এন্ট্রান্স দেওয়ার সময় কলেজে ঢুকেই চোখ আটকেছিল স্লোগান আর পোস্টারে , কিছু মুছে দেওয়া, কিছু উঠে যাওয়া , কিছু আবার নতুন নতুন দাবির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া । হাঁ করে দেখেছিলাম, এই সেই প্রেসিডেন্সি ! এইখানেই লোকে ধর্মপালনের মত করে রাজনীতি করে ! এই দাদা দিদিরা যারা প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে এরাই কি তবে "ইউনিয়নের দাদা দিদি" !
তারপর ভর্তির পর্ব , আবার অবাক চোখে কলেজ থুড়ি বিশ্ববিদ্যালয়টাকে দেখা । হেরিটেজ দেওয়ালগুলোর ওপর বড় বড় করে লেখা “RESPECT EXISTENCE OR EXPECT RESISTANCE” কখনো "একটি কুঁড়ি মাতাল হয়ে বারুদ গন্ধে ফুটবে কবে, সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে . . . " কখনো বা “হাল্লা বোল” সব মিলিয়ে তো রক্তচাপ একেবারে একশো আশি ছোঁয় ছোঁয় ! তখন কে জানত পিকচার আভি বাকি হ্যায়! বলিউড ফিল্মে যেমন স্টুডেন্টরা পড়াশুনো ছাড়া বাকি সবকিছু করে বেড়ায় তেমনি এখানেও ছাত্র রাজনীতিতে ইলেকশান ছাড়া আর সবকিছু অ্যালাউড।সবই নাকি উৎকর্ষের কেন্দ্র হয়ে ওঠার জন্য !
কেলাস শুরু, সবে দু’মাস হল স্কুলছুট আমার কলেজলাইফ শুরু । কলেজের প্রতিটা খিলান, সিঁড়ি, করিডোর আমার সঙ্গে এক ঝুলি গল্প করে, কান পাতলেই শুনতে পাই নব্যবঙ্গীয়রা খলবল করছে,বন্ধুরা ব্রেকে বেশি চেঁচামেচি করলে মনে হয় এই বুঝি মেন বিল্ডিং এর কোনা থেকে আচার্য জগদীশ বসু ধমক দিলেন, তার যে এখনও বেতার তরঙ্গের গবেষণা চলছে ! আরেক বসু সুভাষচন্দ্র এই বুঝি দেশপ্রেমের চোটে মেন বিল্ডিঙের সিঁড়ি থেকে এক লাথি মারছেন অধ্যাপক ওটেন সাহেবকে ! আর সেই চিরবৃদ্ধ প্রফুল্ল চন্দ্র, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে তো সে বুড়োর প্রেমে পড়েছে ! কী মুশকিল !
যাই হোক ! একে একে সেই 'ইউনিয়নের’ দাদা দিদি দের সঙ্গে আলাপ হতে শুনলাম , ওম্মা ! ইউনিয়নই নেই, আর ইউনিয়নের দাদা দিদি! জাঙ্গিয়ার আবার বুকপকেট! তো যাই হোক সেই ইউনিয়ন করা সিনিয়রদের থেকেই গল্প শুনি হাঁ করে (আসলে আমি বড্ড হাঁ করা, নইলে কলেজে বারিস্তার আউটলেট দেখে হাঁ করি!) ইউনিয়ন থাকার সময় কলেজটা কেমন ছিল . . . ঠিক ফিল করে উঠতে পারিনা । আমরা ফার্স্ট ইয়াররা কেউই এটা পারিনা খুব, অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো, এই দু বছরে, দিব্যি চলছে কলেজ থুড়ি ইউনিভারসিটি , শুধু ফেস্ট টা হচ্ছেনা এই যা দুঃখু সবার । কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমাদের ক্লাসরুমের সমস্যা একইরকম, একটা উড বি ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভারসিটিতে নেই কোনও সস্তা ক্যান্টিন, নেই সস্তা খাতাবইয়ের দোকান , নেই স্টুডেন্টদের জন্য ইন্টারনেটের সুবিধা . . . এরকম গাদা গাদা নেই-এর খবর একটু এদিক ওদিক কান পাতলেই পাওয়া যায় । এদিকে কথা নেই বার্তা নেই চলছে নতুন প্রফেসর নিয়োগ ও পুরনো প্রফেসর বদলি । তাও আবার ডেমো ক্লাস না নিয়ে, আর এই প্রফেসরদের ‘এক্সেলেন্স’ নিয়ে কানাঘুষো তো ইউনিভারসিটির আনাচে কানাচে! শুনছি লাগু হবে CET(Common Entrance Test) । নিজের home university-তে স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ আর থাকবে না । তার ওপর এই পরীক্ষা নাকি হবে MCQ । আমি , এক ইঞ্জিরি অনার্সের ছাত্রী প্রশ্ন পাবো, কিটসের পুরো নাম কি? জন , মদন নাকি আরাবুল ! তাই নিয়েও ধোঁয়াশা । সবার অজান্তে বসছে প্রাইভেট গার্ড , হেরিটেজ বিল্ডিঙের বিউতিফিকেশানের ঠ্যালায় ঘষে ঘষে পোস্টার তুলে দেওয়া দেওয়ালটার গায়ে ঝলমল করছে আলোর মালা, আরও কত কি! ছাত্রদের কোনও অফিশিয়াল বডি নেই, ফলে জানার উপায়ও নেই । কখনও statute body, কখনও সংঘর্ষের ভাঁওতা দেখিয়ে স্থগিত রাখা হচ্ছে নির্বাচন । পাঠানো হচ্ছে এমন সার্কুলার যার কোন ভিত্তিই নেই । সজ্জনে বলে সবই নাকি উৎকর্ষের কেন্দ্রস্থান হয়ে ওঠার জন্য, সবই নাকি মেন্টর গ্রুপের দয়া , আর নিন্দুকে বলে এসবের কারণ নাকি এই আট বিঘের ক্যাম্পাসে ঘাসফুলের ছিটেফোঁটাও না দেখা যাওয়া! এদিকে বছর বছর স্টুডেন্টদের থেকে নেওয়া তিনশো টাকা ইউনিয়ন ফীজ কোন ভাঁড়ারে জমা হচ্ছে তা প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী (!) বাবা বিবেকানন্দই জানেন!
রাজ্য সরকার বলেছে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র আন্দোলন । তাই নাকি নির্বাচন বন্ধ । দুঃখজনক হলেও সত্যি, রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ছাত্র সংগঠন দুটির সংঘর্ষে এবছরে আহত যদি অন্তত তিনহাজার জন হয় তবে প্রেসিডেন্সির দশ বছরের ছাত্র সংঘর্ষে আহত টেন্ডস টু জিরো । তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ কর, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর তারবেলা ?!
সে হনুমানও নেই, সে কলাও নেই । ফলে, অনভ্যস্ত ফার্স্ট ইয়ার আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা সত্যিই কষ্টকর যে ইউনিয়ন না থাকা মানে দিন দিন আমাদের কথা বলার ন্যূনতম অধিকার চলে যাওয়া । প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য সাতচল্লিশ থেকে সত্তর পেরিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক, তাকে রক্ষার দায় যদি নাও বোধ করি, তাও, নিজেরা হেসেখেলে নিজেদের ক্যাম্পাসটায় বেঁচে থাকার জন্যই বোধয় একটা সুস্থ স্টুডেন্ট’স বডি প্রয়োজন । যা হচ্ছে হোক যদি চলতে থাকে , তেমন হাল হবে নাতো , নীম্যোলার যেমন বলে গেছিলেন , ওরা যখন ধরতে আসবে তখন কেউই থাকবে না যে প্রতিবাদ করবে . .
এইসব সাতপাঁচ ভেবে সময় নষ্ট না করে কিছু একটা করে ফেলা দরকার এটা আমাদের সবারই মনে হচ্ছিল । তার ফলাফল হিসেবেই প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের একাংশের তরফ থেকে দীর্ঘকালীন ধর্না , ভিসি , রেজিস্ট্রার, ডিনকে ঘেরাও, অবস্থান ইত্যাদির পর আশ্বাস মিলল বহু প্রত্যাশিত ছাত্র নির্বাচনের , মনের আনন্দে জমা দিলাম সমস্ত নমিনেশান । ক্যাম্পাসে ইলেকশানের আবহাওয়াই আলাদা, আই.সি , এস.এফ.আই , ডি.এস.ও সব্বাই প্যানেলের নমিনেশান দিতে আর পোস্টার মারতে ব্যস্ত , সব মিলিয়ে একদম হইহই কান্ড , রইরই ব্যাপার !
এর মধ্যে হঠাৎ হরিমোহন কলেজে বহিরাগতদের হাতে পুলিশ খুন এবং স্বপনকুমার সিরিজের হিরোর ন্যায় কোথা হইতে কী হইয়া গ্যাল, ব্রাত্য বলিলেন সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকশান বন্ধ । কি সুচতুরভাবে একটা ঘটনা, যা আবার আদৌ “ছাত্রছাত্রীদের” হাতে হয়নি তার উপর দিয়ে এই নির্দেশ পাস করিয়ে নেওয়া হল সেটা বুদ্ধিমান পাঠকপাঠিকাই ভেবে দেখুন! এক ঢিলে দুই পাখি – খুনিকে ছাত্র বলে চালিয়ে দিয়ে পার্টির ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলা এবং একইসাথে জনমানসে ছাত্ররাজনীতি শব্দটিকে আরও ভীতিপ্রদ করে তোলা যাতে ছাত্রদের কথা বলার অধিকার শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখেও লোকে বলবে যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে । ভাবলে অবাক লাগে , মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী , আই.সি-র প্রাক্তনী !
হরিমোহন কলেজের ছবিই ছাত্ররাজনীতির একমাত্র ছবি নয়, পাওয়া-পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতির আর বোমা-গুলি দিয়ে এলাকা দখলের দলীয়তার বাইরেও ছাত্ররাজনীতি সম্ভব , ইউনিয়ন না থাকলে সত্যিই আমরা পিছিয়ে পড়ব । উঠে যাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , ফেস্ট । উঠে যাবে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য রাখার প্ল্যাটফর্ম । উঠে যাবে ছোট ছোট পত্রপত্রিকা, ফটোগ্রাফি , নাটক, ব্যান্ড ইত্যাদির প্রয়াস । প্রেসিডেন্সিতে গত তিনবছর ধরে যে অরাজকতা চলছে, যেকোন নতুন প্রয়াস নিতে গেলেই আমাদের নির্ভর করতে হয় ফ্যাকাল্টিদের দয়াদাক্ষিণ্যের , ফেস্ট উঠে গেছে, মূলধনের অভাবে উঠে গেছে একরাশ গ্রাফিটি , পথনাটক, ফোকব্যান্ডের সবে ডানা মেলা প্রচেষ্টা – সমস্ত কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলিরই এক দশা হবে । এর হাত ধরে ঢুকবে আই কার্ড চেকিং , সিসিটিভি । এই প্রচেষ্টা শুরুও হয়ে গেছে , মিডিয়ার হাত ধরে বারবার সামনে আনা হচ্ছে বেসু, লোরেটো , জেভিয়ারসের ক্লাস মনিটর মডেলকে । মগজে ঠুকে ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রী মানেই অধ্যয়নং তপঃ , পরিক্ষায়নং তপঃ , চাকরিয়নং তপঃ । তারা আবার রাজনীতি করবে ? ভাববে সমাজ-সমকাল নিয়ে ? রামঃ !
এর পরেও আমরা কথা বলব, এর পরেও দেওয়ালগুলো স্লোগান শিখবে, এর পরেও আমরা গান বাঁধব , পুরনো বাড়িটা জুড়ে ছবি আঁকব , এরপরেও আমরা পথে নামব, এরপরেও কথা বলতে দেওয়ার দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলবে, প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যাদবপুর সহ বাকি কলেজ- ইউনিভার্সিটিগুলির আন্দোলনের মিলিত অগ্রগতি হোক । ঊনিশ তারিখ প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে বিকাশভবনে গিয়েও শিক্ষামন্ত্রীর দেখা পায়নি, জমা দিয়েছে ডেপুটেশন । ইতিমধ্যে কলেজ-ইউনিভারসিটিতে পাঠানো নির্দেশিকার “উপদেশ” পর্যবসিত হয়েছে ফতোয়ায়, যা না মানা হলে উপযুক্ত “ব্যবস্থা” নেওয়া হবে , নামানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অটোনমির উপর সরাসরি আঘাত । এই একুশে আইনের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের পথে নামা ফলপ্রসূ হবেই । কাউকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার জন্য নয়, আমাদের প্রত্যেকের স্বার্থেই আরও জোরদার আন্দোলন দরকার । ইয়ে আজাদি জো তুম না দোগে, হাম ছিনকে লেঙ্গে !