শহরে হেমন্ত আসে না। আসতে আসতে দু'দুটো ঢাউস জোড়া ব্রিজের মুখে সে কর্পুরের মতো উবে যায়। বিকেল নাগাদ একটা অজানা ঠাণ্ডা গন্ধ ছড়ায়। কারোর হঠাৎ মন কেমন করে। প্রয়োজনীয় কথার ফাঁকে ফাঁকে অকারণ ক্ষণবিরতি। এক মুহূর্তের কিছু বা বিস্মরণ। কোথাও কি যাবার ছিল? কেউ আসবে? কী জানি। পথচলতি লোকজন অকস্মাৎ একেকবার চোখ তুলে অকারণ আকাশ দেখে নেয়। কী দেখল কেন দেখল, জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না।
সেসময় রোদ মরে এলে ঘোষগিন্নি ফণিমনসার গাছের টব থেকে গতকালের বাসি প্রদীপ তুলে নিয়ে যেতে ছাদে আসে। ঘষেমেজে কালি তুলে সন্ধেতে আরেকবার উঠে আসবে। রুগ্ন কাঁটা-পাতায় তখন একাকী দৈব আলো পড়ে।
লাগোয়া ছাদে বসাকবাড়ির বউ আনমনে খোলা ছাদের আসলেতে দীর্ঘ কেশপাশ খুলে কী যেন সব মনে পড়াতে চাইলে মনে তেমন পড়ে না। হাতের তালু চুলকোয়। এখানে পাশাপাশি বাড়ির ছাদ জোড়া। প্রায় সব ছাদের আলসের পলেস্তারা খসে ন্যাংটা ইঁট ও সিমেন্টের চলটার জ্যামিতিক নকশা। কোনো একটি চিলেকোঠার ওপর উঠে পড়ে পাখির চোখে দেখলে এক নজরে সদ্য খনন করে তুলে আনা কোনো বিস্তৃত প্রত্নতত্ত্ব মনে হবে। তারে তারে মেলা লুঙ্গি ব্রা শাড়িগুলো খোলামকুচি। ফুলগাছের টবগুলো স্তূপোপরি আগাছা। ডিস অ্যান্টেনাগুলো ছত্রাক।
বসাকবাড়ির যুবতী এয়োতি বউ মেঘে ভাসা রঙ দেখে। দূরের ছাদে উড়ন্ত ব্যাডমিন্টন কক দেখে। আকাশে কচিৎ একটা ভোকাট্টা, দুলে দুলে ভেসে ভেসে কোথায় কোন পাড়ার আকাশমণি গাছে আটকে যাবে। হেমন্ত চিরকাল ক্রন্দসী ভালোবাসে বলে ঐ ভোকাট্টা আর হাওয়ার মধ্যে গুনগুন করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। শহরে হেমন্ত আসে না।
শহরে শরৎ আসে। বিলবোর্ডে আসে। এফএমে আসে। লাইটপোস্টে আসে। হরিসাহার হাটে আসে। শপিং মলে আসে। দশকর্মা ভাণ্ডারেও আসে।
সকাল দশটায় হাতিবাগান বাজারে নিউ গন্ধেশ্বরী দশকর্মা ভাণ্ডারের পরেশ বসাক সহকারী অভয়কে নিয়ে দোকানে মাল সাজাচ্ছিল। বয়াম কৌটো ঠোঙা বস্তা সব পূজার দ্রব্যাদিতে ঠাসা। হরতুকি বহেড়া আমলকির শুঁট, গোটা সুপুরি। তুলসীমালা ঘুনসি আলতা। যব তিল, ধানের ছড়া। ঝুটা শাঁখা-পলা সিঁদুর প্যাকেট, ধুনো গুগ্গুল। সরা ঘটি দীপদানি, মাটির জোড়া লক্ষ্মী গণেশ, চন্দনকাঠ, শোলার মালা। নর্মদা কাবেরী যমুনা গোদাবরীর জল। সরস্বতী মরে গেলেও সেই নদীর জল নিশ্চয় বোতলবন্দি রয়েছে।
অভয় লক্ষ্মী-গণেশের ঘটে ফুল ধূপ চড়িয়ে ভক্তিভরে দু'হাত জোড় করে রোজকার পূজা সারল।
অভয়ের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমায়। সাত আট বছর এই দোকানে মাসমাইনের কাজ করে। বাড়িতে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বউ, হাত-পা পড়া বাপ ও সুস্থ মা।
পরেশ বাবুর ওপরের পাটির তিনটে দাঁত গত সনে তুলে ফেলতে হয়েছে অকথ্য ব্যথার কারণে। এখন দাঁত থেকে ব্যথা গিয়ে কোমরে সায়াটিকা বাত। সত্তর বাহাত্তর বছরের পারিবারিক ব্যবসার দোকান। পুরোনো খদ্দেরদের কথা ভেবে আসতেই হয়। নয়ত বাড়িতে শুয়ে বসে কাটাতে মন চায়। লাগাতার চল্লিশ বছর একঠেয়ে দোকান-বাড়ি করেছেন।
উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলে গায়ে গায়ে বারোয়ারি দুর্গাপূজার ধুম পড়ে। বিশ তিরিশটা প্যান্ডেল এদিক ওদিক এক কিলোমিটারের মধ্যে। এছাড়া বনেদি বাড়ির পারিবারিক পূজা তো রয়েছেই। মহালয়া থেকে গন্ধদ্রব্য, পুজোর হোম ইত্যাদির জিনিসপত্র, ঘি মধু চাঁদমালা ইত্যাদির বিক্রিবাট্টা তুঙ্গে উঠে যায় ফিবছর। অভয়কে নিয়ে তিনি সবদিক সামলাতে হিমসিম খান। দোকান বন্ধ করে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট ধরে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত হয়ে যায়। কোনো কোনোদিন অভয় তাকে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে নিয়ে যায়। কোমরে ব্যথা বাড়লে পরেশবাবু সাইকেলের রডে বসতে পারেন না।
আজ কী মাছ কিনে দিয়ে এলি অভয়? আমি তো দেখার ফুরসতই পেলুমনি রে।
বাটা ভালো পেইলাম আজকে।
কে নিয়ে বসেছিল? হরি?
না গো জেঠু। আজ ছাতুবাবুর বাজারে যাইছিলি।
ওখানে যাইছিলি কেন? পরেশবাবু হালকা ভেংচালেন।
জেঠিমা জর্দা আইনতে বলেছিল। তেনি তো আবার ওখানকার ওই দোকানের জর্দা বিনা পান খাবেননি।
পরেশবাবু ফের মুখ ভেংচালেন। যেন জর্দা বস্তুটি তার বয়মের চিরতা পাতার কুচি। পরেশবাবু ঘর বাহির পৃথিবীর বহু সংবাদে অবিরল মুখব্যাদান করেন এবং এটি তার মুদ্রাদোষ। সকল ঘটনায় তিনি কন্সপিরেসির গন্ধ পান। তিনি মাঝে মাঝে বলেন নাক তার বেনে, শরীর কায়েত। গন্ধ শুঁকে তিনি দোকানের কোন মালের কী স্টক বলে দিতে পারেন। বাজারে সবই প্রায় পুরোনো দোকানদার। সবাই মুখ ফিঁচকে হাসে। কোণের দিব্যজ্যোতি বাসনালয়ের প্রবাল, বাপের হার্ট সার্জারির পর সবে বছরখানিক দোকানে বসছে। সে মনে মনে গড় করে বুড়োকে।
বাটা কত করে নিল?
দু'শর এক টাকাও কমাইলনি।
অভয় এক সেকেন্ড পজ খেয়েছে বলার আগে। পরেশবাবু বুঝে গেলেন বাটা একশ আশি দর ছিল। চাঁদমালার গাছি একগোছ করতে করতে শুধোলেন, আজ দুপুরে খেতে যাবি তো? নাকি এখানেই খাবার আনিয়ে নেব?
এই কথার জবাবে অভয় একটু থমকে গেল। তার চোখে এক ঝলক একটি রমণীমূর্তি ভেসে উঠল। দীর্ঘ ভেজা চুল মাথা থেকে নেমেছে, সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়ানো জিয়ন্ত একটা দুর্গার পট যেন বা। কথা কম বলে। হেঁটে চলে বেড়ায় পুরোনো বারান্দা জুড়ে। দুপুরে গোটা বাড়িটা নিঃঝুম হয়ে থাকে। কার্নিসে কার্নিসে ঘুমন্ত বেড়াল। টেবিলে ভাতের থালা রাখার সময় জিয়ন্ত পটেশ্বরীর নাকের নিচে ঠোঁটের ওপরে দুতিনটে ঘামের বিন্দু থাকে। সালোয়ার কামিজের ওড়নায় মুছে নেওয়ায় আগে ভাতের ওপরে দুটো চোখের কিছু কিছু রেণু ফেলে ঝটিতি চলে যায়।
কী করবি? যাবি নাকি আনাবি?
তুমি দোকানে থেইকো তবে। আমি খায়া তোমার খাবার ফট করি আনি দিব। তুমি গেলে বড় দেরী কর।
যা ভালো মনে করিস। একদম দেরী করবি না কিন্তু। বড্ড ব্যবসার চাপ এখন। ষষ্ঠী সপ্তমী অবধি এই চলবে। তারপর একটু ফুরসত মিলবে।
কথায় কথায় দোকানে খদ্দের এসে গেছে। বাসক পাতা চাই। গোলমরিচ তার সঙ্গে। দুজন কাজে লেগে পড়ল।
দুই
দুপুর নাগাদ জোয়ার আসে। জেটির লোহার খাঁচার পায়ে পায়ে জল ফেনা তুলে ঘনঘন খোঁচা মারে। কচুরিপানা গাছের ডাল জমে থাকে খাঁজে খাঁজে। জলের টানে বিবিধ শব্দ তরল হয়। জলে-ভাসা ফুলগুলো নৈবেদ্যর স্মৃতিতে ফের ফিরে এসে ঘাটের পৈঠায় মাথা ঠোকে। দেবতা হাসলে জলে অতিরিক্ত ছলাৎছল ছড়ায়। কচুরিপানার দামে কুঁচবক চঞ্চল হয়।
বিলাস ডাল পোস্ত মাছের ঝোল শেষ করে জলে টিফিন ক্যারিয়ার ধুতে আসে। গতদিন পা পিছলেছে ঘাটের শেষ ধাপে। আজ পা টিপে টিপে নামে। বাবুঘাটের দিকে যাত্রীভর্তি একটা ভেসেল এই মাত্র ছেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ টিকিট বেচা বন্ধ। এরমধ্যে আহার শেষ করে মুখে গুঠখাটি ফেললে যেন দুপুর শেষ হয়ে বিকেল শুরু হবে।
পরেশ বসাকের বেশি বয়সের একটিমাত্র সন্তান বিলাস বাগবাজার ফেরিঘাটে টিকিট কাউন্টারে বসে। বিস্তর তুকতাক জড়িবুটি টোটকা। তাবিজ মাদুলি জলপড়া কোনোকিছু বাদ যায়নি। বাদ গেছে কেবল গাইনোকলজিস্ট। শেষমেষ করুণার ঊনচল্লিশ বছরে অকস্মাৎ গর্ভধারণ। এর ব্যাখ্যা তারা নিজেরাও যথাযথ বোঝেনি বলে বিলাস তাদের প্রাণের হারামণি হয়ে রইল।
মাধ্যমিকের পর বন্ধুসঙ্গে বিলাসের সোনাগাছির নেশা ধরে যায়। বাপ আর পড়ার ব্যাপারে সায় দেয়নি। করুণা ঈষৎ তড়পেছিল। যুবক ছেলে সোনাগাছি গেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। পড়াটা দরকার। চাকরি বাকরি পেলে সব ছেলেই থিতু হয়। বিয়ে দিলে তো সোনার বাড়া উত্তরাধিকার। মা হয়ে ভবতারিণীর ডোর বেঁধে দিয়েছেন ছেলের মণিবন্ধে। ফি-শনিবার পারিবারিক গুরুঠাকুরের পাদোদক এক চুমুক। ছেলে নিশ্চিত তার গর্ভের সম্মান রাখবে।
বাপ হয়ে পরেশ বসাক বিশেষ কিছু আর আশা করে না। লোকাল কাউন্সিলরের সঙ্গে কিছু খাতির করে রেখেছিল। ধরা-করা করে হত্যে দিয়ে দিয়ে ফেরিঘাটে বিলাসের চাকরিটি হয়। তাও ক্যাজুয়াল বেসিসে। ভোর ছটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা।
বিলাস তার মায়ের আশা সম্মানটিও যথাযথ রেখেছিল। জেটি দেখভালকারি বিষ্ণু হালদারের নৈহাটির বাড়িতে ঘনঘন গিয়ে তার মেয়ের পেট বাঁধিয়ে ফেলে। মেয়ে নাবালিকা। বিয়ের বয়স হতে তখনও সোয়া এক বছর। অগত্যা কাঁকিনাড়ার হাতুড়ের হাতে পেট খসিয়ে তিন বছর অপেক্ষা। গত্যন্তর না দেখে পরেশ বসাক চার হাত জোড়া করে বংশে বধূরত্ন আনলেন। তারপর চারটি শরৎ চলে গেছে। জবার পেটে আর কিছু আসেনি।
করুণার ঘরে সারাদিনমান টিভি খোলা থাকে। কেবল খাওয়ার সময় বন্ধ হয়। এমনকি দ্বিপ্রহরে ঘুমের সময় যথারীতি সিরিয়ালগুলো নাগাড়ে ড্রামা দেখিয়ে যায়। জবাদের ঘরে ঢিভি নেই। দুপুরের খাওয়ার পর ঘন্টাখানিক সে করুণার ঘরে বসে থাকে। প্রথম হাইটি উঠলে নিজের ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে জেগে থাকে। এপাশ ওপাশ করে। বিয়ের অ্যালবাম দেখতে তার বিরক্তি লাগে। বিকেল গড়ালে কুলফিওলার ডাক শুনে ছাদে উঠে আসে।
খোলাছাদে তখন ঘর্মাক্ত আকাশ শ্বাস নিচ্ছে আনমনে। তখন কচিৎ একটা দুটো ভোকাট্টা। জবা উত্তরের দিকে চেয়ে কী যেন কী মনে করার চেষ্টা করে।
তিন
না।
আর ভাত দেব না? কেন বাটা মাছটা ভাল করিনি?
হ্যাঁ।
অভয়ের গলার স্বরে কী যেন কী ছিল, জবা নাকে সিকনি টানার শব্দ করল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অভয়ের পিছন দিকে এসে জড়িয়ে ধরল প্রায়।
আঃ খেইতে দাও।
জবার মাথা ঘুরে গেল মুহূর্তে। টলমল করে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ে হাঁফাতে লাগল। শরীরে কেমন গা গুলোচ্ছে। কেউ যেন গলার নলি টেনে ধরেছে ভেতরে। জবা জলের বোতল থেকে জল খেতে লাগল ঢকঢক। যেন মনে হচ্ছে বোতল, বোতল ফাটিয়ে গোটা টালার ট্যাংকটাকে গলায় ঢুকিয়ে নেয়।
অনেকটা জল খেয়ে জবা একটু ধাতস্থ হল। সামনের মানুষটার দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। পাশের ঘর থেকে করুণার খুকখুক কাশির আওয়াজেও সে চাওয়া বিঘ্নিত হয় না।
প্রাচীন জীর্ণ বসতবাটির বাইরে রোদদুর, ভেতরে বিবিধ ছায়ার ছিন্ন ছিন্ন ভগ্নাংশ। নিঃঝুম দোতলার বারান্দায় বেড়াল নিশ্চিন্তে হাই তোলে। ঘুলঘুলিতে কোথাও কোনো পায়রার ফরফর পাখসাট। লাগোয়া কোনো বাড়ি থেকে শিশু ট্যাঁ ট্যাঁ কেঁদে ওঠে। টানা অনেকক্ষণ ধরে কেউ সুর ভেঁজে চলেছে ভৈরবীতে। দয়ানি ভবানী দয়ানি ভবানী মহাবাক্যবাণী...
বিলাস জবার ওপর আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। খামচে খিমচে জবার শরীরের ভেতর যে জেগেছিল, তার যতটা কৌতূহল ছিল, আনন্দসংস্থান রতিমাত্র ছিল কি? ধস্তাধস্তির রেতঃপাত শরীরে যাকে দেয় তার কোনো বিবৃতি জবার কাছে ছিল না।
বিস্রস্ত বিছানার চাদরে নগ্ন জবা মুখ ঢেকে পড়েছিল। এক নজরে দেখলে মনে হবে মূর্ছা গেছে। বিলাস অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কাটা দাগটায় খেলাচ্ছলে পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে চেপে হাসছিল, লাগে? লাগে?
জবার ব্যথা লাগছিল, এবং যুগপৎ কান্না। শরীরের পাপড়ির ভেতরে মকরত ও পোকার যৌথবসবাস তাকে নীরব বিস্মিত করে দিয়েছিল।
মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে এসে তার উনিশ বছরের শরীর নিজেকেই প্রথমে কেড়ে নিয়ে শহরের বাইরে রেখে আসে। শান্তি স্বস্তি সূত্র। গলির ওপার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসা বহির্পৃথিবীর তরঙ্গ দৈনিকে ছোট ছোট নখরাঘাত করে তাকে ক্রমে ক্রমে শিষ্ট তির্যকতা দেয়। প্রতি দুপুরে খেতে আসা অভয়ের সাইকেলের ক্রিং বেল যেন একটা হঠাৎ হাসি। ক্রিং বেলের ধাতব শব্দটা সারা সকালের ঝিমিয়ে থাকা অস্তিত্বের জলে এক দলা কলিচুন ফেলে রোজ। হঠাৎ ঘেমে ওঠা বুকের খাঁজে বিহ্বল আঁধারের হর্ষ। 'ফটাফট ভাত বাড়হ বৌদি' কুহকের স্বর। পায়ের পাতা ঘেঁষে বেড়াল দৌড়ে গেলে গা শিরশির করে ওঠে। রাত্রিতে বিছানায় সেই শিরশির বিলাসের পাশে অসম্পৃক্ত নিষ্পলক কাঠ।
অভয়ের দিকে এখন জবা চেয়ে আছে অপলকে। সে দৃষ্টিতে একটুও কোনো গন্ধ কি নেই? বহুদূর থেকে আসা বুনো মাদলের ডাক। যখন হাওয়া ছিল না ঘরে, জানলা গলে আসা রোদদুরকে আগন্তুক মনে হয়; যে গবাক্ষ কিছুমাত্র আন্দোলিত করেছিল, তার পাল্লাদুটো কি এবার বন্ধ করে দিতে হবে?
অভয়ের এখন বারবার মন টানে পাথরপ্রতিমার দিকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করতে ইচ্ছে করে বউকে। থেকে থেকে একটা নরম গোলা বলের মতো মায়া পাক খায় মস্তিস্কে। বউটার পেটে কী আছে? কে সে? শরীরে বল পেল? হাত পা? চোখ?
ষষ্ঠী পড়লে বাড়ি যাব।
অভয়ের কথায় জবার ধড়ে যেন সাড় এল।
বাড়ি থেকে কবে আসবে?
অভয় মাথা নিচু করে বাটা মাছের কাঁটা ছাড়াচ্ছে। জবা একদৃষ্টিতে অভয়ের দিকে চেয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে একটু আগের কোনো মায়া মোহ টান কিছু নাই যেন। অত্যন্ত দুঃখের পর কোনো পাথরের দেবীমূর্তির দিকে যেন চেয়ে থাকা। কী বা পারো তুমি হে অন্তর্যামী? মাঝখানে অনন্ত ক্রন্দসী। অপার অন্তরালের পিছে কোনো দিবাস্বপ্ন।
আমার বউটা পেগনেট।
কী?
আমার বউটার পেট পাঁচ মাসের।
জবা এবার ধীরে সুস্থে ফুঁপিয়ে উঠল। করুণার ঘরের দিকে চেয়ে সচকিত হল একবার। ফের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে টেবিলের ওপর মাথা ঠুকে ঝুঁকে পড়ে। আর যেন তোলার শক্তি নেই শরীরে।
কই আগে বলোনি তো।
কইনি? ভুলি গেইছি তবে।
অভয় ঝোলমাখা ভাতের বড়ো গরাস মুখে তুলছে। জবা নিজে হাতে শিলনোড়ায় জিরে ধনে বেটেছে। বাটা মশলার টেস্ট। রোজ রাঁধার সময় কী একটা আনন্দ যেন গান হয়ে গুনগুন করে ঠোঁটে।
জানো আমার এ মাসে বন্ধ।
কী বন্ধ।
অভয় মুখে ভাত ভরে বলে ওঠে।
মাসিক বন্ধ।
অভয়ের মুখে ভাত শেষ হয়ে গেছিল। ফের বাটা মাছের দিকে ঝোঁকে। এত ঝাল কেন? ঝোলে কেউ এত ঝাল দেয়? খচ্চর মাগি! জবা ঢুকরে ঢুকরে হাসে কিংবা হাসির মতন কিছু কাচের টুকরো ঠোঁট থেকে উগরে দেয়।
আমার পেট দেখবে? হাত দাও।
জবা ঝটিতি উঠে এসে অভয়ের বাঁ হাত ধরে টান মারে।
পেটে হাত দাও। দেবে না? তুমি তো ঢ্যামনা পুরুষ।তোমাকে বলি, এতদিনের থমকে থাকা শাপ। তুমি আর এসো না। কুগ্রহ বিদেয় হও।
অভয় স্থিরচিত্রবৎ চেয়ারে। তখনও পাতে দু'তিন গরাস ঝোলমাখা ভাত। অভয় ভাত কুড়িয়ে খাওয়া মানুষ। মাথা নিচু করে ধীরে সুস্থে ভাত ক'টা যত্ন করে খায়। বোতল থেকে জল খায়।
চার
পরেশ বাড়ি ফিরেছে গায়ে জ্বরভাব নিয়ে। হয়ত কয়েকদিনের প্রচণ্ড কাজের চাপ ছিল বলে। খাটে শুয়েছে পরেশ বসাক। করুণা মাথায় পেইনবাম ঘষছে। ডাইনিং টেবিলে ঠং ঠুং শব্দ হচ্ছে শুনে ডাক দিয়ে বলে, বৌমা রেডিওর ব্যাটারি পরিয়েছে বিলু?
হ্যাঁ মা।
বাজিয়ে দেখে নিয়েছে তো?
হ্যাঁ মা।
এখনও কী এত ঠং ঠাং করছ? শুয়ে পড়ো। চারটেয় অ্যালার্ম দিয়েছ?
হ্যাঁ মা।
ঠিক দেখেছ তো?
হ্যাঁ মা।
পরেশ বসাক দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে। করুণা মাথার কাছের জানালাটা বন্ধ করে দিল। ঘরের লাইট নেভাতে নেভাতে দেখল একটা জোনাকি যেন ঘরের মধ্যে। জোনাকি না? হ্যাঁ জোনাই দপদপ করে জ্বলে জ্বলে নিভে নিভে ঘরে পাক খাচ্ছে। করুণা পরেশের পায়ে হাত ছুঁয়ে পাশে শুয়ে পড়ল।
সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রখ্যা চতুর্ভির্ভুজৈঃ
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা।
আমুক্তাংঙ্গদ-হার-কঙ্কণ-রণৎ কাঞ্চীক্বণন্নূপুরা
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা।।
ট্রানজিস্টার ভেদ করে আসন্ন অমানাশের শিখা শিহরিত হয়ে উঠেছে। একদিকে অমিতবলশালী অসুরের সামনে দেবী চন্ডী প্রপন্নার্তিহরে। অন্যদিকে অজস্র কর্ণকুহর। দশপ্রহরণধারিণী ভোর আসছে আলোর ভেতরে গড়িয়ে কাটামুণ্ডর মতো। জবার পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠছে একটা পুঁতির মতো অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ড। বিলাসের একখানি হাত জবার পেটের ওপর সম্পন্ন পাগলের মতো শায়িত। জবা কাঁদছে, অল্প অল্প বমনেচ্ছা। জবা যেন অসুরের ভেতর থেকে, কাটা মহিষের রক্ত থেকে ফুটে উঠবে। এই তো সেই অজেয় পরাভব। এই তো সেই খালি ঘরের অমেয় মলিন হাসি। জবা আধোঘুমে মৃদু মৃদু হাসছে যেন। তার ওষ্ঠাধরে অসীম বেণুবন ও বাঁশরী।
অভয় এপাশ ওপাশ করছিল। কানে জড়িয়ে যাচ্ছে চেনা একটা সুরের ঊর্ণজাল। পাশাপাশি সব ঘর থেকে সুর ছড়িয়েছে। একটু আগে পিছে বেজে বেজে মিশ্রিত ভোররাতের অনুরণিত আঁধারস্তর।
জটাজূটসমাযুক্তামর্ধেন্দুকৃতশেখরাম্
লোচনত্রয়সংযুক্তাং পূর্ণেন্দুসদৃশাননাম্
অতসীপুষ্পবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্ নবযৌবনসম্পন্নাং সর্বাভরণভূষিতাম্...
কী এর অর্থ শব্দব্রহ্ম? তোমার নাদের কিনারে কিনারে কোন ঢেউ পরিত্যক্ত অতিরিক্ত হয়ে শারদ ছড়িয়েছে ভুবনে? অতসী ফুলের পাপড়ি কী কথা বলে? অভয়ের মনে হচ্ছিল তার বউ, জবা, জেঠু, বিলাস, জেঠিমা, নিউ গন্ধেশ্বরী দশকর্মা ভাণ্ডার রণভূমি ছেড়ে চলে যেতে গিয়ে সারিবদ্ধ শব্দরাজি। কত কত যেন গন্ধের সুন্দরী গরান জঙ্গল। যব তিল ধান কালোজিরে...সব একের সঙ্গে আরেক মিশে সঙ্গম। ভ্রূণসংস্থান। কে আসে? কে যায়? কেউ কি যায়? কখনও যেতে পারে এই ফুটি ফুটি আলোর শেষরাত ফেলে?
অভয় সিঁড়ির পাশের ঘরে একলা খাটে উঠে বসে। পেটে যেন তার বউয়ের পেট মিশে ভরা কুসুমাদপি। জবা সেই কুসুমের পিঠে খর-ঠোঁট হয়ে চেপে বসেছে। তোমাকে কিছু দিয়েছি যেমন, নিয়েছি তেমন গোপন আলো। এই আলো অবিমিশ্র। অভয় ফের শুয়ে পড়ে বালিশে মাথা রেখে কান পেতে সমূহ অস্ফুট শুনে চলে।
আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা
মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি
অপাং স্বরূপস্থিতয়া ত্বয়ৈতৎ
আপ্যায্যতে কৃৎস্নমলঙ্ঘ্যবীর্যে ।।
ও বিলু, তোর বাবার সঙ্গে যা বাবা। ঘাটে তর্পণটা সেরে আয়। ও বিলু ওঠ বাবা। কাউকে কষ্ট দিতে নেই।
চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতদ্ ব্যাপা স্থিতা জগৎ
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ...
আকাশ থেকে নীলকণ্ঠ পাখির ছেঁড়া ছেঁড়া ঝরা পালকের মতো আলো এসে লুটিয়ে পড়েছে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের অন্দরে। করুণা দোর খুলে বারান্দা দিয়ে বিলুদের ঘরের দিকে হেঁটে আসছেন বিড়বিড় করতে করতে, সারাবছর তেষ্টা নিয়ে রয়েছে। তোর বাবা জ্বর গায়ে জল দেবে। যা, সঙ্গে যা।