এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জল জঙ্গল কথা ৪

    SEPA লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ নভেম্বর ২০১৩ | ১১৮৫ বার পঠিত
  • (৪)

    বালিগঞ্জ থেকে ট্রেনে ক্যানিং আসার পথে দেখছিলাম এক অন্ধের হাত ধরে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন এক মহিলা। পোষাক-আসাকে বলা চলে ইনি ইসলাম ধর্মীয় সামাজিকভাবে। গাইছিলেন যা তা ভক্তিগীতির কাছাকাছি। একটা ছোট মাইক নিয়ে, পাশের ঝুলিতে বক্সের সাহায্যে ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে গাইছিলেন। দুটো বিষয় এখানে লক্ষ করার মতন। প্রথমত আমাদের দেশের ট্রেনে অন্ধেরা গাইবেন বা অন্ধজনের হাত ধরে কেউ গাইবেনই গাইবেন। আমার মৃত্যুর আগে অব্দি এর কোনো বদল বোধহয় দেখে যাওয়া হবে না। দ্বিতীয়ত, ইসলাম ধর্মে গান গাওয়া সেই অর্থে নিষিদ্ধ। তবু আমি কত কত ইসলাম ধর্মীয় গায়ক-গায়িকাকে দেখেছি এ জীবনে। তখন মনে হয় ধর্ম যাঁরা তৈরী করেন তাঁরা যাই ব্যাখ্যা দিন না কেন, মানুষ তার নিজের কাজ করবেই। মানুষ মিটিং-মিছিল করেই শুধু বিদ্রোহ করে না, এমনকি বিদ্রোহের চিৎকারও করে না সব সময়ে, খুব সামান্য আয়োজনে নিজের মতন করে যা বলার তা স্পষ্ট করে দেয়। এবং তা এত স্পষ্ট, এত জোরালো যে তাকে চিরকাল দমন করে রাখা যায় না। তাই ঐ মহিলা গান করে উপার্জন করে পেট চালান, মনসার পালা করেন ইসলাম ধর্মীয় মানুষ, আবার বনবিবির পালায় জান লড়িয়ে দিয়ে থাকেন তথাকথিত হিন্দু শিল্পী। এদের কাউকে চোখ রাঙিয়ে, গায়ের জোর দেখিয়ে, ধর্মের ভয় দেখিয়ে ঠেকানো যায়নি, যায়ও না। এই একই কারণে পৌরাণিক ও বৈদান্তিকদের একসময়ে মানতে হয় মনসাকে।

    মনসা পূজোর নানান রকম আছে। যেহেতু আমাদের সাধারণ বিশ্বাস মতে মনসা সর্পের দেবী তাই মুখ্যত ভাবনা থাকে যে দেবীর মূর্তির পূজা হবে। তা একদম নয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্নুহী বৃক্ষ বা সিজমনসা গাছের বা জীবন্ত সাপের অথবা মনসার মূর্তিতে পূজো হয় মনসার। নানা রকমের মূর্তি হয় মনসার। কোথাও পদ্মের আসনে মনসা- মাথার উপরে বহু ফণাযুক্ত সর্প, কোথাও সিংহাসনে বসে- পাশে স্বরস্বতীর বাহন হাঁসটিও। জ্ঞানের সঙ্গে মনসার প্রাচীন সম্পর্কের উদাহরণ এই মূর্তি। চব্বিশ পরগণায় অবশ্য এই মূর্তি খুব কম। সাধারণভাবে মনসার চারটি হাত। উপরের দুই হাতে শঙ্খ ও সর্প। নীচের হাতে পদ্ম এবং বরাভয়মুদ্রা। দেবীমূর্তি হলে সাধারণভাবে সালঙ্কারা। কিন্তু চব্বিশ পরগণায় বেশী পূজো হয় মৃণ্ময় সর্পমূর্তির। বরিশাল, খুলনা এই সমস্ত স্থান থেকে আগতরা এই পূজোটা করে থাকেন। এই সর্পফণা অঞ্চলভেদে আটটি, ন'টি, বিয়াল্লিশটি। বিয়াল্লিশ নাগের পাশে থাকে ছোট ছোট সর্পফণা যা 'কোকা' নামে পরিচিত। সর্পমূর্তির উপরে থাকে পদ্ম। এই নাগ হল পদ্মা।

    এই দুধরণের রীতির পূজোর মধ্যে দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ নাগপূজো কিন্তু আসলে বসুন্ধরা পূজো। সেই প্রাচীন উর্বরতার সংযোগ এই পূজোতে। স্থানীয়ভাবে এই পূজোও মনসা পূজো। পূজোতে মানত হয়। হাঁস-পাঁঠা এই সমস্ত বলিও হয়। এখন এ পূজো ব্রাহ্মণ করে। ঢাক-ঢোল বাজিয়েই হয়ে থাকে এই পূজো শ্রাবণের সংক্রান্তিতে। নাগপূজোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে যার থেকে মনসার সঙ্গে উর্বরতার সম্পর্ক খুব পরিস্কার হয়ে আসে। রবি বা বৃহষ্পতিবার বাদে যে কোনো দিন 'হালাপাতা' শুরু হয়। প্রথমে কচুপাতা, সরা বা অন্য কোনো মাটির পাত্রে আগে থেকে মাটি রাখতে হয়। এর পরে মুগডাল ও অন্যান্য শষ্যবীজ ভিজিয়ে তাতে ছড়িয়ে দিতে হয়। মাটির রসে ওই বীজ চার-পাঁচদিনে অঙ্কুরিত হয়। এই হালাপাতা বিসর্জন হবে নাগপূজোর পরের দিন। ফণাযুক্ত নাগের দুদিকে থাকে খাঁটি দুধ ও সবরীকলা। পূজোর পরে সকলকে পরিবেশন করতে হবে একে। যত ফণা তত সংখ্যক কলা লাগবে। নাগের সামনের বাটিতে আতপচাল, পান ও হরিতকী থাকে। ধুপ, ধুনো ও প্রদীপ জ্বলে পূজোতে। তবে চব্বিশপরগণাতে এ পূজোতে ধুনো দেওয়া হয় না। প্রাচীন প্রবাদ হল, 'একে মা মনসা কানী, তায় ধুনোর গন্ধ'!

    এ ছাড়াও চব্বিশ পরগণার আরেকটি পূজোও আদতে মনসার সেই প্রাচীন ফার্টিলিটি কাল্টের চিহ্ন। তা 'রান্নাপূজো' নামে সাধারণ্যে পরিচিত। এর প্রথমদিন হল রন্ধন, পরের দিন অরন্ধন। এর মধ্যেও টানাটানি আছে। রন্ধন পূজোকে যুক্ত করা হয়েছে ব্রহ্মপুজোর সঙ্গে। এখানে কিছুটা সংশয় আছে। ব্রহ্মপূজো এবং ব্রহ্মাপূজো এক নয়। বস্তুত ব্রহ্ম যেহেতু অনির্বচনীয় এবং মুখ্যত বেদান্তের সৃষ্টি, সুতরাং তার পূজোর এই জাতীয় বিধি থাকা অস্বাভাবিক। বরং যেহেতু এই পূজো পূর্বপুরুষের পূজোও বটে, তাই একে ব্রহ্মাপূজো মনে করাই সমীচিন। তাছাড়া একটু আগেই আমরা দেখেছি যে সরস্বতীর হাঁসের সঙ্গে মনসার সম্পর্ক আছে। কাজেই সেই একই সূত্রে সরস্বতী এবং ব্রহ্মার একত্র পূজোর রীতি এটি মনে করাই উচিত হবে।

    এবারে আমরা পূজো পদ্ধতি ছেড়ে কিছুটা এগোবো। আমাদের মূল লক্ষ হল পালাগানের সংস্কৃতি ও সুন্দরবনের সম্পর্ক তুলে ধরা। আগের কালে এই পালাগানের কিছু কিছু পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। আসরের এক জায়গায় মনসার উদ্দেশ্যে একটি ঘট স্থাপন করতে হয়। মাটির, পিতলের বা তামার ঘট হতে পারে। আমপাতা, সশিষ ডাব, নতুন কাপড়, লাল সুতো, আলতা পাতা, সিঁদুর, শাঁখা ও নোয়া থাকে ঘটের মাথায়। সামনে থাকে গোটা আলু, পান, সুপুরি, এক বাটি আতপ চাল, একটি টাকার মুদ্রা। এই পাত্রটি হল পূন্যপাত্র। মনসার পালা মুখ্যত একদিনের বিষয় ছিল না। এটা কয়েকদিন ধরে চলতো। একেকদিন অনুষ্ঠিত হত একেক অংশ। পালাগান চলার সময়ে ধানগাছের শিষ বা 'বেজনী', বেহুলার ভাই-এর বেহুলার জন্যে আনা চিঁড়ে, মুড়কি, বাতাসাপূরণ বেতের ঝুড়ি যা 'মেলানীর ঝুড়ি' নামে পরিচিত, আর চাঁদবেনের পূজোর জন্য দুটি ঘট- যা একটাতে হবে শিবপূজো, অন্যটাতে মনসার- এ সমস্ত লাগে। আরো আছে। লক্ষীন্দরের ষষ্ঠিপূজোর সময়ে একজোড়া ডিম, বিয়ের সময়ের বরণডালা, সনকার সাধভক্ষণের মিষ্টি এই সমস্তও লাগে।

    ঘটবসান সংস্কারও স্থানভেদে আলাদা হয়। তবে মোটামুটি রূপটি একই। নায়েকের বাড়ি যে কদিন গান চলে সে কদিন ঘট যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সেখান থেকে নড়বে না। একেবারে পালার শেষে পালাগায়ক অষ্টমঙ্গলা গান গেয়ে, হরির লুট দিয়ে ঘটটি নেড়ে দেবেন। একে বলে ঘটনাড়া। ঘটনাড়া হয়ে গেলে পালাগান আর চলবে না। এর পরে নায়েকের স্ত্রী মাথায় করে সে ঘট নিয়ে চলে যাবেন কাছের কোনো ঠাকুরথানে, বা বাস্তু ঠাকুর থানে। সেখানে একে স্থাপন করা হবে। এর আর পূজো কিন্তু চলবে না। বাস্তু ও ফসলের সঙ্গে এই সম্পর্কই মনসা পূজোকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। পূজোর নিয়মাবলী সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা যখন করে নিলাম, তখন এর পরের পর্বে এই কাহিনীর অন্য অংশে আমরা চলে যেতে পারি।

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ নভেম্বর ২০১৩ | ১১৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:০৫45560
  • আচ্ছা
  • ujbuk | ***:*** | ২৯ নভেম্বর ২০১৩ ১০:৫৮45561
  • সুন্দর
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন