চট্টগ্রামের পথে পথে ৩
সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে শহরের কমবেশি ২০ কিমি ব্যসার্ধের মধ্যে থাকা প্রকৃতির মায়া-মাখা কয়েকটি দর্শনীয় স্থান কথামতো গাড়িতে ঘুরিয়ে দেখালেন আখতার ভাই। প্রথমেই বলে রাখি, চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার: একদিকে সমুদ্র, আরেক দিকে উচ্চ-নীচ নানা মাপের পাহাড়। এমন সুন্দর সহাবস্থান খুবই কম দেখা যায়। সান-রাইজ ও সান-সেট দুটোই চাক্ষুষ করতে হলে চাঁটগা-ই উপযুক্ত স্থান। পাতেঙ্গার সমুদ্র সৈকতের কথা তো আগেই বলেছি। এবার পর্বতের কোলে নিটোল, সুশীতল জলাভূমি, যার পোশাকি নাম লেক; ছায়া দানকারী বৃক্ষ-গুল্মের মিছিল ও পাখির কলতান। মূলত প্রকৃতির খেয়ালে বেড়ে ওঠা ভ্যাটিয়ারি লেকের দিকে সব পথটাই দৃষ্টি-নন্দন গাছপালা, জাস্ট অ্যা ওয়ে টু হেভেন! পর্যটকদের জন্য এখন বেশ কয়েকটি ভিউ-পয়েন্ট বানানো হয়েছে। তার মধ্যে ১৩১ ফুট উঁচু সানসেট পয়েন্টটি সকলেরই হৃদয়-চক্ষু স্পর্শ করবে। এতটা উপরে দাঁড়িয়ে কফিশপে কফিতে চুমুক দিয়ে নীচে সূর্যাস্ত দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রাম-হাটহাজারীর এই মহাসড়কটি প্রকৃতি-মায়ের কোমল স্পর্শ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছে। ২০ বর্গ কিমি এলাকায় আঁচল-পাতা এই লেকটি এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে রয়েছে। মূল রাস্তা থেকে সবটুকু আপনার দৃশ্যগোচর হবে না। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই লেকে টিকিট কেটে ভিতরে আপনাকে ঢুকতেই হবে। প্রবেশ পথেই একটি এথনিসিটি ম্যাপ জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের জন-বৈচিত্র্য। সকলেই বাঙালি, কিন্তু এক এক জনগোষ্ঠীর এক এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নিজস্ব পরিচয় বহন করে চলেছে। অন্যান্য বিভিন্ন দেশে যেমন হয়, মাঝে মধ্যে উদারতা তথা সহনশীলতার অভাব সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে। 'এক দেশ এক সংস্কৃতি'-র মতাদর্শ তথা সংকীর্ণ নেতৃত্ব ও রাজনীতি এখনো সমস্যাদীর্ণ মানব সভ্যতাকে মাঝে মধ্যে আরও বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অন্য সকলের উপরে জোর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। ভারত বা বাংলা বা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান-কেউই তার তার থেকে মুক্ত নয়। সুস্থ মনের মানুষকে দুটি বিকল্প থেকে বেছে নিতে হয়, আপরাপর সংস্কৃতি বা পরিচিতি-সত্তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে 'বয়েলিং বাউল'-এ ফেলবে, নাকি বহুসংস্কৃতিবাদের 'বাউল অফ স্যালাড'-কে মেনে নেবে (অবশ্যই সাবধানতার সঙ্গে)। আমার তো মনে হয়, সামনে পথে এগিয়ে যেতে হলে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য'-কে মেনে নিতেই হবে, নইলে আরও আরও পিছিয়ে পড়তে হবে।
হাঁ, যে কথা বলছিলাম, ভ্যটিয়ারি লেকের ভিতরে
ইতিহাস চিহ্নস্বরূপ দু একটা যুদ্ধ-কামান, অসংখ্য গাছ-গুল্ম, বসে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধানো বেঞ্চ, পদ্ম-শালুক, দামি দুষ্প্রাপ্য ফলের গাছও! সবটাই যেন ছবির মতো। বান্দরবানের নীলগিরির একটি দিক এই অঞ্চল। কিন্তু ছাত্র তপনের তাগাদায় প্রকৃতি-মায়ের আঁচলের শেষটুকু আর ঠাউর করা গেল না।
যাই হোক, ফেরার পথে আর একটি লেক, যার নাম ফয়েজ লেক, তার কথা বলতেই হয়। আমাদের ছাত্রী মেমের শ্বশুর, যিনিএই কর্ণফুলি উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা, এই লেকটি দেখার কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন। এ লেকের সবটাই প্রাকৃতিক বললে ইতিহাসের অপলাপ করা হয়। শুধু বর্তমানের চোখে দেখলে একবারে প্রাকৃতিক মনে হবে। শহরের মধ্যে চিড়িয়াখানার পাশে থাকা যন্ত্র-সভ্যতার ক্লান্তি কাটিয়ে রিফ্রেশড করতেএই জলাশয়টির জুড়ি মেলা ভার। একটি প্রাইভেট কোম্পানি কনকর্ড বিনোদন-পার্ক হিসাবে একে রক্ষণাবেক্ষণ ও লভ্যাংশ গণনা করে। অবশ্য এনজয়মেন্ট বা উপভোগ-এই পরিভাষাটি আমার বড্ড মোটা দাগের মনে হয়। নৌকা বিহারের ব্যবস্থা খুবই ভালো। কিছুটা চিড়িয়াখানার আদলে সংরক্ষণ, ইত্যাদি অনেক কিছু। এধরনের জলাভূমি বা লেকে নিবিড়ভাবে প্রকৃতিতে তন্ময় হয়ে একাকী একঘন্টা কাটানোকে বোঝাতে কি ভাষা উপযুক্ত হবে বলুন তো!
এবার ইতিহাসে আসি: চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় অবস্থিত এই হ্রদটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে উপর থেকে নেমে আসা ঝরণাগুলিকে একত্রিত করে জলসংরক্ষণের ব্যবস্থা থেকেই এই লেক। ইংরেজ রেল ইঞ্জিনিয়ার ফয়-ই এর মূল কারিগর। তাই তাঁর নামেই ফয়েজ লেক। বোটিংএর সুন্দর ব্যবস্থা, কয়েক ঘন্টা বোটটিকে মধ্যিখানে নিয়ে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হলে আপনার মানস সরোবর ভ্রমণের অনুভব হবে। পাশেই বাচ্চাদের জন্য বিনোদনের নানা রকমের ব্যবস্থা, সঙ্গে হালকা রিফ্রেশমেন্ট পাবেন।
আমাদের ড্রাইভার-ভাইয়া সবশেষ সন্ধ্যায় যেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন তা আমাদের স্বপ্নের প্রীতি- লতাদির সেই অ্যাকশন স্কোয়াড! যে দুটি কারণে আমি 'আমার স্বপ্নের চট্টগ্রাম' বলছি তার একটি এই ইউরোপীয়ান ক্লাবে পরাধীন ভারতমাতাকে শৃঙ্খল মোচনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনপন লড়াই। (অন্যটি মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মস্থান। বেশ কিছুটা দূরে, তাই এবার হ'ল না। এশিয়ান য়ুনিভার্সিটি ফর ওমেনের তাপু ম্যাম অবশ্য বলেছেন, পরের বার নিয়ে যাবেন। উনাদের গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি। বয়াজিদ বোস্টামি মাজার ও কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি, জিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ইত্যাদি কয়েকটি স্থানও দেখা বাকি রয়ে গেল!) এই সেই ক্লাব যেখানে বোর্ডে লেখা থাকতো "Dogs and Indians not allowed!" বাঙালির তথা ভারতবাসীর এই অপমান স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ছিল।
প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। তিনি এই পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দলের তাঁর নেতৃত্বে ক্লাবে অগ্নিসংযোগ করে। গোলাগুলি চলে এবং পরে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড মুখে দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের 'প্রথম মহিলা শহীদ' অন্যত্র সম্মান পেলেও এই স্থানে তাঁর জন্য বরাদ্দ কেবল এক
ছটাক জমি আর একটি ফলক! ক্লাবটি এখন রেলের একটি অফিস হয়েছে দেখলাম। এখানে তাঁর স্মৃতিতে একটি আবক্ষ মূর্তি বা একটি সংগ্রহশালা আশা করা কি অন্যায়? বড্ড হতাশ হলাম। এর কারণ কি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গি, না বাহান্নর আগের ইতিহাসের প্রতি প্রভাবশালী মহলের উন্নাসিকতা!
পরের দিনের আর একটি অভিজ্ঞতা এখানেই তুলে রাখি। আমার লোক্যাল গার্ডিয়ান ইমরান ছাড়া আমাদের অবস্থা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। কন্ফারেন্সের দিন তাপু চৌধুরী ( চ বি দর্শন বিভাগের প্রাক্তনী, এখন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় "এশিয়ান য়ুনিভার্সিটি ফর ওমেন" এর অ্যাসিস্টান্ট রেজিস্ট্রার) ম্যমের নারীবাদের উপর বক্তব্য শুনতে শুনতে কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়। আমার আবার ফলমুখী দর্শন তথা মানবীবিদ্যা বিষয়ে কেউ কিছু মিনিংফুলি বলার চেষ্টা করলে তার সাথে যোগাযোগ করা, বা বলতে পারেন অযাচিতভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়া আমার মূদ্রাদোষ। ফোন নং যোগাড় করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলাম, কাল সকালে তাঁদের য়ুনিভার্সিটিতে সকালে আমাদের দেখা হবে ঠিক হ'ল। কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ মনে হল, ইমরান ভাইয়ের শরণ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। প্রস্তাব তুলতেই জানালো, সকালে জন ম্যাথুকে নিয়ে ওখানেই যাবে। আপনিও স্বাগত! ওখানে একটু আগে পৌঁছে যাই। মাডামের আসতে দেরি থাকায় কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে নাইজেরিয়ান স্যার ড. সাইমন ক্লেয়ার্ক জেণ্ডারের উপর তাঁর ক্লাসে আমাদের ডেকে নিলেন। বি এ এর ক্লাস। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। খোলামেলা আলোচনা। আমি যোগ করলাম সেক্স ও জেণ্ডারের মধ্যে পার্থক্য, ডিফারেন্ট লেভেলস অফ মিসোজিনি। ম্যাথু স্যার হিস্ট্রি অফ সায়েন্স থেকে আলাপ করলেন। হিউম্যান জেনম প্রোজেক্ট, ইউজেনিকস বিষয়ে আলোচনায় আমিও সমৃদ্ধ হ'লাম। এশিয়ার নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে মেয়েরা এখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছে। আফগান সহ কিছু মেয়ের জীবন-কাহিনী ও সংগ্রাম করে বেরিয়ে আসার গল্প পরে তাপু ম্যামের কাছে শুনেছি। আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার হওয়া একটি মেয়ে ঘুমাতে পারে না, আধোঘুমে এখনো চীৎকার করে উঠে! গেটস ফাউন্ডেশন সহ অনেক ফিলানথ্রোপিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাই চলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ বেশ উদার, টাইম-টেবল অবশ্যই একটা আছে। তবে প্রয়োজনে স্যারেরা অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাস নেন। ছাত্রীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না শিখছে বা বলতে পারছে ততক্ষণ ছাড় নেই! মিডিয়াম অবশ্যই ইংলিশ। মনে মনে ভাবলাম, রিটায়ারমেন্টের পর এখানে জয়েন করলে কেমন হয়!
(চলবে)