শিরশিরে অনুভূতি জাগিয়ে একটা সাপ সড়সড় করে চলে গেল। একটা পেঁচা ডাকলো ধারেকাছেই। একটা কাকও। কাঁচাঘুম ভেঙ্গে। একটু দূরে মাঠের মধ্যে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তাকিয়ে আছে। শিয়ালও হতে পারে, ভামও। রাতচরা এবং দিনচরা দুদলই বেশ বিরক্ত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। স্বাভাবিক। নিজস্ব কাজ বা বিশ্রাম, দুয়েরই ব্যাঘাত ঘটলে শুধু মানুষ নয়, সমস্ত প্রাণীই বিরক্ত হয়।
কিন্তু সেই বিরক্তির কারণ যখন অপেক্ষাকৃত বলশালী কেউ তখন সেই বিরক্তি গোপন করে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। পুরো গোপন করা না গেলেও অন্তত তাকে প্রতিবাদের রূপ তো দেওয়াই নেই। এও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। তাই মানুষগুলোও কিছু বলছে না। তাদেরও ঘুম ভেঙ্গেছে। পাড়া জুড়ে ইতস্তত ক'টা কুপির আলো আর হঠাত করে হাট ছেয়ে ফেলা তিনটে পুঁতি ব্যাটারীর দশ টাকা দামের কয়েকটা টর্চের হঠাত হঠাত জ্বলে উঠেই নিভে যাওয়া দেখে মালুম হচ্ছে। বিরক্তিই উঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তার জায়গা নিয়েছে উৎকণ্ঠা আর ভয়।
কুকুরগুলো তো আরও সেয়ানা। রাতে গ্রামে কোনও বাড়িতে কুটুম আসলেও চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে। কিন্তু এখন টু শব্দ দূরের কথা, টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না একটারও।
ওরা বলশালী। ওরা পুলিস। ওদের কাছে বন্দুক থাকে। ওরা এসেছে। এই মাঝরাতে। গ্রামে ঢোকার মেঠো রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দুটো গাড়ি। আলো নিভিয়ে, চুপ করে, গুঁড়ি মেরে। কোনও বাড়িতে ঢোকেনি, সোজা চলে গেছে গ্রামের উত্তরধারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অলসভাবে ছড়িয়ে পড়ে থাকা মাঠটাতে। নির্দিষ্ট করলে, মাঠের পশ্চিমপাড়ে, যেখানে বিরাট বাঁশঝাড় আর একটা ছোটখাটো ঝোপজঙ্গল রয়েছে, তার ধারে।
মোট আটজন। একটা ছোট বৃত্ত। চারটে বড় পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ। জ্বলছে। একটা তার মধ্যে মাঝেসাঝে একটু পাড়াটা বা মাঠে চোখ বোলাচ্ছে। যেসব মনুষ্য এবং মনুষ্যেতর প্রাণীরা তাদের এই কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছে, তাদের মধ্যে কোনও অবাঞ্ছিত চাঞ্চল্য ঘটছে কিনা মেপে নিচ্ছে। আর বাকি তিনটে আলো স্থির। ঐ বৃত্তটার কেন্দ্রে। কেন্দ্র মানে ঠিক বিন্দু নয়। বরং আর একটা বৃত্ত। দু'জন কনস্টেবল শাবল দিয়ে ক্রমাগত ঝপাঝপ কুপিয়ে যার পরিধি আর গভীরতা সমানে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনটে টর্চের সাথে পাঁচজোড়া চোখও ওই দিকেই নিবদ্ধ। বাকি একজোড়া চোখ আলাদা। সেও দেখছে ওদিকেই। কিন্তু ওই আলগোছে। মাঝেমাঝেই চোখ সরাচ্ছে। কখনও বুজছে। এই চোখজোড়ার মালিক গোটা দলটার মধ্যেই যাকে বলে অড ম্যান আউট। বাকিরা সবাই সশস্ত্র, সবার কাছেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল, কেবল এই দলটার নেতা যে, স্থানীয় থানার মেজবাবু, এস আই দিবাংশু কর, যে সিগারেট টানছে, গর্ত খোঁড়াটা নজর করছে আর মাঝেমাঝে আড়চোখে ওই লোকটাকে দেখছে, তার খালি কোমরে সার্ভিস রিভলভার। কিন্তু এই লোকটা নিরস্ত্র। সুঠাম চেহারা, একটা চোখ আর ঠোঁটের কোনটা ফুলে রক্ত জমে আছে। পরনে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি আর আস্ত লুঙ্গি। দুটো হাত সামনে জড়ো করা। হ্যান্ডকাফ লাগানো। কোমরেও একটা মোটা দড়ি বাঁধা যার খুটটা পেছনে এক কনস্টেবলের শক্ত মুঠোয়।
সুপেন মণ্ডল খুব যে দরের ক্রিমিনাল তা নয়। উত্তর দিনাজপুর জেলার যে অংশটা ম্যাপে বকের গলার মতো সরু হয়ে উত্তর দিকে দার্জিলিং জেলায় গিয়ে আছাড় খেয়েছে, সেই এলাকায় গরু এবং ফায়ার আর্মসের চোরাকারবার অনেকেই করে থাকে। একপাশে বাংলাদেশ, একপাশে বিহার। পূর্ণিয়া, কাটিহার, মুঙ্গের। মাল আমদানির স্বর্গরাজ্য। এই যে রায়গঞ্জ শহরে লুম্পেন্সির এত বাড়বাড়ন্ত, প্রায় সব চ্যাংড়াপ্যাংড়ার হাতেই নাইন এম এম শোভা পায়, সেগুলো সবই মুঙ্গেরি মাল। পুলিসকর্তারাও এসব ভালোই জানে আর এই র্যাকেটের লোকেদের সাথে তাদের বেশ খাইখাতিরেরই সম্পর্ক হয়। সুপেনের সাথেও তাই। কিন্তু গণ্ডগোল পাকালো বিকেলে থানায় এসপির ফোনটা। বড়বাবু ছুটিতে আছে। ফলে জ্ঞান, কিছু প্রচ্ছন্ন হুমকিও, সবটাই গেল দিবাংশুর ওপর দিয়ে। মেজাজটা খাট্টা হয়ে ছিলই। সেইসময়েই নজরে পড়লো থানার উল্টোদিকে বাজারের মধ্যে চোলাইয়ের দোকানটায় সুপেন ঢুকলো। ব্যস, আর যাবে কোথায়! বস্তুত, এসব সময়ে সুপেনের চেয়ে সফট টার্গেট বোধহয় আর কেউ হতেই পারে না। এমনিতে দিবাংশু জানে ইদানীং ওর কারবারের রমরমা বেড়েছে। আর সবচেয়ে ভালো ব্যাপার যেটা, এই ব্যাটা কোনও নেতার তাঁবে থাকে না। সম্পর্ক সবার সাথেই ভালো রাখে, কিন্তু ওরকম গুরুঠাকুর কেউ নেই।
নেশা জমে ওঠার মুখে আকস্মিক তলবেও লোকে বিরক্ত হয়। কিন্তু সুপেন সেই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মটা মনে রাখেনি। বাংলার ঘোরেই হয়তো। ফলে তুলে আনার সময় কিছু বলপ্রয়োগের চিহ্ন আপাতত শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ওইটুকুই। থানায় নিয়ে আসার পর দিবাংশু ওকে বুঝিয়েই বলেছে ওপরমহলের চাপের জন্যই ওকে আপাতত একটু ঢোকাতে হচ্ছে। আর সাথে ওকে কিছু মালের হদিশ দিতে হবে। সিজার লিস্টটাও তো দেখাতে হয়। সুপেন জানে এগুলো। কিন্তু একটু ঘাড়ট্যারা করে বসেছিল অনেকক্ষণ। আর তারপর বললো তো বললো, এই আড়তের হদিশটাই দিলো। কেন? বাংলা? সে যাই হোক, সব মিলিয়ে সুপেনের ভাবসাব ভালো লাগেনি দিবাংশুর। তাই কোমরে দড়িটা পরাতে হল। ফোর্সও একটু বেশি নিতে হল। বলা তো যায় না! যতই গেলাস ভাগাভাগি হোক না কেন, দুইতরফের পারস্পরিক সম্পর্কটা তো অবিশ্বাসের।
পেয়ে গেছে। একটা বড়সড় প্লাস্টিকের প্যাকেট। সুন্দর বেঁধে প্যাকিং করে রাখা। যে দুজন খুঁড়ছিলো, তাদেরই একজন প্যাকিংটা খুলে ফেললো। ছটা নাইন এমএম, দুটো ওয়ান শাটার, একটা অটোমেটিক সিক্সার। কিছু বুলেটও আছে। মন্দ না, ভাবলো দিবাংশু। কিন্তু ও টর্চ মেরে গর্তের মধ্যে কি হাতড়াচ্ছে? আরেকজন যে খুঁড়ছিলো, নেপালি কনস্টেবল সুদেশ থাপা, সে? দিবাংশু ওর পাশে গেলো। উঠে পড়েছে সুদেশ, হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট। উঠেই তাকালো দিবাংশুর দিকে, দিবাংশু সুপিনের দিকে, প্যাকেটটা নিতে নিতে। সুপিনের ভুরুদুটো বিশ্রীরকম কুঁচকে গেছে। প্যাকেটটা খুলে টর্চটা জ্বেলে তার মধ্যে উঁকি দিলো দিবাংশু। মুখটা বের করলো কয়েক মুহূর্ত পর। সুপিনের দিকে তাকিয়ে বললো, "এসবও শুরু করেছিস!"
অন্ধকারে কেউ খেয়াল করলো না, প্যাকেটের ভেতর থেকে মুখটা বাইরে আনার মধ্যে মুখের বিস্ময় আর উত্তেজনার রেখাগুলো মিলিয়ে দেওয়ার জন্য এস আই দিবাংশু করকে প্রাণপণ পরিশ্রম করতে হল।
২.
ভোরের দিকে যখন রত্নার ঘুমটা গাঢ় হতে শুরু করেছে, তখনই এলো আক্রমণটা। ওর প্রথমে মনে হলো কোনও জন্তু। হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে কোনওরকমে একটু হাত-পা ছুঁড়তে চাইলো। বুঝলো, সম্ভব না। তখন, চিৎকার করতে চাইলো। সেও হলো না। গলা দিয়ে অস্ফুট গোঙানির মতো কিছু একটা আওয়াজ বের হলো। ও বুঝলো, ওর দম আটকে যাচ্ছে।
আসলে রত্না ঘুমের মধ্যে ছিলো তাই, নইলে এই আক্রমণের সাথে ও অপরিচিত নয়। কোনও কিছুতে প্রচণ্ড খুশি হলে বা আনন্দ পেলে দিবাংশু এরকমটা করে। ঘুমটা ভালো করে কাটার পর সারা শরীরময় প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়েও ও বুঝতে পারলো দিবাংশু কোনও কারণে খুব আনন্দিত হয়েই ভোররাতে বাড়ি ফিরেছে।
ব্যাপারটা মিটলো একসময়। দিবাংশু আর সময় নষ্ট করলো না। ছাড়া জামার মতো রত্নার যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরটা বিছানায় ফেলে রেখে তড়াক করে উঠে পড়লো। একটা সিগারেট ধরালো। মোবাইলটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করার শব্দ আসলো। কোনও জরুরি ব্যাপারই বটে। উঠে পড়লো রত্না। গোটা শরীরটা টাটাচ্ছে। কিন্তু চা তো বসাতেই হবে।
কিন্তু ফোনটা কাকে করা যায়? বড়বাবু? অসম্ভব! পুরো ক্ষীরটা নিজে মেরে দেবে! এস পি? হুম... করা যায়... কিন্তু...! আচ্ছা, সরাসরি হোম সেক্রেটারিকেই জানালে কেমন হয়? এটা তো সেই লেভেলেরই ব্যাপার। দিবাংশু নম্বর ডায়াল করে।
আর মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। পকেট হাতড়ে প্যাকেটটা আর কোমর হাতড়ে রিভলবারটা একবার অনুভব করে নেয়। রত্না তখন সবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছে চা বসানোর জন্য। দিবাংশু বলে...
"শোনো, আমি বেরোচ্ছি। কলকাতা যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। নাও ফিরতে পারি..."
"চা খেয়ে যাবে না?"
"না... সময় নেই..."
দিবাংশুর পুলিস লেবেল লাগানো সাদা টাটা সুমোটা যখন চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে দক্ষিণমুখে দৌড় দিলো তার ঠিক মিনিট চল্লিশেকের মধ্যেই আরও একটা পুলিস লেবেল লাগানো জমকালো মাহীন্দ্রা স্করপিও একইমুখে ছুট লাগালো। উত্তরবঙ্গের এই ক্ষুদ্র জনপদে এতক্ষণে ভোরের আলো ফুটে যাওয়ার কথা, কিন্তু হাইরোডের ধারে নিজের গুমটি চাদোকানটার উনুনে আঁচ ধরাতে ধরাতে বুড়ো চাদোকানি দেখলো আজ আকাশটা কেমন জানি গুম মেরে রয়েছে।
৩.
টেবিলটা গোল। আর তার ঠিক মাঝখানে রাখা রয়েছে জিনিসটা। তার দ্যুতিতে টেবিলটা, ঘরটা তো বটেই, রাজ্য তথা দেশীয় রাজনীতির অতীত এবং ভবিষ্যতের অনেকটা পর্যন্ত আলোকিত হচ্ছে।
জিনিসটা একটা মুকুট। ছোট্ট। আক্ষরিক মুকুট না বলে মুকুটের রেপ্লিকা বলাই ভালো। খাঁটি সোনার। হবেই। তখনকার রাজারাজড়ারা রাজকীয় ঠাটবাট সম্বন্ধে ভালোই সচেতন ছিল। আর এ তো খোদ ইংল্যান্ডেশ্বরীর উপহার। প্রাপক কোচবিহারের মহারাজ। ঘোষিতভাবে মহারাজের শিল্পসংস্কৃতির চেতনা এবং তার প্রজাপরায়ণাতে মুগ্ধ হয়ে রানী তাকে এই উপহার দিয়েছিল। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে, ওসব বলার কথা। আসল ব্যাপার, কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশ বশ্যতা স্বীকার করার তোফাস্বরূপ এই রত্নখচিত দান। হ্যাঁ, রত্নও আছে বটে! ছোট মুকুটটার ওপর পাঁচখানা কুচি হীরে এই দিনের বেলাতেও ঝলসানো দীপ্তি ছড়িয়ে সে কথা প্রমাণ করছে।
ফলে বস্তুটার অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্য নিয়ে তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু, আপাতত সেসবকে ছাপিয়ে এর রাজনৈতিক মূল্যটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। বস্তুটি আপাতত একটি নির্ভেজাল চোরাই মাল। ভালো ভাষায় বললে হারানিধিও বলা যেতে পারে। এটি রক্ষিত ছিলো কোচবিহার রাজবাড়ীর মহাফেজখানায়। বেশ আঁটোসাঁটো নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে। কিন্তু বজ্রআঁটুনির মধ্যেই ফসকা গেরো থাকে গুরুজনেরা বলে গেছেন। আট বছর আগে সেইরকম কোনও ফসকা গেরো দিয়েই বেপাত্তা হয়ে যায় মুকুটখানা। হৈ হৈ ওঠে চারদিকে। "বাঙালির আর কিইবা থাকলো!" হাহাকারে রাজ্যের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তৎকালীন রাজ্য সরকার, যারা নাকি তার দু'বছর পরেই গদিচ্যুত হবে, তারা তখন এমনিতেই নানান অশান্তিতে জেরবার। তার মধ্যে এই শাকের আঁটিটাও যখন চাপলো, তারা আর রিস্ক না নিয়ে সিধা সিবিআইয়ের ঘাড়ে ঠেলে দেয় কেসটা। তারপর চারবছর ধরে সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের গাড়িতে সাতমণের বেশিই তেল পোড়ে, জনগণ নামক রাধা নেচে সরকারও উলটে দেয়, কিন্তু মুকুটের হদিশ মেলে না। সিবিআই কর্তারাও কিছুদিন পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে বেশ ভারি ভারি শব্দ বলে কেসটা থেকে হাত ধুয়ে ফেলে, বাঙালিও বুঝতে পারে, তাদের অনেক কিছুই রয়ে গেছে। অতএব একটা মুকুটের কথা ভুলে গেলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
এহেন মুকুটই কিনা পাওয়া গেলো সুপেন মণ্ডলের জিম্মায়! মাটির তলে! সযত্ন অবহেলে! ভাবা যায়!
৪.
টেবিল ঘিরে আপাতত সাতজন। মুখ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্য ও শিক্ষামন্ত্রী। ক্ষমতার বিন্যাসে নাকি এরা মন্ত্রীসভার দুই এবং তিন। মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসা তার সুন্দরী, যুবতী পিএ। দুই দুঁদে আমলা, মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব। এবং এস আই দিবাংশু কর। অড ম্যান আউট! কিন্তু হলেও আজকের বৈঠকের উপলক্ষ এবং মধ্যমণি এই লোকটাই।
মুখ্যসচিব কথা শুরু করলো...
"সুপেন মণ্ডল কি কনফেস করলো মি.কর? মানে জিনিসটা ওর কাছে এলো কি করে?"
"বলছে, অনেকদিন আগেই নাকি ওর কাছে এসেছে স্যার। যারা চুরিটা করেছিল, তারা নেহাতই চোর। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। ওদের থেকে মালটা কিনে নেয় কোচবিহারের এজেন্টরা। কোচবিহার থেকেই হয়তো বেরিয়ে যেত জিনিসটা। কিন্তু তখন সিবিআই ইত্যাদির উৎপাতে ওরা ব্যাপারটা দিনাজপুরের এজেন্টদের হ্যান্ডওভার করে। তখন থেকেই এটা সুপেনের জিম্মায়। ও মূলত আর্মসের কাজ করে বলে ওর দিকে নজর পড়বে না, এরকমটাই হিসেব ছিল। আর সেটা মিলেও গেছে। তবে কার কাছ থেকে ও এটা পেলো, সেটা বলেনি। আমিও চাপ দিইনি। দরকারে দেবো স্যার.."
"হুঁ... সুপেন মণ্ডলও তাই বলছে..." স্বরাষ্ট্রসচিব বললো...
"ওনার ওপর রাগারাগিও করছে না?" মুখ্যসচিবের ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি খেললো...
"হুঁ... উনি নাকি বলেছিলেন এই কেসে ওকে জড়াবেন না..." স্বরাষ্ট্রসচিবও হাসলো...
"মানে স্যার... এগুলো... আপনারা..." দিবাংশু সত্যি বুঝতে পারছে না। পারার কথাও নয়...
"সে বলছি..." স্বরাষ্ট্রসচিব আবার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের ঘেরাটোপে, "একটা জিনিসে খটকা লাগছে মি.কর... লোকটা এত সহজে আপনাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলো কেন?"
"এটা স্যার আমারও মনে হয়েছে..! আমি ওকে বলেছিলাম কিছু আর্মস রিকভার... মানে ওর কাছে যা যা ইললিগাল আর্মস আছে আর কী..."
"হ্যাঁ, সে আমরা জানি... ক্যারি অন..."
"হ্যাঁ স্যার..." ঢোক গিললো দিবাংশু, "ওই এই জায়গাটা বললো। আর সেখানে খুঁড়তেই দেখি এটা... আলাদা করে রাখা ছিলো অবশ্য.. আর একটু ডিপে... মনে হয় স্যার, সেদিন ওর মাথা ঠিক কাজ করছিলো না.. নেশা করেও ছিলো... হয়তো মনেও ছিলো না ওখানেই ওটা রেখেছে..."
"ওয়েল, মি.কর..." মুখ্যসচিব বেশ ডিসিসিভ ভঙ্গিতে শুরু করলো, "লেটস কাম টু দ্য পয়েন্ট। প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই এই ব্রেক থ্রুটার জন্য। আপনি বিষয়টা সরাসরি আমাদের জানিয়েও খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। বাট ফ্রম নাউ, ইউ হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ ইট। সুপেন মণ্ডলকে ইতিমধ্যেই আমরা কলকাতায় আনিয়ে নিয়েছি। ক্রাউনটাও রইলো আমাদের জিম্মাতেই। বুঝতেই পারছেন আশা করি, বিষয়টা কতো গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে আর একটা কাজই করতে হবে, কাগজপত্র থেকে সুপেন মণ্ডলকে জাস্ট ওয়াইপ আউট করে দিন। মানে কাল ওকে তোলার যদি কোনও কাগজপত্র আপনাদের কাছে থেকে থাকে আর কী। আর পারলে আপনার মেমোরি থেকেও। নাউ দ্যাটস অল, মি.কর। থ্যাঙ্ক য়ু অ্যান্ড কনগ্র্যাচুলেশনস এগেইন... ওঃ হো হো... সরি সরি... আসল কথাটাই বলা হয়নি... আপনার প্রমোশনের ব্যাপারটা আমরা দেখছি...." মিষ্টি হাসলো লোকটা!
"কিন্তু স্যার..." আর্তনাদ করে উঠলো দিবাংশু! ওর মুখচোখ থমথম করছে...
"স্যার আপনার নেক্সট মিটিংয়ের টাইম হয়ে গেলো..." মুখ্যমন্ত্রীর যুবতী পিএ বলে উঠলো। মুখ্যমন্ত্রীকেই...
"হ্যাঁ, উঠি... আচ্ছা, একটা কাজ করুন। এর জন্য যে সিআইডির স্পেশাল টিমটা বানানো হবে, তাতে এই ভদ্রলোককে যাতে ইনক্লুড করে নেওয়া হয়, সেটা বলে দিন... আচ্ছা, নমস্কার! ভালো থাকবেন...!"
প্রথম অংশটা পিএর প্রতি, মাঝেরটা মুখ্যসচিবের প্রতি, এবং শেষটা দিবাংশুর প্রতি বলে মুখ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালো। হাতটা জোড় করা। ঠোঁটে অমায়িক হাসি ঝুলছে।
সবাইই উঠে পড়লো। স্বাভাবিক। অগত্যা দিবাংশুও। কিন্তু ও বেচারি মুখ্যমন্ত্রীকে পালটা নমস্কার করতে ভুলে গেলো!
রাতে যখন দিবাংশু বাড়ি ঢুকলো, রত্না ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। একটা খবরের চ্যানেল চলছে। দিবাংশু দেখলো, সেই অমায়িক হাসি দেওয়া লোকটা। প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে। লোকটা বলছে...
"কোচবিহারের রাজমুকুট বাংলার সম্পদ। আমরা সেটা ভুলে যাইনি। প্রথম দফায় অনেক কাজকর্মের মধ্যে আমরা এদিকে মনোযোগ দিতে পারিনি। আর তখন সিবিআই দেখছিলও ব্যাপারটা। যাইহোক, আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। তবে এটুকু জোরগলায় বলছি, বাংলায় যোগ্য পুলিস অফিসার এবং কর্মীর অভাব নেই। আমরা কেসটি রিওপেন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর জন্যে সিআইডির বাছাই করা অফিসারদের নিয়ে নতুন টিম করা হচ্ছে। কোচবিহারের রাজমুকুট আমরা যেকোনও মূল্যে ফিরিয়ে আনবোই। বাংলার মানুষের কাছে এ আমাদের প্রতিজ্ঞা!"
"শুয়োরের বাচ্চা...." গাড়ীর চাবিটাই টিভির দিকে ছুঁড়ে মারলো দিবাংশু। টিভিতে না লেগে লাগলো পাশের দেওয়ালে বুকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা টিকটিকির গায়ে। পালালো টিকটিকিটা। লেজটা মাটিতে পড়ে কাঁপতে লাগলো তিরতির করে। রত্না তাড়াতাড়ি রিমোট টিপে বন্ধ করলো টিভিটা। আর করতে করতেই আঃ বলে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে যেতে অনুভব করলো, তীব্র আনন্দ আর তীব্র রাগের অভিব্যক্তি একইরকম হয়।
৫.
এর ঠিক সাতদিন পর মুখ্যমন্ত্রীর আরেকটা প্রেস কনফারেন্স প্রচারিত হল...
"আজ আমাদের অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের দিন। বাংলার মানুষের ঐতিহ্যশালী সম্পদ কোচবিহারের ঐতিহাসিক মহার্ঘ্য রাজমুকুট আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এবং সেটা পেরেছি সম্পূর্ণ আমাদের সুযোগ্য গোয়েন্দাদের ওপর ভরসা রেখে। এর জন্য সমস্ত অভিনন্দন প্রাপ্য দীনেশকুমারের নেতৃত্বাধীন সিআইডির বিশেষ তদন্তকারী দলের। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের সাথে পাঞ্জা কষে এই কঠিন কাজটি সমাধা করেছেন। আজ ভোর রাতে মুকুট উদ্ধারের অপারেশনে এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন সুপেন মণ্ডল নামে এই চক্রের এক চাঁই। বাকিরা পালিয়েছে যদিও, কিন্তু পার পাবে না। আর হ্যাঁ, সবশেষে, এটাও আবারও প্রমাণ হল, আমাদের সরকার যা বলে তা করে দেখায়!"
এবং তার ঠিক তিনদিন পরে আবার....
"খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, রাজ্য পুলিসের সুদক্ষ অফিসার মি.দিবাংশু কর আজ সন্ধেবেলা গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। দিবাংশু কর কোচবিহার রাজমুকুট উদ্ধারের অপারেশনে আমাদের বিশেষ তদন্তকারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। আমাদের ধারণা, এর পেছনে সেই আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদেরই হাত রয়েছে। তার মতো দক্ষ পুলিসকর্মীকে হারানো রাজ্য পুলিসবাহিনীর এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তার পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি এবং সমস্তরকমভাবে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছি। তার হত্যাকারীদের আমরা খুঁজে বার করবোই। এ বাংলার মানুষের কাছে...."