রাগ হলে কী করি আমরা? আমরা –-- মানে সাধারণ মানুষজন, যাদের পুলিশ বন্দুক গুণ্ডা লাঠি জলকামান নেই, তারা?
খুব ছেলেবেলায়, রাগ হলে ভাত খেতাম না। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আলতো করে পিঠের জামাটুকু তুলে মা দেখতে আসত তার পাঁচ আঙুলের দাগ মেলালো কি না। শোষিত ও শোষকের ভেতর এই মধুর বিশ্বাসটুকু ছিল। আর ছিল বলেই কবে যেন ছোটো থেকে বড়ো হয়ে ওঠা। কিন্তু তারপর?
রাগ হলে ছাদে গিয়ে বসে থাকতাম। একের পর এক ঢিল ছুঁড়তাম সামনের বাগানে। অকারণেই।
এইসব রাগদুঃখ অনেকটাই ব্যক্তিগত ঘাত-প্রতিঘাতজাত। কিন্তু যখন দেখলাম সিঙ্গুরে মানুষের জমি কেড়ে নিতে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে পুলিশ? দেখলাম, দিকে দিকে এক নিঃশব্দ অবরোধ জারি রেখেছে শাসকদল, মানুষের ঠোঁটের ওপর অদৃশ্য আঙুল, গান গাওয়ার কন্ঠগুলো চেপে ধরেছে অদৃশ্য হাত, তখন? গণসঙ্গীতকে নিজেদের কব্জায় এনে, নাটকের মঞ্চগুলো দলদাস-অধিকৃত করে যখন প্রাণপণ এক বিপ্লবী ভাবমূর্তি বজায় রাখতে চেষ্টা করছে সাম্যবাদী শাসক আর বারে বারে বেরিয়ে পড়ছে তাদের আসল মুখ, তখন?
এক বন্ধুর সঙ্গে কলেজ থেকে বেরিয়েই শুনলাম কলেজ স্ট্রীটে এক মিটিং-এ তৎকালীন সরকারী ছাত্র-সংগঠনের নেতা বলছেন – ওই AIDSO কে আমরা কী বলি জানেন? বলি – “ AIDS Organization”। গলে পচে যাওয়া একটি সংগঠন। ওদের কথায় ভুলবেন না। একথা শুনে যখন তপ্ত আঁচে টক্টকে লাল হয়ে উঠছে একনিষ্ঠ AIDSO সদস্য-কর্মী আমার বন্ধুর মুখ, তখনও কিচ্ছু করিনি। ডাল-ভাত রবীন্দ্রনাথ আর দশটা-পাঁচটায় অভ্যস্ত আমার আত্মা আমাকে উস্কে দেয়নি ভীড় ঠেলে ওই কথার দিকে এক-দলা থুতু ছুঁড়ে দিতে।
যখন চোখের সামনে ঘটে গেল নন্দীগ্রাম গণহত্যা, যখন লালগড় অঞ্চলে একের পর এক মানুষ খুন হলেন, এক রাজনৈতিক নেতার মা ও বোনকে দরজা বন্ধ করে পুড়িয়ে মারা হল, তখন?
নাঃ। কিচ্ছু করতে পারিনি। শুধু দিশাহীনভাবে ভেবেছি – এর প্রতিকার কী? কোথায়? কার হাতে? নির্বোধের মতো শুনে গেছি চোদ্দটা লাশকে আট আর ছয়ে ভাগ করে শকুনের মতো টানাটানি করছে দুই পক্ষ। সবাই নিজের পক্ষে দুটো লাশ কমাতে তৎপর। আর আমি ভেবেছি আমার জায়গা কোথায়?
ওই শায়িত চোদ্দটা লাশের পরের শূন্যস্থানে শুয়েছিলাম। আর কিচ্ছু করতে পারিনি।
রাগ হয়েছে। অব্যক্ত ক্ষরণ-যন্ত্রণায় অস্থির হয়েও কিছু করতে পারিনি, কারণ কী করতে পারি তা জানতাম না। আজও জানি না।
এরপর একের পর এক নারী নির্যাতন, ধর্ষণকে নবীন শাসকের প্রত্যক্ষ সমর্থন, ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করার হুমকি ও তার সপক্ষে সরকারের প্রাণপণ আইনি লড়াই, পাঁড়ুই, লাভপুর, কামদুনি, সারদা ও সব শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি সন্ত্রাস। আবার ভাবছি, অসহায়ের মতো ভাবছি, প্রতিকার ... প্রতিরোধ ... প্রতিবাদ ...
বোকার মতো, নিষ্ক্রিয় হয়ে যখন ভাবছি এই উপায় খোঁজার কথা, আমারই ছোটো ছোটো পাঁচ ভাইবন্ধু একটা ছোট্ট নাটক লিখে, রাত জেগে রিহার্সাল করে, তাকে রেকর্ড করে ছড়িয়ে দিল আমাদের মধ্যে। খুব শান্তভাবে ওরা দেখিয়ে দিল নিজের জায়গা থেকেই কত কিছুই না করা সম্ভব! পুজোর ছুটিটুকু তারা ভেবেছে কীভাবে এই কলরবের ভেতর মিশে যাতে পারে তাদের কন্ঠস্বর। রাজপথ দখল করে নেওয়া ওই লক্ষ নিশানের ভেতর কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় আরও একটি নিশান। যখন ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে কলরবীদের, লাবণি থেকে তেরজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়, আর উলটোদিকের স্টলে চুপ করে বসে দেখছেন মহিলা সমিতির বক্তৃতাসর্বস্ব নেত্রী-কর্মীরা, তখন ছ-মিনিটের এই নাটকে ধিক্ধিকিয়ে জ্বলে উঠছে যৌবসমিধ!
বৃষ্টি পড়ুক রক্ত ঝরুক ঝরুক শত মার
শাসকদের এই মারণখেলায় সহস্র ধিক্কার
বারুদগুলো জমা আছে জ্বলবে সময় হলে
দাঙ্গাবাজি মানছিনেকো উড়ছি ডানা মেলে
রাজার আসন জানে নাকো বাড়ছে শিকড় অন্তরে
উঠবে হঠাৎ মহীরুহ গোপন কোনো মন্তরে ...
শুধু শাসক নয়, উর্দিধারী ক্রীতদাস নয়, আমার মতো যারা রয়েছে হতবাক, চুপ ও দ্বিধান্বিত তাদের নির্জীব অন্তরাত্মাকেও এক বিরাট ধাক্কা দেয় এই পবিত্র প্রচেষ্টা। মনে পড়ছে সেই সব মানুষের কথা যারা বর্মায় লুন্ঠিত মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য, দীর্ঘকাল অন্যায়ভাবে গৃহবন্দী জননেত্রী সু কি-র মুক্তির জন্য গোটা দুনিয়া জুড়ে ডাক দিয়েছিল সূর্যমুখী ফুল-ফোটানোর। যে মানুষ জানে না বর্মাদেশের কথা, প্রবল অত্যাচারী মাদক-চোরাচালানকারী জুন্টা শাসক আর তাদের চোখে চোখ রেখে শিরদাঁড়া টান করে দিনের পর দিনে যুদ্ধরত সু কি-র কথা, সে যখন দেখবে সূর্যমুখীর ঢেউ উঠেছে দিকে দিকে, তখন নিশ্চয়ই জানতে চাইবে – কী কারণ? আর এইভাবে ছড়িয়ে পড়বে অক্লান্ত অকুতোভয় সু কি-র বুকের আগুন দেশকালজাতির সীমানা ছাড়িয়ে।
মারের দাগ একদিন মিলিয়ে যাবে। শাসক বদলাবে। পতিতোদ্ধারিণীর স্রোত নিজের বুকের গভীরে টেনে নেবে আরও নররক্ত, হাড়, হলাহল। কিন্তু শাসকের মারের মুখে নতুন প্রজন্মের এই প্রতিবাদ চাবুকের দাগের মতো জ্বল্জ্বল্ করবে অনাদিকাল। - অক্ষয়, অবিনশ্বর, অনির্বাণ।
এই বিজয়ায় আমার অন্তরের সবটুকু প্রণাম জানালাম এই নাটকের পাঁচ কুশীলবকে যারা আমার চিন্তার অতীত, যারা আমার সমস্ত ব্রতের মূর্ত অভিলাষ, যারা সৌপ্তিক, নিজেদের একাগ্র সমর্পণ ও জেদের অর্ঘ্যে যারা জয় করে ফিরছে গোটা দুনিয়া ...
https://soundcloud.com/sarbojit-sarkar/hok-kolorob