এ হোমেজ টু দ্য রেইন গডস
বর্ষা মাথায় নিয়ে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সঙ্গে লাইভ পারফর্মেন্সে ইউকের পাম্পরুমে থাকতে পারা এক অসাধারণ আবেগজাগানিয়া ঘটনা, সাক্ষাতের শুরুতেই ত্রিশ মিনিট ধরে সন্তুরে তিনি বর্ষা আবাহন করেন, পরের বিশ মিনিট ধরে বর্ষাস্তুতি এবং সবশেষে বর্ষানামা আরো বিশ মিনিট ব্যাপে, কল্পনায় হলেও এই শেয়ারযোগ্য অনুভূতিমালার ভার সতত চালিত হতে থাকে সাঁইজির ওই জগৎজিজ্ঞাসার দিকে, যে, ‘কে গো জানতে পায় রসের রসিক না হলে’, যেকোনো নিষ্ঠ মেঘমল্লারেই আদপে গুঁড়িয়ে যেতে হয়, কেননা তখন ‘পররূপে কাতরতা জাগে মৃদু-মৃদু’, ফোঁটায় ফোঁটায় কোটিধা বিভক্ত হয়ে যাওয়া নিজ-অস্তিত্ব জানান দিতে তখন প্রিয়ার সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যায় মন ও মানস, ওদিকে আকাশের সজলতা কি বাতাসের খ্যাপা প্রবণতা এসে ঘাঁই মারতে থাকে উড্ডয়নরত খাঁচারূপী ইনফ্রাস্ট্রাকচারে, তখন মাসুদ খানের মতো অনুভূতি হয়, মনে হয় ‘বর্ষাই মূল পাঠ্যকৃতি,/ মূল আখ্যানপাত্র/ আর সব ঋতু পাঠসহায়িকা,/ টীকা-টিপ্পনীমাত্র’
পাম্পরুম থেকে বেরিয়ে ভিজতে ভিজতে আমরা লবণাক্ত ও বিস্বাদ সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকি, লোনাবৃষ্টিতে সঙ্গীর কৃষ্ণকুন্তলঝাড়ের দিকে এগিয়ে যাই, চোখ-মুখ-কান ঢেকে যায় কৃষ্ণ আশীষে, এরপর চোখ বুজে মনের মাপে ভেতরদৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাই টিলা-ট্যাঙ্গর ও নদী-হ্রদ পেরিয়ে, ক্রমে আনুপূর্ব ঘেমে উঠি, উবু হয়ে বসে পড়ি মোহনার কাছে, সমস্ত লবণ যেখান থেকে পরিবাহিত হয় বন্দরে বন্দরে, ওই বৃষ্টিশীলতার ভেতরে থাকে যে উষ্ণ নুনতা স্বাদ, কখনোসখনো তা সুমিষ্ট ও সুপেয়ও বটে, আগে তা মোটে জানাই ছিল না, নবজ্ঞানের ওই ভারে সৈকতের ভেজা বালিতে আমরা পরস্পর লীন হতে থাকি, সূচনার বৈতালিক লীনগতি ক্রমশ এক তাল তিন তাল হয়ে খেমটায় এসে ঠেকে, উত্তরসমুদ্রের ঝাউগাছের ওপারে তখন ধ্বনিত হতে থাকে পণ্ডিত যশোরাজের সুমিষ্ট স্বর ‘বরষা ঋতু আয়... ঋতু আয়...’, আর সিমুলটেনিয়াসলি পূর্বপ্রান্তের পাথরগুচ্ছের ধার ঘেঁষে সাজানো হার্ডড্রিঙ্কসের দোকানিরা অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে কাউন্টার দেয় ‘মেঘমেদুর বরষায়...’ বাজিয়ে, এককেন্দ্রিক অথচ দ্বিমুখী এহেন সুরে বুঁদ বজ্রধর ইন্দ্র স্বীয় পুরীতে বসে তার সহস্রমুখী বজ্রাস্ত্র পৈথানে রেখে নেপথ্যে অনবরত তাল ঠুকে যেতে থাকেন, সুর-তালের মহামূর্ছনাজনিত ওই দূষণমধ্যে আমরা তখন লবণজলে পা ভিজানোকে গৌণ ঠাউরিয়ে আকাশঢালা জলের কাছে এমনকি গায়ের টুকরো বস্ত্রতক সঁপে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাই
স্ফীতিহীন স্ফীতকার্য
প্রথমে মেঘমালা সঞ্চালিত হয় ও যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, পরে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, তারপর একত্রিত ও পুঞ্জীভূত হলে আমরা দেখি বিজলিপ্রভা, শুনি বজ্রধ্বনি, যা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে, পরে প্রকৃতির অনুগ্রহে পরাগ ও বারিবহনকারী বায়ুরাশি প্রেরিত হয়, সুসংবাদবাহী বাতাস ছাড়া পেয়ে পর্বতশৃঙ্গে বিশ্রামরত পুষ্কর মেঘকে চুলের মুঠি ধরে বয়ে নিয়ে আসে নিষ্প্রাণ ভূখণ্ডের দিকে এবং তারপর আকাশ থেকে পরিমিতভাবে বিশুদ্ধ ও উপকারী বারিবর্ষিত হয়, এতে মৃত জমি পুনরায় জীবিত হয় এবং অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়, তাতে সব রকম গাছের চারা ওঠে, ওতে উদ্গত হয় ঘনসন্নিবিষ্ট উদ্যান ও সবুজ পাতা, সৃষ্টি হয় শস্যদানা, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, অন্য সব রকম ফল ও গবাদিপশুর খাদ্য, প্রাণী ও ভূমি জীবনের রোমাঞ্চ অনুভব করে ও স্ফীত হয়, আর তাতে জোড়া জোড়া সব রকম সুন্দর জিনিস উৎপাদিত হয়, এই বাণীরূপ যাকে কেবলই স্ফীতিকার্য বলে কখনোসখনো তা অস্ফীতিঘটনও, বৃষ্টির দিকে আমার ওই বিকেলগমনটি যেমন ছিল স্ফীতিলোপের জন্য
সেদিনের অপরাহ্ণিক সৈকতে সুন্দরী বিজলি ছিল, বজ্রের হুঙ্কার ছিল, তবু একদম টলি নি, আমাদের ঝোঁক ছিল পুরোটাই মেঘমল্লাররূপী শান্তিপূর্ণ বৃষ্টিপাতে, আগুনরূপী দীপক রাগে নয়, তবু বাজিয়ে দেখতে বজ্রসম্ভাবী বাচাল মেঘকে আদর করে কাছে ডাকি, গল্পগুজব করি, বলি যে এ যাত্রা যাহোক একজন অলরাউন্ডার চাই, যদি অন্তত সেরকমটি হও, তাহলে আগুন হলেও চল আমরা খেলি, সে জানায় যে, আক্ষরিকভাবে যাকে অলরাউন্ডার বলে, তা সে নয়, প্রথম রাউন্ডে সে বরাবরই খুব নীরব ও চিৎপাত, আকাশজুড়ে তার শুধু শুয়ে থাকা ও চটুল যত হাকডাক এবং অতি অবশ্যই তা বৃষ্টিপাতহীন, যদি বাতাস এর পরও প্রবাহিত হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে এবং তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে সমর্থ হয়, তাহলেই সে কেবল হ্যারিকেনরূপিণী হয়ে ওঠে, তখন সে ক্ষুধার্ত ঝড়, শুষে নিতে পারে আমূল সাগর এবং সুনামি হয়ে ভাসিয়ে দিতে পারে রাশি রাশি জনপদ, ভয় যদিও আমার ধাতে নেই, তবু ভয় ভয় একটা অনুভূতি সহসাই কাঁটা দিয়ে ওঠে মনে, ওরে ব্বাপ, সংলাপ পর্বে ক্ষান্ত দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখি বৃষ্টিসম্ভাবী নরম-কোমল বিচূর্ণ মেঘ, শ্বেতসর্পিণীর মতো তার অবয়ব, বলি, ওগো নুন, তুমি বর্ষিত হও, ওগো ধুন, তুমি গীত হও, সে শুরু করে খুব নিচে থেকে, ফাল্গুনি বাতাস বয়ে যাবার ঢঙে, কিন্তু তা ছিল ভেজা খুব, মন্ত্রপাঠের মতো নিচুস্বরে বিড়বিড় করতে করতে সে ক্রমে ভিজিয়ে দিতে থাকে যে অংশ কখনোই কোনো বৃষ্টিতে ভিজে না সে অংশসহ, ক্রমশ সে ঊর্ধ্বমুখী হলে তাকে ত্রাণকর্ত্রীর মতো লাগে, উলটেপালটে তৃপ্তি না মেটা পর্যন্ত ভিজি, মনে হয়, বৃষ্টি নয় বর্ষিত হচ্ছে শান্তি, হঠাৎ লোভ হয় উৎসমূলে তাকাবার, কিন্তু ও বৃষ্টি এমনই গোলবৃষ্টি যে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তার মূল কিংবা চূড়া, এই যা, ‘সবখানেই তার আদি, সবখানে অন্ত’, ‘শেষ নেই প্রভু তার শেষ নেই’, এই নামতা জপতে জপতে গর্ভে শান্তির বীজ নিয়ে এরপর হেলেদুলে কেবলামুখী হই, যে কেবলা খুঁজে পেতে প্রতিবারই আমাকে প্রাণান্ত হতে হয়
কদমতলায় বৃষ্টিতে
যাত্রামুখে দেখি চোখ বড়ো করা কালো মেঘ গায়ে লালাভা মেখে ওত পেতে আছে, শিলাপাতের সম্ভাবনাসহ, ‘আকাশের শিলাস্তূপ থেকে তিনি বর্ষণ করেন শিলা, আর এ দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন’, শঙ্কা জাগে মনে, আমার খেতের গর্ভিণী ধানের ছড়া, আমার গাছের আমের যত বোল, আমার খড়ের প্রিয় চালাঘর, এ যাত্রা সর্বনাশের সামনে দাঁড়িয়ে গেল তাহলে, হঠাৎ এ-ও মনে হয়ে যায় যে ‘...আর যাকে ইচ্ছা তার ওপর থেকে এ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন’, সহসাই এরকম বিশ্বাস জেগে ওঠে মনে যে আমার ওপর থেকে তা ফিরে যাবে অন্যদিকে, হ্যাঁ, যাবেই ফিরে ইচ্ছাশক্তির বলে, এ বিশ্বাস আমাকে দেন ভারতবর্ষীয় কৃষি ও আবহাওয়াবিদ খনা, তাঁর ‘ধলা মেঘে গলা পানি/ কালা মেঘে ছাগল দৌড়ানি’ আর্যাযোগে, ঝরঝরে লাগতে থাকে নিজেকে, মেঘের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং কনিষ্ঠাঙ্গুলি দুটোই একযোগে তুলে ধরি, বলি যে, দুটোর যেকোনোটা খুশি ঢুকিয়ে বসে থাক, শান্তি পাবে, বেচারা মেঘের লালচোখ মুহূর্তে নত হয়ে যায়, ব্রেভো, গর্বে আবারও সাঁইজির চরণ জাগে পোড়া মুখে, কেন যে জাগে, ‘মানুষে মানুষের বিহার/ মানুষ হলে সিদ্ধ হয় তার/ সে কি বেড়ায় দেশ-দেশান্তর/ যেজন পিড়েয় পেরুর খবর পায়’, বারকয় চরণটি ভাঁজতে ভাঁজতেই আমার বোরাক এসে পৌঁছায় কদমতলে, এ কদম সেদিন যে সে কদম ছিল না, নিচে তার ছিল যথেচ্ছ প্রশ্রয়, কামনার ইঙ্গিত
ছাগল দৌড়ানি বৃষ্টির ঝটকা ঝরঝর কদমপাতা চুঁইয়ে নিচ পর্যন্ত আসতে পারে না, বরং কদমফুল বরাবর পতিত যে ফোঁটাগুলো, তারা ওই নির্গন্ধ ফুল থেকেই এক ধরনের মৌতাত ঝেটিয়ে বাইরে বের করে দিতে থাকে, এই আচানক মৌতাতে আমাদের জটলার ত্রিভুজঘরানা দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ হতে থাকে, ক্লান্ত বিকেল সন্ধ্যার দরজায় এসে কড়া নাড়ছিল যখন, তখন কদমগাছের শাখা-প্রশাখা ছাড়িয়ে পুব আকাশে চোখ পড়তেই দেখা গেল বিজলির প্রাচীন সুমেরীয় দেবী জারপেনিভকে তাঁর করিৎকর্মা স্বামীকে নিয়ে যুদ্ধে চলেছেন বায়ুরথে চড়ে, দু’হাতে তাঁর দু’গুচ্ছ বজ্রবাণ, ভয়ে আমরা গাছতলা ছেড়ে আলিশান এক বিজলিদণ্ডের আশ্রয়ে আসি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে মনে রেখে, খোদার ওপর খোদকারী মানুষ হামেশাই করে দেখি, কিন্তু ভরসা পায় না বলে বিজ্ঞানীর ওপরে একদমই নয়, তাই আমরা বাজাই না গির্জার ঘণ্টা কিংবা দিই না সুরেলা আজান, বরং একটা রংধনু দেখবার ইচ্ছায় কুত্তা-বিলাই ঝরঝরানির মধ্যেও উত্তরচোখে আঁড় হয়ে থাকি, জানি যে পতন রহিত হলে এহেন ধারাজলের, ক্রমে আকাশমাঠে খেলে উঠবে সপ্তচক্ষু রং, ডেকে-পেতে ক্লান্ত মিলন শেষে আড়মোড়া ভেঙে দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে উঠবে বেপরোয়া একটা হলুদ পুরুষ ব্যাঙ, যার নরম উরুদ্বয়ের রপ্তানিপণ্য হবার দিনকাল আপাতত ফুরিয়ে এসেছে
ব্যাঙের বিয়ের দিন
আহা ব্যাঙ (‘হায় ব্যা’ নয়), বর্ষার সাথে তার সম্পর্কসূত্র আমি ভুলতে পারি না, ঢাকার ভূমিজলে কোনো ব্যাঙ নেই বলেই না আকাশে দেখি তার ছায়া, কী নিঠুর এই বেদনা, ভাবি, কত বদলে গেছে আমার নাগরিক বর্ষা, ব্যাঙহীন, স্যুয়ারেজ উপচানো পচা ও দুর্গন্ধ জলের স্রোত টপকে ঘিনঘিনে পথঘাট পেরিয়ে তুমি যেদিকেই যাও বাল্য-কৈশোর-যৌবনের বর্ষা তুমি কোথাও পাবে না, ব্যাঙের বিয়ের কথা বাদই দাও, সোনাব্যাঙের পালটাপালটি কোরাসগীতি শুনতে শুনতে কাদাখেলের আনন্দ তুমি খুঁজবে কোথায়, কোথায় পাবে ব্যাঙের ছাতা, কোথায় তোমার আষাঢ়ে গল্পের পাত্র ও ক্ষণ, তবু রক্ষে যে সংসারসমরে লিপ্ত থেকেও কোনো এক চোরা ভ্যান্টিলেটর পথে সংসার থেকে ছুটি নিয়ে ক্রমবর্ষণ শব্দের মাঝে নিজের সাথেই নিজে আড্ডা জমিয়ে তোলার অবকাশ থেকে গেছে আজও, কিন্তু কতক্ষণ আর, নিজের মুখ-চোখ-অভিব্যক্তি-কণ্ঠস্বর খুব পরিচিত ও ক্লিশে বোধ হলে আশ্রয়ার্থে ঘুরে দাঁড়ানো লাগে অন্য কারো দিকে, ধরা যাক সামনে রবীন্দ্রনাথ, ধরা যাক বাতাস এসে খুলে দিয়ে গেছে তাঁর ‘বর্ষার চিঠি’র পৃষ্ঠা, হায়, তাঁরও ঠিক অবিকল দশা দেখে ভেতরে কাত হয়ে পড়ে কান্নাকলসি, তাঁরও দেখি একই হাহাকার, ব্যাঙ হারাবার, “কিন্তু আজকাল ব্যাঙ ডাকে না কেন? আমি কলকাতার কথা বলছি। ছেলেবেলায় মেঘের ঘটা হলেই ব্যাঙের ডাক শুনতুম, কিন্তু আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতা এল, সার্বভৌমিকতা এবং ‘ঊনবিংশ শতাব্দী’ এল, পোলিটিকল অ্যাজিটেশন, খোলা ভাঁটি এবং স্বায়ত্তশাসন এল, কিন্তু ব্যাঙ গেল কোথায়? হায় হায়, কোথায় ব্যাস বশিষ্ঠ, কোথায় গৌতম শাক্যসিংহ, কোথায় ব্যাঙের ডাক!” শেষে ভাবি, জগৎসংসারের ঐতিহ্যবাহী হাহাকারসংস্কৃতি বুঝি এতটাই চিরন্তন যে তার চর্চারিক্ত কোনো সভ্যতা নেই, অসভ্যতাও, মানে বন্যতা ও বর্বরতা, এর বিস্তার যৌনাঙ্গ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত প্রসারিত এবং সেটা ক্রিয়মান আছে গন্ধমফল সেবন থেকে টুইন টাওয়ার উড়িয়ে দেয়া অবধি
একলা পঙক্তির সুখদুঃখ
ছন্দ লিখি না আমি কবিতা করতে বসে, কবিতা করি না আমি বৃষ্টি আঁকতে এসে, কিছুই করি না আমি যখন কবিতা আসে, আসে মানে কোত্থেকে আসে, আমারই ভেতর থেকে, আমারই ভেতর মানে আমারই সঞ্চয় সে, আমারই সঞ্চয় মানে যতটা ছুঁয়েছে আশে, ছুঁয়েছে তো কেমন সে ছোঁয়া, পাথর না হৃদয় সেটা, গোল না লম্বাটে বাঁকা
আসলে কি হৃদয়পুরী গোল মহাগোল, পৃথিবীপ্রাচীন ঘন মহাতীর্থ বলে, তাতেই তো ছাট এসে লাগে বেয়াড়া বৃষ্টির, ভিজে যাচ্ছি ভিজে যাচ্ছি আমুণ্ডু আমূল, তেমন কারো নিজস্ব তোয়ালে হলে সুগন্ধ সমাহৃত, গা-মাথা মুছে ফের কাজে যাওয়া যেত, কাজ মানে কাজ, দোষগুণে ভরা, বিবেচিত হাওয়াই দ্বীপে, ওয়াইয়ালিয়েলে হিলে, কিংবা কাছে মেঘালয় চেরাপুঞ্জি থেকে
আকাশের বিবেচনা পাতালের উলটোয় স্থির, নদীর গানের সুর মরুভূমি বোঝে না কখনো, এটা সকলেই জানে
ড্রিজলিং অ্যান্ড প্রেসিপিটেশন
কাউন্টার থেকে ছাড় পেয়ে লাইনে থাকতে থাকতেই ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দোতলায় তার সাথে আবার দেখা, অসাধারণ এক হাসিতে অভ্যর্থনা জানাল সে, ওয়েটিংরুমে বৃষ্টিদেবতা আমাদের পাশাপাশি বসবার বন্দোবস্ত করে দিলেন, ‘জানেন না তো, আমরা যেতে চেয়েছিলাম হিমালয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোখরা থেকেই ফিরতে হয়েছে, এত বৃষ্টি বাপের জন্মে দেখি নি, সবাই খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, তাই হেলিকপ্টার ওড়ে নি, অতৃপ্ত হয়ে ফিরছি’, আমিও কম যাই না, বলি, আমার অতৃপ্তি বিস্তৃত হয়ে আছে রামগিরি থেকে অলকা অবধি, রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, কালিদাসের মহাভারত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বৈষ্ণব কবিতার একটা বড়ো অংশ কিংবা রবীন্দ্রনাথের অজস্রাজস্র কবিতা হাতড়েও তুমি এত হাহাকার কোথাও পাবে না, যেমনটি বুকে নিয়ে আমি ফিরছি, এমনকি আমার বৃষ্টিও হয় নি দেখা, এ দেশের রাজতন্ত্র ফুরাল, কিন্তু বিরহভাব, কই, ফুরায় নি মানুষের, রাজাহীন রাজকীয় হোটেলের ছাদের নিচের দ্বিদিবসিক সেমিনারের হাহাকারই ছিল মূল স্তোত্র, এরকম বাজে ভ্রমণ আর হয় না জানেন, সম্পূর্ণ বাজে অবশ্য বলা যাবে না এখন, আপনার সাথে দেখা হবার পর, ‘আমাকে তুমি বলুন, প্লিজ, মাত্র ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছি’, ও-কে, মনে হচ্ছে যেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় ঠেস লেগে গুঁড়িয়ে যাওয়া মেঘের থেকে আসা বৃষ্টিদলের ছোঁয়াটা এই এখন মাত্র বাগে পাচ্ছি তোমার মারফতে, এই যে এখন বন্দরজুড়ে ড্রিজলিং হচ্ছে, ধারণা করি সেটাও ওই তোমারই কল্যাণে, নইলে কাঠমান্ডুতে চার দিনেও বৃষ্টি দেখব না ময়ূরের মৈথুনঋতুতে, এটা কেমন করে হয়, দেখো, তোমার সম্মানে নামা ড্রিজলিং থাই এয়ারওয়েজের সদ্য ল্যান্ড করা বিমানটির আজদাহা শরীরে আদুরে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে
জানেন, ওই যে বন্দরের চারপাশের পাহাড়গুলো, এই মিষ্টি ড্রিজলিংয়ের ভেতর কেউ একজনের হাত ধরে ওই দিকে হাঁটা দেয়া গেলে দারুণ হতো’, সে তো বটেই, আমার দিক থেকেও দারুণ হতো না কি, গিয়ে হয়ত দেখতাম, ঘাসের ওপরে রক্তবর্ণ সব মখমল পোকার উৎসব, কিন্তু সে তবু হবার নয়, বরং চলো ঢাকাতেই কোনো ঘোল খুঁজে নেব, এহেন দুধের বদলে, স্প্রাইটের জামা পরা ভ্যালেন্টাইনস স্কচ গলায় ঢেলে মনে মনে ঢাকার ঘোলঘরগুলোই তখন ভাবতে থাকি কেবল, যেন হয়ে উঠি বর্ষার দূত, চাতকপাখি, যার এটা প্রজননঋতু
আমরা এরপর অজস্রবার ড্রিজলিং ও প্রেসিপিটেশন মাথায় নিয়ে হাতে হাত ধরে হেঁটেছি স্বর্গ থেকে নরক অবধি, পিচের রাস্তা থেকে মাটির রাস্তা, ঘাসের রাস্তা সব দিয়ে চিত্রকূট পর্বত অবধি, বাস্তবে ও স্বপ্নে, কিন্তু ত্রিভুবন বিমানবন্দর ঘিরে থাকা গাছময় পাহাড়গুলোর ভেজা হাতছানি এখনো মনের মধ্যে রয়েই গেছে, আমরা কি আবার ল্যান্ড করব কখনো, ওই বন্দরে, মাত্র দু’জন, এসব ভাবনার মধ্যে একদিন রাত সোয়া এগারোটা থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল ড্রিজলের সঙ্গপ্রণোদনা, ছিঁড়ে গেল ভেতরগত যোগসূত্র, আমরা চিরকাল যেরকম একা ছিলাম, আবারো হয়ে গেলাম তেমনি নিঃসঙ্গ বেদনাবৃক্ষ
নিজের কাছে নিজে
পৃথিবীর সর্ব পশ্চিমপ্রান্তের অন্যতম পর্বতচূড়া ওয়াইয়ালিয়েলেকে চেরাপুঞ্জিরও আগে স্থান দিতে যাদের মন উশখুশ করে বৃষ্টিসংক্রান্ত অ্যাজেন্ডায়, তাদের জন্য চেরাপুঞ্জির ১১,৪৩০ মিলিমিটারের পাশে বছরে (৩২ বছরের গড় ধরে) ১১,৬৮৫ মিলিমিটার বা ৪৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের তথ্য তুলে ধরা চমকে দেবার নামান্তর, যেখানে এই পর্বতচূড়ার মাত্র কয়েক মাইল দূরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড মাত্র ২৫০ মিলিমিটারে নেমে আসে, এটুকু তথ্যসম্পদ নিয়ে আমি ভেজা একটি পত্র রচনার যে উদ্যোগ নিয়েছি গোপনে গোপনে, তাতে অ্যাসিডবৃষ্টি কিংবা বিপরীতপক্ষে ঘোর খরার সম্ভাবনাই এক অর্থে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে, আনাড়ির অস্বাভাবিক এই বৃষ্টিবন্দনা কি শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাবে না বিদ্যমান সব ফ্লোরা ও ফিউনার বিরুদ্ধে, এ যদি সত্য হয়, তবে জোছনারাতে পিচের আদর বুলানো ছাদে ঘন প্রেসিপিটেশনের মধ্যেও যে আমি কোটি কোটি বেলিফুল ছড়িয়ে পড়ার আনন্দ খুঁজে পাই, সেই মিথ্যার লেজ ধরে এরকম একটি নামতা জপে যাওয়া ছাড়া বস্তুতপক্ষে উদ্ধারের আর কোনো জানালাই আমার সামনে খোলা নেই, ‘মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে/ তারা আমায় ডাকে আমায় ডাকে’