এবারে অরুপশঙ্কর মৈত্র মহাশয় ওপরে যা সব বলেছেন সে নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক। এ ব্যাপারে যেটা ভয়ঙ্কর সমস্যা সেটা হচ্ছে এই যে, জবাব দেবার জন্যে প্রথমে তো অবান্তর আগড়ম বাগড়ম কথাবার্তার পাহাড়ের মধ্যে থেকে প্রথমে তাঁর বক্তব্যের সারকথাগুলোকে টেনে বার করতে হবে, এবং সেটাই এক মহা পরিশ্রমসাধ্য কর্ম। এমনিতে তিনি কিন্তু বেশ বিনয়ী ব্যক্তি। স্বীকার করেছেন, "অর্থনীতি আমি খুব বুঝি না, যেমন ডাক্তারিটাও বুঝি না।" এই বিনয়টা যদি বাংলা ভাষা সম্পর্কেও দেখাতেন, বেশ হত। এবড়োখেবড়ো বাক্যগঠন ছাড়াও, 'আগমন'-কে লিখেছেন 'আগমণ', 'অদ্ভুতুড়ে'-কে লিখেছেন 'অদ্ভুতুরে', আর 'ফুলঝুরি'-কে লিখেছেন 'ফুলঝুড়ি'। এমন কি, শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের চেষ্টাটুকুতেও খামতি হতে দেননি। রাজনৈতিক 'বাম' শব্দের উৎস খুঁজে বার করেছেন 'ব্রাহ্ম'-র মধ্যে, আর 'ব্রাহ্ম'-র উৎস খুঁজে বার করেছেন 'ব্রাহ্মণ'-এর মধ্যে।
তা সে যাই হোক, আজকের আলোচনা অবশ্য বাংলা ভাষা নিয়ে নয়।
অতিমারি, ভাইরাস ও ভ্যাকসিন নিয়ে তাঁর যে বিচিত্র জ্ঞানভাণ্ডার তিনি উন্মুক্ত করেছেন, সে নিয়ে আলোচনাটা এ থ্রেডের ওয়াকিবহাল পাঠকেরা আমার জন্য ফেলে রাখেননি, যা করার করে দিয়েছেন। কাজেই, আমি বরং এট্টু অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি। এখন সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতি নিয়ে অরূপবাবু যা বলেছেন তাকে 'ভুল' বলা মুশকিল, কারণ, ঠিক-ভুলের বিচারে যেতে গেলে বাক্যগুলোকে অর্থপূর্ণ হতে হয়, কিন্তু অরূপবাবু অর্থহীন বাক্য লিখেছেন। ভুল বাক্যের সঙ্গে অর্থহীন বাক্যের পার্থক্যটা মনে আছে তো? 'রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কুহু ডাকে' --- এইটা হল ভুল বাক্য। এর মানেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সেইজন্যে রয়্যাল বেঙ্গলের সামনে নিয়ে গিয়ে তার হাঁক শুনিয়ে এ ভুল ভাঙানো যায়। কিন্তু, 'পরমব্রহ্ম একটি তন্দ্রালু মুলিবাঁশ' --- এ বাক্যের ঠিক-ভুল নির্ণয়ের প্রশ্ন ওঠেনা, কারণ বাক্যটির অর্থ নেই। অরূপবাবুর লেখা বাক্যের ঠিক সেই দশা। যেমন ধরুন, এইটা --- "একবছরে এই দুশ’টাকার মোট জিডিপি কত হতে পারে? বছর শেষেও মুদ্রা হিসেবে ওই দুশ’টাকা দুশ’টাকাই থাকবে। কিন্তু জিডিপি? কয়েক কোটি টাকাও হতে পারে।" বুঝুন, বছর ঘুরলে তিনি মাত্র দুশো টাকা থেকে কোটি টাকার জিডিপি বার করতে পারেন! অরূপবাবুকে বললে সম্ভবত বিশ্বাসই করবেন না যে, 'দুশো টাকার জিডিপি' বলে কিছু হয়না। জিডিপি হচ্ছে এক বছরে কোনও একটি অঞ্চলের মোট উৎপাদনের (জিনিসপত্তর + পরিসেবা) মাপ, ওই অঞ্চলের অর্থনীতির মোদ্দা আয়তনের সূচক। টাকার আবার জিডিপি কী!
তা, খামোখা জিডিপি-র কথা পাড়লেন কেন? উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, আমি যে বলেছি, ভ্যাকসিনের মুনাফা মোট অর্থনীতির নগণ্য অংশ অতএব তার জন্য লকডাউন করে গোটা অর্থনীতিকে ধসানোর পরিকল্পনা অবাস্তব, তিনি এই কথাটা নস্যাৎ করতে চান। তাঁর বক্তব্য, আমি নাকি মুনাফার সঙ্গে জিডিপি গুলিয়ে ফেলেছি। মুনাফা এবং জিডিপি যেহ্বেতু এক না, অতএব মোট জিডিপি-র সাথে ভ্যাকসিনের মুনাফার অনুপাত কষা চলবে না। তাঁকে বলি, না, আমি কিছুই গুলিয়ে ফেলিনি। দুটো সংখ্যার অনুপাত কষতে গেলে দুটোকে এক বলে মনে করার দরকার হয়না। ধরুন, অর্থনীতিবিদ যখন মাথাপিছু আয় নির্ণয় করার জন্য জিডিপি-কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করেন, তখন কি তিনি জিডিপি-র সাথে জনসংখ্যাকে গুলিয়ে ফেলেন? বর্তমান অর্থনীতিতে ভ্যাকসিন-ব্যবসার ভাগ কত, সেটা জানার ও ছাড়া আর কী উপায় আছে? যদি জিডিপি-তে ওষুধ-ব্যবসার মোট ভাগ ধরেন, তাতেও ব্যাপারটা আধ শতাংশের বেশি উঠবে না, এবং ভ্যাকসিন তারও এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। জিডিপি কী বস্তু না জেনেই যিনি বিগ ফার্মার ষড়যন্ত্রের গল্প ফাঁদতে চান, তাঁর আর দুশো টাকা থেকে কোটি টাকার জিডিপি নিষ্কাশন না করে উপায় কী বলুন? মুনাফাই যে শেষ পর্যন্ত গিয়ে জিডিপি-তে যোগ হয়, সে ধারণা তাঁর নেই।
লকডাউনে গোটা পৃথিবীর জিডিপি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার নেমেছে এটা লেখায় বলেছি, কিন্তু অরূপবাবু তার তাৎপর্য বোঝেন নি, অর্থনীতির বিন্দুবিসর্গ না জানলে সেটাই স্বাভাবিক। তিনি টেনে এনেছেন অক্সফ্যামের রিপোর্ট, যাতে বলা হয়েছে, এই লকডাউনে কিছু বিলিয়নেয়ারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বেড়েছে। কতিপয় অতি-ধনীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধি আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির মোদ্দা বিকাশের পার্থক্য তিনি জানেন না, সেও না হয় ঠিক আছে, কিন্তু ওই রিপোর্টের খবরটাই আরেকটু ভাল করে পড়লে দেখতে পেতেন, গুগল-আমাজন-টেসলার মালিক ও ওই জাতীয় দশ ধনীতমের সম্পত্তি মোট বেড়েছে আটশো বিলিয়ন ডলার, যেটা অর্থনীতির পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার সংকোচনের তুলনায় কিছুই না। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন, অর্থনীতি এত নেমে গেলে ওঁদের ওইটুকুই বা বাড়ে কীভাবে? এর সম্পূর্ণ উত্তর হয়ত বা মিলবে কয়েক বছর পরে, সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্যের আহরণ ও বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হলে। কিন্তু, যুক্তিসঙ্গত কিছু অনুমান এখনই করা যায়। কলকারখানা ও গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে ম্যানুফ্যাকচারিং পুরো বিপর্যস্ত হয়, এবং পরিসেবাও অনেকটাই। কিন্তু শেয়ার বাজার, আইটি, ই-কমার্স এইসবের ব্যবসা লকডাউনে কমবার কথা ছিল না, বরং তা বেড়েছে। এই সময়কালের মধ্যে যাঁরা তাতে বেশি করে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা সুফল পেয়েছেন, এর মধ্যে বিরাট ধাঁধা তেমন কিছু না-ও থাকতে পারে।
লকডাউন-ও হয়েছে, এবং কিছু ধনীর রেস্তোও বেড়েছে, অতএব প্রথমটাই দ্বিতীয়টার কারণ --- এটা হচ্ছে লজিকের এক বিখ্যাত ফ্যালাসি। তাকে লাতিন ভাষায় বলে, 'পোস্ট হক, এর্গো প্রপ্টার হক', ছোট করে 'পোস্ট হক ফ্যালাসি'। আমার পেটব্যথা হচ্ছিল, এবং মা শীতলার চন্নমেত্তর খাবার কিছুক্ষণ পরে সেটা চলে গেল --- এ থেকে প্রমাণ হয়না যে চন্নমেত্তর খাওয়াটাই পেট ব্যথা চলে যাবার কারণ। ঠিক সেই রকম, বাড়ির উঠোনে যেদিন বকুল ফুল ফুটল ঠিক সেই দিনই যদি এ বাড়ির টেঁপিরানি ও বাড়ির ও বাড়ির পটলার সঙ্গে সটকায়, তার মানে এই না যে টেঁপি বকুল ফুলের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়েই সটকেছে। দুটো ঘটনা 'ক' এবং 'খ' পরপর ঘটলেই প্রমাণ হয়না যে, 'ক'-ই হল গিয়ে 'খ'-এর কারণ।কাজেই, কতিপয় ধনীর ধনবৃদ্ধি লকডাউনের পরে ঘটলেই দুটোর কার্যকারণ প্রমাণিত হয়না, সেটা প্রমাণ করতে গেলে আরেকটু খাটতে হয়। অরূপবাবুকে অনুরোধ করব, দুশো টাকার জিডিপি নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি লজিকের বইগুলোও একটু খুলে দেখুন, লজিকের ম্যাস্টরেরা যে কত আগে থেকে ভ্যাকসিন-কোম্পানিদের সঙ্গে সাঁট করে বসে আছে, সে ষড়যন্ত্র স্বচক্ষে দেখতে পাবেন!
অরূপবাবু বলেছেন, "ট্রায়াল মানে যে যাচাই সেকথা দেবাশিসবাবু ভুলেই মেরে দিয়েছেন? যাচাই মানে তো সুফল, কুফল দুইই ঘটতে পারে; তা বোঝার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তার হিসেব করার ধৈর্য থাকছে না কেন?"
এখানে মুশকিলটা হচ্ছে, ইতিমধ্যে মেটা-অ্যানালিসিসে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা খুব ভালভাবেই প্রমাণ হয়ে গেছে, এবং আমি তা লেখায় পরিষ্কার করে বলেছি, প্রামাণ্য গবেষণাপত্রের রেফারেন্স-ও দিয়েছি। অরূপবাবুর এ মন্তব্য থেকে বোঝার উপায় নেই, তিনি আদৌ তা পড়েছেন কিনা, বা পড়ে থাকলেও বুঝেছেন কিনা। গবেষণাপত্র পড়ে বুঝব না, অতএব তা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করাই ভাল --- এ মনোভাবটা বোঝা কঠিন না, কিন্তু এই অজ্ঞতাটাকেই বেশ একটা তেরিয়া মেজাজের প্রতিবাদ হিসেবে হাজির করার মধ্যে সততার বহরখানি দেখে চমৎকৃত হতে হয়!
ভেবে অবাক হই, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লাভ করতে গেলে কলকারখানা দোকান-পাট স্কুল-কলেজ খুলে কর্মীদেরকে কাজ করতে দিতে হয়, এবং সে সব বন্ধ হয়ে গেলে অর্থাগমের সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায় --- এই ধরনের একটা অতি সাধারণ কথাকে অস্বীকার করতে গেলে কী ধরনের উন্মত্ত বোকামি লাগে! তিনি বলেছেন, "এককালে রাস্তায় মজদুরদের মিছিল দেখতাম, তারা ছাঁটাইের বিরোধিতায় পথে নেমেছে। দেবাশিসবাবুর এই তত্ত্ব যদি তখন জানা থাকত, তাহলে মিছিলের সামনে গিয়ে নেতার হাত থেকে লালপতাকা ছিনিয়ে নিয়ে বলতাম, আপনারা ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করছেন? আপনি জানেন, ছাঁটাই হলে মালিকের মুনাফা কমে যায়? কেননা, শ্রমিকের শ্রম শোষণ করেই তো মালিকের মুনাফা হয়। আপনারা দাবি তুলুন মাত্র দু'শ শ্রমিক ছাঁটাই করা চলবে না, কম করেও হাজার ছাঁটাই চাই। মালিকের মুনাফার থলি তাহলে খালি হয়ে যাবে।" আজ্ঞে না মহাশয়, আপনি তা বললেও শ্রমিকেরা তা শুনত না, কারণ তারা আপনার মতন শেয়াল-পণ্ডিত নয়। সবাইকে ছাঁটাই করে কারখানা লাটে তুলে দিলে সত্যিই মালিকের মুনাফার থলি খালি হয়ে যাবে, কিন্তু তারা তো তা চায় না, তারা ওই মুনাফা থেকে সম্মানজনক ও ন্যায়সঙ্গত ভাগটুকু চায়।
পরিশেষে বলি, তিনি যে শুধু আমার নিন্দা করেছেন তা নয়, অন্তত একটি প্রশংসাও করেছেন। বলেছেন, "দেবাশিসবাবু বোকা নন"।
বসে বসে ভাবি, তিনি না হয় আমাকে সার্টিফিকেট দিলেন, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিশুদ্ধির সার্টিফিকেট-টা কে দেবেন তবে?