শ্রদ্ধেয় আমার সহকর্মী শিক্ষক্ল-শিক্ষিকাবৃন্দ,
আজ অনশন আন্দোলনের ২৫ তম দিন।কিসের অনশন আন্দোলন?সেটা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না আপনাদের। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলেও তা জানানোর দায় আমার নেই। আপনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন। হ্যঁা এই নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা,বিতর্ক রয়েছে যে এই আন্দোলন সঠিক বা নায্য কিনা। বিশেষ করে তাদের মধ্যে রয়েছে যারা এসে আন্দোলনকারীদের সাথে দেখা করে উঠতে পারেননি।তাই দাবীটা খুব ছোট্ট করে বলে দিচ্ছি।আমরা সবাই জানি ২০১২র এস এস সি র পরে CMP(Combined Merit Panel) ক্যান্ডিডেটদের আন্দোলন হয়েছিল। প্রত্যেকের নামের পাশে এমপ্যানেলেড লেখা ছিল অথচ এস এস সি এবং শিক্ষাদপ্তর বলেছিল তাদের চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। এম্প্যানেলড লেখা থাকা মানেই চাকরি পাওয়া নয়! বুঝুন কান্ড। এতো সুপ্রীম কোর্টের অর্ডারকেও ভায়োলেট করে এবং এস এস সি র নিজস্ব নিয়মকেও। সেই আন্দোলনেও দেখেছিলাম সরকারের অমানবিক মুখ। যাইহোক,তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। আবারও এস এস সি হল ২০১৬তে,প্যানেল বেরলো ১০১৮তে। কি অদ্ভূত তাই না? আচ্ছা আমাদের সময়ও যদি এমনটা হত আজ আপনি ঘরে এলইডি টিভি বা এসি লাগাতে পারতেন? পাঠাতে পারতেন সন্তানকে ভালো স্কুলে? একটু ভাববেন।যাইহোক,তো প্যানেল বেরোনোর পর থেকেই বিস্তর ম্যাজিক ঘটতে লাগল। প্রথমে যার নাম ছিল না হঠাৎ দেখা গেল সেই মেয়েটি চাকরি পেয়েছে। হ্যঁা তার বাবা প্রভাবশালী। তো এসব মায়াজাল টাল তৈরি হওয়ার পরে ক্যান্ডিডেটদের তরফে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে লাগল। কেন?আচ্ছা শুনুন তাহলে। আপনার সাধারণ বুদ্ধি কি বলে।২০১২ এবং ২০১৬ মাত্র দুটো এস এস সি,তাতেও বিস্তর গলদ,দুর্নীতির ফলে তৈরি হয়েছে অসংখ্য শূণ্যপদ। কিন্তু আপডেট করা হচ্ছে না ভ্যাকেন্সি লিস্ট। ৪০০ আরটিআই মামলার পরেও করা হয়নি। প্রমাণ? আচ্ছা কয়েকটি উদাহরণ দি। আমার কিছু পরিচিত শিক্ষকদের কাছে শুনেছি ভ্যাকেন্সি লিস্টে নাকি তাদের স্কুলের নামই নেই,অথচ ভ্যাকেন্সি আছে স্কুলে। আবার উত্তর দিনাজপুরের রাহাতপুর হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক সহিদুর রহমান বাবুর কাছে জানতে পারলাম যে ওই জেলায় একটি স্কুলে ২৭টি পোস্ট ভ্যাকেন্ট,আছেন শুধু হেডমাস্টার। তো তাকে ডি আই অফিস বলেছে ওই ভ্যাকেন্সি লিস্ট নাকি "show" করা যাবে না কোনো অজ্ঞাত কারণে। কি করুণ মজা তাই না? স্কুল শিক্ষক পেল না,চাকরিপ্রার্থী চাকরি পেল না,কিন্তু সরকারের কি তাতে এল গেল? উঁহু একদম না। কারণ একটি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে এর থেকে ভালো আর কিই বা হতে পারে? বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? আচ্ছা তাহলে একটু ভেঙ্গে বলি।
মনে আছে কিছুদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ইন্টার্ণ শিক্ষকের কথা? নাঃ ওটা একেবারেই ইয়ার্কি বা ক্যাজুয়াল কথা ছিল না। এই ইন্টার্ণ বা যাদের আমরা বলছি সিভিক টিচার ওই সিভিক পুলিশের মতন তাদের নিয়োগ করে সরকারের কি লাভ? কেন ১৬র ওপর ১৮ আনা লাভ! এক তো প্রায় বিনা মজুরিতে খাটিয়ে নেওয়া যাবে(কারণ এই বাজারে ২০০০/২৫০০ টাকা দেওয়া আর বিনামূল্যে খাটিয়ে নেওয়ার মধ্যে খুব পার্থক্য আছে কি?) এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই শিক্ষকদের দলের ক্যাডারে পরিণত করা!!ভেবেছেন এভাবে?আসলে এই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি শুধুই দুর্নীতি নয়,এক রাজনৈতিক এজেন্ডা,যে এজেন্ডাটির নাম হলে নয়া উদার অর্থনীতি বা neo liberal economy, যে অর্থনীতি স্থায়ী চাকরিতে বিশ্বাস করে না। কারণ স্থায়ী চাকরি হল পুঁজির পরিপন্থী। আবার স্থায়ী চাকরি একধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি করে প্রফেশানের প্রতি। কিন্তু অস্থায়ী কর্মচারীর এরকম কোনো দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয়। বুঝলেন না তো? আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি। আমরা বেশীরভাগই চাকরি পাওয়ার পর মাথা ঘামিযেছি ছাত্রদের ভালোমন্দ নিয়ে,তাদের ভালোবেসেছি,জানতে চেয়েছি তার পারিবারিক অবস্থা,কেন সে স্কুলে এসে গালি দেয়,কেন সে রোজ খেয়ে স্কুলে আসতে পারে না;আমাদের প্রাণ কেঁদেছে যখন জেনেছি সেই ছাত্র বা ছাত্রীর বাবা দিনমজুর,মা ১০০দিনের কাজ করেন বা লোকের বাড়ি বাসন মাজেন। আমরা চেষ্টা করেছি ক্লাসে ভালো করে পড়াতে যাতে গরীব বাচ্চাগুলোকে একটু হলেও শেখানো যায়। হ্যঁা একে বলে দায়বদ্ধতা। কিন্তু আপনাদের কি মনে হয় একজন সিভিক টিচারের সেই দায়িত্ব থাকবে? নাহ,থাকার কথাই নয়। আর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র,সরকার তো সেটাই চায়। ভেঙ্গে পড়ুক শিক্ষাব্যবস্থা,কায়েম হোক লুম্পেনরাজ,সবাই মদ-গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে শুধু নানান রকম মেলা-খেলায় মেতে থাকুক। আর এইরকম পরিবেশ সৃষ্টি করতে গেলে সবার আগে দরকার হচ্ছে শিক্ষকসমাজকে পঙ্গু করে দেওয়া। কারণ শিক্ষা এবং শিক্ষকই চিরকাল বিদ্রোহ করতে শেখায়,প্রশ্ন করতে শেখায়। মনে করুন হিরকরাজার দেশে গল্পের উদয়ন পন্ডিতের কথা। হিরকরাজা তার শোষণ কায়েম রাখতে তার সর্বপ্রথম আঘাতটা নামিয়ে এনেছিল উদয়ন পন্ডিতের পাঠশালার ওপর। তাই উদয়ন পন্ডিতদের ক্রমশ সমাজ থেকে ভ্যানিশ করে দেওয়াই হল নয়া উদার অর্থনীতির নিয়ম। তাহলে আমরা কি করব? আমরা তো চাকরি করি। আমরা তাহলে কেন নামবো রাস্তায়? আচ্ছা আপনি সিওর তো যে কাল ফোর্সড ট্র্যান্সফারের শিকার আপনি হবেন না? আপনি সিওর তো যে আপনার পিএফ,পেনশানের টাকা বাজারি ফাটকায় ছেড়ে দেওয়া হবে না যেমনটা অলরেডি হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রে? আপনি সিওর তো আগামীদিনে এমন নিয়ম আসবে না যেখানে আপনার স্থায়ী চাকরিটি অস্থায়ী হয়ে যেতে পারে এবং সেটা আটকাতে আপনাকে কোর্টের দোড়গোড়ায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হতে পারে? কি জানি,আমি কিন্তু সিওর নই। আর সেগুলো যদি হয় আপনি কাউকে পাশে পাবেন তো,যদি আপনি অন্যের পাশে না দাঁড়ান? এমনিতেই গোটা সমাজের কাছে শিক্ষকরা পর্যবসিত হয়েছে এমন এক শ্রেণীতে যারা শুধু ডি এ,পে কমিশান আর টিউশান ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। আর তারপরেও শুধুমাত্র আপনি স্থায়ী শিক্ষক বলে হবু শিক্ষকদের আন্দোলনের পাশে না দাঁড়ান তাহলে ইতিহাস ক্ষমা করবে কি? আপনি কি সমাজের কাছে শ্রদ্ধা দাবী করতে পারবেন? ভেবে দেখবেন।
এবারে আবার আমার প্রথম বক্তব্যে ফিরি-কেন এই আন্দোলন নায্য আন্দোলন। এই যে ৭ বছরে তৈরি হয়েছে হাজার ভ্যাকেন্সি,সেই তুলনায় নিয়োগ হয়েছে খুবই কম। ফলাফল? স্কুলগুলো ধুঁকছে শিক্ষকের অভাবে,বেকারত্ব বাড়ছে আর আমাদের মতন স্থায়ী শিক্ষকদের ওপরে চাপ বাড়ছে। আমরা overburdened। কিন্তু তাতে সরকারে কি কিছু এল গেল? নাঃ কাঁচকলা। কিসসু এল গেল না। শুধু আমরা দেখলাম ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে,সংকুচিত হচ্ছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা,দলে দলে শিশুরা গিয়ে ভর্তি হচ্ছে প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা আর পড়ছে না। হ্যঁা মিড ডে মিল,ড্রেস,ব্যাগ দেওয়া সত্ত্বেও তারা ড্রপ আউট,কারণ কে পড়াবে তাদের? শিক্ষক কই?
আর উল্টোদিকে একটা গোটা দশককে আমরা চোখের সামনে শিকার হতে দেখছি বেকারত্ত্বের,সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। এবারে শেষ করব আসল কথাটি বলে। সেটা হল আন্দোলনের দাবী। হ্যঁা দাবী হল ভ্যাকান্সি লিস্ট আপডেট করা,সঠিক মেরিট লিস্ট প্রকাশ করা এবং সেই অনুযায়ী নিয়োগ করা। হিসেব বলছে শূণ্যপদ এবং চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে যে ফারাক তাতে অনায়াসে সমস্ত ওয়েটিং লিস্টে থাকা প্রার্থীদের চাকরি হয়ে যায়। কিন্তু নাঃ আপডেট করা হচ্ছে না ভ্যাকেন্সি লিস্ট। তাই আসুন আমরা শিক্ষাদপ্তর এবং সরকারের কাছে দাবী করি আপডেটেড ভ্যাকেন্সি লিস্ট প্রকাশের,স্বচ্ছ মেরিট লিস্ট প্রকাশের। আসুন রাস্তায় নামি,মিছিল করি,ডেপুটেশান দি। এটা প্রমাণ করে দি যে আমরা এখনো জাতির মেরুদণ্ড;প্রমাণ করে দি যে এই বাঙলারই শিক্ষক ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন এবং আমরা তাঁর এবং আরও অজস্র সংগ্রামী শিক্ষকদের ঐতিহ্য বহন করি।
ইতি
আপনাদেরই জনৈক সহকর্মী।