে, যা আমার মত মুসলমানের বোঝা সম্ভব না হয়ত কোন দিনই।
বিপদের সময় মানুষ চেনা যায়। অতি পুরাতন কথা। শেরপুরের বুকেও সেদিন মানুষ মানুষ চিনেছিল। প্রায় দুইশ বছর পুরাতন মন্দির হচ্ছে আখড়া বাড়ি মন্দির। সেই মন্দির একাই রক্ষা করেছিলেন একজন। নিজের বন্দুক হাতে মন্দিরের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নেকি লোভী কাউকে কাছে ঘেঁসতে দেননি। রক্ষা পেয়ে যায় আখড়া-বাড়ি মন্দির। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাল থাকার কারণে বেঁচে যায় মহিলা কলেজ মন্দির। ধুলায় মিশে যায় শনিবাড়ি মন্দির, মূর্তি ভেঙ্গে তার উপরে উঠে নেচেছে রঘুনাথ বাজার কালি মন্দিরে। তবে যেটা বললাম, প্রচুর মুসলিম পরিবার হিন্দু পরিবারকে বাড়িতে এনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল সেদিন। আসলে মুসলিম পরিবার হিন্দু পরিবারকে না, মানুষ মানুষ কে সাহায্য করে ছিল সেদিন।
এত বছর পরেও হিন্দুদের কাছে আতঙ্কের নাম ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। আমার সমবয়সী যারা তাদের স্মৃতিতে যা আছে তা হচ্ছে নিখাদ আতঙ্ক। একজন বলছিল তাদেরকে রাতে ঘুমাতে দিত না তাদের অভিভাবক। কখন ঘরে কেউ আবার আগুন দিয়ে দেয়!! আরেক জন বলেছিল ওর বেশি কিছু মনে নাই, ওদের বাসা ছিল শহরের মাঝখানে, ও গেটের ফাঁক দিয়ে অনেক মানুষ দেখেছিল, সবার মাথায় টুপি আর গায়ে পাঞ্জাবী, তারা যাচ্ছিল আর তাদের বাড়ির উপরে ঢিল ছুড়ছিল, লাঠি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিল। আহ! আমার শান্তির ধর্মের লেবাস!! মোল্লারা যার জন্য নিত্য কথা শোনায় আমাদেরকে!
আমাদের শহরে মন্দির ভাঙ্গা হলেও প্রাণহানি বা অন্য কোন নাশকতা হয়নি। তবে সবাই আমাদের শহরের মত ভাগ্যবান ছিল না। সারা বাংলাদেশে ৬ এবং ৭ তারিখের দাঙ্গায় প্রাণ যায় ২০/২৫ জনের মত। ধর্ষণ হয় হাজার হাজার নারী। বাস্তুহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। বাংলাদেশের এমন অনেক এলাকা হিন্দুশূন্য হয়ে যায়। বাড়ি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেশছাড়া করা হয় অসংখ্য পরিবারকে। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে পাড়ি জমায় ভারতে।
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের এজেন্ট, যারা ইসলামের ফ্রাঞ্চাইজ বলে মনে করে নিজেদের। সেই জামাতের পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশ করে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ফলে ঢাকায় হিন্দুদের মিষ্টি বিতরণ। ফলাফল হাতে হাতে, নিমিষে রণক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায় ঢাকা। জাস্ট ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুদের উপরে। ঠিক কত মানুষের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার কোন পরিষ্কার ধারণা নেই কারো। দেশের প্রধান মন্দির, জাতীয় মন্দির সেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরও সেদিন রক্ষা পায়নি। বিএনপি নামক যে দলটা তখন ক্ষমতায় ছিল তারা আবার বাবরি মসজিদ তৈরি করে দিতে হবে বলে প্রতিক্রিয়া জানালেও নিজ দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত নিয়ে যে হোলি খেলা শুরু হয়ে গেছে তার ব্যাপারে কোন টুঁ শব্দ করেনি। এত এত প্রাণহানি হলো, ক্ষয় ক্ষতি হলো আজ পর্যন্ত শুনলাম না ওইদিনের ওই ঘটনার ফলে কোন বিচার হয়েছে বা কেউ সাজা পেয়েছিল। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার খেসারত বাংলাদেশ কে দিতে হয়েছে বহুবার, অনেকবার করে। আমার প্রাণপ্রিয় পত্রিকা ইনকিলাব পরের দিন ভুল সংবাদ ছাপা হয়েছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন!! ইনকিলাবের ভুল সংবাদ ছাপিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে পরে ক্ষমা চাওয়া এর পরেও ঘটেছে। ইন্ডিয়ান আর্মি বাংলাদেশের ভিতরে এসে অভিযান চালিয়েছে বলে সংবাদ ছাপিয়েছিল তারা এই কিছু দিন আগে। পরে ক্ষমা চাইলেও এবার আর ক্ষমতায় বিএনপি ছিল না বলে প্রিন্ট নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল সরকার।
ঢাকায় সেদিন আরেক লজ্জার জন্ম হয়েছিল। সার্ক চার জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল তৎকালীন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে। মানুষ দা লাঠি লোহার রড সহ নানা অস্ত্রপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টেডিয়ামে, খেলা চলছিল বাংলাদেশ এ টিমের সাথে ভারত এ টিমের। পুলিশ লাঠি চার্জ করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেনি। সেই খেলা আর হতেই পারেনি। এরপরের খেলাগুলাও বাতিল করা হয়। ক্রিকইনফোতে সেই লজ্জার কথা আজো দেখতে পারা যায়। চমৎকার করে লেখা আছে “Match halted by rioting and due to replayed on 10 December with final to be played on 11 December, but these games were never played.” আমরা ক্রিকেটপাগল জাতি তয় আগে মালুয়ান ঠেঙ্গানি।
বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার ৯২ সালের আগেও হয়েছে। ৭১ সালে হিন্দুদের টার্গেট করে করে মারা হয়েছিল। এক মহা ভণ্ড যখন দেশ চালাচ্ছিল আর দেশ কে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করল তখন আবার হিন্দুরা শিকার হলো নির্যাতনের। আগের সব অত্যাচার নির্যাতন আতঙ্ক পার করে যারা প্রিয় দেশকে ছেড়ে যায়নি তাদের কাছে আবার নতুন করে দেশের অর্থ বদলে গেলো। অনেকেই আর পারলেন না যুদ্ধ করে টিকে থাকতে। পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ান অনেক পরিবার। এই সব এক একটা পরিবারের কাছে দেশ মানে প্রহসন হয়ে থেকে গেছে হয়ত সারা জীবন। বাংলাদেশ আমার কলিজার ভিতরে অথচ তারা নিয়ে বসে আছে হয়ত জিহ্বায়। আমরা উত্তর প্রজন্ম অসহায়, আমরা নতশিরে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা দেখি না এখন আর। কিন্তু আমরাই এখন কতটুকু নিরাপদে রাখতে পারছি আমার প্রতিবেশীকে?
সেই কালো সময়ের উপরে লজ্জা লিখে লজ্জা পেয়ে দেশ ছাড়তে হয়ে ছিল তসলিমা নাসরিনকে। সেখানেও এমন এক পরিবারের কথা বলা হয়েছিল যারা শত বাধা পেরিয়েও দেশ ত্যাগ করে না। বাড়ির প্রধান একজন ভাষা সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাও। নিজের মেয়েকে যখন ধর্ষণ হতে দেখে তখন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। দেশ কাকে বলে তা নিয়ে জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায় তারা। আমরা ভদ্রলোক মানুষ, আমরা এই সব নষ্ট কথা আমরা আমাদের সাহিত্যে মেনে নিতে পারি না। লজ্জা আসলে কার এই রকম একটা কঠিন প্রশ্ন সহ্য করা আমাদের দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব না। লজ্জা যখন বলে - “ধার্মিকেরা কি কখনও পারে বিধর্মীর সম্পদ লুট করে নিজের ধর্ম রক্ষা করতে? এতো আসলে ধার্মিকের কাজ নয়। এ হচ্ছে গুণ্ডা বদমাশের কাজ।” তখন সম্ভবত কোন উত্তর থাকে না জিহাদি জুলুসে জ্বলতে থাকা আমার ভাইয়েদের কাছে। আর তাই দেশ থেকে বাহিরে তসলিমা।
তৎকালীন সময়ের সরকার বা মিডিয়া সারা দেশ জুড়ে যে তাণ্ডব চলেছিল তা বলতে গেলে এক প্রকার চেপেই গিয়েছিল। আজ পর্যন্তও যারা জানতে চায় সে সময় নিয়ে তাদের কে অসহায় হয়ে থাকতে হয়। কারণ বাংলাদেশে ওই সময় নিয়ে বলতে গেলে কোন লেখাই নাই। সম্ভবত তসলিমার পরিণতি দেখে সবাই সাবধান হয়ে গেছে। আজকে ২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে অথচ কোথাও কোন জায়গায় এই সংবাদটাও তেমন করে নাই। যারা করেছে তারা বাবরি মসজিদ কিভাবে ভাঙ্গা হলো, কোথায় কে কে জড়িত সেই ঘটনার সাথে তা নিয়েই তাদের মূল আগ্রহ। দেশের যে একটা কালো দিন তা সম্ভবত তাদের ২৫ বছরেও মনে হয়নি। আর তাই হয়ত আমাদের আকাশের উপরে কালো ছায়া কাটছে না কিছুতেই।
যে বিষ প্রয়োগ হয়েছিল অযোধ্যায় তার ফল ভোগ করেছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ। বাংলাদেশে যেমন হিন্দু পরিবারকে ভোগ করতে হয়েছে নির্যাতন তেমনই ভারতে মুসলমানরা। সরকারি হিসেবেই দুই হাজার মানুষ মারা যায় মসজিদ ভাঙ্গা পরবর্তী দাঙ্গায়। যেখানে একটা প্রাণের সমানও হতে পারে না কোন মসজিদ বা মন্দির। সেখানে সেই মসজিদ ভাঙ্গার জন্য হত্যা, সেই মন্দির তৈরির জন্য হত্যা। রক্ত ঝরা চলছে আজো। আমরা কবে বুঝতে পারব “তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজানালয়, ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!” কবে আমাদের মাথায় ঢুকবে “মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”