প্রারম্ভিক মুখব্যাদান
ইংরেজী দুইহাজার দুই সালের বিশ্ব পিতামাতা দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রতাপগড়ের ভিতর একটি ইশকুলের মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়ানো একটি পোস্টারের সামনে হাবা মার্কা একটি ছেলের সতৃষ্ণ নয়নের...নাহ্, নাহ্, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
আসলে একটা হাপ প্যান্ট পরা ছেলে, তার মা নেই, সেই সংক্রান্ত সেন্টিমেন্টও নেই, বাপের সময় নেই, হেডমাস্টারের রোলকলে সাড়া দেওয়ার মতো ইচ্ছেও নেই, নেই নেই কিছু নেই তবুও তো আছে কিছু বলতে যা বাধা নেই। চ্যুইংগাম আছে, কিশোরীর জুতো আছে, সিঁড়ি আছে। বিশ্ব পিতামাতা দিবসের পোস্টার এবং ছেলেটা প্রেমে পড়ে গেল।
এ ছেলে ঘুঘু পুরো! খাচ্ছিল চ্যুইংগাম, ইচ্ছে করে সেটা মাটিতে ফেলে দেখল কোন মেয়ে জুতো দিয়ে ওটা মাড়ায়। যে মাড়াবে সেই হচ্ছে তার ইয়ে। যাকে উদ্দেশ্য করে আমাদের পরিচিত হাপ প্যান্ট শুধুমাত্র ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ বলে যাবে। আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। দু হাত তুলে, ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’। আরে ঘুরে ফিরে, ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’। আচ্ছা সংক্ষেপে, আশুচেতো...নাহ্ ফের বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং বাপটা হারামী। হতে বাধ্য। ছেলেকে সময় দেয় না। হঠাত কি হ’ল ছেলেকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেল। নে এবার বোঝ। কিশোরী প্রেমে ইতি। কিন্তু এদিকে শ্যুটিং থামে নি। চলছে, যদিও যাওয়ার সময় বিয়োগান্ত সায়োনারার বদলে আই হেট ইউ কপালে জুটেছে। কারণ ঐ প্রিভিয়াস চ্যুইংগাম। আর সিরিয়াসলি, এইরকম ভাবে প্রেম চাওয়াচাওয়ি...যে কেউ তিতিবিরক্ত হতে বাধ্য। কিন্তু তাই বলে বারো না ষোল না আঠারো বছর ধরে বাল্যপ্রেম টিকিয়ে রাখা আর দেদার খাতা জুড়ে আমি শুধু চেয়েছি তোমায় লেখা...শুধু তাই নয়, ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ মদ, ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিগারেট...হুঃ হুঃ হুঃ হুঃ...এ হে হে হে বড্ড হাসি হয়ে যাচ্ছে।
বাট শ্যুটিং চলছে। বাপটার একদিন শ্যুটিং হ’ল। এমন কিছু না, বেসিক্যালি একটা ফোন কানে ধরে বলতে হবে, অভি তুমি অ্যামন কচ্চ কেন? কি চাও? অভি পালটা বলবে, তোমায় চাই। পারবে আমার সঙ্গে সময় কাটাতে? হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ...এটা আমি নয়, নায়ক মানে সেই প্রতাপগড় কিশোর ও ইন্ডিয়া যুবক, সেইই হাসছিল। কিন্তু এইটুকু শ্যুটিং এর জন্যও ওদের বিবিধ মারামারি না করলে চলছিল না। শুরু হ’ল প্রথম অধ্যায়।
প্রথম অধ্যায়
তো, এই মারামারিটা না হলে হিরো গলা জড়িয়ে ‘বাবা’ বলার চান্সটুকু পাচ্ছিল না। তাই নিয়ে পরিচালকের সাথে একপ্রস্থ ক্যাঁওম্যাঁও। শেষে রফা হ’ল একটা আরবিট ফাইটিং সিকোয়েন্স রাখা হবে। সেটা এইরম। নায়িকা হঠাত দার্জিলিং এ ল্যান্ড করেছে। ঘুম স্টেশন। ট্রেন থেকে সবে নামবে। লুচ্চারা হাজির। বিক্ষিপ্ত টোনটিটকিরি। ছোট্ট ঘটনা। সেই সুযোগে নায়ক লুচ্চাদের উদুম ক্যালাবে। এবং হাজির থাকবে একটা ফার্স্ট এইড বক্স।
এই বক্সটা গুরুত্বপূর্ণ। খুব কম ফুটেজ পেয়েছে। কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। হিরো ভিলেনদের ক্যালাচ্ছে, এবং বক্সটা নিজের ভেতর থেকে কখনো ক্রেপ ব্যান্ডেজ, কখনো ছুঁচ সুতো, কখনো টিংচার আয়োডিন, কখনো ইঞ্জকশন সিরিঞ্জ হিরোর মুখে মুখে জুগিয়ে চলেছে। হিরো ক্যালাতে ক্যালাতে ফার্স্ট এইড দিচ্ছে, দিতে দিতে আবার মারছে। এইভাবে খানিক চলার পরে কনভার্জেন্স এল এবং সাথে পুলিশ নিয়ে এল। আসেই, সবাই জানে, নতুন কিছু না। কিন্তু এইখানে কিছু সিন এডিটরটা ছেঁটে দিয়েছে। ওগুলোতে নাকি সাউন্ড আসেনি। কি করা যাবে, যা অবস্থা তাতে তো, পুলিশের বলার মতো কিছু নেই।
বাট হাম কঁহা থে? আচ্ছা, উয়ো মারপিটকে পাস। ব্স, খতম হোনে কে বাদ শ্যুটিং ফিরসে চালু। খালি একটা ইনফরমেশন না দিলে চলছে না। এই প্রি ইন্টারভ্যাল ভিলেন গুলোকে টাকা পয়সা দেওয়া নিয়ে সেটে একটা ঝামেলা হয়। তো পরিচালক এমনিতেই এদেরকে ক্যালানোর ধান্দাতে ছিল। ফলে কিছুক্ষণ পরেই ওরা সেটা রিয়েলাইজ করে। হারে হামাদের মারছেন কেনো? এই বলে বিস্তর চ্যাঁচামেচি। কিন্তু তাতে কি! হিরো সেসবে কান না দিয়ে হুলিয়ে ঠেঙিয়েছে। সাথে ঐ ফার্স্ট এইড বক্স। ওকে অবশ্য টাকা পয়সা কিছু দেয় নি। তবে রিভ্যুতে এইসব বিবিধ বাওয়াল নিয়ে না লেখাই ভালো...বরং দ্বিতীয় অধ্যায়কে টেনে আনা যাক।
দ্বিতীয় অধ্যায়
শুরুতেই দেখতে হবে নায়িকা দার্জিলিং এ কেন? সে তো ছিল প্রতাপগড়ে। জীবন চলে গিয়েছে ষোলো ষোলো বছরের পার। শ্যুটিং পড়েছে দার্জিলিং এ। অতএব নায়িকা এসে একটা কলেজে ভর্তি হ’ল। নায়িকা এখন আর কচি খুকী নেই। দস্তুর মতো রূপসী বাংলা। তক্কে তক্কে হিরোও হাজির। কি করে সে দার্জিলিং এ হাজির হ’ল, কিভাবে খুকীকে চিনল, সেসব প্রোডাকশন ম্যানেজাররা ভালো বলতে পারবে। বাট আম আদমি, এই ডিস্ক্রিট পয়েন্টে এসে বুঝতে পারবে, কলেজ থাকলে সাইকোলজি অনার্সও থাকবে। একটি প্রিন্সিবাবু থাকবেন। হিরো ইটিসি এরা তো আছেই।
কে এই প্রিন্সিবাবু? একজনই হয় স্যার, একজনই হয়। রবি ঘোষ করতেন বাঘা, ভানুবাবু গোয়েন্দা, আর খরাজবাবু করেন প্রিন্সিপ্যাল। বাংলা সিনেমার তিন অবিসংবাদিত অভিনেতা। জানা গ্যাছে যে, খরাজবাবু আজকাল একসেট প্রিন্সিপ্যাল সিকোয়েন্স আগে ভাগে শ্যুট করে রাখেন। কেউ এলে দিয়ে দেন। যে যার মতো করে বসিয়ে নেয়। এডিটরদের পোয়াবারো। নায়িকারও। কারণ খরাজবাবু শুধু সাইকোলজি পড়ান না, নায়িকার পেয়ারের নায়ককে খুঁজে অবধি দেন।
আচ্ছা, বলেছি কি নায়কটা কে? বলিনি? নায়ক হচ্ছে অঙ্কুশ। দেব নয়। একে সে খোকা তায় চারশোবিশ। কলেজে ঢোকালে প্রেস্টিজ নষ্ট। এদিকে নায়কের কলেজ রোলটা কি হবে সেই নিয়ে পরিচালক এবং সহপরিচালকের মধ্যে কথাকাটাকাটি চলছিল। এই ফাঁকে একটি তৃতীয় পার্সন মাঝখানে ঢুকে কিছুটা ফুটেজ খেয়ে নেয়। আমরাও বুঝতে পারি এইবার আসল খেল শুরু হতে চলেছে। এবং এমতাবস্থায় তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়।
তৃতীয় অধ্যায়
এই তৃতীয় পার্সনের এন্ট্রি হচ্ছে ঘোটকে মানে গাড়ীতে চড়ে। হয়েছে কি, নায়িকা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে দার্জিলিং এর খানাখন্দ ভর্তি রাস্তাকে আমেরিকান হাইওয়ে ভেবে রীতিমত বেঁকে চুরে লিফট চাইছিলেন। এছাড়া মাঝে মাঝে লেপচা কি নেপালী কি গোর্খা ছেলেমেয়েদের সাথে সেলফি তুলছিলেন। হঠাৎ গাড়িটা আসাতে ত্রস্ত পায়ে সেন্টের বন্যা বইয়ে টুক করে উঠে পড়লেন, অমনি থার্ড পার্সন ওঁকে দেখে প্রেমে পড়ে গেল। লভ। অ্যাট ফার্স্ট সাইট। আমাদের কিছু করার নেই। পরিচালক চীৎকার করে বললেন, সহ-পরিচালক! দাঁড়াও তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। পেলে দা! পেলে দা! কোথায় গেলে?
পেলে ভটচায স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। স্টেপল করার সময় দুপাতা এদিক ওদিক হয়েছে, সেকথা বুঝিয়ে পারছেন না। পরিচালক খাপ্পা! আমার বাস্কেটবল কোর্টের দৃশ্যটা কই? অ্যাঁ! বলি কই? কোথায় সেটা। সুতরাং খোঁজ খোঁজ খোঁজ। দেখা গেল, হিরো এবং থার্ড পার্সন এসব ঘটবে জেনেই আগেভাগে সেখানে চলে গেছিল। লাইটসম্যান তখনো গিয়ে পৌঁছতে পারেনি। ফলে আবছা অন্ধকারে দুজনে দুজনকে শপশপানি কথা চালাতে লাগল।
-- ভূমি আমার!
-- ন্যঅ্যা্যাহ্, ভূমি আমার!
-- ভূমি আমার!
-- আলহমদুলিল্লাহ্, ভূমি আমার!
নোপ স্যার, যা ভাবছেন তা নয়। নো দুই বিঘা জমিন কেস। ভূমি হচ্ছেন নায়িকা। আমাদের রূপসী বাংলা। কলেজে আপাতত ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লোকের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সব ঠিকঠাক চলছে। অল ইজ ওয়েল।
কিন্তু সব ঠিকঠাক মোটেই চলছে না। কারণ প্রথমতঃ ত্রিকোণ প্রেম। তারপর বাহুগুলো বেশ লম্বা লম্বা। প্রায় সব গানেই করেস্পন্ডিং নায়ক হাত অ্যাত ছড়িয়ে দিচ্ছে যে সিনে প্রায় আঁটে না আর কি! শেষে খরাজবাবু একটা ক্লাস ডেকে এইসব গানবাজনা বন্ধ করলেন। হাজার হোক কলেজ তো। একটা ডিসিপ্লিন থাকবে না!
এই ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা আমাদের হিরোর মানে ঐ অংকুশ এর মনে ধরল। ওমা, ওমনি দুম করে সে পাট করে চুল আঁচড়ে গায়ে ভি কাট সোয়েটার পরে, সাদা এফোর শিটের প্যাকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নায়িকা ইম্প্রেসড। আরে বাঃ। একটা ছেলে, তাও লেখাপড়া করে! লাভলি। কিন্তু এই সহজ সরল রিয়েলাইজেশনের পেছনে কি ট্যুইস্ট নেই। আছে। ভূমি জানে না যে এই সিম্পলমতি ছোকরার ব্যাকগ্রাউন্ড আসলে প্রতাপগড়ের চ্যুইংগাম। হিরোও জানে সে কথা। তাই ভালছেলের ছদ্মবেশ সে একদিন টপাত করে নায়িকাকে কিসি করে দেয়। তাও ভরি মেহফিল মেঁ। মানে লাইব্রেরীতে। কিছু বইপত্রও পড়ে যায়। ক্যামেরাম্যান আহত হয়। হবেই। অমন উদ্ভট অ্যাঙ্গেল থেকে সিন তুলতে গেলে ভুঁড়িতে আটকাবেই। সে যাক গে, এই কিসিং সিকোয়েন্স নিয়ে সেটের মধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয় যে, ‘এ মা! কিস খেলো’। ফলে এই ব্যাপারটা পর্দাতেও ছড়িয়ে পড়ে এবং একটা গুজব হিসেবে সোজা খরাজবাবুর কানে। খরাজবাবু দিলদরিয়া লোক, বিশ্বাসই করলেন না। ছোঃ অমন কত্তে পারে ও। কত ভালো ছেলে। ব্যস্, হিরোইন খাপ্পা। অ্যাঁ, মশাই এতো শ্লীলতাহানির কেস! কিছু না পারেন দুটো সংলাপ এটলিস্ট কাটুন। পরিচালক কিছু বলেন না, শুধু বগ দেখান।
ঠিক এরপর মার্কেটে কলার তুলে খেলতে নামল থার্ড পার্সন।
চতূর্থ অধ্যায়
আর কী! ছাতের উপর দুপুর বেলা মারধোর। যেন দুই হুলোবেড়ালে পারস্পরিক খিমোচখিমচি করছে। আরে কীইই আশ্চর্য! মারপিট না করে সিনেমাটার একটা গতি কর না বাপ। ভাল্লাগে না। এটা মনে হতেই মারপিট থামিয়ে বিবিধ সেন্টু এবং একটি সাংঘাতিক ট্রান্সিটিভ রিলেশনের এস্টাবলিশ্মেন্ট। সেটা কিরম? আমি ভূমিকে ভালবাসি। ভূমি যদি তোকে ভালবাসে, তাহলে আমিও তোকে ভালবাসি।
-- অ্যাঁ! সহ-পরিচালক, এইসব রয়েছে স্ক্রিপ্টে! পেলে দা!
-- আচ্ছা! না না দাঁড়াও ঠিক করে দিচ্ছি। নতুন করে, স্টার্ট...
আমি ভূমিকে ভালবাসি, ভূমি যদি আমাকে ভাল না বেসে তোকে বাসে, তাহলে ওর ভালবাসা কে আস্ত রাখার জন্য আমি আমার ভালবাসাকে সরিয়ে রেখে তোর ভালবাসা আর ভূমির ভালবাসা যাতে একরৈখিক হয় সেজন্য আমার ভালবাসাকে নিয়োজিত করে রাখব। আর ভালবাসা...
-- অ্যাঁ! সহ-পরিচালক! পেলে দা!
চোপ! পেলেদা ধমকে ওঠেন। ডিল সেটলদ হয়। এবং হাপ টাইম এসে পড়ে। কোন পক্ষ কত গোল খেল সেটা কনফিউজিং কারণ প্রপার ভিলেনের দেখা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না এবং আপাতত সেটে চা এসেছে।
পঞ্চম অধ্যায়
হ্যাঁ, তা, চা ফা খাওয়ার পর, একটা চোঙা নিয়ে পরিচালক একটা উঁচু টুলে উঠে ঘোষণা করলেন, নায়িকা কিডন্যাপড।
সে কী! কে কিডন্যাপ করল? ঐ তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী আশ্চর্য। সহ পরিচালক কথাটা কানে কানে বলতেই পেলেদা খেঁকিয়ে উঠলেন, কেন ?! বাংলাদেশের প্রতাপগড় কি মরে গ্যাচে নাকি! ওখানে ভূমির বাপ মানে পিতৃভূমি রয়েছেন। উনি ফষ্টি নষ্টি বরদাস্ত করতে পারেন না। নায়িকাকে কান ধরে ডেকে পাঠিয়েছেন। বিয়া অইবো।
-- সেকী! নায়িকা জানে সেটা?
ওকে দিয়ে অ্যানাউন্স করিয়ে দাও।
তাইই হয়। নায়িকা কেঁদে কেটে থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার কে বলে হ্যাঁ গো, আমাকে বাবা কিডন্যাপ করেছে। আমি বাংলাদেশে। এখানে উল্টোসিধে করতে এলে সোজা ডানহাত কেটে বাঁহাতে ধরিয়ে দেবে।
আমার কি হবে!
সত্যিই কি হবে! এইখানে প্রচুর সেন্টু ঝরে পড়ে এবং তার সাথে ভূমি হারানোর শোক। স্ক্রীনের বাঁদিক জুড়ে হিরো অবস্থান করতে থাকে। এদিকে তৃতীয় হাবাটি একটু ভিতু প্রকৃতির। সে ঝামেলায় যেতে চায় না। প্রিভিয়াস ডিল রয়েছে। হিরোর সাথে অনাক্রমণ এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি। তার দাবি নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপাশে চলে যাওয়া ভূমি তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেন্টু হিসেবে ঐ ভালবাসার ভালবাসার ভালবাসার...ট্রান্সিটিভ ক্লজটি।
অগত্যা স্ক্রিন জুড়ে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ। বরিশাল, ঢাকা, খুলনা চট্টগ্রামের বাংলাদেশ। প্রতাপগড়ের বাংলাদেশ। বাঙাল ভাষায় ঝিনচ্যাক গান। মেঘ ও রৌদ্র। পাঞ্জাবী ঘরাণায় বিয়েবাড়ীতে ঢোলক নিয়ে সব হাজির। রাশি রাশি সোনার গহনা ইত্যাদি পড়ে চামর দুলিয়ে বৌ গণ সব ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।
এমন সময় দেখা গেল দুদেশের মধ্যকার কাঁটাতার টপকে আমাদের হীরো অলরেডী বাংলাদেশে ইনফিলট্রেট করে গ্যাছে। দার্জিলিং, তিস্তা, প্রতাপগড়। সোজা রুট। প্রতাপগড়ে চৌধুরী পরিবার। তারা খানদানী জমিদার। খানদানী আদবকায়দা। খানদানী পাইক পেয়াদা। খানদানি শত্রুসমূহ। শত্রু না থাকলে চলে!
তো অহন বিয়া অইবো, তো পাত্রপক্ষটি কে? কার ফুল ফুটল গো? এইখানে পেলেদা যে সহিষ্ণুতার বার্তা ছড়িয়েছেন তা এককথায় চমকপ্রদ। চৌধুরী রাজবংশীয় মহাপুরুষটি তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন অপোনেন্ট শ্রীভিলেনের একমাত্র ছেলের সাথে। একে আমরা তালুকদার পুত্র বলে চিনব। এর রেজাল্ট হবে একটি বৃহত নেট নিউট্রালিটি। মানে, মিলে মিশে যাও, মুরগি প্যাঁদাও। আক্ষরিক অর্থেই মহতী উদ্দেশ্যে বিয়ে। কিন্তু নায়িকা সে কথা শুনলে তো! সে তখনও প্রেমিক প্রেমিক প্রেমিক করে টিকটিক করে চলেছে।
কিন্তু তাতে কি! হীরো তো অলরেডি প্রতাপগড়ে। বুক ফুলিয়ে রাজপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। আপনার মেয়েকে ভালবাসি।
আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন রাজপুরুষ জমিদারকূলপতি। শালা, এখনো একঘায়ে কুড়িটা মাথা কাটি, তো এ তো একটা মাত্র। সাহস তো বেশ। আচ্ছা দাঁড়াও মন্ত্রী, অমাত্যগণ! ওকে পরে কোতল করবে, আগে দেখো তো মতলব টা কি!
মাক্কালী এই সিন দেখা মাত্র মনে পড়ে গেসল, ‘নিছক মাগির দোষে হইল কোতল’। কিন্তু পুরন্দর এট অল দের রিক্যাপিচুলেশন করে এখন লাভ নেই, আসব আসব করে ষষ্ঠ অধ্যায় এসেই পড়ল।
ষষ্ঠ অধ্যায়
এইখানে কিছু জিনিস ক্লীয়ার করে নিতে হবে। হীরো কিন্তু মূলত ভূমি উদ্ধারের জন্য এসেছে। তাকে উদ্ধার করে সেই তৃতীয় পার্সনের হাতে তুলে দিতে হবে। মানে হাবাপনার চোদ্দগুষ্টি আর কী! সেটে ব্যাপারটা অনেকবার অনেকে আপত্তি করেছে, কিন্তু পেলেদা শুনতে চাননি। ওঁর একটাই দাবী। সেটা হ’ল, যত বেশী গোঁৎ, তত বেশী ফোঁৎ। সুতরাং দর্শকের নিডপূরণ ও ন্যাপকিনের কথা মাথায় রেখেই হীরোর এই উদারীকরণ। তার বেশী কিছু না। অতএব প্ল্যান অনুযায়ী হীরো বিয়ে ভন্ডুল করবে। তারপর নায়িকাকে নিয়ে পালাবে। তিস্তার দিক দিয়ে পালানোটা বেটার। সাদা সুমো করে। ব্রিজের ওপারে তৃতীয় পান্ডব লাল সুমো নিয়ে অপেক্ষা করবেন। একটা ট্রেন থাকবে। সেটা চললেও কোনো অসুবিধে নেই। কোনটা ভারত বাংলাদেশ বর্ডার সেটা নিয়ে দর্শককে মাথা ঘামাতে দিলে চলবে না। দৈবাৎ কেউ যদি ঘামিয়েও ফেলে তবে তার জন্যে রয়েছে নির্ভেজাল মুগ্ধবোধ।
সুতরাং প্ল্যান মোতাবেক বিয়ে ভন্ডুল হ’ল। একটি কুকুর মারফত। এটি অপোনেন্ট বাড়ির কুত্তা। আসলেই বিচ্ছু। সে বিয়েবাড়ীর খাবার খেয়ে মরে যাওয়ার ভান করল। তৎক্ষণাৎ হুলুস্থুলুস। অমনি দুপক্ষ খাওয়ার টেবিলের নীচে, বটগাছের মাথায়, কুয়োর পাড়ে, দেরাজ পাতির ভিতর, যেখানে যা লুকোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল সব নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। দুই কূলপতি লাইট সেবার প্রায় বার করতে যান আর কী। কিছু স্থূলকায় বৃদ্ধা হাঁউমাউ, বুকে ব্যাথা বলে মুচ্ছো গেলেন।
এদিকে দেখাগেল শ্রীভিলেনের চতুরচূড়ামণি ছেলেটি, অর্থাৎ তালুকদার পুত্র, মানে যার ফুল ফুটেছে আর কী, সে অলরেডী হাওয়া। ফলে লগ্ন ভ্রষ্টা ইত্যাদি পৌরাণিক ব্যাপারের হাত থেকে বাঁচতে হিরোর সাথে একটা আপতকালীন বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট। এদিকে বিয়ে হয়ে গেলে কি হবে, হীরো সামান্য সময়ের জন্যও ভোলেনি তার অ্যাকচুয়াল কর্তব্য। নায়িকাকে নিয়ে সে সীমান্তের কাছে। সেখানে অপেক্ষা কচ্চে তৃতীয় পান্ডব। ফলে বাউন্ডারীর কাছে কেস জমজমাট। সে প্রচুর লোক। ম্যালা ক্যাওস। বর্ডারের কাছে এক মঞ্চে সব পক্ষ, প্রতিপক্ষ। ক্যামেরাম্যান, সহপরিচালক তো আগেই চলে গ্যাছে বলেছি। কিন্তু মাইরি, এইটার বর্ণনা আলাদা করে লিখতেই হচ্ছে।
সপ্তম অধ্যায়
এই ক্যাওসের শুরুতেই ‘বং’। এক তুমুল প্রতিআক্রমণে ভিলেন অর্থাৎ তালুকদার পুত্র নাইকাকে ছিনিয়ে নিয়ে সরে পড়ে। অন্যদিকে চৌধুরীর দলবল অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে তৃতীয় পান্ডব কে। হীরো উপায়ন্তর না দেখে আক্রমণ করে তালুকদার পূত্রকে। বিং। তুমুল শরনিক্ষেপ করে আকাশ শরজালে অন্তরীণ করে একফাঁকে সে হুমদো তালুকপুত্রকে নিয়ে সরে পড়ে সেখানে থেকে। কিন্তু পড়ে থাকে নাইকা। গং। কিন্তু অলরেডী পরবর্ত্তী যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়ে গেছে। হীরো ঘোড়া ছোটায় এবার চৌধুরীর দিকে। চৌধুরী গদার একঘায় ঘায়েল করে তৃতীয় পান্ডবকে। গদাম। তালুকদার হাসতে থাকে। হীরো পায় ভয়। সে অ্যাতো ভয় পায় যে পন এক্সচেঞ্জের পরিকল্পনা করে। এতে সহ-পরিচালকের সায় থাকে না। পরিচালক তাকে বরখাস্ত করেন। পেলেদার এই চিত্রনাট্যে তার কোনো জায়গা নেই দেখে সে পরিচালকের উদ্দেশ্যে শুধু মন্তব্য করে ওরে বাল।
কিন্তু আভ্যন্তরীণ মারপ্যাঁচ এখনো বাকি আছে। মুগ্ধবোধের শেষটা এইবার শুরু হচ্ছে। শুরু হচ্ছে এই পক্ষের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এপিসোড, চৌধুরী বনাম তৃতীয় হাবা প্রেমিক । এক আচম্বিত প্রতি আক্রমণের ঝটিকায় যখন হাবাবাবু প্রায় খুন হতে চলেছেন, সেই সময় আমাদের অন্যতম গাড়ল হিরো সেই উদ্যত খড়্গের সামনে নিজের পেটটি এগিয়ে দেয়। তৎক্ষণাত মেকয়াপ ম্যানরা এগিয়ে আসেন। টনটন রক্ত মাফিক রঙ দেখে নিজের সৃষ্টির সামনে পেলেদা নিজেই অসহায় বোধ করেন এবং জনশ্রুতি যে উনি রাবীন্দ্রিক অন্ত বেছে নেন। নির্জন নিরাপদ অংশ দেখে পতন ও মূর্চ্ছা।
এবং এই অ্যাতোসবের পর হিরো মরল না বাঁচলো জিজ্ঞাসা করছেন। কেন? দেশে কি হাসপাতাল ডাক্তার বদ্যি নেই। সব আছে।
শেষ ফোঁৎ হিসেবে একটা ছোট্ট সিন উল্লেখ না করলেই নয়। হাসপাতালে ডাক্তার জিজ্ঞাসা কচ্চে, আচ্ছা, এই যে ভদ্রলোক ছুরি খেয়ে কাতরাচ্ছেন, এঁর কি কেউ নেই? বন্ডে সই করবে কে?
আধো আধো গলায়, লাল শাড়ি সামলে নাইকা বলে উঠছে, কেন, আমি আছি। ওঁর স্ত্রী।
বুঝলেন! ক্ষীইই সাটল্টি!