সুব্বি-র লড়াইয়ের গল্প
গল্পটা একজন উজ্জ্বল যুবকের, অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে যিনি কানপুর আই আই টি-র মত প্রথম সারির একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পেরেছিলেন। কিন্তু গল্পটা শুধু তাঁর সাফল্যের নয়, চাকরী পাবার পর সহকর্মীদের তরফ থেকে তিনি যে অহেতুক শত্রুতার শিকার হয়েছিলেন, আর যেরকম শান্তভাবে অথচ দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ়তার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছিলেন এটা আসলে সেই গল্প। মানুষের চরিত্র ও নীতিবোধ যে কতখানি ভঙ্গুর হতে পারে, পরশ্রীকাতরতা যে মানুষের নিজস্ব আচরণ কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে সেটা চাক্ষুষ করার জন্যও গল্পটা সকলের জানা দরকার।
কানপুর সমেত সমস্ত আই আই টির শিক্ষক গোষ্ঠীতেই সংরক্ষিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নেহাৎই নগণ্য। সেই ফাঁক ভরাতেই ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে শুধুমাত্র সংরক্ষিত শ্রেণীর কাছ থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছিল। যথারীতি জমা পড়া আবেদনের মধ্যে থেকে বাছাই করে কিছু কিছু আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের জন্য আবেদন করেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা, এই গল্পের নায়ক, তার নামটা সংক্ষেপে লেখা যাক সুব্বি, যিনি এম টেক আর পি এইচ ডি দুইই করেছেন কানপুর আই আই টি থেকে। যাঁর অধীনে করেছেন, সেই প্রফেসরই (এ কে জি) তখন বিভাগীয় প্রধান।
নির্বাচনের অন্তরালে
এইসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ আবেদনকারীদের নিজের কাজের ওপর একটা বক্তৃতা (জব-টক) দিতে ডাকা হয়, সেখানে কিছু প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে একপ্রস্থ যাচাই হওয়ার পর তাঁদের টক-এর ফলাফল, অনুমোদনপত্র (রেকোমেন্ডেশন), যোগ্যতামান ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখে নির্বাচিত কিছু আবেদনকারীকে সরাসরি ইন্টারভিউতে ডাকা হয়। তার আগে এই প্রার্থীদের বিষয়ে সমস্ত তথ্য পর পর অনেকগুলো কমিটিরর হাতে যাচাই হয়, যার মধ্যে বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ কিছু শিক্ষক, অধিকর্তা, বিভিন্ন বিভাগীয় ডিন এমনকি কয়েকজন বাইরের সদস্যও থাকেন। ইন্টারভিউ-এর পর চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়। মোটের ওপর পদ্ধতিটা খুবই জটিল এবং যথাসম্ভব নিরপেক্ষ, যার প্রথম পর্যায়ে সুব্বি কেও বক্তৃতা দিতে ডাকা হল, আর গল্পটা শুরু হল সেখান থেকে।
আরে ! দেখো কে আবেদন করেছে !
নিয়মমত এই বক্তৃতাগুলোয় সকলেরই আসার সুযোগ থাকলেও সাধারণতঃ যে বিভাগের ‘টক’ সেখানকার শিক্ষক-গবেষকরাই এই টক শুনতে আসেন। এই ক্ষেত্রে কিছু ব্যাতীক্রম দেখা গেল এরোস্পেস বিভাগ ছাড়াও মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং এর কিছু শিক্ষককেও দেখা গেল এই টক শুনতে। এই রকম টক-এর সময় নানারকম প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে বক্তার জ্ঞান-বুদ্ধির একটা মূল্যায়ণ চলে, তাই কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা হিসেবের মধ্যেই থাকলেও সাধারণতঃ আমন্ত্রিত বক্তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয় না। সুব্বি যদিও নিজের বিভাগে নিজের মাস্টারমশাই ও বন্ধুদের সামনে টক দিতে খুবই উৎসাহিত ছিলেন কিন্তু আলোচনাসভায় তাঁকে কেউ কেউ সরাসরিই বিদ্রুপ করলেন। তবে যাবতীয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুব্বির টক ভালোই উতরে গেল, দু-একজন ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষক সুব্বি-র স্বপক্ষেই মতামত দিলেন, এবং সংক্ষেপে বলতে গেলে পরবর্তী যাবতীয় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাবার পর সুব্বি কানপুর আই আই টি-র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পেলেন।
চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বাচন কমিটিতে ছিলেন সদ্য নিযুক্ত অধিকর্তা ডঃ মণীন্দ্র আগরওয়াল, যিনি লিখেছেন যে কমিটির তিনজন সদস্য একমত হয়ে সুব্বি-র নিয়োগকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। (বলে রাখা ভালো বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির মধ্যে বিভাগীয় প্রধান এ কে জি ছিলেন না। সুব্বি-র পি-এইচ-ডি-র গাইড হিসেবে কোনোরকম পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে যাতে না ওঠে সে জন্য তিনি নিজেকে আগেই সরিয়ে নিয়েছিলেন।) সুব্বি যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত UAV (Unmanned Air Vehicle) বানিয়েছেন সেটা নিয়ে ওঁরা খুবই উচ্ছসিত ছিলেন। ওই ধরনের দক্ষতা খুব বেশি লোকের নেই আর সেইজন্যই সুব্বিকে পেলে আই আই টি কে (কানপুর)-র মঙ্গল। সুতরাঙ সুব্বি-র স্বপ্ন সার্থক হল, নিজের প্রতিষ্ঠানে উনি শিক্ষক হয়ে যোগ দিলেন, এক সময়কার শিক্ষকরা তাঁর সহকর্মী হয়ে গেলেন। সেটা নভেম্বর মাস।
তিন সপ্তাহে স্বপ্নভঙ্গ !
কয়েকদিনের মধ্যেই বিভাগের কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক অধিকর্তার কাছে গিয়ে অভিযোগ করলেন যে সুব্বি-র নিয়োগটা একটা ভুলভাল সিদ্ধান্ত, উনি এই রকম প্রতিষ্ঠানে পড়াবার যোগ্য নন, মানসিকভাবেও স্থির নন এমনকি ঠিকমত ইংরেজীও নাকি বলতে পারেন না। এতজন সম্মাননীয় ব্যক্তি একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে ব্যাপারটা কিছুটা গুরুত্ব পায় কিন্তু যেহেতু সুব্বি তখন যোগদান করে ফেলেছেন আর ডঃ মণীন্দ্র নিজে ইন্টারভিউ তে তাঁকে ঝরঝরে ইংরেজী বলতে শুনেছেন তাই তিনি এই নিয়ে আর জল ঘোলা করতে বারণ করলেন। অভিযোগকারীরা জানিয়ে গেলেন যে তাঁরা ছাড়বেন না, আর তারপর ঘটনাগুলো পরপর ঘটতেই থাকল।
বলতে গেলে যাঁর পরিবারে লেখাপড়ার চলই নেই তেমন পরিবার থেকে উঠে আসা একজন উচ্চাকাঙ্খী মেধাবী তরুণ ইঞ্জিনিয়ার যিনি যোগ্যতাবলেই একটা প্রথমসারির প্রতিষ্ঠানে চাকরী পেয়েছেন, তাঁকে ভেঙেচুরে দিতে আর কি লাগে !