কাশ্মীর নিয়ে প্রবল হইচইয়ের মধ্যে নতুন খবর এই, যে, দেশের ৪১ টি আগ্নেয়াস্ত্র (অর্ডন্যান্স) কারখানার লক্ষাধিক কর্মী সর্বাত্মক ধর্মঘটে নেমেছেন বেসরকারি হাতে অস্ত্র কারখানা বেচে দেবার উদ্যোগের বিরুদ্ধে। এমনিতে সরকারি সংস্থা বেচে দেবার খবরে নতুনত্ব কিছু নেই। দেশের অর্থনীতির হাঁড়ির হাল আমরা সকলেই জানি। অর্থনীতির মন্দা ঘনিয়ে আসছে। পার্লে গতকালই ১০০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ, সমস্ত কর্মী কাজ হারিয়েছেন। গাড়ি শিল্পে প্রবল মন্দা সমাগত। আনুমানিক সংখ্যা অনুযায়ী এই শিল্পে নিয়োজিত ১০ লক্ষ লোক সম্ভবত কাজ হারাতে চলেছেন শীঘ্রই। বস্ত্র শিল্পে সংকট আরও অনেক তীব্র। খুব সম্ভবত ৩ কোটিরও বেশি মানুষ কাজ হারাতে চলেছেন আর কিছুদিনের মধ্যেই। ভারতবর্ষের এই বিপুল জনসংখ্যার ৩, ৪ বা ৫ শতাংশ মানুষের একই সঙ্গে কাজ হারানোর ফলাফল কী হতে পারে, তা আলাদা করে বলার কিছু নেই।
অর্থনীতির এই হাঁড়ির হালে সরকারের রোজগারও সঙ্গীন। এরই মধ্যে ব্যাংক-ঋণ মকুব করা হচ্ছে শিল্পপতিদের। শোনা যাচ্ছে, বিদেশে পালিয়ে যাওয়া শিল্পপতিদের কাছে অনাদায়ী টাকার পরিমান (পড়ুন চুরি করা টাকার পরিমান) ১০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সরকার এই শিল্পপতিদের দেশের বাইরে চলে যেতে দিয়েছে, এবং ফিরিয়ে আনার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা হয়েছে বলেও খবর নেই। এমতাবস্থায় ভারত সরকার, পড়ন্ত জমিদাররা যা করে চলে, তাই করছে। অর্থাৎ নিজের সম্পদ বেচে খরচ চালানো। বিএসএনএল বা হ্যাল এর কর্মীদের মাইনে না হবার খবর মাঝে-মাঝেই ভেসে উঠছে। বিএসএনএল ৫৪,০০০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে বলে খবর। এই দুটি সংস্থাকে শেষ পর্যন্ত সম্ভবত জলের দরে বিক্রিই করে দেওয়া হবে। এয়ার-ইন্ডিয়া বেচে দেবার প্রক্রিয়াও চলছে পুরোদমে।
এসব কোনো নতুন খবর নয়। তবুও অস্ত্র কারখানা বেচে দেবার উদ্যোগ আলাদা এই কারণে, যে, কাশ্মীর এবং দেশপ্রেম নিয়ে তীব্র ঢক্কানিনাদের মধ্যেই পুরোদমে চলছে এই উদ্যোগ। বিচিত্র এই দেশে একদিকে চলছে 'জাতিয়তাবাদ' এর হুঙ্কার, সৈন্যদের বীরত্বের জয়গাথা, অন্যদিকে সেনাদের অস্ত্র তৈরির কারখানাকে বেচে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সেনারা এখন কাশ্মীরে বা অন্যত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করবেন (মতান্তরে সরকারের রাজনৈতিক চাল সফল করার ঘুটি হিসেবে কাজ করবেন), তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম কেনা হবে জনগণের অর্থে, কিন্তু আসলে পেট ভরবে কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর। তাঁরা সেই ছুতোয় ব্যাংক থেকে আরও কিছু লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালাবেননা, এর কোনো গ্যারান্টি অবশ্যই নেই। শোনা যাচ্ছে, গোয়ালিয়রে ইতিমধ্যেই নামমাত্র খরচে জমি দিয়ে দুটি শিল্পগোষ্ঠীকে প্রতিরক্ষা প্রকল্পে কাজ শুরু করতে দেওয়া হয়ে গেছে। গোষ্ঠী দুটির নাম রিলায়েন্স এবং আদানি। এদের নাম আন্দাজ করার জন্য অবশ্য কোনো পুরষ্কার নেই, যেমন নেই মাথার উপর কয়েক লক্ষ টাকা দেনা নিয়ে এঁরা আসলে জনতার পয়সাতেই ব্যবসা চালান, এই তথ্য জানার জন্য।
প্রায়-অলীক কিন্তু ঘোরতর-বাস্তব এই বেওসা বা ভাই-বেরাদরি-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই সর্বাত্মক প্রতিবাদ হিসেবে চলছে ধর্মঘট। এআইটিইউসি সরকারি পদক্ষেপকে "ভারত-বিরোধী (অ্যান্টিন্যাশানাল)" আখ্যা দিয়েছে। সিটুর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলেছেন, সরকার 'জাতিয়তাবাদ' এর বুলি আওড়ালে কী হবে, জাতীয় স্বার্থকে মুনাফা-লোভি ব্যবসায়ী এমনকি বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দিতেও সরকারের কোনো দ্বিধা নেই। বহু বিজ্ঞাপিত কারগিল কিংবা সার্জিকাল স্ট্রাইকে এই সব কারখানার তৈরি সরঞ্জামই সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে, যা মুনাফা-চালিত কর্পোরেট সময় মতো সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিও দিতে পারেনি। বস্তুত 'জাতীয় স্বার্থ'কে বন্ধকই দেওয়া হচ্ছে। খুবই আগ্রহজনক ব্যাপার, যে, মোদী সরকারকে ভারত-বিরোধী বলা এই সমস্ত শক্তির সঙ্গে পুরোদমে যুক্ত হয়েছে বিজেপির শ্রমিক সংগঠনও। ফলে অভিযোগগুলি নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে ঐকমত্য আছেই বলা যায়, যার ফলশ্রুতিতেই এই সর্বাত্মক ধর্মঘট।
ধর্মঘট সর্বাত্মক হলেও, ভারতের অন্যান্য অংশের মতো পশ্চিমবঙ্গের অস্ত্র কারখানাতেও পুরোদমে ধর্মঘট চললেও, অবশ্য বঙ্গীয় মিডিয়ার এই নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। সর্বভারতীয় মিডিয়ায় ছিটেফোঁটা খবর আসছে অবশ্য, কিন্তু কাশ্মীর এবং সেনাবাহিনী নিয়ে যে প্রবল হইচই লক্ষ্য করা যায়, সেনাদের সরঞ্জাম বা অস্ত্রশস্ত্র তৈরির উৎস বেচে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে তার কিয়দংশও নেই। বঙ্গীয় মিডিয়াও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এবং তাঁর বান্ধবীর জামার রঙের ম্যাচিং নিয়ে গবেষণায় যত ব্যস্ত, তার কণামাত্রও নয় এইসব খবরে। এ কি শুধুই হুজুগের চাষবাস? নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভও কি তবে ভাই-বেরাদরি-বেওসা সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়ল?