নিজেকে অনন্যাই মনে হত জ্ঞান হওয়ার পর থেকে। একটা বড় পরিবারের সবার চোখের মণি। প্রচণ্ড দুষ্টু আর দুরন্ত একটা মেয়ে। একটু বড় হতে বুঝলাম যে আমি সত্যিই অনন্যা, তাই সব কিছুতেই আমার জন্য না। বন্ধুদের বাড়ি যাব, তাতে না, পাড়ায় কারোর বাড়ি যাওয়াতে না, সবেতেই না, না, আর না। চারপাশের অদৃশ্য দেওয়ালটাকে ভালভাবে টের পেতে শুরু করেছিলাম। অবশ্য সেই সময় যে এটা নিয়ে খুব মাথা ঘামাতাম তা নয়। আমি কোথাও যেতে পারতাম না তো কী হয়েছে, আমার বন্ধুদের তো আমার বাড়িতে আসার বা আমার সঙ্গে খেলার কোন বাধা ছিল না। আর যখন তারা আসত, আশ মিটিয়ে খেলে নিত সে সবার সঙ্গে। এছাড়া বাড়িতে দাদা-দিদিদের ত অভাব ছিল না কোন, হোক না তারা অনেক বড় কিন্তু তার দাবি মেটাতে সবসময় এক পায়ে খাড়া।
তবু এর মাঝেই যখন দম বন্ধ হয়ে আসত, বায়না জুড়তাম মায়ের কাছে গিয়ে। ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকতাম বাইরে যাওয়ার জন্য। তখন স্কুলে যাচ্ছি, বাড়ির বাইরেটাকে দেখতে পাচ্ছি, তাই কী করে সবসময়ে বাড়ির মধ্যে আটকে থাকা যায়? অনেক চেষ্টা করেও মা যখন থামাতে পারত না, হাতের সব কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত এদিক সেদিক। মোটের উপর ভালই দিন কাটছিল আমার। স্কুল, খেলাধুলো, ঠাকুমার কাছে গল্প শোনা – সব মিলিয়ে বেশ ভাল কাটছিল।
ইতিমধ্যে বাড়িতে বড় দিদির বিয়ের কথা চলতে থাকে। আমি আবার দিদির খুব ন্যাওটা ছিলাম। সারাক্ষণ তার সঙ্গে লেপ্টে থাকতাম। এরপর যেদিন মায়ের কাছে শুনলাম দিদি বিয়ে করে চলে যাবে, সেদিন থেকে তো এক মুহূর্ত তাকে কাছছাড়া করা নেই। পাত্রপক্ষ আসে দিদিকে দেখতে, দিদি গান গেয়ে শোনায়। আমারও ইচ্ছে করে গান করতে। সবাই উৎসাহ দেয় আর আমিও গান জুড়ে দিই খুশিতে। কিন্তু দু’দিন পরে বাড়ির সবার মুখ ভার। খবর এসেছে পাত্রপক্ষ দিদিকে নয় আমাকে পছন্দ করেছে! বাবা মাকে খুব বকাবকি করে আমাকে ওদের সামনে যেতে দেওয়ার জন্য। আমার সব খুশি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মনে মনে ঠিক করি আর কোনদিন গান করব না। কিছুদিন পরে আবার অন্য পাত্রপক্ষ দিদিকে দেখতে আসে। এবারে আমি আড়াল থেকেই দেখি। হবু জামাইবাবুকে দেখে বেশ পছন্দও হয়ে যায়। এবারে আর কোন সমস্যা হয় না। কদিন পরে হইহই করে দিদির বিয়ে হয়ে যায়।
বাড়িতে অনেকে কানাঘুষো করলেও আমার খুব ভাল লেগেছিল যখন জানতে পারলাম বিয়ের পর দিদি-জামাইবাবু এই বাড়িতেই থাকবে। আমার কাছে তো এটা মেঘ না চাইতেই জল ছিল। এক তো দিদি বাড়িতেই থাকবে আর উপরি হিসেবে ডাক্তার জামাইবাবু। বিজ্ঞানে লবডঙ্কা এই শালিকে কি দয়া করে একটু পড়া দেখিয়ে দেবে না? যখনই সময় পেতাম ঘুরঘুর করতাম নতুন দম্পতির আশেপাশে। জামাইবাবুও আমাকে খুব পছন্দ করে। দোকানে নিয়ে যায়, পড়া দেখিয়ে দেয়, কত গল্প বলে। আর কত কত গল্পের বই আছে জামাইবাবুর কাছে। এর মধ্যে এসে যায় অন্যরকম একটা দিন। দুপুরবেলা দিদি-মা-জ্যেঠিমারা বাইরে যেতে ডাক পড়ে আমার নতুন জামাইবাবুর ঘরে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাই। নিশ্চয়ই নতুন কোন গল্পের বই এনেছে। কিন্তু অবাক হয়ে যাই যখন গল্প বলার ছলে তার হাত আমার সারা শরীর ছুঁতে থাকে। অস্বস্তি হতে থাকে, সরে আসতে চাই পারি না। অবাক লাগা, অস্বস্তি বদলে যায় ভয়ে যখন আমাকে বিছানায় চেপে ধরে নিজের শরীরের নিচে পিষে ফেলতে চায় ঐ বড় চেহারাটা। যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠতে যাই সে তার শক্ত পুরুষাঙ্গটা জোর করে ঢোকাতে চায় আমার যৌনাঙ্গে। এই দিনের আগে তো যৌনাঙ্গ কাকে বলে তাও জানতাম না। অনেক চেয়েও পারি না চিৎকার করতে। আমার গলার আওয়াজকে চেপে দেয় আমার ঠোঁটের উপর চেপে বসা তার ঠোঁট। তবে যে মা বলেছিল যখনই কোন বিপদে পড়বে ঠাকুরকে ডাকতে, কই চোখের জলে নিজেকে ভাসিয়ে এই যে এত করে ডাকছি, কেউ তো আমাকে বাঁচাতে আসেনা। এই সময়ে প্রায় নীল হয়ে যাওয়া আমার মুখ দেখে হয়ত ভয় পেয়েই আমাকে ছেড়ে দেয় সে। আমি ছাড়া পেয়ে পালিয়ে আসি, লুকিয়ে থাকি সেই অন্ধকার ঘরটায় যেখানে আমি দিনের বেলাতেও ভয়ের চোটে ঢুকিনা। লুকিয়ে থাকি ততক্ষণ, যতক্ষণ না বাড়ির বড়রা সবাই ফিরছে।
এরপর থেকে পালিয়ে বেড়াতে থাকি আমি সবসময়। ভেবেছিলাম এভাবে পালিয়ে বেঁচে যাব। কিন্তু পালিয়ে যেতাম কোথায়? বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার তো উপায় ছিল না। তারই সুযোগ নিল জামাইবাবু আবার। এই বাড়িতেই একটা ঘর ছিল আমার খুব প্রিয়। একমাত্র এখানেই আমি নিজের জগতে হারাতে পারতাম। আর এখানেই সম্পূর্ণ হল আমার সর্বনাশ। নিজের খেলার জিনিস নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে বুঝিনি কখন শিকারি আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন বুঝতে পারলাম, তখন আমার আর পালাবার রাস্তা ছিল না। এবারে আর সহজে ছাড়া পাই না। পুরুষাঙ্গকে জোর করে ঢুকিয়ে ঘষে চলে সে আর যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। এবারেও মায়ের ঠাকুর আমাকে বাঁচায় না। এক দাদার সাড়া পেয়ে আমাকে ঐ অবস্থায় ফেলে রেখে পালায় কাপুরুষটা।
এবারে আর আমি চুপ করে থাকি না। ভয় পাই, খুব ভয় পাই। তবুও বলে ফেলি নিজের কষ্টের কথা। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তাই বার বার বলে যেতে থাকি। এবারে আর থামি না আমি। বড়রা বিরক্ত হয়। আমাকেই দোষ দিতে থাকে। বাবা-মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে। ঠাকুমাও চলে আসে আমাদের সঙ্গে। তবে কেউ না বুঝুক, দিদি বুঝেছিল আমার কথা। তাই বাড়ি ছাড়ার সময়ে আমাকে বুকে চেপে ধরে সমানে কেঁদে গেছিল।
সেদিনের পরে বড় হয়ে গেছিলাম আমি। হয়ত সময়ের অনেক আগেই বড় হয়ে গেছিলাম। বুঝে গেছিলাম কোন জায়গাই আর আমার জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিইনি আমি। তিল তিল করে তৈরি হয়েছি এই ধরনের শয়তানদের মোকাবিলা করার জন্য। আজ আমি জানি কি করে এই সব কাপুরুষদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়। কিন্তু অনেক দাম দিয়ে এটা আমাকে শিখতে হয়েছে। কাউকে বিশ্বাস করি না আজ আমি। ভালবাসার জনের প্রথম ছোঁয়াতে আড়ষ্ট হয়ে গেছিলাম যা কাটাতে অনেক সময় লেগেছিল। তার কাছে কৃতজ্ঞ আমি যে সেই সময় সে আমার পাশ থেকে সরে যায়নি। তাও সামান্য উনিশ-বিশেও বুকের মধ্যে আজও সন্দেহের কাঁটা তিরতির করে ওঠে। কোন সম্পর্কই আজ আর সহজ নয় আমার জন্য। আজও ঘুমের মধ্যে সেই দিনটাকে দুঃস্বপ্নে দেখে জেগে উঠি। ওভারপ্রোটেক্টিভ হয়ে উঠি নিজের সন্তানের প্রতি। ভুলে যেতে পারলে ভাল হত কিন্তু তা হওয়ার নয়। আজ সেই জায়গা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও তাই মাঝে মাঝে হানা দেয় ঐ দুটো দিন আমার স্মৃতিতে। শিউরে উঠি আমি। তবু আমি এগিয়ে চলি। যেতেই হবে আমাকে। আমি যে অনন্যা।
(লেখিকার নাম পরিবর্তিত)