এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বইমেলা বইমেলা

    Parthasarathi Giri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ | ২১০৮ বার পঠিত
  • বইমেলা বইমেলা

    ▶️

    পরমেশ জোয়ারদারের আমাশা কোনোকালে ছিল না। কখনও কবিতা লেখেননি এবং দুই হাতের দশ আঙুলে সর্বসাকুল্যে আটটি জিএসআই সার্টিফায়েড মহার্ঘ পাথররাজি।
    পরমেশ বাবু কোল ইন্ডিয়ার অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসর নেওয়ার কিছুদিন আগে মরিয়া হয়ে ছত্রিশ বছরের বিবাহিত পত্নীর সঙ্গে সেক্স করার চেষ্টা করেছেন। চাহিদা ও জোগানের সূত্র ব্রেকডাউন করে একটু দরকচা টাইপ হলেও, আদতে খুব একটা মন্দ ছিল না কম্মোটি। যদিও পত্নী সংযুক্তা দেবী এর জন্য তাঁকে বিস্তর বকাঝকা করেছেন, 'বুড়ো ভামের নেত্য' বলে কিম্ভুত উপমা দিয়েছেন, কিন্তু তিনিও যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছেন যে কত্তার হার্টসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি বেশ জোরদারই আছে।
    পরের দিন বিকেলে সহেলি সখীদের চায়ে নেমন্তন্ন করেছিলেন, আসলে এই পরমাশ্চর্য ঘটনাটি রসিয়ে কষিয়ে জুতসই উদযাপন করবেন বলে। কিন্তু পরমেশ সেদিন দুপুরের পর ভাইয়ের কাছে গেলেন না বলে চা-পার্টি মুলতুবি রাখতে হয়েছিল। কত্তার সামনে কত্তার কুকীর্তির বর্ণনা লাগসই হয় না।

    কলকাতার উপকণ্ঠে তাদের বাংলো প্যাটার্ন দোতলা গৃহখানি সতেরো শো স্কোয়ার ফুট কার্পেট এরিয়া সহ গঙ্গার দিকে মুখ ফেরানো। একমাত্র ছেলে পনেরো বছর বিদেশে বসবাসকারী বউ কন্যাসহ। গৃহের কেয়ারটেকার সনাতন বিশ্বস্ত ও চৌখস। গাড়ির ড্রাইভার শিবলাল। পরমেশ গোলাপের টবে ওয়াটারিং করতে করতে নানাবিধ সুদ ডিভিডেন্ড বাবদ মাসিক প্রায় লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করেন এখনও।

    এহেন পরমেশ বাবু এবং তাঁর পত্নী সংযুক্তা, উভয়ের একটি সুন্দর আলোকোজ্জ্বল সকালে শখ হল লেখক হওয়ার। দুজনেরই ধারণা তাঁদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার উপচে পড়েছে জীবন সায়াহ্নে। কাজেই জনগণে সেসবের ভাগ বাঁটোয়ারা করা আবশ্যিক কর্তব্য।
    এছাড়াও দুজনেরই ধারণা যে, তাহাদের উইট হিউমরের প্রখরতা বিদ্যমান। লেখাগুলো হবে বটে এই সব রসদে।প্রৌঢ়তার সঙ্গে লেখালিখির জগৎটা সেঁটে গেলে জীবনভর চাকুরীসর্বস্ব ছাপোষা দেখনদার আপন মহল থেকে বেরিয়ে জীবনদর্শন টর্শন নিয়ে দেশ কাল সময় নিয়ে ভাবিত শ্রেণিতে পাখা মেলে দিব্য শ্লাঘা মিলবে।

    এই সব নিউ ওয়েভ চিন্তা ভাবনা তারা পরষ্পর আলোচনা করে ঠিক করছেন তা নয়। চায়ের টেবিলে, সান্ধ্য টেলিভিশনের সিরিয়ালে টুকটাক কথাবার্তায় বাসনাটি পাখা মেলেছিল দিনে দিনে।

    সংযুক্তা একসময় তার বাবার চাকরির সূত্রে সাউথ আফ্রিকায় কনভেন্ট স্কুলে বাচ্চা পড়িয়েছেন। দেশ বিদেশ ঘুরেছেন। বিদেশি জার্নালে ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। কাজেই শেষ বয়েসে গপ্পো উপন্যাস লিখতে সাধ হওয়াটা বিসদৃশ কিছু নয়। আর পরমেশ নাইবা যৌবনের কবিতা লিখলেন, আমাশায় ভুগলেন, এই যে কোল ইন্ডিয়ার এতদিনের গুরুপদ চাকরি, বদলি, ফন্দিফিকির প্যাঁচ পয়জার, এই সব অভিজ্ঞতা ফেলনা নাকি?

    পরমেশ বাবু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুললেন। সংযুক্তা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুললেন বেশ ঘটা করে। নিজের পেজ একটি খুললেন। সেদিনও বেশ জমকালো জমায়েত হল রুফ টপ গার্ডেনে। মহিলাদের জন্য ঘোষিত বিউটি পত্রিকা 'ললিতা'র সম্পাদিকা সুরঞ্জনা মুখুটি সহ বাঘা বাঘা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী বেসরকারী কর্মীবাবুরা এসেছিলেন।

    সুরঞ্জনা মুখুটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সহযোগে লাইম কর্ডিয়াল জিনে এতটাই প্রফুল্ল হলেন, প্রস্তাব দিয়ে বসলেন প্রতি পাক্ষিকে একটি কলাম এবং একটি অণুগল্প সংযুক্তাকে লিখতেই হবে। কলামের সঙ্গে অণুগল্প আসার কারণটি আর কিছুই না, সংযুক্তা পাইকিরি রেটে কিছুদিন যাবত অণুগল্প লিখছিলেন। একদিন তো গড় রেট ছাড়িয়ে পাঁচটা অত্যাশ্চর্য অণুগল্প লিখে ফেলেছিলেন চারবেলায়। পাঁচটার বিষয়ই ভয়ানক কনটেম্পারারি। সেগুলি যথাক্রমে শিশুশ্রম, এসকর্ট সার্ভিস, স্ত্রীর অধিকার, বিরিয়ানির হ্যাংলামি এবং গৃহ পরিচারিকার বিলুপ্তি।
    অণুগল্পমালা তিনি ল্যাপটপে থরে থরে সাজিয়ে বৈকালিক সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন। সেদিন প্রভূত খাদ্য পেয় সমারোহে ব্যাপারটা ডিটেলে বলতে পারেননি। আভাসে ইঙ্গিতে সেরে রেখেছিলেন।

    সেদিক থেকে দেখলে পরমেশ সংযুক্তার তুল্যমূল্যে হালে পানি পাচ্ছিলেন না। তিনি রোজ একটি স্মৃতিকথা এবং বিকটাণু গল্পে আটকে গেলেন। কমোডে বসে এক সকালে এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলেন পায়ে ঝিঁঝি ফিঁঝি ধরে নাস্তানাবুদ। ওয়াশ করতে গেলেই পায়ের ঝিঁঝি ঝনঝন করে উঠছে কথাকলির ঘুঙুরের মতো। একবার ভাবলেন সংযুক্তাকে ডাকবেন। ইগো একটু গা মটকাল। সংযুক্তাকে ডাকলেও অবশ্য তিনি সাহায্য পেতেন না। সংযুক্তা তখন 'কবির ব্রহ্মচর্য' নামক কলামে অথৈ বানভাসি, সংজ্ঞাহত জ্ঞানরহিত।

    পরমেশ বাবু প্রথমে একটু ধাক্কা পাড় ধুতির স্টাইলে নিজেকে বয়ান করেছিলেন। 'আমি কী আর এমন লেখক' বা 'পঙতি ভোজনে যদিও আমি শেষ মেম্বার' লিখে তারপর নানাবিধ গপ্পো সপ্পো ফাঁদছিলেন গ্রুপে গ্রুপান্তরে। প্রথমে লাইক ফটাফট পাচ্ছিলেন কেননা তিনি প্রতিদিন গড়ে সাড়ে পাঁচশো লাইক বিলিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? তিনিও সুড়সুড় করে বেশ লাইক কুড়োচ্ছিলেন। বাঃ, অনবদ্য, দারুণ, খুব ভালোলাগল, এ সব পেতে পেতে কেলো হল যখন কেউ কেউ হঠাৎ বেমক্কা বলে বসলেন, 'একটু কম বললে বেশ হত।' এইখানে পরমেশ বাবু চমতকৃত হতে হতে চমকিয়ে গেলেন। সংযুক্তাকে অবশ্য এই টানাপোড়েনের বিন্দু বিসর্গ টের পেতে দেননি।

    তারপর এল গ্রুপে গ্রুপে গেট্টুর হিড়িক। এইটা কিন্তু ব্যাপক সরেস একটা ব্যাপার। সঙ্গলিপ্সু প্রৌঢ় বয়স গেট টুগেদারের জন্য সতৃষ্ণ। খাওয়া দাওয়া আর 'সেভেনটি থ্রিতে আমি একটা অর্থোডক্সকে প্যারাডক্সে আনলাম, সে এক ব্যাপার বটে।' লালরঙের গোল টেবিল ঘিরে চাপা ব্যঙ্গ, গা চিমটোনোর ভিড়ে এইসব রোমন্থন বেশ লেগেছে।

    ক্রমে ক্রমে সংযুক্তার দর দহরম বাড়তে লাগল পরমেশের তুলনায়। ফেসবুকে প্রতি আধঘন্টায় স্টেটাস আপডেট। মাটি কাঁপলে 'শেষের দিন কি সমাগত?'। কবি মরলে, 'অমুকের শ্রাদ্ধে আলাপ হয়েছিল। শব্দের অমন অমায়িক কান্ডারীর প্রয়াণে বাঙালি চুপ কেন?' ইত্যাদি প্রভৃতি।
    বড় মাঝারি পত্রিকা অফিসে যাতায়াত করতে করতে অমুকের দাদা তমুকের বৌদি পরিচয়ের খাতে আপন মনের মাধুরী দীক্ষিতকে সাজিয়ে গুছিয়ে পেশকাশ করতে লাগলেন। কিন্তু মন পড়ে রইল আসলি লেখক বায়নাতে। দুচারখানি নিজের লেখা বই আহা! ড্রয়িংরুমের শোভা। যেমন গড়িয়াহাট মোড়ের শোভা ট্রেডার্স ফচকেমি।

    সংযুক্তা কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছিলেন পরমেশ ঠিকমতো যেন দাড়ি শেভ করছেন না। শেভ করার পরেও চিবুকে বিস্তর চুল থাকছে। কত্তার হাত কাঁপছে নাকি আজকাল? ঘরোয়া ডিজিটাল বিপি মেজারিং মেসিনে দেখা গেল ব্লাড প্রেশার ১৭২/৯০। পারিবারিক মিত্র ডাক্তার ত্রিপাঠী ভয়মুক্ত করলেন, এই এজে এটা কোয়ায়েট নর্মাল। একদম ঠিকঠাক। তবে?

    সপ্তাহ পেরোতে প্রকাশিত হল পরমেশের ফ্রেঞ্চ কাট সুষমা। সংযুক্তা একটু ফোড়ন কাটলেন, ঘাবড়ে দিয়েছিলে কিন্তু! বেশ লেখক লেখক লাগছে এখন। পরমেশ দাড়িতে হাত বুলিয়ে ভাবছিলেন, কফি হাউসটা মাস্ট এ সব ব্যাপারে।

    গুটি গুটি পায়ে শেষ দুপুরে কফি হাউসে উপস্থিত হলেন। এত শব্দ কেন? দেখলেন জানালা টানালা বিশেষ নেই, এমন একটা ফ্লোরে শতাধিক লোক নাগাড়ে বকে চললে এই নাদব্রহ্মই ওঠে। বেশ। তবে তাই হোক।

    এক উঠতি প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ হল। সৌম্যসুন্দর গুহ। আহা যেন দেবদূতের আগমন। বই বানিয়ে দেবেন। দুশ কপি প্রথমে। চল্লিশ হাজার টাকা মূল্য দেয়। বই বাজারে কাটলে রয়্যালটি দেবে। বাঃ! এ তো দিব্য ব্যাপার! ঈশ্বরের কৃপায় ৪০০০০ টাকা পরমেশের কাছে এক টিপ নস্যতুল্য। আহা! লেখক স্টেটাস! এই অবসরপ্রাপ্ত জীবনে গণ্যিমান্যি কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক মিডিয়া-বোয়ালদের সঙ্গে ওঠাবসা। ভাবা যায় না!
    কফি হাউসটা যেন পলকে বাংলা অ্যাকাডেমির হলঘর হয়ে গেল। ডায়াসে পরমেশ নিজেকে দেখছেন, পাশে প্রথিতযশা জনপ্রিয়তম অতিপ্রৌঢ় লেখক। ফিচিক ফিচিক ছবি উঠছে। পরমেশ মৃদু সুললিত ফ্রেঞ্চ কাট হাস্যে ভার্জিন কপিটি বুদ্ধের বরাভয় মুদ্রার মতো ধরে আছেন বুকের ওপর। হাজারদুয়ারি পত্রিকার লেখকশিরোমণি দু চার শব্দে বইটিকে ব্যাখ্যা করলেন, 'মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ গুরুর জাবর যেমতি'। পরমেশের আশ্লেষে ঘুম পেয়ে গেল যেন!

    চেতনা ফিরে এলেই ফেসবুকে বোমাটি পাঠালেন। 'আসন্ন আমার সন্তানের শুভমুক্তি।' মুহূর্তে খবর রটি গেল নগর শহরে দেশে দেশে। নোটিফিকেশনের পিং শব্দে মোবাইল নাচতে লাগল লাগাতার। কমেন্ট সমূহ নিম্নরূপ :-
    'এ মা! ছ্যাঃ ছ্যাঃ!'
    'এই বয়সে?'
    'রস কত!'
    'বিকলাঙ্গ জন্মাবে।'
    'সময়ে অ্যাবরশান করিয়ে নেননি কেন?'
    'জন্মিয়েই ফটোতে ঝোলা আপনাকে দেখে তেড়ে অভিশাপ দেবে।'

    পরমেশ এই করেন কি ওই করেন! এ কি অর্বাচীনতা! কী কথার কী মানে! অনেক ভেবে স্টেটাস আপডেট এডিট করে 'বইমেলায়' শব্দটি যোগ করলেন। 'আসন্ন বইমেলায় আমার সন্তানের শুভমুক্তি।'
    ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল পরমেশের। লাইকে ভেসে যেতে লাগল স্টেটাসবোমা। লাল ফন্টে 'অভিনন্দন' শব্দতে আঙুল ছোঁয়ালে কনফেত্তি ফেটে ফুটে গেল।
    বাড়ি ফিরে দেখলেন সংযুক্তা দাঁতে দাঁত চিপে চা খাচ্ছেন আর বিড়বিড়। বলি কান্ডজ্ঞান কি লোপ পাচ্ছে দিনে দিনে? সন্তানের শুভমুক্তি! ছিঃ ছিঃ! বিদেশে বসে ছেলেটা যদি তোমার এইসব কীর্তি দেখে, কী ভাববে বলত?

    বইমেলার এক হপ্তা আগেই দুজনের বইয়ের ভার্জিন কপি হাতে এসে গেল। পরমেশের সাবেকহাল প্রকাশনী, সংযুক্তার পরমা প্রকাশনী। নাম হল যথাক্রমে 'পরমেশের পরবাস' এবং 'আজবনগর'। পরমেশের চার ফর্মার ডিমাই সাইজের বইয়ের নীল প্রচ্ছদে একটি মানুষের স্কন্ধোপরে গুলি পাকানো সুতোর মতো চাঁদ। সংযুক্তার অপেক্ষাকৃত স্লিম বইয়ের মেরুন প্রচ্ছদে গাড়ির বাতিল টায়ারের ফাঁক দিয়ে একটি কুকুরের মুখ। দুটির প্রচ্ছদেই বিমূর্ত শিল্পভাবনা। যদিও দুজনের কারোর তেমন একটা ভাললাগেনি, অঙ্কনশৈলীর উচ্চমার্গতার কারণে মেনে নিয়েছেন।



    সাবেকসাল প্রকাশনী থেকে সৌম্যসুন্দর স্পেশাল নজর দিয়ে বইমেলায় স্টলে পরমেশের বইয়ের বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ করেছে। পরমেশ স্টল তৈরীর সময় হালকা সার্ভে করে এসেছেন। সংযুক্তা অবশ্য নিজে যাননি সরেজমিন দেখভালে, পরমার কর্ণধার মিসেস কাঞ্জিলাল আশ্বস্ত করেছেন বইয়ের বাজারজাতকরণের ব্যাপারে।

    শুভদিনে স্টলে লেখক দম্পতি স্টলে স্টলে বসে রয়েছেন। ওদের কাছে অবশ্য পুরো হপ্তাই শুভদিনে ভরপুর। স্টুল থেকে উঠে উঠে শেল্ফে শেল্ফে জনতার ঘেঁটে যাওয়া বই পরমেশ নিজহাতে সোজা টোজা করে দিচ্ছেন। সংযুক্তা পরমার স্টলে বসে ঠোঁটের কোণে অলৌকিক মৃদু একটি হাসি-হাসি হাস্য ছুঁইয়ে রেখেছেন। যেহেতু দুটিই নবীন প্রকাশনা সংস্থা, জনতার পুস্তকক্রয়ের প্রকরণ এ বাটে একটু অন্যরকম, নাজুক টাইপ। বাঘা সংস্থায় কেনাকাটির হৈ চৈ নখরা বাজেট সব উচ্চকোটির।

    সংসার নির্বাহকালে এই সব আদাল বাদালের খবর তাদের জানা ছিল না বলে লেখক দম্পতি অত্যন্ত আগ্রহে জনগণমন নিরীক্ষণ করছেন। সংযুক্তা পরের কলামের সাবজেক্ট পেয়ে গেলেন। 'বইমেলার বই-কুণ্ঠ'। তির্যক দৃষ্টিপাতে তিনি ওই লেখায় বইমেলাকে ফালা ফালা করে ধুদ্ধুড়ি নেড়ে দিতে চান। কিন্তু থেকে থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসছে কেন?

    পরমার সাতশ একাশি নম্বর স্টলটি পাবলিক টয়লেটের লাগোয়া বাঁদিকে। জনতা প্রস্রাব সেরে ফটাকসে পরমাতে ঢুকে বই টই দেখে ধাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ হেঃ! হাত টাত সবাই ঠিকমতো ওয়াশ করছে তো? নাকি এমনি এলেবেলে হাতে তার প্রিয় সৃষ্টির বুকে হাত মারছে?

    সংযুক্তার বড্ড দিগদারি এসে গেল দেখে শুনে। আধোয়া হাতে তার বই শত হাতে চটকাচ্ছে? সংযুক্তা বড্ড পিটপিটে মানুষ। সংসারে মাসিক লিক্যুইড হ্যান্ড ওয়াশই বরাদ্দ চার বোতল। হাত ধুয়ে ধুয়ে হাজা লেগে যাওয়ার জোগাড়। এ হেন লেখকের বইয়ে পেচ্ছাপমাখা হাত?

    সংযুক্তার মস্তিস্ক ক্রমোত্তপ্ত হল। ঘন ঘন নাক থেকে রিমলেস চশমা হড়কে গেল। গা থেকে থেকে রি রি করে উঠল। পরের বই আর কভু পরমাকে নয়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তার কপালেই কিনা পাবলিক ইউরিনালের সংসর্গ!

    সংযুক্তার রাগ পিছলে গিয়ে পরমেশের ওপর পড়ল। উনি তো দিব্য সাবেকহালে হালে পানি কাটছেন! একবার সতর্ক কথা যেত না তাকে? বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যেত স্টলে। ন্যাপকিন টিস্যু পেপার, ডাস্টার ইত্যাদি হরেক আইটেম ছিল।

    রেগে টং হয়ে সংযুক্তা ফোন করলেন পরমেশকে। নট রিচেবল্। ধ্যাৎ গুষ্টির রিচেবল্ পিন্ডেবল্। বইগুলো না জানি কী বিরক্ত হচ্ছে কাঁচা ইউরিয়ার স্পর্শে! সংযুক্তা থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে স্টল থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন এবং ফুড কোর্টের উদ্দেশে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।



    আজ বইমেলার শেষদিন। সন্ধ্যা আটটা মতো বাজে। একটু পরেই লাস্ট বেল বাজবে। লোকজন করজোড়ে যেন ক্যারলে প্রভূ যিশুর উদ্দেশে দোয়া প্রার্থনায় লাল প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে পাছা তুলে উঠে দাঁড়াবে। তার আগেই পরমেশ এবং সংযুক্তা ড্রাইভার শিবলালকে পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি বার করতে বললেন।

    এবারের বইমেলায় তাদের একটি বইও বিক্কিরি হয়নি। পরমেশের এক কপি বইয়ে চায়ের কাপ উল্টে যাওয়াতে সেটি এখন পরমেশের গাড়ির ডিকিতে। সংযুক্তার একটি বইয়ে একটা ছোঁড়া নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে হাতের পেচ্ছাপ মোছার জন্য অনেকক্ষণ ঘেঁটেছে বলে সেটিও এখন গাড়ির নোংরা ডিকিতে। বাকি একশ নিরানব্বই গুণিতক দুই সংখ্যক বই শেল্পে এবং গাঁটরি বাঁধা ইনট্যাক্ট।

    গাড়ি বইমেলার তোরণকে ডানহাতে রেখে বাইপাশ রোডে বেঁকে গেল। শিবলাল দিনকতক ঘ্যান ঘ্যান করছে ছুটি নিয়ে নিজভূম ছাপরায় যাবে। মেজ ছেলের বিয়ের ইন্তেজাম। কিসের ছুটি? অ্যাঁ কিসের ছুটি? ওসব হবে না। বিয়ের দিন যেও। পরমেশ দাবড়ে দুবড়ে দিয়েছেন।

    শিবলালের মাথায় বোধহয় রাগ ছিল। রাস্তার পাশের টায়ারের স্তুপে গাড়ি গিয়ে মারল বেমক্কা ধাক্কা। তেমন জোরালো কিছু নয়। গাড়ির ডিকি খুলে বইদুটি রাস্তায় পড়ে গেল। শিবলাল সিট থেকে বেরিয়ে বাইরে ক্ষয়ক্ষতি কিছু হয়নি টয়নি দেখে টেখে গাড়ি নিয়ে প্রবল বেগে বেরিয়ে গেল।

    মেরুন টায়ারের স্তুপ থেকে উটকো ঝামেলায় বিরক্ত কুকুরছানাটি বেরিয়ে দেখল পথপরে নীলরঙের কিম্ভুত অজানা বস্তু। গুলি পাকানো সুতো দেখে শিশ্ন সুড়সুড় করে উঠল। জঞ্জাল দেখলেই মার্জার সারমেয়দের হিসু পায়। অগত্যা গুলি পাকানো সুতোর চাঁদে এক ঠ্যাং তুলে চমৎকার হিসুকর্মটি সমাধা করল এবং অপসৃয়মান গাড়ির লাল ব্যাকলাইটটাকে দেখে পরিষ্কার কুকুরের গলায় বলে উঠল, মরণ!
    বাইরে অবশ্য শোনা গেল 'ঘেউ।'
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ | ২১০৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রিভু | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:২৭50499
  • সুখপাঠ্য। সমস্যা অবশ্য প্রাচীন।
  • সিকি | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৫50500
  • চমৎকার! আরো বারচারেক পড়ব। অতি উপাদেয়!
  • pi | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৯50501
  • :)))

    এরকম যে কত দেখার সুযোগ হচ্ছে, গত ক'বছর ধরে!
  • dd | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৭50502
  • খুবি মজার লেখা।

    আরো চমৎকৃত হলাম লেখকের versatality দেখে।
  • T | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:০০50503
  • এ লেখা কিশু হয়নি। জাস্ট কিচ্ছু না। এরম মোটাদাগের স্ল্যাপস্টিক লেখা এই লেখকের কাছ থেকে আশা করি না।
  • জি | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৮50504
  • চমৎকার লেখা।
  • Tim | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৪৭50505
  • হ্যাঁ এরকম একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। ঃ-)

    বিষয় হিসেবে প্রাসঙ্গিক কিন্তু গপ্পোটা পড়ার সময় ভালো লাগছিলো না। তবে শেষ প্যারাটা হেব্বি হয়েছে।
  • | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:০১50506
  • কেমন জাজমেন্টাল বিশ্রিমত লেখা।
  • সুকি | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:৫৬50507
  • লেখা খারাপ লাগলে সাধারণত কমেন্ট করি না - এই লেখকের অন্য লেখা পড়ে যেমন ভালো লাগে এবং উনার লেখনী শক্তি যেমন মনে হয়, তার কাছে এই লেখা একদমই পৌঁছয় নি। একদমই ভালো লাগল না।
  • de | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৬:১০50508
  • মজা লাগলো পড়ে -

    এরকম লোকজন দিব্বি দেখা যায় চারপাশে -
  • শঙ্খ | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৬:২৬50509
  • আমার আবার দিব্য লাগল। লেখনীর গুণে না, তার দরকারও নেই। চারপাশে এত এত উদাহরণ দেখি, এই লেখাটা একদম সেই পপুলেশনকে টার্গেট করছে। তাও তো পুশ সেল নিয়ে লেখেন নি। আজকাল এত এত ফেসবুক কবি ও লেখক, আর পারা যায় না।
  • Parthasarathi Giri | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ১০:৪৭50510
  • প্রিয় পাঠকবন্ধুদের প্রীতি। লেখার বিষয়কে ইচ্ছাকৃতভাবে একটু লঘু করার চেষ্টা করেছিলাম, গুরু করে সুরাহা মেলার নয়(যদি অবশ্য সুরাহা বলে কিছু হয়)।
    বিষয়ের সঙ্গে যায় যে ভাষার ধরণ, সেইটি নেওয়ার চেষ্টা করেছি, যদিও এমন ভাষার চলনে আগে কখনও লিখিনি। আমিও কিছুটা নাক কুঁচকেই গপ্পোটা লিখেছি।
  • | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:৪৩50511
  • আরে যা প্রাণে চায় লিখুন না, আমরা আপনার ফ্যান। নিন্দে করবো মাঝে মাঝে কিন্তু আপনার লেখায় আমরা অনেকেই একেবারে মুগ্ধ। ট এর সমালোচনা একটা লেখাগুলোর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। ঈশ্বর করুন আপনার যেন কোন একটা নির্দিষ্ট জঁর না হয়, যখন যা তাগিদ অনুভব করবেন লিখে ফেলুন, আমার দুর্দান্ত লাগে আপনার লেখা, জ্জিও গুরু।

  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৪১50512
  • কাগজের এই রকম অপচয় হয় বৈকি, ওতে শেষ পর্যন্ত মুদ্রণ শিল্পেরও উপকার হয় না। লেখাটা আরো সাবলীল হতে পারতো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন