এক জটিল রেখার খোঁজে
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বেশ কিছুকাল আগে। তখন ধরণী ছিল কাঁচা, আকাশ ছিল সবুজ আর সূর্য ছিল সজল। সেই অপাপবিদ্ধ সকালে এক সরলা বালিকা তার পিতামাতার খাটে, তোষকের তলায় নিরোধের মোড়ক আবিষ্কার করে ফেলেছিল। তারপর থেকে আর কখনো তেমনো সকাল হয়নি।
এমন করে সেই খাটে জটিলতা জন্মায়। এবং সে বালিকার কানে ফুস মন্তর দিতে শুরু করে –আসলে তো কেউ বড়ো নয় তাহলে, কেবল বড়োর মতো দেখায়! বালিকা বিপন্ন বোধ করে, কারণ তার আগেই সে ইস্কুলে প্রবল ঝগড়া করেছে প্রানের বন্ধুর সঙ্গে - তার মা-বাবা . . . জাস্ট হতে পারেনা!
‘তোমার ব্যাপারটা আমি জানি না ভাই, কিন্তু আমার মা-বাবা মোটেই ওসব করেনি, কক্ষনো না!’ এক বন্ধু, সে আবার উকিল – আপাত গম্ভীর মুখে কালো কোটের বোতাম আঁটতে আঁটতে বলেছিল। ওমনি হাসির ঝড় বয়ে গেছিল আকাদেমির সারা চত্বর জুড়ে। সেদিন, ১১ই ডিসেম্বর, ২০১৩ আমরা জমা হয়েছিলাম অনেক মানুষ একসাথে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করতে। সেখানেই রাগ, দুঃখ, হতাশা, ঘৃণা – এর সাথে সাথে টুকরো টাকরা হাসি মজাকও চলছিল। একদল উদ্ভিন্নযৌবন মানুষ হইহই করে স্লোগান দিচ্ছিল – ‘কে কার সাথে শোবে / সুপ্রিম কোর্ট বলে দেবে? / কে কেমন করে শোবে / সুপ্রিম কোর্ট বলে দেবে?’ মা যদি থাকতেন এখানে তাহলে বোধহয় পৃথিবীকে দ্বিধা হতে বলতেন, যদি জানতেন এইসব স্লোগানের পিছনে আছে তাঁর মেয়েটিও, তবে কী করতেন জানিনা, ভাবতেও পারিনা! সরলা বালিকা, যে এখন জটিলা নারী, আচমকা তার মনে পড়ে গেছিল সেই সকালের কথা – সেই আসলে কেউ হয়না বড়ো-র নিমপাতাবাটা শিক্ষা।
মা - সব সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রমহিলার মতো তাঁর একমাত্র সন্তানটিকে কুকথা, কুশিক্ষা, কুসঙ্গ, কুঅভ্যাস, থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন। আর কামের থেকে বড়ো ‘কু’ আর কীই বা আছে! যেদিন তাঁর সঙ্গে যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার সময় হল সেদিন বুঝিয়ে বলেছিলেন যৌনতার সঙ্গে ভালোলাগার কোনও সম্পর্ক নেই, ভালবাসার সঙ্গে তো নেইই। যৌনতা একটা কাজ, সেটা করতে হয় সন্তানের জন্য। আসলে মাও তাঁর রক্তের মধ্যে বহন করে নিয়ে চলেছিলেন পূর্বজন্মের স্মৃতি, শরীরকে অবিশ্বাস করে চলতে শিখেছিলেন, কামনাকে অবিশ্বাস করে চলতে শিখেছিলেন, পুরুষকে অবিশ্বাস করে চলতে শিখেছিলেন(একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ তাঁর স্বামী, মেয়ে তো আর সেই পুরুষটিকে পেতে পারে না)। তাই নিজের মেয়েকে মাতৃধন হিসাবে তিনি দিয়েছিলেন অবিস্বাসের পরম্পরা।
এ কিছু নতুন কথা নয়, এইসব টুকিটাকি নিয়েই মায়েরা ও মেয়েরা বড়ো হয়, তারা কামচর্চাও করে, প্রজননহীন যৌনতাও। আমার মাও তোশকের তলায় নিরোধ রেখেছিলেন সন্তান চাননি বলেই। তবু ভেবে দেখলে যৌনতা নির্ধারিত হয়ে চলে ছেলেপুলে হওয়া দিয়েই, না হওয়াটাও তো হওয়ারই উলটো পিঠ। কিন্তু যখন কামের সঙ্গে সন্তানের আদপেও কোনও সম্পর্ক থাকে না, সন্তান না হওয়াবার জন্য কোনও ব্যবস্থাও নিতে হয়না এমনকি, কাম তখনই বোধহয় নখদাঁত খিঁচিয়ে চোখের সামনে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। তখন তাতে বড়ো ভয় পাই।
প্রথম যে অবস্থানটার কথা বলেছিলাম ভয় ছিল সেখানেও। সে ভয়টাও সন্তানকেন্দ্রিক। একদিকে যেমন কামের একমাত্র প্রয়োজনীয়তা হিসাবে প্রজননকে সামনে রাখতে হয়, অন্যদিকে আবার সেই প্রজননটাই মেয়েদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় – যেই তার শরীর প্রজনন উপযোগী হল ওমনি তাকে ঢেকেঢুকে বেঁধেছেঁদে রাখাতে হয় নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে।
সরলা বালিকাটির দুধের গন্ধ মাখা শরীরে শয়তান বাসা বেঁধেছিল তাই সে ন’বছরেই ‘বড়ো’ হয়ে যায় – মানে আসলে আর নকলে তাকে বড়োর মতো দেখাতে থাকে। মা বলেন ‘খারাপ মেয়েদেরই এতো তাড়াতাড়ি মাসিক হয়’ – আর সেই মাতৃবাক্য শিরোধার্য করে বালিকার জীবন চলতে থাকে নানাবিধ সিঁড়ির তলায় নানা চেনা-অচেনা মানুষের আবাহনে। এই শরীরকে নাড়তে, চাটতে, শুঁকতে, ঘাঁটতে আসা মানুষজনের হাতে হাতে। মা ট্রাম-বাসের দমবন্ধ ভিড়ে আমার দম আরও বন্ধ করে চেপেচুপে আটকে রাখেন আমার শরীর লুঠ হয়ে যাবার ভয়ে; আমি খারাপ মেয়ে বলে ভিড় ঠেলে নেমে ফোঁস ফোঁস রাগ করে রাস্তার অচেনা মানুষদের সামনে চেঁচিয়ে বিপ্লব করি – আমাকে ওরম চেপে ধরছিলে কেন? আমি কি তোমার মানিব্যাগ? মা জানতেও পারেননা ক্রমশ মানিব্যাগ গলে খুচরো পয়সার মতো আমি হরির লুঠ হয়ে যেতে থেকেছি!
সরল এভাবেই জটিল হয় আর একবার জটিল হয়ে গেলে তার আর ফিরে আসার উপায় থাকেনা যেমন একবার দুপায়ের ফাঁকে থাকা ইজ্জত চলে গেলে আর তা ফিরে পাবার উপায় নেই। তাই সরলা বালিকাকে সোজা সাপটা নারী হয়ে উঠতে বলা হয় এবং ক্রমশ সংসারসন্তানধর্ম পালনের সরলরেখাটিকে ধরে একদিন তাকে শুয়োরের মাংস করে দেওয়া হয় পরম সারল্যে। বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় যে কোনও বিপন্ন-বিস্ময় তার কম্মো নয়, নয় কোনও প্রগাঢ় জটিলতা।
সরলের বাইরে যা থাকে তা বক্র, কুটিল, নচ্ছার এবং ক্যুয়ার। আর এটাই হল পরম ভয় – যা বোধহয় ইজ্জত লুঠের থেকেও বড়ো, সন্তান (অ)কামনার থেকেও তীব্র। কেননা কিছু দিয়েই আর আমাকে বাঁধা যাচ্ছে না। ‘বাঁধা যাচ্ছে না’-টাই অপারেটিভ শব্দ কারন আয়োজন যা তা সব বাঁধারই জন্য।
সরলা মেয়েটি একদিন মায়ের দেওয়া ‘খারাপ মেয়ে’ সরতাজ মাথায় নিয়ে সরল থেকে জটিল/ক্যুয়ার হয়ে পড়েছিল আর তাকে ক্যুয়ার হয়ে যেতে দেখে দ্বীন-দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল। আর তার জটিলতাও তো শুধু একরকম নয় - পা ফাঁক করে বসতে চাওয়া নিয়ে সে জটিলতার শুরু হয় যদি, পুরুষবন্ধুর দঙ্গলের সঙ্গে পাহাড় চড়তে চড়তে সে তবে পথ হাঁটে, প্রাকবৈবাহিক কামকলায় তার বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটে। আর এসবের পরেও, জীবনের প্রায় তিনেরদুইভাগ নিজেকে বি-সমকামী জেনে কাটিয়ে ফেলার পরেও, আবারও একবার আপাদমস্তক নারী আমি আরেক আপাদমস্তক নারীকে প্রানের দোসর বলে চিনে নেবার জটিল স্পর্ধা রাখি। ক্যুয়ারনেস আমার নরকারোহনের সঙ্গী, অনুসরণ করে চলেছে আমাকে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, যতই মা আমাকে সরল সিধে জীবনের নিয়ম শেখান না কেন!
সুপ্রিম কোর্ট আমার মতো মানুষদের শায়েস্তা করতে হুঙ্কার ছেড়েছিল ১১ই ডিসেম্বর ২০১৩, মানবাধিকার দিবসের ঠিক পরের দিনটাতেই – ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বলবত থাকবে এবং এই ধারা অনুযায়ী সমকামী যৌনতাচর্চা দণ্ডনীয় অপরাধ হয়েই থাকবে।
তবে কি বলব মা-ই ঠিক ছিলেন, আমি ভুল? আমাকে বাঁধার প্রয়োজন আছে এবং সে প্রয়োজন রাষ্ট্রও স্বীকার করে নিচ্ছে? তবে কি বলব আইন করে রাষ্ট্র ঠিক করে দেবে আমি কার সঙ্গে কেমন জীবন কাটাবো? সমকামী অর্থাৎ ভুল? সমকামী অর্থাৎ বিকৃত? সমকামী অর্থাৎ অসুস্থ, অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃত? দিল্লী হাইকোর্ট ২রা জুলাই, ২০০৯ এর রায়ে বলেছিলেন ৩৭৭ ধারাটি ভারতীয় নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে, বিশেষ করে সংবিধানের ১৪, ১৫ আর ২১ ধারায় ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত যা কিছু তার বিরোধিতা করছে এই আইন। চার বছরের মধ্যে আমার সাংবিধানিক অধিকারের মানে কি তবে বদলে গেলো?
না। এসব কিছুই নয় আসলে। আমরা জানি রাষ্ট্র যা কিছুকে বাঁধা যায় না তাকেই ভয় পায়। নিজে ভয় পায় বলেই ভয় দেখাতেও চায়। ৩৭৭ ধারা আ আসলে একটা জুজু, তাকে দিয়ে শাস্তি বিধানের তুলনায় ভয় পাওয়ানোর কাজটা হয় বেশি। এতো ফাঁপা আইন দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না আমাদের, আমরা যারা কামকে ভয় পেতে শিখিনি, যৌনতাকে লাভের জন্য ব্যবহার করতেও শিখিনি, আমরা যারা যার যার মায়ের কাছে ‘খারাপ মেয়ে’ হয়েছি নানা সময়, নানা কারণে। আমরা জানি এশুধু কয়েক মাস বা বছরের অপেক্ষা, আইন বদলাবেই।
যা নিয়ে ভাবছি তা অন্য – যেদিন রাষ্ট্র সমকামী মানুষের অধিকার মেনে নেবে বা নিতে বাধ্য হবে, সেদিন যত ক্যুয়ার, বক্র, নচ্ছার, সমকামী-মূল-স্রোতের বাইরে থাকা জটিলারা তাদের মতো জায়গা পাবে তো?
সুমিতা স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্য