গৌরচন্দ্রিকা
বিপ্লব ও যৌনক্রিয়ার মধ্যে আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কি? থাকলে কী ভাবে? কী সেই সম্পর্ক? বলা মুশকিল। তবে শোভা দে বলেছেন -- লেখনক্রিয়া আর যৌনক্রিয়া প্রায় একই। লিখতে গিয়ে আমরা আবেগের সঙ্গে কলমের নিব দিয়ে সাদা পাতায় আঘাত করি, ঝরে পড়ে কালি। সৃষ্টি হয় নতুন রচনার। সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু বিপ্লব? আমাদের মানসপটে যে বিপ্লবের সঙ্গে ভায়োলেন্সের ব্যাপারটা জড়িত। বাঙালি মননে অহিংস-বিপ্লবী আর কাঁঠালের আমসত্ত্ব যে প্রায় একই জিনিস। কিন্তু হিংসার সঙ্গে যৌনতা? যৌনমিলনরত নারীপুরুষের আবেগের মাঝখানে হিংসা আসছে কোত্থেকে? একি মাকড়সা না মৌমাছি যে মিলনের পর নারী তার প্রণয়সঙ্গী পুরুষকে খেয়ে ফেলবে বা হত্যা করবে?
আচ্ছা, এবার রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই লাইনটি দেখুনঃ
মরণ আলিঙ্গনে
কন্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে।
দংশনক্ষত শ্যেন-বিহঙ্গ জুঝে ভুজঙ্গ সনে।
ভাবুন, যদি আগের লাইন "মোগল-শিখের রণে" না বলা হয় তাহলে উপরের পংক্তি কয়টি কী অনায়াসেই তীব্র আশ্লেষে মিলনরত নারীপুরুষের কাব্যিক বর্ণনা হতে পারে।
এবার একটু বিপ্লবীদের নিয়ে কথা।
অগ্নিযুগের রোল মডেল ছিলেন বঙ্কিমের "আনন্দমঠে"র সন্তানদলের সদস্যেরা। আর বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে সন্তানদলের সদস্যদের আচরণবিধিতে রেখেছেন লক্ষ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্য্যন্ত ব্রহ্মচর্য্য পালন করা, দরকার হলে আজীবন। এই পিরিয়ডে কোন নারীর সঙ্গে একাসনে বসে বাক্যালাপ ও নিষিদ্ধ; সেই নারী ওনার বিবাহিত পত্নী হলেও! শপথ ভাঙলে শাস্তি ছিল মৃত্যু। কিন্তু বঙ্কিম পট বয়লার বা প্যাম্ফলেটিয়ার নন, রীতিমত বাস্তব জীবনের জমিতে পায়ে হেঁটে চলা লেখক। তাই উপন্যাসের অন্যতম নায়িকা শান্তির কন্ঠে গান বসিয়েছেন -- "এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে, হরে মুরারে!"
আমরাও বলি-- হরে মুরারে!
আসুন, আমরা এর কারণ হিসেবে একটি নারীবাদী আখ্যান দেখি।
একথা নতুন করে বলার দরকার নেই যে বঙ্কিমকে বলা হত বাংলার ওয়াল্টার স্কট। কারণ ওনার শুরু করা ঐতিহাসিক রোমান্সের প্যাটার্নটি অবশ্যই স্কটের "আইভান হো", "রব রয়" এগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। ইউরোপীয় পরম্পরায় নারী তো সেই আদিজননী ঈভের সময় থেকেই পুরুষের পতনের নিমিত্ত কারণ হয়ে এসেছে। তাই পবিত্র ব্রত সুসম্পন্ন করতে নাইটদের ব্রহ্মচর্য্য পালন করতেই হবে। রাজা আর্থারের রথীদের দেখুন, অথবা শেক্সপীয়রের হ্যামলেটকে। প্রেমে ধর্মসংকটে প্রায় হ্যামলেটের মতই আধপাগল ওফেলিয়াকে অনায়াসে হ্যামলেট বলেন --"গো টু নানারি! বেশ্যালয়ে যাও।" ভয় নিজেকে, পাছে "যৌবনজলতরঙ্গ" রোধ করা অসম্ভব হয়ে যায়। তাই ভারতীয় পরম্পরাতেও "নারী নরকের দ্বার"। হিন্দুনারী ঘরের মধ্যে পুরুষের সহধর্মিনী বটে, কিন্তু ঘরের বাইরে বিশাল কর্মক্ষেত্রে আদৌ নয়। সেজন্যেই বঙ্কিমের ব্যতিক্রমী বা বিদ্রোহী নারীচরিত্র গুলোরও শেষ পরিণতি হয় ঘরকন্নায় ফিরে যাওয়া( দেবী চৌধুরাণীর প্রফুল্ল, আনন্দমঠের শান্তি) নয় মৃত্যুকে বরণ করা (কৃষ্ণকান্তের উইলের রোহিণী, বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী ইত্যাদি)।
অতএব, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের জন্যে যৌনতা ছিল ফোর লেটার ওয়ার্ড। নীরদ সি চৌধুরি ওনার "বাঙালি জীবনে রমণী" বইয়ে শুনিয়েছেন যে ওনার ছোট ভাই একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিল। গীতা পড়ত, লুকিয়ে একটি ছোরা রাখত আর ডায়েরি লিখত। অনুশীলন দলের দাদাদের আদেশে ওনাকে ডায়রিতে বিভিন্ন পাপের ছককাটা ঘরে এন্ট্রি করতে হত। তার মধ্যে একটি ছিল রূপতৃষ্ণা। একদিন পিতৃদেবের ছোট ছেলের ডায়েরির পাতায় চোখ পড়ল। তাতে "রূপতৃষ্ণা'র ঘরে বারবার ঢ্যাঁড়া দেখে মহাচটিতং হয়ে ছেলের স্বদেশী আখড়ায় যাওয়াই বন্ধ করিয়ে দিলেন।
মনে রাখতে হবে ভারতে বা বঙ্গদেশে কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরাও একই ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। অনেক আদি কমরেডই এসেছেন কালাপানি ফেরত হয়ে, নারী সম্বন্ধে একই দৃষ্টির ধারাবাহিকতা নিয়ে। ফলে কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ বাদ দিলে তাঁদের অধিকাংশের জীবনসঙ্গিনীরা তাঁদের কর্মসঙ্গিনী নন। তাঁদের ভূমিকা ঘর সামলানো, ছেলেপুলে মানুষ করা। মনে হয়, "যে কোন সফল পুরুষের সাফল্যের অন্তরালে একজন নারীর ভূমিকা থাকে"-- এই আপ্তবাক্যটি আসলে এই পুরুষবাদী মানসিকতারই ফসল। ভেবে দেখুন, এখান থেকে হিটলারের "নারীর আসল জায়গা হল রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর" বক্তব্যে পৌঁছতে আর কয় পা হাঁটতে হবে?
তাই রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকাংশই হয় ব্যাচেলর, নয় ঘরে বৌকে রেখে আসা যুদ্ধক্ষেত্রে "চিট্ঠি আয়ী রে" গুনগুন করতে থাকা সোলজার। হ্যাঁ, তাঁরা সবাই সৈনিক, সবাই রণক্ষেত্রে; কেউ স্বাধীনতাসংগ্রামী, কেউ লড়ছেন সমাজবাদের জন্যে, কেউ বা সাম্যবাদের। এখন কেউ যদি বলেন - মশাই, গোটা বিশ্বে ইসলামী ন্যায়ের রাজ্যস্থাপন বা সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে মার্কিনী ধাঁচের গণতন্ত্র রক্ষায় যাঁরা তাদের কেন বাদ দিলেন? ওদের যৌনতার সমস্যা কি কিছু আলাদা? ওদের লিঙ্গের দৈর্ঘ্য বা মানসিক ফিক্সেশন ইত্যাদির ব্যাখ্যার জন্যে কি আর একজন ফ্রয়েড, এলিস বা ইয়ুং চাই? তাহলে কিন্তু-কিন্তু করে বলব, - না, আলাদা হওয়ার তো কথা নয়। আমার বক্তব্য সাধারণতঃ আদর্শের জন্যে নিজের জীবনপণ করে যাঁরা লড়ছেন তাঁদের সবার জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। এখন সে আদর্শটি কেমন, খায় না মাথায় দেয়,সে কথা স্বতন্ত্র। তাই এই গোরু-রচনাটি অগ্নিযুগের বিপ্লবী থেকে আজকের নক্সালপন্থী বা মাওবাদী, অথবা ইসলামী সমাজতান্ত্রিক-- সবার মাথার ভেতরে ফুটোস্কোপ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা। ভাড়াটে সোলজারদের( মহাভারতের নারায়ণী সেনা) কথা আলাদা।
কাজেই, এই স্বল্প পরিসরে আমরা একে একে দেখব বাঙালি মানসিকতায় বিপ্লবী ও নারী, সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত, বিপ্লবী মানসিকতা ও যৌনতার শক্তি, এবং আজকের মাওবাদী আন্দোলনে যৌনশোষণের অভিযোগের যাথার্থ্য।
বাঙালি মানসিকতায় বিপ্লবী ও নারী
বাঙালির চোখে বিপ্লবী হবেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, কামিনীকাঞ্চন থেকে শতহস্ত দুরে। আনন্দমঠের সন্ন্যাসী এর প্রোটোটাইপ। এঁরা অতিমানব। এঁরা অনায়াসে সমুদ্র সাঁতরে পেরিয়ে যান, হিমালয় ডিঙিয়ে যান। এঁদের যৌনতার বোধ নেই, নইলে জিতেন্দ্রিয় হবেন কী করে! তাই বাঙালি সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রেমপত্র প্রকাশিত হলে আনন্দবাজারে ভাঙচুর চলে। গান্ধীজির প্রায় আশি বছর বয়সে নাতনীর বয়সী মেয়েদের সঙ্গে যৌনতার এক্সপেরিমেন্টের দলিল (যা নির্মল কুমার বোস "মহাত্মা ইন নোয়াখালি" বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন) এড়িয়ে যায়। তসলিমা নাসরিনের পিতাতূল্যদের যৌনতা নিয়ে লেখাপত্তরে যারপরনাই বাক্রুদ্ধ হয়। বাপের যৌনতা নিয়ে কথা বলা? আরে গান্ধীজিও তো জাতির জনক! আর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও বিপ্লবীরাও যে পিতৃতুল্য।
সর্বত্যাগী? হ্যাঁ, স্কুলজীবনে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে থাকতে কথাটা প্রায়ই শুনতাম। সন্ন্যাসীদের ভাল খাওয়াদাওয়া নিয়ে কথা উঠলে মাস্টারমশাইয়েরা বলতেন -- ওঁরা কত ত্যাগ করেছেন! সব ছেড়ে এখানে বরানগর আশ্রমে এসেছেন!
স্বামী বিবেকানন্দ নিজে ভোজনরসিক ছিলেন। তাঁর কল্যাণে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে মাছ-মাংস-ডিম সবই রান্না হয়। ভারত সেবাশ্রমের মত কলাইয়ের ডাল আর ডাঁটা চচ্চড়ি নয়।
নারী? বা যৌনতা? আরে রাম-রাম! মোহমুদ্গর আওড়াও। কিন্তু যৌনতাকে চাইলেই কি এড়িয়ে যাওয়া যায়?
তাই হোস্টেলে অনৌপচারিক সমান্তরাল পাঠশালায় সিনিয়র দাদাদের মুখে শুনি -- ব্রহ্মচর্য্য অত্যন্ত জরুরি। আশি ফোঁটা রক্ত থেকে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি হয়। ওকে নষ্ট করতে নেই, ধারণ করতে হয়। জানিস্, বিবেকানন্দ একবার গঙ্গায় স্নান করছিলেন। তখন স্নানরতা এক নারীকে দেখে ওনার স্খলন হয়, কিন্তু উনি বীর্যের স্টক করছিলেন। তাই হাতে ধরে নিয়ে গঙ্গাজলের সঙ্গে খেয়ে ফেললেন। স্টক কম হয় নি। কারণ বীর্যের স্টক বাড়তে বাড়তে ব্রহ্মতালু ছুঁয়ে ফেললে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তি হয়।
তাই বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার সঙ্গে বাঙালী সহজেই বৃটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারাটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে স্বস্তি পায়।
মাছ-মাংস তো হল, কিন্তু নারী? কথামৃতের পাতায় পাতায় সন্ন্যসীদের নারীদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকার নির্দেশ। এমনকি সেই নারী ভক্তিমতী হলেও। সেই নির্দেশ কাজ করে আমাদের চেতনায়, স্থান পায় অস্থিমজ্জায়। তাই বিবেকানন্দের ভাবশিষ্যা হয়েও নিবেদিতাকে খৃষ্টান মিশনারীদের সন্ন্যাসিনীদের মত বেলুড় মঠের থেকে আলাদা একটি সমান্তরাল আশ্রম গড়ে তুলতে হয়।
এবার দেখা যাক এই বিপ্লবী কর্মকান্ডে নারীর স্থান কোথায়?
বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে কড়া ফরমান দিয়েছেন। লক্ষ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিপ্লবী সন্তানদের নারীসঙ্গ, একাসনে বসা নিষিদ্ধ, নিজের স্ত্রী হলেও। নিয়ম ভাঙ্গলে শাস্তি স্বেচ্ছামৃত্যু। কিন্তু জুরাসিক পার্কের সেই বৈজ্ঞানিকের কথা মত "জীবন নিজের রাস্তা খুঁজে নেয়"। এটাকেই এক শতাব্দী আগে বঙ্কিম নিজের ভাষায় বলেছেন -- "এই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে? হরে মুরারে!" স্কট-মিল-বেন্থাম পড়া বঙ্কিমের মনে কিছু ছায়া পড়ে উনিশশতকীয় ইউরোপীয় ব্যক্তিস্বাত্ন্ত্র্যের, নারীর সমানাধিকার নিয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা চিন্তনপ্রক্রিয়ার। তাই শান্তি সত্যানন্দের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার পক্ষে তর্ক করে যায়। আর এক দিকে সিনিয়র বিপ্লবীর রূপতৃষ্ণা ওঁকে রক্ষক থেকে ভক্ষক করে তোলে। মহেন্দ্রপত্নী কল্যাণীর জীবনদাতা ভবানন্দ ক্রমশ কামের প্রভাবে পাগল হয়ে কল্যাণীকে গৃহবন্দী করে সারেন্ডার করার জন্যে চাপ দিতে থাকেন। এমনকি সংগ্রামের পথ ছেড়ে কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন।
(আমি অবাক! এ কি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের গল্প? না কি আজকের মাওবাদী আন্দোলনের জাগরী বাস্কে-শোভা মান্ডি-সুচিত্রাদের রূপকথা!)
যাই হোক, জীবানন্দ ও শান্তির জন্যে হ্যাপি এন্ডিং! যুদ্ধশেষে ওরা সুখী গৃহকোণে ফিরে যায়। ভবানন্দের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত -- যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছামৃত্যু। আর গৃহী থেকে বিপ্লবী হওয়া মহেন্দ্রের পত্নী কল্যাণী পার্টি সিমপ্যাথাইজারের ঘরে সংঘর্ষের সময় কাটান। তারপরে স্বামীর সঙ্গে মেইনস্ট্রীম লাইফে ফিরে যান। আর ভবিষ্যতের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি মডেল।
আর অগ্নিকন্যারা? কোথায় শান্তির উত্তরসূরীরা? তাঁদের প্রথম দেখা পাই "চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন" এ প্রীতিলতা ওহদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত।
না, ভুল বল্লাম। এঁরা শান্তি নন, বিবাহিত নন। এঁরা মাত্র কিশোরী থেকে যুবতী হওয়ার পথে পা বাড়িয়েছেন। এঁরা বরং জোয়ান অফ আর্কের মানসকন্যা। কিন্তু এমনটি কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে আবার পৌঁছে যাই বঙ্কিমের লেখায় ও রামকৃষ্ণ মিশনের নারী কল্পনায়।
শরৎচন্দ্র কেন নয়? পথের দাবী? -- আরে সব্যসাচী তো অমিতাভ বচ্চন। তাঁর কেঠো আঙুলের চাপে ব্রজেন্দ্রের বাঘের থাবাও গুঁড়িয়ে যায়। সুমিত্রা ? ভারতী? রক্তমাংসের চরিত্র নয়, আদর্শায়িত। তবু দেখুন, কোথায় যেন বিপ্লবী পিউরিটানিজমের সুর কাটে। বিপ্লবী কবি শশী নয়নতারার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্নে সাময়িক ভাবে তুচ্ছ করে বিপ্লবের স্বপ্নকে। আর, আর একটু,-- কোথায় যেন নারী-পুরুষের নৈকট্যে যৌনতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বিপ্লবীর গোপন আড্ডায়। হঠাৎ খালি ঘরে ভারতী ভয় পেতে থাকে সব্যসাচীকে। সব্যসাচী চেষ্টা করেন, চেষ্টা করেন ভারতীর ভয় ভাঙাতে। কিন্তু এই গন্ধের সত্যতা ও উৎস নিয়ে সচেতন থাকেন। এসব ব্যাপারে মেয়েদের ওলফ্যাক্টরি নার্ভ কি বেশি স্পর্শকাতর? অন্তিম অধ্যায়ে আজকের মাওবাদী আউটফিটে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে কথা বলার সময় আমরা এই পটভূমিকা মনে রাখব।
যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় তথা রাজশক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলা নারীদের ভবিতব্য কী? বঙ্কিমের চোখে এগুলো নারীর স্বভাববহির্ভূত কাজ, আসল ভূমিকা গৃহলক্ষ্মী হওয়া। তাই জীবানন্দের স্ত্রী শান্তি, দেবী চৌধুরাণীর প্রফুল্ল, সীতারামের শ্রী- সবাই ডাক শুনতে পান,"ফিরে চলো আজ আপন ঘরে"। বংকিমের হ্যাপি এন্ডিং নভেলে, যেমন "ইন্দিরা", সেই ঘরকন্নার ছবি দেখুন। সেই কালিদাসের ইন্দুমতীর কথা মনে পড়বে; নারীর ভূমিকা? সেই "গৃহিণীসচিবসখী-প্রিয়শিষ্যা-ললিতে কলাবিধৌ"।
এর বাইরে পা রাখলে? মরতে হবে। একই কর্মে দুই পার্টনার -- "কৃষ্ণকান্তের উইল"এ গোবিন্দলাল ও রোহিণী। কিন্তু শাস্তি আলাদা। গোবিন্দলাল সন্ন্যাসী হয়ে রেহাই পেলেন, রোহিণীকে মরতে হল গোবিন্দলালেরই হাতে। ম্যাজিস্ট্রেট বাবু বঙ্কিমচন্দ্র এটা কী রায় দিলেন। সমালোচকদের "রোহিণীকে মারিলেন কেন?" প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন -- "আমার ঘাট হইয়াছে"। কিন্তু নিজে জানেন রায় ঠিকই দিয়েছেন। আইন সবসময়ে সমসাময়িক সমাজের মূল্যবোধের দর্পণ। তাই বিশ শতকের শেষার্ধে অন্ধ্র প্রদেশের নকশালবাদী অ্যাকটিভিস্ট ভূমাইয়া ও কিস্টা গৌড়ের হত্যাপরাধে ফাঁসির হুকুমের বিরুদ্ধে আপীল শুনে সুপ্রীম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার খানিকটা মৃণাল সেনের "মৃগয়া" ফিল্মের জজসাহেবের ভাষায় বলেন যে আসামীদের যত মহৎ উদ্দেশ্যই থাকুক বর্তমান বিচারব্যবস্থায় আইনের চোখে ওরা অপরাধী, মৃত্যুদন্ড মকুব করা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ কী বলেন?
কী বলবেন? হিংসার পথে সমাজবিপ্লবে ওঁর যে ঘোর অনীহা। তাই "ঘরে-বাইরে"র সন্দীপকে এঁকেছেন মোটাদাগে ভিলেন করে। তার মুখে "এসো পাপসুন্দরী" গোছের পাপের ভজন মনে করুন। কিন্তু বিমলা যে তার প্রতিই আকৃষ্ট, আত্মিক শক্তিতে শক্তিমান স্বামী নিখিলেশ তার চোখে ম্যাড়মেড়ে, মিনমিনে। তার পাশে সন্দীপের জোর- করে- চাওয়া বিমলাকে টানে দুর্নিবার বেগে। আর "চার অধ্যায়ে"র এলা? অতীনের হাতে মরার মুহুর্তে সে বুকের জামা ছিঁড়ে বলে-- মারো, অন্তু! ঠিক এইখানে মারো।
তারপর মরার মুহুর্তে তার তীব্র আত্মনিবেদন-- শেষ চুম্বন আজ অফুরান হল অন্তু!
এইখানে এসে সার্কিট পুরো হয়,- হিংসা ও যৌনতা, বিপ্লব ও নারী মিলেমিশে যায়। আমরা জানি এই সিচুয়েশন অ-রাবীন্দ্রিক ভাষায় স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গে সহিংস বিপ্লবের ঘাঁটিতে বহুবার অভিনীত হয়েছে।
বাঙালী মানসে বিপ্লব-হিংসা-নারীর ইকুয়েশন বুঝতে আরেকবার ফিরতে হবে আমাদের ধর্মাচরণে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বটে-- বুকভরা মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে,
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে।
তা' গড়পড়তা বাঙালী যে মাদার-ফিক্সেশনে ভোগে সে কথা তো অনেকেই মনে করেন। তাই তারা বৌ আনতে যায় না, বলে - মা, তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি। (আজকের কোলকাতার প্রজন্ম নিয়ে কথা বলছি না, বলছি পূর্ব প্রজন্ম ও আজকের গ্রামীণ সমাজকে সামনে রেখে।) তবু রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিতে চাই, উনি হলেন ইউরোপীয় তথা আধুনিক শহুরে সংস্কৃতির পথিকৃৎ। বাংলা সাহিত্যে ও মননে পরিশীলিত রোম্যন্টিক প্রেমের কাঠামো নির্মাণের বিশ্বকর্মা। এ নিয়ে নীরদ সি চৌধুরি মশায় ওনার "বাঙালি জীবনে রমণী' বইটিতে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। দেখিয়েছেন বংকিমের ইংরেজি উপন্যাস "রাজমোহন'স ওয়াইফ"এ পুকুরে স্নান সেরে ফেরা ভিজে কাপড়ের মেয়েদের দেখে সরস মন্তব্য করা পুরুষরাই বাঙালির তৎকালীন সমাজের সিংহভাগ। তাই হেমেন মজুমদারের নিজের স্ত্রীকে মডেল করে আঁকা সিক্তবসনার ছবির এত কাটতি। তাই "চলে নীল শাড়ি নিঙারি নিঙারি পরাণ সহিত মোর" বা একটু পরিশীলিত "নীলাম্বরি শাড়ি পরি নীল যমুনায়, কে যায়!" একেবারে বাঙালির প্রাণের গান। নীরদ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সফিস্টিকেটেড "বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে" নয়, ভারতচন্দ্রের "দেখিলাম সরোবরে কোন এক কামিনী, কোনমতে মোর সনে বঞ্চে এক যামিনী' আমাদের পুরুষমানসিকতার সঠিক প্রতিফলন।
তবু তো রবীন্দ্রনাথে পূজা ও প্রেম মিলেমিশে যায়। সুফী সাধকদের ফার্সিতে রচিত গীত-গজলে বা আমাদের সহজিয়া পথের আউল-বাউলদের গানে যেমন। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের গানের বিশাল ভান্ডারে রোম্যান্টিক গানের কোন স্থান নেই। সেখানে যে যাত্রা বা নাটক হলেও স্ত্রী-চরিত্রে পুরুষদের অভিনয় করতে হয়। ঠাকুর চৈতন্যলীলায় নটী বিনোদিনীর পুরুষভূমিকায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মিশনে অভিনেত্রীদের প্রবেশ সম্ভব নয়। তাই মিশনের গানে নারীর বর্ণনা হল দেবীর বর্ণনা, মাতার বর্ণনা। আবার বঙ্কিম, আবার আনন্দমঠ; মা-যা-ছিলেন, মা-যা-হইয়াছেন ইত্যাদি।
এবার একটু ভাবুন,"বিপ্লবী বাঙালি"র আরাধ্য দেবীপ্রতিমা আসলে কে? লক্ষ্মী? সরস্বতী? উঁহু। তাহলে কি দূর্গা? উনি তো বড়মানুষের দেবী। ওনাকে বছরে একবারের বেশি পূজো করা যায় না। আবার সেই পূজোর নানা বিধি নিষেধ, মেলা খরচ। একসময় ওনার পূজো ঘটা করে করত রাজা-মহারাজা, জমিদারেরা। দূর্গামন্ডপ, নাটমন্ডপ কোন সাধারণ গেরস্ত বাড়িতে দেখা যায় ? তারপর ভাবুন দূর্গাপূজোর প্যান্ডেলে গিয়ে প্রতিমা দেখলে কী মনে হয়? ঠিক যেন বাড়ির বড় মেয়ে স্বামী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। অসুরের বুকে পা থাকলেও আর হাতে দশপ্রহরণ ধারণ করেও "বিপ্লবী হিংসা"র ছবি ঠিক ফোটে না। বরং বেশ ডেকরেটিভ দেখায়। তাহলে রইলেন কে? কেন, কালী মা! জনগণের দেবী, শক্তিপূজার দেবী। বিবেকানন্দ থেকে নজরুল তাঁকে নিয়ে গান কে বাঁধেন নি? সে তুলনায় দূর্গা? আবার দেখুন নারীরূপের সঙ্গে হিংসার সমন্বয়। নগ্নিকা নারী, শ্যামা, হাতে খর্পর থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে, গলায় মুন্ডমালা, পদতলে লুন্ঠিত শিব। সঙ্গে কোন পুরুষের ছত্রছায়া নেই। সঙ্গী বলতে ভীষণা ডাকিনী-যোগিনী। মাঝরাতে একা সেই মূর্তির সামনে বসে থাকুন -- মনে হবে যেন মাওবাদীদের নারী গেরিলা স্কোয়াডের হাতে কিডন্যাপ হয়ে ওদের হাইড আউটে আছেন। সেই ডাকাতে কালীর ট্র্যাডিশন থেকে আজও ভোটের দিন বা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের দিন বাঙালি পূজো দেয় কালীঘাটে; দিল্লি থেকে ভিলাই-বিলাসপুর-লুরু, সব জায়গায় কজন বঙ্গসন্তান একত্র হলেই গড়ে তোলে কালীবাড়ি। রামকৃষ্ণ মিশনে হয় কালীপূজো, সারারাত ধরে হয় কালীকীর্তন। গানগুলো দেখুন--
"লম্বিত গলে মুন্ডমালা মা,দম্ভিত ধ্বনি মুখকরাল,
স্তম্ভিত পদে মহাকাল, কম্পিতা ভরে মেদিনী।।"
বা,
"কেমন মেয়ে নগ্না হয়ে আসিল এ সমরে,
করে রণ, অনুক্ষণ, দৈত্যগণ সংহারে।"
রামপ্রসাদী মা-ছেলে বা বাপ-মেয়ে গতের শ্যামাসংগীত রামকৃষ্ণ মিশনে ঠিক পাত্তা পায় না। ওঁদের নিজস্ব পছন্দের রচয়িতা আছেন। তাঁদের রচনায় বীররস ও বীভৎস রসের প্রাধান্য। বিবেকানন্দেরও বাগানের বেড়া বাঁধা রামপ্রসাদী ছোট্ট মেয়ের চেয়ে "নিঃশেষে নিভেছে তারাদল" এর পটভূমিকায় "করালবদনী তুই আয়" রূপের পূজো পছন্দ। কালী রাত্রির সৌন্দর্য্যের দেবতা। তাঁর পুজো দিনের বেলায় হবে কী করে?
আর একটু এক্সট্রাপোলেট করুন,-- কালীরূপেই বাঙালির নারীকে নিয়ে গোপনস্বপ্নের পূরণ। নারী দিনের বেলায় পুরুষের আজ্ঞাকারিণী, অন্তঃপুরবাসিনী; কিন্তু রাত্রে সে হবে অধীশ্বরী, ডমিনেট করবে পুরুষকে। দিনের বেলায় দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে ভেতো বাঙালির শক্তিপুজোয় নারীকে নিয়ে গোপন স্বপ্ন মুক্তি পায় তন্ত্রের আচার-আচরণে। তাই মহানির্বাণ তন্ত্র থেকে সমস্ত তন্ত্রে ছবি দেখুন -- মহাশক্তি শিবের সঙ্গে সদাই বিপরীত বিহারে, নীচে দমিত পুরুষ আর উপরে সক্রিয় নারী। এর প্রাকৃত বর্ণনা দেখা যায় আব্দুল জব্বারের "বাংলার চালচিত্র" বইয়ের একটি গুড় তৈরির আখড়ার বর্ণনার এপিসোডেঃ
টগবগ করে ফুটছে গরম গুড়, জ্বাল উঠছে। "নিকষ কালো স্বাস্থ্যবতী হেঁতালী দাসী শালপাতায় করে গরম গুড় চেটে খেতে থাকে। হেডমিস্ত্রি ওর অনিচ্ছুক স্বামীকে হেঁতালী বলে --"আরো একটু গুড় দাও মিনসে, রাত্তিরে তোমায় বাঘের খেলা দেখাব।" মন্তব্য অনাবশ্যক।
আমার প্রতিপাদ্য হলঃ বিপ্লবীরা আকাশ থেকে পড়েন না বা তালগাছের মাথার থেকে নেমে আসেন না। ওঁরা যখন হিংসাত্মক বিপ্লবী কর্মকান্ডে যোগ দেন তখন পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে পাওয়া নারী সম্বন্ধে দৃষ্টিকোণ ও প্রতীক-মিথ সবকিছুর উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যান। আর নারীরাও।
আগামী অধ্যায়ে নক্সালবাদী-মাওবাদী জীবনে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে আলোচনার সময় আমরা ওপরের পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখেই কথা বলব।
(চলবে)