দেশপ্রেম নামক ন্যারেটিভটি একেবারেই হাসির জিনিস নয়, বরং সিরিয়াস আলোচনারই যোগ্য। কিন্তু গত পাঁচ বছরে, বিশেষ করে ২০১৯ এর প্রথম কয়েক মাসে গোটা পৃথিবীর সামনে এই শব্দটিকেই প্রহসনে পরিণত করে ফেলেছে ভারত সরকার। প্রহ্সন, কারণ, ব্যাপারটা একাধাধারে ট্র্যাজিক এবং হাস্যরসাত্মক। এই অদ্ভুত প্রহসন নিয়েই এই লেখা। ২০১৯ এর কিছু ঘটনার প্রতিবেদনের আদলে লেখা। প্রতিবেদনগুলি একটিও সত্যি নয়, কিন্তু প্রহসন এরকমই হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারিঃ ভারতীয় সেবক সঙ্ঘের বিশেষ অপারেশন গতকাল কলকাতার জানবাজার সীমান্তে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা এখনও নিশ্চিত করে জানা যায়নি। পুলওয়ামার আক্রমণের পর থেকেই পশ্চিম-সীমান্ত বাদ দিয়ে দেশের সর্বত্র যুদ্ধ চলছে। ফেসবুক ও টুইটারে সংঘর্ষের খবর সবচেয়ে বেশি। একমাত্র পাকিস্তান সীমান্ত খুবই বিপজ্জনক হওয়ায় সেবকরা তাকে যুদ্ধের এলাকা থেকে বাদ রেখেছেন। এ ব্যাপারে সেবক সঙ্ঘের নেতা শ্রী গোলদেওয়ালকর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন 'কাশ্মীরে অনেক ঝকমারি, ঠান্ডা, অক্সিজেনের অভাব, কথায় কথায় গুলি চলে যায়, মানুষ মরে যায়, এমনকি ছারপোকাও আছে, ওখানে লড়াইয়ের খুব ঝকমারি। ওখানে আসল সেনারা পুরোনো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে লড়ুক, এখানে আমাদের নিজের-নিজের সীমান্ত নিজেই খুঁজে নিতে হবে।' সেই পথ অনুসরণ করে সেবকরা এ পর্যন্ত দেড়শোজন শত্রুকে ফেসবুকে বধ করেছেন। একলা কাশ্মিরিদের পিটে জখম করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কেউ শান্তি চাই বললেই বাড়ি গিয়ে হুজ্জুতি করা হয়েছে। কালকের আগে পর্যন্ত সেবকদের দিক থেকে কোনো ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ ছিলনা। বিশেষ সূত্রের খবর, কালও যে ক্ষতি হতে পারে এরকম কোনো আন্দাজ ছিলনা। দুপুরে খাস কলকাতা শহরের জানবাজার সীমান্তে এপিডিআর নামক একটি শত্রু-সংস্থা 'শান্তি-চাই' বলে মিছিল করবে বলে খবর ছিল। এই মিছিলের লোকগুলি একেবারেই শান্তশিষ্ট সুশীল, অতীত ইতিহাসে মার-ধোরের অস্তিত্বমাত্র নেই, দেশদ্রোহী হবার জন্য এর চেয়ে ভালো লোক আর হয়না। কিন্তু আক্রমণের পরমুহূর্তেই দেখা যায় হিসেব মতো কোনো কিছুই এগোচ্ছেনা। দেশদ্রোহীরা চুপচাপ মার না খেয়ে পাল্টা দিচ্ছে। এ ধরণের বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা কেউ মাথায়ই আনেনি। অনেকে বলছেন এপিডিআরের হাতে মার খাওয়া একটি বিশ্বরেকর্ড। এ ব্যাপারে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সেবকরাও এ নিয়ে কোনো মতামত দেননি। বিশেষ সূত্রের খবর, এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁদের গোপন মিটিং এ এই ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনা চলছে।
৫ ই মার্চঃ ভারত-সরকার আয়োজিত 'দেশপ্রেমের গল্প লেখ' প্রতিযোগিতায় পরীক্ষার ফলাফল গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। আদিত্যনাথ ফার্স্ট হয়েছেন। একাই ৪০০ জঙ্গী মেরেছেন। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী অর্ণব গোস্বামী ও অন্যান্য ভারতীয় মিডিয়া। তাঁরা মেরেছেন ৩৫০। তৃতীয় স্থানে অমিত শাহ। সভাপতি হয়েও ২৫০ র উপরে উঠতে পারেননি। ওদিকে সাংসদ আলুওয়ালিয়া বলেছেন জঙ্গী মারতে যাওয়াই হয়নি, ফাঁকা মাঠে বোম ফেলে ব্রহ্মতেজ দেখানো হয়েছে মাত্র। তিনি পেয়েছেন সান্ত্বনা পুরষ্কার। ভারত সরকার সরকারি ভাবে বলেছে, তারা এই জাতীয় কোনো খবর দেবেনা। সরকার পরীক্ষায় ডিসকোলি হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া অনেক চেষ্টাতেও একটিও জঙ্গীকে মারতে পারেনি। তারা কেবলমাত্র একটি কাক মেরে সর্বশেষ স্থানে।
ওদিকে অন্য পাশে আরেকটি প্রতিযোগিতা চলছে নোবেল প্রাইজ নিয়ে। ইমরান খানকে কারা যেন বিশ্বশান্তিতে নোবেল প্রাইজ দিতে চেয়েছিল। জবাবে বানর সেনা বলে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম অহিংস সার্জিকাল স্ট্রাইকের জন্য পুরষ্কারটি আসলে নরেন্দ্র মোদীরই প্রাপ্য। কিন্তু শোনা যাচ্ছে বিশ্বশান্তিতে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির মতো অবদান না থাকায় আপাতত এদের কাউকেই পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছেনা। পরিবর্তে গোটা ভারতীয় মিডিয়াকে অসম্ভব ভালো গল্প লিখতে পারার জন্য সাহিত্যে নোবেলের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জি নিউজ আর রিপাবলিকের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা। রবিশ কুমার বলেছেন, আপাতত মাস তিনেক কে জিতল সেই বিচার নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ইন্ডিপেন্ডেন্টের মতো এক্সপার্টদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। পাবলিক যেন পাকামি করে এইসব চ্যানেল না দেখতে যায়। মহৎ শিল্প ফুচকা-খাওয়া পেটে সহ্য হবেনা, ফুড পয়জনিং হতে পারে।
এবং সবশেষ খবর মাসুদ আজহারের গুষ্টির। এই গুষ্টির সকলেই অর্ণব গোস্বামী এবং ভারতীয় মিডিয়ার তীব্র আক্রমণে পটল তুলেছিল। তাদের মধ্যে দুজনকে পাকিস্তানে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম ফাঁসি হয়ে যাবার পরও অপরাধী ছাড়া পায়নি, তার সাতদিনের জেলও হয়েছে। 'বিশেষ সূত্র' থেকে জানা গেছে এটি আসলে আচ্ছে দিন এর সাফল্য। এর জন্য অবশ্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছেনা, কারণ ভুডু বিদ্যায় ওই পুরষ্কার দেওয়া হয়না।
২৯ শে মার্চঃ ভারত সরকার গতকাল বহিঃশত্রুর উপর তীব্র আক্রমণ হানতে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করেছে। উপগ্রহটি অবশ্য ভারতের নিজেরই ছিল। এ ব্যাপারে সেবকরা সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। সঙ্ঘের মুখপাত্র শ্রী গোলদেওয়ালকর জানিয়েছেন এমন একজন বীর প্রধানমন্ত্রী না থাকলে নিজেদের উপগ্রহ নিজেরাই ভেঙে ফেলা সম্ভব হতনা। এর বহুদিন আগে থেকেই এই প্রযুক্তি হাতে ছিল। কিন্তু কংগ্রেস সরকার কখনই নিজেদের উপগ্রহের উপর হামলা চালানোর সাহস দেখাতে পারেনি। জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, যে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যে, পাকিস্তানের উপগ্রহ ভাঙলে অনেক ভাল হত, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের কোনো উপগ্রহ নেই। এটিও ৫৬ ইঞ্চিরই কৃতিত্ব। নেহরু জমানা হলে এতদিন পাকিস্তান ভারতের কক্ষপথ দখল করে উপগ্রহ ছেড়ে দিয়ে মজা দেখত।
বিরোধীরা অবশ্য যথারীতি সমালোচনা করে বলেছেন, নিজের উপগ্রহ ভেঙে সরকার জনগণের পয়সা নষ্ট করল। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বিশেষ সূত্র নাম না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। উপগ্রহটি আসলে বিকল ছিল। কোনো কিছুতেই ঠিকঠাক ফোকাস করতে পারতনা। এই জন্যই পাকিস্তানে বোমারু হামলায় বাড়ির বদলে পাইনবন খতম হয়েছে। মাসুদ আজহারের বদলে মারা গেছে একটি কাক। এর দায় কংগ্রেসের, কারণ উপগ্রহটি ছোঁড়া হয়েছিল ইউপিএ জমানায়। ওই বস্তু ভেঙে তাই দেশের লাভই হয়েছে, ক্ষতি নয়। জি নিউজের এক বিখ্যাত সাংবাদিকও নাকি ঘরোয়া ভাবে জানিয়েছেন, যে, সন্ত্রাসবাদের এত রমরমা, পুলওয়ামার আক্রমণ, সবই এই বিকল উপগ্রহের কারণে। এর আগে তিনিই আমাদের খবর দিয়েছিলেন, যে নোটবন্দীর নতুন সব দু-হাজার টাকার নোটে জিপিএস ন্যানো চিপ থাকবে এবং সেগুলি স্যাটেলাইট দিয়ে ট্র্যাক করা হবে। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, এই দেশভক্ত সাংবাদিক বলছেন স্যাটেলাইট কাজ না করার ফলেই নোটের ন্যানো চিপ আর কাজ করেনি। এর দোষও ইউপিএ সরকারেরই। এই খবর শীঘ্রই তিনি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেবেন।
১১ ই এপ্রিলঃ এক নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী রইল সুপ্রিম কোর্ট। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আইনজীবীরা রাফালে প্রসঙ্গে আদালতে জানান, যে, চুক্তির নথি সব চুরি হয়ে গেছে। দেশের সামনে এখন বড় দুর্দিন। চারিদিকে চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট যেন চুরি হওয়া নথিকে গ্রহণ করে চোরকে প্রশ্রয় না দেয়। এই ব্যাপারে আদালত চুরির প্রমাণ পেশ করতে বললে সরকারপক্ষ কয়েকদিন সময় চেয়ে নেয়। আজই ছিল সেই প্রমাণ পেশ করার দিন। সরকারি আইনজীবি চুরির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, যে, শুধু রাফাল নয়, শাসক দলের আস্ত ওয়েবসাইটও চুরি হয়ে গিয়েছিল। বারো-চোদ্দদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই হারানো ধন উদ্ধার করা গেছে। সেখানেই শেষ নয়। নতুন ওয়েবসাইটের কোডও নাকি চুরি করা, এই নিয়েও আবার অভিযোগ এসেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে চুরি ব্যাপারটা দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ওয়েবসাইটেই শেষ নয়, দেশের মানসম্মানও চুরি গেছে। বিদেশী সংবাদপত্ররা একযোগে বালাকোট হামলা নিয়ে হাসাহাসি করে ভারতের সম্মানহানি করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, চুরি একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্তও। এ চক্রান্ত শুধু আজকেরও নয়। এর আগেও দেশ থেকে সব কালা ধন চুরি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত নোট বাতিল করেও তার এক কানাকড়িও উদ্ধার করা যায়নি। সেই কারণেই এই প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। মহামান্য আদালত যেন চুরিকে প্রশ্রয় দিয়ে নথি গ্রহণ না করেন।
এই সওয়ালের পরে তিন বিচারপতির বেঞ্চ সরকারি আইনজীবিকে প্রশ্ন করেন, চুরি ঠেকানোর জন্য কী করা হচ্ছে। জবাবে আইনজীবি বলেন দেশ জুড়ে ইতিমধ্যেই অজস্র চৌকিদার নিয়োগ করা হয়ে গেছে। তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিচারপতিরা দেখতে চাইলে তিনি দেড়হাজার চৌকিদারের একটি তালিকাও আদালতের হাতে তুলে দেন। এরপর বিচারপতি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন, সরকারের তরফে এত সতর্কতা অবলম্বন করা হলেও চুরিটা হচ্ছে কীকরে? জবাবে আইনজীবি বলেন, 'কারণ সর্ষের মধ্যেই ভূত স্যার, চৌকিদারই চোর'।
এই বিবৃতির পর দেশজুড়ে আলোড়ন পড়ে গেছে। পরবর্তী শুনানির আগে আদালত এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট চেয়েছেন। রিপোর্ট ও তার ফলাফল জুন মাসের আগেই চলে আসবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের খবর। আর তার আগেই চলে আসবে গণা আদালতের বিচারের ফলাফলও।