মহেশবাবু ভূত মানতেন না। ভূত মানেই বুজরুকি এটাই বলতেন। ভূত বিষয়ে প্রচুর বই পড়তেন, গাল দিতেন, খুব রাগ হত, কিন্তু তার পর আবার বই কিনতেন আর তর্ক করতেন। আমার কাছে ভূত হল ব্যোমকেশ নিয়ে বানানো সিনেমা। দেখি, রাগ হয়, গাল দিই, আবার দেখি।
বাংলার ভাগ্যাকাশে এখন ব্যোমকেশের দুই সত্ত্বাধিকারী, ঈশেন আর সত্যবাহন, ইয়ে মানে দত্তবাবু আর শীলবাবু। দত্তবাবু ল্যাপ শুরু করেছিলেন আগে, অন্যজন সদ্য যোগ দিয়েছেন। ওনার আগের ফিল্মটা দেখে মনে হয়েছিল, বজরা টজরা এনে ট্রিবিউট দিয়ে ফাটিয়ে দিতে চাইলেও, জ্ঞানের বহর প্রথমজনের চেয়ে একটু কম হওয়ায় হয়তো একটু বেশি সহনীয় হবে। কিন্তু এই পর্ব দেখে উপলব্ধি: এটা বাস্তবে দত্ত vs দত্ত।
আসলে ট্রিবিউটের মধ্যেই কেলোটা লুকিয়ে ছিল। এতে উনি ট্রিবিউট দিয়েছেন স্বয়ং অঞ্জন দত্তকেই, একটু আদিবাসী নাচে আগন্তুক, রেসকোর্সের বাইরে সীমাবদ্ধ ইত্যাকার কিছু হালকা সত্যজিৎ বাদ দিলে। লোকেশন সেই এক ডুয়ার্স, ভিলেন সেই এক কৌশিক, গ্রেফতারির আগের সেই এক ধাঁচের বক্তৃতা, এবং জ্ঞানের বাটখারা।
ফিরে এসে মনে হল ন্যাশনাল এনথেম ও ন্যাশনাল সং দিয়ে মোড়া এই সিনেমাটিতে কী কী চমক লাগলো, তারও লিস্টি করা দরকার। শুরুতে ড্রোন ক্যামেরায় রেল লাইনের বিহঙ্গদৃষ্টি অতি চমৎকার, কিন্তু তারপরেই চমক। রাইটার্সে বসে আছেন স্বয়ং অরিন্দম শীল, টেবিলে লেখা 'মুখ্য সচিব'। এবং তার পর থেকেই সত্যবতী, অজিত, বড় দারোগা সবাই বিন্দাস বলে যাচ্ছে মুখ্য সচিব অমুক, মুখ্য সচিব তসুক। ১৯৪৮এর আগস্টের আগেই 'মুখ্য সচিব' শব্দের এরূপ প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা দেখে তাক লাগার শুরু। আমার সহদ্রষ্টাকে বললাম, ইয়ে তখনও মাউন্টব্যাটেন আছেন, সংবিধান আসতে বহু দেরি তো, তিনি বললেন, চুপ করে দ্যাখ। দেখলাম। এবং এটা হজম করার পর আর কষ্ট হল না যখন দেখলাম সেই মুখ্য সচিবের ঘরের দেওয়ালে অখণ্ড বাংলার ম্যাপ, তিনি নিজেই সান্তালগোলার তদন্তের দায়িত্ব দিতে তো এসেইছেন সরকারের তরফ থেকে, সেই সান্তালগোলার সম্ভাব্য কোন কোন ব্যবসায়ী আসামী হতে পারেন তার লিস্টিও তিনিই পকেটে নিয়ে ঘোরেন, দারোগা নন, এসপি নন, এমনকি সিপিও নন। তা সেই তথাকথিত নগণ্য জায়গার ওসিকে সরাসরি নির্দেশ দেন মুখ্য সচিব, এবং তার পরেও সেই সচিবের পাঠানো খাস গোয়েন্দার সামনে সরাসরি তাচ্ছিল্য, হুমকি ইত্যাদি দেখাতে সাহস করেন আংরেজ জমানার সেই দারোগা। চুপ করে দেখা ছাড়া উপায় নেই। আমি তো কোন ছার, ব্যোমকেশ-ই চুপ।
ব্যোমকেশ-ও যে সে লোক না কিন্তু। মারপিট করতে যাচ্ছি বললে গিন্নী পাছে মানা করেন, তাই তিনি নিয়মিত সাহিত্যসভায় যাওয়ার নাম করে চীনাপট্টিতে গিয়ে নারীপাচারকারী দুর্ধর্ষ চৈনিক দস্যু ঘচাং ফু:-এর দলবলের সাথে কুংফু লড়েন, তারপর জেমস বন্ডের মতো টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে, ইয়ে মানে জহর কোট পরতে পরতে পুলিশের থেকে কাচা পাজামা পাঞ্জাবি বায়না করেন। প্রথমে ধরতে পারি নি ঠিক, পরে মনে হল ঠিক কথা, বরের পোশাকে একটু ধুলো থাকলে গিন্নী সন্দেহ করতে পারে, অন্য কারো পোশাক পরে এলে তো সন্দেহের জায়গাই নেই।
তো সেই ব্যোমকেশ তো সতীর্থ এবং সস্ত্রীক এলেন সন্তালগোলায়। টিপ্পনি দিলেও দারোগাসাহেব তাদের এক আলিশান বাংলো দিলেন। সেখানেও চমক। দৃশ্যত উত্তর কলকাতার একান্নবর্তী পরিবারের চাবিহাতে কর্ত্রী অবয়বের ফর্সামসৃণ বাসন্তী আদিবাসী অবতারে পুরুলিয়া ডায়লেক্ট শুনিয়ে চমকে দিলেন। অরণ্যের দিনরাত্রির সিমি গরেওয়ালকে ট্রিবিউট দিলেন কিনা কে জানে, তবে সিমির মেকআপের কথাটা ভুলেই গেলেন। আর পুরুলিয়া বাঁকুড়ার ডায়লেক্ট ভুলে গেলে যে সেখানে ঢাকা বরিশাল দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়, এ তো আজকাল শিশুটিও বোঝে। তবে হ্যাঁ, এখানে হরেক রকম ডায়লেক্ট পাবেন, এত বৈচিত্র্য যে আমি তো বটেই, অভিনেতারাও গুলিয়ে ফেলছিলেন।
ইতিমধ্যে গপ্পো হু হু করে ছুটছে। লাশ কা মাউন্টেন, খুন কা ফাউন্টেন। দুটো খুনই বেশ যত্ন নিয়ে দেখানো, ভালো লাগলো। সদানন্দ হিসেবে রুদ্রনীল অনবদ্য। তবে মৃতদেহের আশেপাশের মাটিতে দৃকপাত না করে হুট করে সটান সদানন্দের বাড়ি চলে এসে পাঁচিলের কাছে ঘোড়ার ক্ষুরের দাগ খোঁজায় মজা পেলাম।
যাকগে, মূল গপ্পো তো আর খুন না, বেআইনি অস্ত্র ব্যবসা। এখানে অবশ্য বারবার শুধু কালোবাজার কালোবাজার বলে গেল সবাই, লেটেস্ট ট্রেন্ড-ও হল, আবার নেহেরু সেই সময় কাদের যেন নিয়মিত ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতেন, তা সেসব ট্রিবিউটেরও ব্যাপার হতে পারে। নাম যাই হোক, ব্যোমকেশ এসেই মুখ্য সচিবের লিস্টি ধরে চারজনকে বেনামি হুমকি দিলেন। নিজের হাতের লেখায়। এবং তাঁরা রকমারি ক্যারিকেচার দেখাতে লাগলেন। শুভাশিস দারুণ অভিনয় করেছেন যথারীতি, রজতাভর নাম বি এন দস লেখা দেখে গোয়েন্দাযুগল খিল্লি করলেন, কে জানে হের দস ঘনাদাকে ট্রিবিউট দানের এরকম একটা সুযোগ পরিচালক মিস করলেন কি করে। তবে এই বদ্রিদাস চরিত্রে অনেক মজা আছে, পরে প্রকাশ্য, আপাতত ইনি শুধু পাইপ ধরিয়ে বাঞ্চ অব হ্যাগার্ডস আর বাস্টার্ডস এসব বলেই যাবেন।
এর মাঝে সত্যবতী বাজারে গিয়ে উইন্ডো শপিং করবেন, মলোচিত উচ্ছ্বাস দেখাবেন, রাজকাহিনী করার সময় আয়ত্ত করা পশ্চিম রাঢ় ডায়লেক্ট আলগা ঝালিয়ে নেবেন, হঠাৎ সামনে দেখবেন জুন মালিয়া। জুন সেজেগুজে সাঁজেলিজেতে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন, সামনে সত্যবতী পেয়ে একখানা জব্বর আলাপ করলেন। যে তিনি নাকি যুথিকা, বিশ্বনাথের গিন্নী। আর ওমনি সত্যবতী কি মিট্টি কি মিট্টি করে খেজুর শুরু করে দিলেন। ভালো কথা, তখনও কিন্তু সত্যবতীর সাথে বিশ্বনাথের আলাপ পরিচয় হয় নি, হিসেবমত তিনি নামও জানেন না, কিন্তু তাতে কি। আপনি জানেন, আমি জানি, মুখ্য সচিব জানেন।
তো এর মাঝে ফোক কালচার হবে, মুখ্য সচিবের লিস্টি ধরে চারমূর্তি আসবেন, নাচের মাঝে জুন আর সোহিনী হঠাৎ ঢুকে পড়ে মমতাশঙ্করকে ট্রিবিউট দেবেন, সামাজিকতায় চারদিক ভরে উঠবে।
এবং এর পরেই চমকের পর চমক। সদানন্দের রেসের বই আর আতর দেখেই ব্যোমকেশের মনে হবে কলকাতায় সদানন্দেরর ফূর্তির ছানবিন করা দরকার। আর কে না জানে, কলকাতা শহরে ফূর্তি করার একটাই জায়গা আছে। আর সেখানে রিকশায় চেপে, লিপস্টিক, পান আর উড়ুনি চাপিয়ে যেতে হয়। এবং সেখানে চীনাপট্টিতে, লখনৌ ঘরানার, ভোজপুরী ডায়লেক্টের বাঈজীর সাথে কথা বললেই সে এক মুহূর্তে চিনতে পারে কোন গ্রামের কোন আঁচিলওয়ালা লোক তাকে নিজের বউয়ের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়েছিল। এলিমেন্টারি। তবে আইটেম সং ভালোই ছিল। সায়ন্তিকার বিশেষ ভূমিকার পর এবার মীর আশরাফ আলি। রেসের মাঠ। বাইরেই সীমাবদ্ধ হতে হল, ভেতরে আর কী শুট করবেন এখনের নিরেস কলকাতায়। ছুটন্ত ঘোড়ার প্রেক্ষাপটে স্ট্যাটিক নায়ক দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ, এখানে স্ট্যাটিক ঘোড়ার আস্তাবলে ছুটন্ত নায়ক দেখিয়ে দিলেন অরিন্দম। রিভার্স ট্রিবিউট, জটিল ব্যাপার।
হুঁ, তো কলকাতা পর্ব থেকে আমরা কী জানলাম? সবুজ ডায়েরি বার করে লিখে ফেলুন। এক, বদ্রিদাস একসময় রেসের জকি ছিলেন। না না, বিশ্বনাথ না, বদ্রিদাস। দুই, বিশ্বনাথের দুটো ঘোড়া রেসের মাঠে আছে। তিন, সদানন্দ বদ্রিদাসের সাথেই এই তীর্থে আসতেন। ট্রাভেল এক্সপেন্স আর মেকআপ খরচ বাদ দিলে এই তিন তথ্য গোয়েন্দার নিট লাভ। এবার তাদের কার্যকারিতা দেখব বলে আশায় রইলাম। শরদিন্দুর প্যাঁচ আরো এক ফেরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন অরিন্দম, এবার গোটানো দেখব।
ব্যোমকেশ কিন্তু বেশ কিউটমতো গোয়েন্দা, মানে সত্যান্বেষী। ফিরেই হের দসের সামনে গিয়ে জানিয়ে এলেন যে জকির গল্প উনি জানেন। অতঃপর ব্যোমকেশ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন বদ্রিদাস সদানন্দকে চিনতেন কিনা, এবং বদ্রি অস্বীকার করিলেন, পুনরায়। খেলা জমে উঠেছে।
তার মাঝে বিশ্বনাথ, মানে কৌশিক সেন, ফোন করে ইউরোপীয় ক্লাবে আসতে বললেন, জরুরী তথ্য দেবেন বলে। ব্যোমকেশের বাড়িতে তখন ভরা বাদর, মাহ ভাদর। চটপট ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল বক্সিং ডে ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। বিষয়টা মনে হয় ওঁরাও খেয়াল করেছিলেন। পরের সিনেই তাই সোহিনী বলছেন, কি ঘন ঘন আবহাওয়া পাল্টায় এখানে বলো। অত সুন্দর ইংলিশ ক্রিকেটটাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে, আর আমাদের ইডেনেই শুধু সুপার সপার দিয়েও দুফোঁটা জলের পর ম্যাচ ভেস্তে যায়।
শেষের দিক চলে এসেছে, অনেক নতুন প্লট ঢুকিয়েও আর টানা যাচ্ছে না, কিন্তু হাতে সময় আছে। এমতাবস্থায় কিং করণীয়ং অস্মভী? অঞ্জন দত্ত হলে কী করতেন? ঠিক ধরেছেন, পিকনিক, ডুয়ার্সের অনন্য সব ক্যালেন্ডার পিকচার পোস্টকার্ড দেখা আর গান। প্লাস নদীর ধারে বেতের ঝুড়িতে খাবার এনে বসলে সেই ওনাকেও ছোঁয়া যাবে। শুধু আর মেমরি গেম না প্লিজ, ওটা পচে গেছে, বরং শতরঞ্চি পেতে দাবা খেলুন, কারো কারো নাম ও গেম-মাহাত্ম্য থেকে অন্য কোনো নাম মাথায় ঝিলিক দিতেই পারে। জুন ব্রিজ থেকে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে নদী দেখেন। একটি বাইনোকুলারের জন্ম ও মৃত্যু হয়। ও ভালো কথা, পিকনিকে কারা গেলেন জানেন তো? ব্যোমকেশ এট অল এবং বিশ্বনাথ এট অল। ডিপ ব্যাপার স্যাপার। এবং থ্রিলার গল্পের স্পিড এবং থ্রিল ততক্ষণে পুরো ইন দ্য ভোগ অব মা।
এবার শেষ করতেই হয়। গোয়েন্দারা রামডিহি যান। ব্যোমকেশ যথারীতি রাস্তায় নেমে গিয়ে বাগমারী। এর পর দুটো চমক। এক, কথা নেই বার্তা নেই, দেখি ব্যোমকেশ ঘষা কাঁচের চশমা নিয়ে এক পর্দাঘেরা মুদীর দোকান ধরণের জায়গায় শোওয়া। হলই বা কী করে, আর তাতে কী চতুর্বর্গ লাভ হল, কিচ্ছুটি বোঝার জো নেই। কারণ পরের দৃশ্যেই তো আবার মধ্যযুগীয় নাইট হয়ে তিনি অসিতাশ্বে ধাবমান। যাই হোক, ছদ্মবেশ হয়ে গেছে দুবার, খাতায় টিক পড়ে গেছে, ওতেই হবে। দুই, গ্রামের চারজনকে ব্যোমকেশদা জানায় আরো সব বন্ধুবান্ধব নিয়ে যেন পাহারা দেওয়া হয়। এতই টপ সিক্রেট ব্যাপার, গোটা গ্রামকে না জানিয়ে কী করে হয়। তাহলে ব্যোমকেশের এবার কী করণীয়? কেত কেত, আবার কি। হঠাৎ দেখব এক অশ্বারোহীর পাশে আরেক অশ্বারোহী, ক্যাঁত করে লাথি, তার পরেই হর্স রেস। এবং আসামীর পনেরো ফিট দূর থেকেই বিন্দাস পলায়ন। সত্যান্বেষীর ফিরে আসা, কালো শেয়াল দেখা, এবং নিদ্রা। কালি প্রাতে আরম্ভ হইবে মহারণ।
ভালো কথা, অস্ত্র কোথায় ছিল বলুন তো। ফণীমনসা ঘেরা মরাগাছে। গাছের ডালে, কোটরে, মাটির তলায়? মাক্কালি, কেউ বলে নি। আসামী ঘোড়া নিয়েই বা কেন যেত, বাড়তি কী সুবিধা? শরদিন্দু উত্তর দিয়েছিলেন, এখানে কিস্যু জানা নেই। জকি তো বদ্রি ছিলেন, বিশ্বনাথ কোদ্দিয়ে অত ভালো ঘোড় সওয়ার? জবাব নেই। এবং সেটাও ব্যোমকেশ জানলেন কোদ্দিয়ে? নাকি অজিত মহাভারত পড়তে পড়তে শমীবৃক্ষ কথাটি উচ্চারণ করায়, চলন্তিকা দেখে। জাস্ট চান্স। আগের গল্পের মতোই।
এবার ধরুন আপনি হলেন কালোবাজারি অস্ত্রের কারবারি। জানেন এলাকায় সরকারি গোয়েন্দা এসেছে। সেই গোয়েন্দা আপনাকে এবং আরো দশজনকে জানিয়েছে কাল বা পরশু জঙ্গলে সার্চ হবে। আম জিন্দেগী হলে কী করবেন, একটুও সময় নষ্ট না করে সেই রাতেই অস্ত্র সরাতে চাইবেন। শরদিন্দুর আসামী তাই করেছিল। কিন্তু এখানে আসামী শীলিত, মেন্টস জিন্দেগী। তাই সেদিন তিনি গোয়েন্দার বাড়িতে ডিনার এবং অপেরা মিউজিকে বিনোদিত হন, পরের সারাদিন পিকনিক চলে। বিকেলে যখন তিনি বাই চান্স জানতে পারেন যে গোয়েন্দা একটুক্ষণ বাইরে থাকছেন, তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গলে ঢোকেন, তাও গোয়েন্দা গিন্নীর থেকে কনফার্ম করার পর। আরো মজা, পরের দিন জানা গেল, তাঁর কাঠের গোলার কর্মচারী সবাই নাকি এতই বিশ্বস্ত যে মালিকের হুকুমে সরকারী গোয়েন্দাদের খুন করতেও তৈরী। অথচ তাদের কাউকে নিয়োগ করা যায় নি এই কর্মে, এমনকি সদানন্দকে খুনের বুবি ট্র্যাপ পাততেও একজনকেই যেতে হয়। যে কারণে ঘোড়ার ওপর এত নির্ভরতা শরদিন্দুর গল্পে, তার প্রতিটি দিয়ে চুরমুর বানানো হয় অক্লেশে।
ভেবেছিলাম সব অবাক হওয়া শেষ। ও হরি, একটা মেগা তুরুপের টেক্কা ছিল ওনার আস্তিনের তলায়। কাঠের গোলায় মারপিটের পরে যখন কৌশিকবাবু ধরা পড়লেন, তিনি মিনি বক্তৃতায় কী বলেন ভাবতে পারেন? এইসব অস্ত্র নাকি সমাজ বদলের জন্য, সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য! এইজন্য এতক্ষণ তেভাগা তেভাগা করে কুঁই কুঁই করছিল হতভাগাগুলো বুঝি! তো বিরক্ত হয়ে ব্যোমকেশ খুনের রাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতি ইত্যাকার এক বক্তৃতা দিলেন, যেটি প্রাসঙ্গিক হবে আরো কুড়ি এবং ষাট বছর পরে, সে আর কি করা যাবে। যাই হোক, কৌশিক যদি মার্কিন অস্ত্র কিনে অতিবাম রাজনীতিই চালান, তাহলে কালোবাজারি অস্ত্রব্যবসা তো পুরো ক্যাশলেস জুমলা হয়ে গেল, লে হালুয়া!
এবং বাকি প্রশ্ন আর উঠলোই না। বদ্রিদাস অব্দি দিব্যি থানায় বসে চা সিঙ্গাড়া খেয়ে গপ্পো শুনে গেলেন। তাঁর জকি থাকা, সদানন্দকে চিনতে অস্বীকার করা, আগের রাতে কী বলতে এসেছিলেন কিস্যু জানা গেল না। রজতাভ এ যাত্রায় ভিলেনির আঁচ পেলেন না একরত্তি। পুরো কান্তিশাহের স্টাইল। ভিলেন খতম, দি এন্ড।
কিন্তু হাজার হোক, অরিন্দম কান্তি শাহ নন। তাঁর একটা পোগোতিশীল ভাবমূর্তি আছে। তাই এল ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৮। তেরঙা পতাকা উড়লো। বন্দে মাতরম গান হল। তারপর শ্রীখন্ডবাবু বললেন, দেখুন এরা আশা করে আছে আপনি কিছু বলবেন। তখন ভবদুলাল বললেন, বেশ তো। দেখো বালকগণ, আমার একটি বই বেরোবে, চলচিত্তচঞ্চরী। তাতে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা থাকবে। যেমন এক জায়গায় আছে চুরি করা মহাপাপ। ইত্যাদি। আসলে কী হয়েছে, দেশ ও দশের উদ্দেশ্যে একখানা ছোট্ট বক্তৃতা ব্যোমকেশের ছিল, আদিম রিপু গল্পে। কিন্তু তার কপিরাইট তো দত্তস্যারের। শীলস্যর এখানে ধাঁ করে সেটা গুঁজে দিয়ে বেশ একটা দেশাত্মবোধক আমেজে ফিল্ম শেষ করে দিলেন। তার ওপর বন্দে মাতরম। দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে আপনি বাধ্য। আমেন।