এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • সামনে আলো নেই

    Parthasarathi Giri লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৭ এপ্রিল ২০২০ | ৩৪৭৩ বার পঠিত
  • কিছুদিন আগে ডিমানিটাইজেশন হয়ে গেছে। আমাদের দেশের লোকগুলো আর যাই করুক, দু পয়সা জমাতে জানত। ধনীরা ন্যাশনালাইজড্ ব্যাংকে, বা শেয়ারে মিউচুয়াল ফান্ডে। আপামর দরিদ্র দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ লক্ষ্মীর ঘটে, টিনের ট্রাংকে জমাত। গাঁয়ের প্রতিটি বউয়ের একটি গোপন ব্যাংক থাকে চালের হাঁড়ির ভেতর, সত্যপীরের বেদীর তলায়। বলতে নেই, চরম অসময়ে কিষান তাঁতি জেলে কাঠুরের পুঁজি সাপ্লাই দিত এই ব্যক্তিগত ব্যাংক।

    বহু হাজার গ্রাম রয়েছে, যাদের একটি সমবায় ব্যাংকে পৌঁছতে দশ মাইল হাঁটতে হয়। দরিদ্রের সে সব অলিখিত পুঁজি সরকার রাতারাতি নষ্ট করে দিয়েছে।

    পুঁজিহীন এই সব মানুষেরা তারপরও মাটি কর্ষিয়ে জল ঢেলে, গায়ের ঘাম নিঃশেষ করে শাকসবজি ফসল ফলিয়ে আমাদের বাঁচাবার আশা জাগিয়ে রেখেছিল। আমরা তাই খেয়ে কোনোমতে বাঁচছিলাম। আজ মাঠ খালি। লক্ষ্মীর ঘট শূন্য।

    ফড়ে আড়তদারে দেশ ভরেছে। চাষী টোম্যাটো বেচে ষোল থেকে কুড়ি টাকা পাঁচসেরি পাল্লা। খুচরো বাজারে সেই টোম্যাটো চল্লিশ টাকা কিলো। চাষী মূল্য পায়নি। উপভোক্তা এবং উৎপাদকের মাঝে হাতফেরতা ফড়ে দালাল আড়তদার দই মেরে দিয়েছে। উৎপাদকের কেউ কেউ দেনার ভারে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।

    অজস্র সরকারি স্কিমের টাকা মাঝপথে উধাও হয়ে গিয়েছে। সেখানেও উদ্যম ফি। অর্থাৎ কিনা টাকা পাওয়ার মাঝপথে অনেক পকেট। সেগুলোতে নজরানা দিতে দিতে যৎকিঞ্চিত উদ্যোগকারীর হাতে পৌঁছোয়।

    তার মধ্যে গাঁয়ের ঝি ঝিউড়ি কুটিরশিল্পে বাঁচার চেষ্টা করছিল। মাত্র দুটি হাত সম্বল করে, আর বাপ জেঠার কাছ থেকে পাওয়া পুরুষানুক্রমে শিল্পবোধের উত্তরাধিকারে।
    ভারত সরকারের অসামান্য চীনপ্রেম সে সব কুটির শিল্পকে ধীরে ধীরে গলা টিপে মেরেছে। মাটির পুতুল মরে গেছে। এসেছে সস্তার প্লাস্টিকের চীনা পুতুল। কাঁচা চামড়ার অল্পদামের জুতো বানাত মেয়েরা। সে সবের জায়গায় এসেছে চীনা ক্যানভাসের সস্তা জুতো। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি।

    শুধু মরা পুতুল নিয়ে পুতুলখেলার কাহিনি এটা নয়। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করার কাহিনি। একটি আমদানি নির্ভর দেশে পরিণত হওয়ার সরকারি দাস্তান।
    ভারত রপ্তানি করত। কী করত? বাগদা। কাজুবাদাম। এমন শভাগ রপ্তানিযোগ্য আইটেম। ব্রিটিশ আমলের নীলচাষের মতোই ঘটনা। ভাগাড় অত্র। বাগিচা অন্যত্র।

    যা কিছু পরিবেশের ক্ষতিকর, তাই ভারত চষে গেছে। ধনী দেশকে বেচে গেছে। বাগদার ভেড়ির পর ভেড়ির নুনে শালি জমি মরে কাঠ। নুনে ক্ষারে সরস মাটি জমে কাঠ। অর্থাৎ একটি অস্থায়ী কৃত্রিম নষ্ট অর্থব্যবস্থা। পার্টির ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত একটি অনিষ্টকর সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল গত চার পাঁচ দশকে।

    আজ মিঃ মুদীর জগতসভায় যা কিছু বুলি বুলবুলি, সব এই অস্থায়ী কৃত্রিম ঠেকনার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে। ভারত সরকার ভেবেছিল, এই চলবে। মন্দ কী! সুতরাং দুটি মাত্র কুমীরছানা চাই। এক পাকিস্তান। দুই মুসলিমহীন দেশের বায়না। সব সমস্যাকে পলকে সরিয়ে দেবে এই দুটি তাসের চাল।

    সাম্প্রতিকে দেখছি নিজামউদ্দিন তবলিঘির ঘটনা। ঘটনার স্রোত সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে নিপুণভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া হল ধর্মীয় বিদ্বেষে। কিভাবে? পর্যবেক্ষণে থাকা সেন্টারে সম্ভাব্য রোগীরা নাকি ন্যাংটো হয়ে নার্স সিস্টারদের পুরুষাঙ্গ দেখিয়েছে।
    মিডিয়াকুলপতিরা ফেক নিউজে ছত্রখান করে দিল মুহূর্তে। একটি ছবি নেই। আধুনিক যুগে একটি ভিডিও নেই। কিন্তু অনর্গল ফেক নিউজ।
    আজ জানা গেল গাজিয়াবাদ এইমস বলছে, এরকম কোনো অভিযোগ তারা পায়নি।

    অর্থাৎ, সেই নিপুণ কুমীরছানা দর্শানোর গল্প। ভারত সরকারের অসামান্য নৈপুণ্যে এমন কাহিনি আমরা শুনে শুনে নিজেদের অভ্যস্ত করে ফেলেছি। আমরা মৃত্যুভয় ভুলে যাচ্ছি। আমরা অনতিদূর মন্বন্তর ভুলে যাচ্ছি। আমরা রাগ ভুলে যাচ্ছি। আমাদের ক্ষোভের ওপর ধর্মের আরোপিত ছাই জমছে আজও।

    এ কথা ঠিক যে ভারতের ইতিহাসে হিন্দু মুসলমান প্রেম কখনও ছিল না। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ধর্ম সভ্যতার স্রোতে সহাবস্থানে এসে গিয়েছিল। হিন্দুধর্ম চরম পৌত্তলিক। মুসলিম ধর্ম নিরাকারবাদী। হিন্দুদের ধর্মীয় অজস্র বাহ্যিক মোটিফ আর্কিটাইপ। মুসলিমদের বাহ্যিক নিরালম্বন। ফলত দুই ধর্মের যুগে যুগে সংঘাত ছিল।

    তবু আস্ত একটা সুদৃঢ় দেশ একটি জায়গায় স্থির থাকে। মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে। মাটির ঠিক ওপরে দুই কৃষক, কামারশালে দুই কামার, নদীর পাড়ে দুই কুমোর, ঢেউয়ের ডগায় দুই মাছশিকারি, তাঁতে পা দিয়ে দুই তাঁতির ধর্মের প্রয়োজন গৌণ। মুখ্য ছিল জীবন। কেবল অকৃত্রিম একটি জীবন।

    আজকের ভারতবর্ষ সব মূল্যবোধকে নিপুণতায় কবরস্থ করে দিয়েছে। ধর্মের বৈষম্যকে আপ্রাণ সরাবার পরিবর্তে জনজীবনে চেপে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে দশকের পর দশক। ব্রিটিশের প্রস্থান এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বহুকাল অতীত হয়ে যাওয়ার পরও অসামান্য নৈপুণ্যে নিঃশব্দে ভারত সরকার এই দুই কুমীরছানার ওপর ভিত্তি করে ক্রিয়াশীল।

    এই করে, খুনোখুনি করে, নির্দিষ্ট বিরতিতে একটা পুলওয়ামা সংঘটিত করে চালিয়ে যাওয়া যেত হয়ত। কিন্তু করোনা মহামারি সব সমীকরণকে রাতারাতি প্রহসনে পরিণত করে দিয়েছে। উলঙ্গ লাশের গন্ধটিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কংকালের দেখা মিলেছে গলিত মাংস ভেদ করে।

    তাই সম্মুখে আকাল। ছ মাসের চাল ডাল মজুদ থাকলেই আকাল প্রতিহত হতে পারে না। আমাদের মনোজগতের বিদির্ণ আকাল অনেক বেশী প্রসারিত হয়ে গেছে। আমরা পররাষ্ট্রনির্ভর। আমাদের সস্তার চাকচিক্যে ভরা এতদিনের সুখী গৃহকোণ। আমাদের লুটেরা মনোবৃত্তি। আমাদের ইসলামোফোবিক আরাম। আমাদের চাকরিনির্ভর সম্মান সামাজিকতা। চাল ডালের পাশে আমাদের অন্তর্জাত স্বপাক পঞ্চব্যঞ্জনের সমারোহ।

    আকালের অনেক রঙ হয়। নানাবিধ ঢঙ হয়। আমাদের অজস্র পড়শি প্লাস্টিকের নীলাভ স্যানিটাইজড্ ক্যাপসুলে একাকী কখন হারিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের বেড থেকে সোজা মাটির গভীরে, আমরা কেউ কখনও জানব না। একটি নম্বর মাত্র। কোনো প্রিয়জন, কোনো সন্ততি, কোনো বধু একবার অন্তত চোখের দেখা দেখতে পায়নি তার এতদিনের জীবনের সহচরকে।

    আমি মরে গেলে, আপনি মরে গেলে এভাবেই নিঃশব্দে নিঃসঙ্গতম অন্ধকারে হারিয়ে যাব।

    কিন্তু যদি কোনোক্রমে বেঁচে যাই, মহামারি থেকে শিক্ষা নেব তো?

    ভেবে দেখা যাক।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৭ এপ্রিল ২০২০ | ৩৪৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন