৭১ থেকে ২০১৫, গত ৪৪ বছর ধরে আমরা শিখেছি, শুনেছি, জেনে আসছি যে মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ লক্ষ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা ভুল জেনে আসছি, যা শিখেছি ভুল শিখেছি। সত্যিটা হল, একাত্তরে কোন নারী তার সম্মান হারায় নি, কোন নারী তার ইজ্জৎ হারায় নি।
হ্যাঁ এ ইতিহাস ষোল আনা সত্যি যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনি এবং আমাদের এদেশীয় দালালরা বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ষিত দলিল ও বিদেশী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ নারী যুদ্ধের ৯ মাসে নির্যাতিত হয়েছিল যাদের বয়স হবে ১৩ থেকে ৫৫।
সুজান ব্রাউনমিলার 'এগেইনস্ট আওয়ার উইলঃ মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ' গ্রন্থে দাবি করেছেন,
'১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশে ৪ লাখের মতো নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। সুজান লিখেছেন, 'অস্ত্রেশস্ত্রে বলীয়ানথাকায় পাকবাহিনির পক্ষে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে যখন-তখন যে কোনো ঘরবাড়িতে ঢুকে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে ধর্ষণ চালানো খুবই সহজ ছিল।' তিনি লিখেছেন, 'বাংলাদেশের এই ধর্ষণ ঘটনাগুলো এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ৮ বছরের শিশু থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে পর্যন্ত বর্বরপন্থায় নিপীড়ন করা হয়েছে।' তিনি আরও লিখেছেন, 'এমন উদাহরণও পাওয়া গেছে যে, কোনো কোনো মেয়েকে উন্মত্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা একরাতে দলগতভাবে ৮০ বার পর্যন্ত পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। সেই হিসেব করছে ধর্ষণের সংখ্যাটা অনেকগুণ বেশি হবে।
প্রশ্ন হল কোন নারী ধর্ষিত হলে তার সম্মান কেন যাবে? পাকিস্তানি বাহিনি ধর্ষণ করছে, তাই ধর্ষিতা নারীদের সম্মান চলে গেছে? তাদের ইজ্জৎ নষ্টহয়ে গেছে? তারা সব হারিয়েছে? ধর্ষিত হলে নারী কেন সম্মান হারাবে? সম্মান যাবে ধর্ষকদের, ইজ্জত গেলে, সেটা ঐ ধর্ষক পাকিস্তানীদেরইজ্জত গেছে । ওরা মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হয়েছে, এখানে নারীদের ইজ্জত কিভাবে গেল?
অনেকেই বলবেন, আসলে এটা তো রূপক অর্থে ব্যাবহার করা হয়। আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলছি রূপক অর্থে ভুল শিক্ষা দেয়া হয়। একটা বাচ্চা যখন তার স্কুলে শেখে, ৭১ এ দুই লক্ষ নারীর সম্মানের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন সে আরও একটা ভুল শিক্ষা নেয়, সে শেখে ধর্ষিতহলেই মেয়েদের ইজ্জৎ চলে যায়। ঐ বাচ্চাটি যখন বড় হয়ে কোন মেয়েকে ধর্ষিত হতে দেখে সে ধরেই নেয়, মেয়েটার সম্মান চলে গেল। সে বড়হয় প্রচণ্ড ভুল ধারণা নিয়ে।
দিল্লির মেয়ে সোহায়লা আব্দুলালি ধর্ষণের পরও ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরেছিল। সে তার জীবন সম্পর্কে লিখেছে,
আমি ব্যথা পেয়েছিলাম, আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল কিন্তু আমার সম্মান হারায়নি । আমার সম্মান আমার যোনিতে – এই ধারণা আমি প্রত্যাখ্যান করি। যেমন আমি প্রত্যাখ্যান করি পুরুষের বুদ্ধি তার অণ্ডকোষে/ কোন ধর্ষিতার কাছ থেকে এর চেয়ে চমৎকার কথা আর কিছুই হতে পারে না ।
ধর্ষণে নারীর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে অবশ্যই তার সম্মান নয় । ধর্ষিতাদের এই সমাজ করুণা করে, দোষারোপ করে, তাদের কে নষ্টা ভ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু আসলে কি বিষয়টা তাই? ধর্ষিতা মেয়েটার তো কোন অপরাধ নেই, বরং ধর্ষকটা অপরাধী। তাহলে ঘৃণা কার পাবার কথা? কাকে সমাজের নষ্ট বলা উচিৎ?
লি ওক-সিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধর্ষিত এক নারী। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপের একটা অংশ ছিল জাপানের আওতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের একটি পতিতালয়ে ১৪ বছর বয়সি লি ওক-সিয়নকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকে রেখেছিল জাপানি সেনারা। দীর্ঘ তিন বছর তাঁর উপর চলে পাশবিক নির্যাতন। সেই নারীই এখন প্রতিবাদের অনন্য রূপ হয়ে উঠেছেন। তাকে সাহসী নারীর সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।
এটা তো শুধু একটা নাম, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের পরবর্তীতে বীর হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। তাদের সম্মান গেছে, এমন ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে অপমান করা হয়নি।
তবে আমাদের নারীদের কেন এ অপমানের বোঝা বহন করতে হচ্ছে?
৭১ এ যে নারীরা ধর্ষিত হয়েছিল তারা তো সম্মান হারায় নি বরং তারাই সম্মানিত, তারাই আমাদের গর্বের প্রতীক। তারা বীর। এই বীরদের ইজ্জৎ হারানো নারী উপস্থাপন করে তাদের কি অসম্মানিত করা হচ্ছে না? ইজ্জৎ তৈরি হয়, মেধায় শ্রমে, মানুষের কর্মে। শরীরে কিংবা মনে আঘাত লাগলে কারও ইজ্জৎ যায় না । বরং ইজ্জৎ যাবে আঘাতকারীর । তার জঘন্য কর্মের জন্য সে সমাজে বেইজ্জত হবে। তাই প্রতিটা পাকি ধর্ষকদের ইজ্জৎ গেছে। এইগুলাই ইজ্জৎ হারানো নষ্ট, ভ্রষ্ট অমানুষ।
ধর্ষিত হয়েছিল বলে অসংখ্য নারীরা ৭১ এ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। মালতী দাস, সীমা কর্মকার, আমিনা খাতুন এমন অসংখ্য নারীকে সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে তারা আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছিল। ধর্ষণের মত অমানুষিক নির্যাতনের পরে এই নারীরা বেঁচে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু সম্মান চলে গেছে এই ধারণা থেকে তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে।
একজন নারী ধর্ষিত হয়েছে, যে বা যারা তাকে ধর্ষণ করেছে তাদের সম্মান যায়নি , সম্মান গেল ধর্ষিতা মেয়েটার?
ইতিহাসের বইগুলোতে সংশোধন হওয়া জরুরী । সেখানে নারীদের সম্মান এর বিনিময়ে নয় বরং তাদের উপর অত্যাচার হয়েছে, নির্যাতন হয়েছে এবং এই নির্যাতনকারীদের সম্মান গেছে লেখা উচিৎ।
গত ৪৪ বছর ধরে যে ভ্রান্ত ধারণা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে রয়েছে তার কুফল আজও নির্যাতিত নারীরা ভোগ করছে।
যে নারীদের ত্যাগ এর বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে, তারা অসম্মানিত নয়, তারা এই দেশের স্বাধীনতার বলি হয়েছে, তারা নির্যাতন সহ্যকরেছে, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করেছে তাই তারা বীর, তারাই এই সমাজের সব চেয়ে সম্মানিত নারী। আমাদের পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাসের সমস্ত দলিল থেকে সম্ভ্রম, সম্মান হারানো টাইপের ভ্রান্ত কথাবার্তাগুলো বাদ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি ।