যুদ্ধ জারি !
ভেঙেচুরে যাচ্ছিলেন সুব্বি। ১২ই জানুয়ারী ডঃ মণীন্দ্রকে লেখা ই-মেইলে উনি জানতে চান কেন ওঁকে এই ভাবে অপদস্থ হতে হচ্ছে ! এমনটা কি নবাগত সকলের সঙ্গেই ঘটে না কি ওঁর জন্যই এই বিশেষ ব্যবস্থা ? বলা বাহুল্য এর উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না অধিকর্তার। কিন্তু ১৯শে জানুয়ারী যখন সুব্বি-র স্ত্রী শ্রাবন্তী ডঃ আগরওয়ালকে দীর্ঘ ই-মেলে সুব্বি-র মানসিক অবস্থার কথা জানিয়ে এই বিষয়ে কিছু করতে লিখলেন, ডঃ আগরওয়াল তখন আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। উনি সুব্বি ও শ্রাবন্তীর কাছ থেকে পাওয়া এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে খুব তাড়াতাড়ি একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করলেন। ব্যাপারটা শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। কারণ যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা সবাই প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও সম্মাননীয় শিক্ষক, এবং পারস্পরিক বন্ধুস্থানীয়ও বটে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাই আব্দুল কালাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রাখা হল। প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে একজন ও বাইরে থেকে সংরক্ষিত শ্রেণীর একজন বিজ্ঞানীকেও এই কমিটিতে রাখা হল। কিন্তু বিপক্ষের ভান্ডারে আরো কিছু অস্ত্র তখনও বাকি ছিল।
উরুভঙ্গম
অনুসন্ধান কমিটি তাদের মতামত জানাতে শুরু করার আগেই আবার একটা আঘাত এল। ১লা ফেব্রুয়ারি সেনেটের ১৮০ জনেরও বেশি সদস্যের কাছে একটা ই-মেল পৌঁছল, যার শিরোনাম ছিল “দশ বছর আগেকার অভিশাপ ফিরে এল’। এই মেলে সুব্বি-র এম-টেকের ফলাফল নিয়ে মিথ্যে অভিযোগের সঙ্গে তাঁর নিয়োগের গোটা ব্যাপারটাকে একটা কলঙ্ক বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনিতে কুৎসা রটানো ব্যাপারটাই খুব কুৎসিত কিন্তু সংরক্ষিত (দলিত) শ্রেণীর একজনের নিয়োগকে কলঙ্ক বা অভিশাপ বলে রটানোর অভিঘাত কিছু অন্যরকম। এই মেল কিছুক্ষণের মধ্যেই সুব্বি-র কাছে পৌঁছে যায় এবং এই প্রথম উনি অধিকর্তার কাছে ‘জাতীয় তফশিলি জাতি কমিশন’-এর কাছে অভিযোগ জানানোর অনুমতি চাইলেন এবং কয়েকদিনের মধ্যে অভিযোগ জানিয়েও ফেললেন। অধিকর্তা সুব্বি-র অভিযোগটা অনুসন্ধান কমিশনের কাছে পাঠালেন আর বিভাগীয় প্রধান অভিযোগটা তফশীলি জাতি কমিশনে পাঠিয়ে দিলেন। কমিটি তাদের রিপোর্ট দিতে শুরু করার আগে চেয়ারম্যান চাইলেন আর একবার সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা উচিৎ। কারণ এর পর ব্যাপারটা আর মিটিয়ে ফেলার পর্যায়ে থাকবে না। সেই মর্মে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ডঃ মণীন্দ্র ও ডিন এরোস্পেস বিভাগের প্রফেসরদের সঙ্গে বসে পরিস্থিতিটা তাঁদের বুঝিয়ে বলে সুব্বি-র কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে বললেন। যথারীতি কেউই রাজী হলেন না। প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন প্রাক্তন শিক্ষক প্রফেসর কৃপা শঙ্করকে এনে চেষ্ট করা হল কিন্তু পরিস্থিতি একটুও অনূকুল হল না।
এই সময়ে সুব্বি-র স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে কানপুরে চলে এসেছেন। সুব্বি তখন সম্পূর্ণভাবে একজন ভেঙে পড়া মানুষ, তাঁর নিরাপত্তার জন্য দুজন সর্বক্ষণের নিরাপত্তাররক্ষী নিয়োগ করতে হয়েছে। তাঁর ওপর একের পর এক আঘাত আসছে। রাস্তায় দেখা হলে কেউ কথা বলে না, ছাত্ররা আড়াল থেকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করে। মিডিয়ায় এই ঘটনার প্রথম রিপোর্ট বেরোলে তাতে আর সকলের নাম গোপন রেখে সুব্বি-র নামটা ফাঁস করে দেওয়া হয়। যার ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে রাস্তায় ঘাটে যে কেউ এমনকি নিরাপত্তা রক্ষীরাও তাঁকে ডেকে জানতে চান ব্যাপারটা কি। সুব্বি ও শ্রাবন্তী রাতের অন্ধকারে ছাড়া বাইরে বেরোন বন্ধ করে দিলেন। এই সময়ে ডঃ মণীন্দ্র সুব্বির পাশে ছিলেন, তাঁর বাড়িতে গিয়ে নানারকমের কথা বলে তাঁকে উৎসাহিত করতেন, কিন্তু এই ঘটনার বিষয়ে একটিও কথা বলতেন না।
এতকিছু সত্ত্বেও প্রথম সেমেস্টারে ছাত্রদের কাছ থেকে সুব্বির বিষয়ে খুব ভালো মতামত পাওয়া গেল। এর মধ্যে সুব্বিও কিছুটা সামলে নিয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছেন। ঘুড়ির মত দেখতে তাঁর নতুন উদ্ভাবন ‘ডানা’। হতাশার মধ্যেও একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সিদ্দিকি কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পেল। বিচারক চারজন প্রফেসরকে কর্মক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও তফশীলি জাতি/উপজাতি সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন করার অপরাধি দোষী সাব্যস্ত করে এই রিপোর্ট তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং একই সঙ্গে সুব্বিকে তাঁর শান্ত ও সংযত আচরণের জন্য প্রসংশা করেছেন। এই রিপোর্টের ফল হিসেবে বোর্ড অফ গভর্ণরস্-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনজন অভিযুক্ত প্রফেসরের কর্মক্ষেত্রে অবস্থান একধাপ নামিয়ে দেওয়া হল, একজনকে তিরস্কার করে ছেড়ে দেওয়া হল।
কিন্তু সুব্বির যন্ত্রণার শেষ হল না। বিভিন্ন সময়ে এক একটা উড়ো মেল বা অভিযোগ আসতে লাগল আর তাঁকে নিয়ে অবাঞ্ছিত আলোচনা ঘুলিয়ে উঠতে থাকল। এইরকম একটা মেলে প্রচুর লোকজন দাবী করলেন তাঁর পি এইচ ডি থিসিস টুকে লেখা, কেউ বলল এম টেকের থিসিসও টোকা, অতএব সব ডিগ্রী ফিরিয়ে নেওয়া হোক। আবার অনুসন্ধান হল, দেখা গেল থিসিসের যে অংশে আগের কাজের আলোচনা হয়, সেই অংশের কিছুটা আগের একটা থিসিসে আছে কিন্তু নিজস্ব কাজ ও তার ফলাফলের অংশটা পুরোটাই নতুন। অভিযোগ ধোপে টিকল না। ঠিক একবছরের মাথায়, যখন সুব্বি-র চাকরী পাকা হবার (কনফার্মেশন) সময়, ঠিক তখন কিছু ছাত্র দাবী করল সুব্বি সিলেবাস সবটা পড়াননি, দেখা গেল যতটা পড়াবার কথা ততটা তো পড়িয়েছেনই, আগে-পরেও কিছু পড়িয়েছেন। এই ভাবে উত্যক্ত করা চলতেই থাকল।
অবশেষে কাজে যোগ দেবার ৩২২ দিনের মাথায় (১৮ই নভেম্বর, ২০১৮) সুব্বি যাবতীয় উড়ো মেল ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করলেন এবং লড়াইয়ের মাঠে পূর্ণশক্তিতে নেমে পড়ার উদ্দেশ্যে একজন উকিলও নিযুক্ত করলেন। আই আই টি ক্যাম্পাসে ঝড় বয়ে গেল। ক্যাম্পাসের ভেতরে পুলিশ আসার সম্ভাবনার প্রতিবাদে মিছিল, ধর্ণা ইত্যাদির মধ্যে অভিযুক্ত চারজন প্রফেসর এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে পুলিশি তদন্তের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ ও বার করে ফেললেন। সেই মামলা এখনও চলছে।
শেষ ছোবল !
কিন্তু বিষাক্ত সাপ তার ছোবল দেওয়া থামায় নি। সুব্বির থিসিস এর মুখবন্ধ অংশে সামান্য মিল পাওয়া গেছিল আগের একটি থিসিসের সঙ্গে। এই রকম ‘নৈতিক’ (এথিক্যাল) বিতর্কের সমাধান করার জন্য যে কমিটি আছেন, তাঁরা রায় দিয়েছিলেন যে এই সামান্য মিল নেহাৎই ক্ষমার্হ, আর এটা কাজের আসল অংশেও নয়, মুখবন্ধে। এর জন্য ডিগ্রী কেড়ে নেওয়া এইসব দরকার নেই, ওই অংশটুকু (একটা-দুটো অনুচ্ছেদমাত্র) আবার লিখে একটা দুঃখপ্রকাশের চিঠি লিখে জমা দিলেই যথেষ্ট হবে। সুব্বি সে সব দাবি মেনে নিয়ে তৎক্ষণাৎ সব কাজ সেরে ফেললেন; কিন্তু ১৪ই মার্চ, ২০১৯ প্রতিষ্ঠানের সেনেটের অধিবেশনে সুব্বি-র ডিগ্রী ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি ৪২-১৫ ভোটে পাশ হয়ে গেল। এই নির্দেশ কার্যকরী হলে সুব্বি-র চাকরী চলে যাওয়া নেহাৎ-ই সময়ের অপেক্ষা। অর্থাৎ আই আই টি কানপুরকে ‘কলঙ্ক’মুক্ত করার পথে শুভাকাঙ্খীরা কিছুটা এগিয়ে যাবেন, কারণ এখানে ৩৯৪ জন শিক্ষকের মধ্যে সংরক্ষিত (তফশীলি জাতি / উপজাতি / দলিত) শ্রেণীর প্রতিনিধি মাত্রই চারজন ! তবে শেষ পাওয়া খবর অবধি, প্রতিষ্ঠান এখনো সুব্বি-কে তাঁদের সিদ্ধান্ত জানাননি।
সুখের কথা এটাই যে এই ঘটনার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন সারা ভারতের শিক্ষিত সমাজ, বাইরেরও কিছু মানুষ। ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি ঘুরছে আন্তর্জালে, যাতে সই করেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অশোক সেন সহ সারা ভারতের বিভন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। সবাই সরব হয়েছেন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানীর সঙ্গে ঘটে চলা অন্যায়ের সঙ্গে, যিনি তরুণ জন্মসূত্র দলিত।
বিশ্বাসের অপমৃত্যু
এই ঘটনা আমাদের অনেকগুলো ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কিছু বিশ্বাসের মূলেও আঘাত করে। প্রথমতঃ আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থার ব্যর্থতা। একজন নিরপরাধ তরুণ, সে প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল, এক বছর ধরে কষ্ট-অপমান-উদ্বেগ সহ্য করেছিল এই বিশ্বাসে যে তার বিশ্বস্ততাই তাকে রক্ষা করবে। করল না। শেষ অবধি তাকে আইনের আশ্রয় নিতে হল। দ্বিতীয়তঃ মানুষ যত শিক্ষিতই হোক পরশ্রীকাতরতা তার যাবতীয় জ্ঞানের গরিমা, তার মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিতে পারে আর তৃতীয়তঃ আমরা যতই বড়াই করি যে মেধাই আমাদের একমাত্র মাপকাঠি, আসলে জন্ম-ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ অনেক পরিচয়ই আমাদের কাছে গুরুত্ব পায়।
যদি মেধা, দক্ষতা ও বিভিন্ন বিষয়ে ফলাফলের কথা ধরা হয় তাহলে বলতেই হয় সুব্বি এমন একজন ছাত্র যিনি নিজেক বার বার প্রমান করেছেন। উনি যে বিষয়ে কাজ করেন কানপুর আই আই টি তে তেমন কাজের অভিজ্ঞতা প্রায় কারুর নেই। পি এইচ ডি শেষ করার পর উনি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববদ্যালয়ে দু-বছর গবেষণা করেছেন। এখনও যে কোনো সময়ে উনি সেখানে গিয়ে কাজ করতে চাইলে তাঁরা নিজের খরচে সুব্বি-কে নিয়ে যেতে রাজী। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ২০১৮-য় একবার উনি কোরিয়ায় কাজ করেও এসেছেন; সেই কাজের ফলাফল এরোস্পেসের খুব নামকরা জার্নালে গবেষণাপত্র হিসেবে প্রকাশিতও হয়েছে। সুব্বি-র পি এইচ ডি-র সময়কার একটা কাজ (মানে তাঁর উদ্ভাবন করা একটা পদ্ধতি) টাটা স্টিল তাদের কিছু UAV-র ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, সেনাবাহিনীর কাজেও যেটা ব্যবহার হয়। একটা অন্তর্জাতিক সম্মেলনে সুব্বি সবচেয়ে ভাল পেপারের পুরস্কার পেয়েছেন। আই আই টি তে যোগ দেওয়ার পর থেকে যাবতীয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উনি যে ভাবে পড়ানো-গবেষণা-পেপার লেখা চালিয়ে গেছেন তাও খুব কম লোকই করতে পারেন। আর এই সব কিছুই প্রমাণ করে যে সুব্বি প্রকৃতই একজন উপযুক্ত ব্যক্তি যিনি জন্মসূত্রে পাওয়া মেধার সদব্যবহার করে ও সামাজিক প্রকূলতাকে জয় করে নিজেকে সর্ব অর্থে যোগ্য করে তুলেছেন। আমরা তাঁকে নিজের জীবনে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত ও স্বমহিমায় এগিয়ে যেতে দেখতে চাই। আমরা অপেক্ষা করছি।
(শেষ)