যদুবাবু ওরফে জ্যোতিষ্ক দত্ত। তাঁর এই ৭০ পাতার চটি বইতে আলোচনা করেছেন রাশিবিজ্ঞান বা statistics এর সম্ভাবনা তত্ত্ব ও তার স্ববিরোধিতা (probability and paradox) নিয়ে। Probability বা সম্ভাবনা তত্ত্ব শুধু যে অংকের ক্লাসে বা বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রেই ব্যবহৃত হয় তা তো নয়। বরং রোজকার জীবনে আমার আপনার মত সাধারণ মানুষেরাও ব্যবহার করি এই তত্ত্ব ---- কখনও জেনে, কখনও বা না বুঝেই। ধরুন, পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং মেলে AC 2 tier এ confirmed টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা বা এবারের ICC Test Championship এ ভারতের champion হওয়ার সম্ভাবনা কতটা --- এই ধরণের আলোচনা তো আমরা হামেশাই করে থাকি। যদুবাবু এই সব ধরণের সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর আলোচনাগুলো একেবারে আমাদের মত আনাড়ি সুলভ নয়। আবার যদুবাবু এই বিষয়ে পণ্ডিত হলেও তাঁর লেখার মধ্যে পণ্ডিতি ব্যাপার স্যাপার একেবারেই নেই। বরং দৈনন্দিন জীবনে, রকেট উৎক্ষেপণ বা যুদ্ধক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের পেছনে কিভাবে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা তত্ত্বের প্রয়োগ --- যদুবাবু পুরোটাই আলোচনা করেছেন বৈঠকি মেজাজে। বইটা পড়তে পড়তে মনে হবে যেন পাড়ার রকে বসে কোনও দাদা তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে জমাটি আড্ডা দিচ্ছেন। যে কোনও রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার এর মত একটানে পড়ে ফেলতে হবে বইটা। সম্ভাবনা তত্ত্বকে উপেক্ষা করার মাশুল কিভাবে গুণতে হয়েছে সেই সব গল্পও শুনিয়েছেন যদুবাবু।
বই থেকেই দু-একটা উদাহরণ দিই। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ' ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন। 'কারও কারও জীবনে তা সত্যি হয় বইকি। সেরকম কতো গল্প ঘুরে বেড়ায় লোকমুখে। ছোটবেলায় খুব শুনতাম ধীরু ভাই আম্বানির গল্প। যদুবাবু নিজেই বলেছেন এখন WhatsApp বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে আরও বেশি এই ধরণের গল্প উঠে আসছে। আর আমরা হয়তো অনেকেই আফসোস করছি, হতাশায় ডুবে যাচ্ছি এই ভেবে যে আমাদের অ্যাকাউন্টে লাখ কেন হাজার টাকাও জমছে না। কিন্তু এখানেই ভুল হচ্ছে আমাদের। সংখ্যাতত্ত্ব বা রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে bias। কারণ আমরা একজন Steve Jobs কে দেখছি, কিন্তু Steve Jobes এর মতই প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আরও কত জনের জীবনে এরকম সাফল্য অধরাই থেকে গেছে।
আবার রাশিবিজ্ঞান যে শুধু আমরা ব্যবহার করি বা করার চেষ্টা করি সেরকম তো নয়। গবেষকরা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সরকার, বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন statistics। খবরের কাগজের পাতায় আজ দেখলেন রীতিমত তথ্য প্রমাণ সহ heart এর জন্য সর্ষের তেল খুবই অপকারী। অবিলম্বে অলিভ অয়েল দিয়ে রান্না শুরু না করলে সমূহ বিপদ। আবার পরের দিনই দেখলেন ঠিক উল্টো প্রতিবেদন। সেও রীতিমত তথ্য প্রমাণ সহ। বা এই corona র সময়ের কথাই ধরুন। কোন টিকা কতো বা আদৌ কার্যকরী কিনা সেই বিষয়ে statistics ব্যবহার করেছিলেন সব পক্ষই। কিন্তু এখানেও কাজ করছে সেই bias। খালি সেই তথ্যটুকুই দেখা হচ্ছে যেটা আমার কোম্পানির তেল বা টিকার সপক্ষে যাচ্ছে। তাই এই বিভ্রান্তি। এই সব bias এর হাত থেকে বাঁচতে গেলেও ভরসা সেই রাশিবিজ্ঞানীরাই।
কার্য কারণ সম্পর্ক টানা আমাদের চিরকালের স্বভাব। দুটো জিনিসের বা চলকের মধ্যে সম্পর্ক (correlation) থাকলেই কি কার্য কারণ সম্পর্ক (causation) ও থাকতে হবে?? আমার বাড়িতে যাঁরা smoker তাদের সঙ্গে এই নিয়ে নিত্য অশান্তি। সিগারেট খাওয়ার সঙ্গে lung cancer এর একটা সম্পর্ক থাকলেও সেটাই কি কারণ?? Non smoker দের কি lung cancer হয় না?? আবার অনেক সময় এমন অনেক ঘটনা একসঙ্গে ঘটে যাদের মধ্যে আপাত কোনও সম্পর্ক নেই। বিরিঞ্চি বাবা বললেন, 'ওঠ, ওঠ…' আর সূর্যি মামাও উঠে পড়লেন। এটা কি সূর্য ওঠার কারণ?? আবার অনেক ঘটনা হয় যেগুলোর মধ্যে আপাত কোনও সম্পর্ক না থাকলেও ঘাপটি মেরে বসে থাকে কোনও তৃতীয় চলক, যাকে আমরা বলি lurking variable. যেমন ধরুন, মানুষের উচ্চতা যত বাড়ছে মাথার চুলের ঘনত্বও তেমন কমছে। ভাবছেন, এ আবার কি উল্টোপাল্টা, তাই তো?? কিন্তু সম্পর্ক একটা আছে। ভাবুন… ভাবা প্র্যাক্টিস করুন…
লেখার মাঝে মাঝেই আমাদের সঙ্গে যদু বাবু পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রাশিবিজ্ঞানের বহু বিখ্যাত এবং রঙচঙে চরিত্রদের সঙ্গে। যেমন আব্রাহাম ওয়াল্ড, যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের ক্ষয় ক্ষতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি সন্ধান দিয়েছিলেন survivor bias এর। মিলিটারি কর্তাদের একদম বিপরীত ছিল তার রিপোর্ট। এই বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী ভারতে ঘুরতে এসে প্রাণ হারান সেই বিমান দুর্ঘটনায়। একেই হয়তো বলে ভাগ্যের পরিহাস। তবে তার মৃত্যু নিয়ে একটা রহস্যেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন যদুবাবু তার লেখায়।
তবে, যদুবাবুর এই বইয়ে আমার সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে তা হল, যদুবাবুর প্রখর সমাজ বোধ। নিজে সমাজতত্ত্ব এর শিক্ষক বলেই বোধহয় এই বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছে বেশি।কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখি আমাদের এখানে মনে করা হয় যারা বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন সমাজ নিয়ে তাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। ও সবের জন্য ' arts ' বা humanities এর লোকজন আছেন। আবার, সমাজতত্ত্ব এর পাঠ্যক্রমে statistics থাকলেও সমাজের সঙ্গে তার ঠিক যোগটা কোথায় বা ইতিহাস পড়লে রাশিবিজ্ঞান জেনে হবেটা কি --- এই রকম ভাবেন অনেকেই। সেই সেতুবন্ধনটা খুব সহজে করেছেন যদুবাবু। বাস্তবের বিভিন্ন ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে দেখিয়েছেন কিভাবে সেখানে সম্ভাবনা তত্ত্বকে কাজে লাগানো হয়েছে অথবা কোথায় ঘটেছে ভ্রান্তি। সম্ভাবনা তত্ত্বের স্ববিরোধিতাগুলি কিভাবে প্রভাবিত করেছে যুদ্ধ বিমানের নকশা থেকে আমেরিকার জনপ্রিয় ফুটবল তারকা O J Simpson এর বিচার প্রক্রিয়াকে সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছেন যদুবাবু। রাশিবিজ্ঞানের তথ্যগুলোকে সাবধানে ব্যবহার না করলে কিভাবে বিপদ হতে পারে সেগুলিও আজকের ভারতবর্ষে ঘটে চলা নানা সামাজিক - রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন তিনি। কোনও তত্ত্ব বা প্রমাণকে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেওয়ার বিপদ ইতিহাসে আগেও দেখেছি আমরা। তাই যদুবাবু মনে করিয়ে দিয়েছেন সক্রেটিসের শিক্ষা, "The unexamined life is not worth living." প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়, বরং সর্বত্র বেয়াড়া রকমের প্রশ্ন --- সেটিই কাম্য। আজকের ভারতবর্ষে বড়ো জরুরি এই কথা মনে রাখা। তাছাড়াও ভালো লেগেছে যদু বাবু প্রতি অধ্যায়ের শেষে যেমন সূত্র নির্দেশ করেছেন তেমনই উৎসাহী পাঠককে দিয়েছেন আরও বই পত্র ও প্রবন্ধের হদিশ।
সেই সঙ্গে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই গুরুচণ্ডা৯-কে। কারণ এরকম একটা বই ছাপার কথা তাঁরা ভেবেছেন। কারণ ইদানীং বাংলা প্রকাশনার জগতে তন্ত্র মন্ত্র, উদ্ভট পুরাণ ইতিহাস ইত্যাদির রমরমা। (দু-একটি ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। শুধু প্রকাশনা জগতে নয় বরং সমস্ত সমাজেই খুব পরিকল্পনা মাফিক কল্পনা এবং অর্ধসত্য মিলিয়ে একটা সমাজ বাস্তবতা তৈরির চেষ্টা চলছে সেটা খুবই উদ্বেগজনক। প্রচ্ছদের ওপর লেখা আছে বাংলায় বিজ্ঞান। আশা করছি চটি সিরিজ এর মত এই সিরিজেও এই রকমই আকর্ষক অনেক বই পাবো আমরা। কারণ বাংলায় সত্যিই popular science এর বই প্রায় নেই বললেই চলে। তবে একটাই অনুরোধ গ্রাফগুলো যদি সাদা কালো না হয়ে রঙিন হয় তাহলে বুঝতে আরও সুবিধে হয়।
●শিরোনামটি কবীর সুমনের একটি গান থেকে অনুপ্রাণিত
যদুবাবুর টিউশনি - প্রোবাবিলিটি ও প্যারাডক্সের গল্প
লেখকঃ জ্যোতিষ্ক দত্ত
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
মূল্য – ১০০ টাকা