সম্প্রতি “গুরুচণ্ডালী” নামে একটি ওয়েব-ম্যাগে জনৈক দেবাশিস ভট্টাচার্য একটি লেখা লিখেছেন যার শিরোনাম “প্রসঙ্গ কোভিড ও ভ্যাকসিন : মাননীয় ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক, আপনাকে বলছি স্যার”।
প্রথমেই খটকা লাগে, ‘আপনাকে’ বলতে ঠিক কাকে বোঝানো হচ্ছে তা লেখক বলেননি। বললে খুঁজে পেতে দেখে বুঝতে সুবিধে হত, অনুল্লেখিত সেই ‘তিনি’ কখন, কোথায় ‘ষড়যন্ত্র’-এর তত্ত্ব এনেছেন। যাহোক...
লেখাটার মোদ্দা কথা হল, সারা পৃথিবীজুড়ে যে ভয়ঙ্কর অতিমারি শুরু হয়েছে, একদল অপবিজ্ঞানী সেই অতিমারির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং তার মোকাবিলায় জন্য রাষ্ট্রসহ নানা “বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা” যে সমস্ত জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। তারা বলছে এইসবই আসলে আন্তর্জাতিক পুঁজির ষড়যন্ত্র। সবকিছুর পেছনেই চিরকাল একদল খুঁত-সন্ধানী থাকে। তাদের সন্দেহ বাতিক প্রায় অবসেসিভ কমপালসিভ ডিস-অর্ডারে পৌঁছায়। এরাই ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক।
যেহেতু শিরোনামে “ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক” শব্দবন্ধ দিয়ে আলোচনা শুরু, কাজেই এই শব্দ-বন্ধের অর্থ খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। এই “ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক”রা কিন্তু ষড়যন্ত্র করে না। তারা সমস্ত কিছুর পিছনেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। তাই তারা তাত্ত্বিক। আঁতেলও বলা যায়।
“গুরুচণ্ডালী” মূলতঃ বাম ঘেঁষা তাত্ত্বিক বা আঁতেলদের সংগঠন। যদিও “বাম” শব্দটা ফাজি। বামেদের আবার নানা জাতগোত্র আছে। উনিশশতকের ব্রাহ্ম শব্দটাই সম্ভবতঃ অপভ্রংশ হয়ে বামে পরিণত হয়ে! আবার ব্রাহ্মও এসেছে ব্রাহ্মণ থেকে। এই তিন প্রজাতির লক্ষণ হল, যখন যে শক্তি ক্ষমতায় থাকে তার সিংহাসনের পিছনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার তাত্ত্বিক ছত্রধর হওয়া। ক্ষমতার কানে কানে অবিরাম বলে যাওয়া, কারা কীভাবে আপনার মহান কর্মকাণ্ডগুলোকে প্রজাবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে অবিরাম প্রচার করে চলেছে। আপনার সৎ উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করছে। সেই ক্ষমতা রাজা উজির সুলতান, বড়লাট কিম্বা মহাকরণ, নবান্ন, টিউটোপিয়া যাই হোক না কেন। এঁরা চরিত্রে বৌদ্ধিক বা আঁতেল। সেই মনুসংহহিতা থেকে শুরু হয়ে গুরুচণ্ডালী। মোডাস অপারেণ্ডি হল, শুরুতেই সেই সমালোচকদের দাগিয়ে দেওয়া। এইখানে যেমন “ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক”। কয়েকপাতা জুড়ে শুধু দাগ, দাগ, দাগিয়ে যাওয়া। পরে যাহোক কিছু সমালোচনার উত্তর দিলেই হল। শ্রোতাতো বুঝেই গেছে এঁরা ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক। এদের কথা ধরতে নেই।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যারা বলে ১৯৪৯-এ বাবরি মসজিদে হঠাৎ রামলালার আবির্ভাব, ১৯৯২-তে বাবরি মসজিদের ধ্বংসলীলা, ২০০২সালে রামমন্দির প্রত্যাগত সন্নাসীদের পুড়িয়ে মারা যার ফলশ্রুতিতে কুখ্যাত গুজরাট-গণহত্যা, সবই নাকি “হিন্দুরাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র! এই ষড়যন্ত্র সার্থক হয়েছে রাম মন্দির নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পরে। এসব কথা যারা বলে তারা যে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
সব তাত্ত্বিকদেরই একটা ইতিহাস থাকে। কবে কীভাবে এই ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের আবির্ভাব? জানা নেই। কিন্তু প্রথম ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের চিনতে পেরে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছিল আমেরিকার একটি সংস্থা। সেখানেও প্রচুর বুদ্ধিজীবীর সমাবেশ। ধীরে ধীরে আজ এই শব্দ-বন্ধটি “প্রতিক্রিয়াশীল”, “ধান্দাবাজ” জাতীয় গালাগালে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার পর একদল মানুষ, সরকারি ভাষ্য মতে অসওয়াল্ড একাই খুন করেছে তা সন্দেহ করতে শুরু করে। তাদেরকেই “ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক” বলে চিহ্নিত করেছিল ‘সিআইএ’। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন। ‘সিআইএ’, এককালে যাদের বিরুদ্ধে নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলা হত। তারা সফল। “ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক” আজ প্রতিষ্ঠিত গালাগাল। আজ বাম আঁতেল গুরুরা ঠিক বুঝে ফেলেছে যে কোভিডের বিরুদ্ধে এই বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক বাইডন, সিডিসি, হু থেকে মোদি, মমতা, নোভাক-বহিষ্কার থেকে মাস্ক, ভ্যাক্সিন ম্যাণ্ডেট, এই সবটাই যারা পুঁজির চক্রান্ত বলে মনে করে আদতে তারা ওই সিআইএ বর্ণিত ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক। এতটা যারা অবলীলায় বুঝে ফেলেন তারা গুরু বৈকী।
এইখানে আমার মুশকিল হল, এখন তো আর সিধু জ্যাটা নেই; তার জায়গায় এখন গুগল-জ্যাঠা। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি প্রায়শঃই গুগল জ্যাঠার শরণাপন্ন হই। (সেটা যে কত বিপজ্জনক, তার বাজার চলতি ব্যাখ্যা জেনেই বলছি)। এক মজার খেলা, প্যালিনড্রোম। একটা সেন্টেন্স বাঁদিক থেকে পড়লেও যা, ডানদিক থেকে পড়লেও তাই। “বিরহে রাধা নয়ন ধারা হে রবি”। বামপন্থী হয়ে বাঁদিক থেকে পড়ুন। এবার দক্ষিণপন্থী হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে পড়ুন। একই কথা। করোনা নিয়ে, ভ্যাক্সিন নিয়ে, মাস্ক নিয়ে সারা পৃথিবীর বহু বিশেষজ্ঞ নানা ভিন্ন মতামত দিচ্ছেন। অনেকেই কিন্তু ফাউচির মত শুধু ন্যারেটিভ নয়, রীতিমত ডেটাও দিচ্ছেন। আবার যারা বলছেন, এ এক অভূতপুর্ব অতিমারি। তিনকোটি লোক মারা যাবে ছিল ভবিষ্যতবানী। তারাও যে সবটাই ন্যারেটিভ দিয়েছেন তা নয়, কিন্তু তারা ডেটা খুব কম দিয়েছেন, তারা শুধু ভবিষ্যত-বক্তা। তাই যারা এই সরকারি বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ করছেন, এবং তাদের যারা ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন, তাদেরকেও ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক বলা যায় তো! প্যালিনড্রোম। হেহে।
আসা যাক যেখান থেকে দেবাশিসবাবুর আলোচনায়।
“(১) লকডাউন করে কর্মস্থল আর গণপরিবহন বন্ধ করে দিলে দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের যে অসীম দুর্দশা হয়, সে তো আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।... দরিদ্রলোককে স্রেফ না খেয়ে বসিয়ে রেখে তো আর ধনীরা ধনী হয় না, ওরা ধনী হয় তাদেরকে খাটিয়ে, তাদের শ্রমজাত মুনাফা সংগ্রহ করে। কাজেই, গায়ের জোরে আইন জারি করে তাদেরকে ঘরে বসিয়ে রেখে পুঁজিবাদের কোনও লাভ নেই, ওভাবে লাভ হলে তো ধনী ও ক্ষমতাবানেরা সব সময়ে সেই চেষ্টাই করত, তার জন্য অতিমারির দরকার হত না।“
অনবদ্য যুক্তি। এককালে রাস্তায় মজদুরদের মিছিল দেখতাম, তারা ছাঁটাইের বিরোধিতায় পথে নেমেছে। দেবাশিসবাবুর এই তত্ত্ব যদি তখন জানা থাকত, তাহলে মিছিলের সামনে গিয়ে নেতার হাত থেকে লালপতাকা ছিনিয়ে নিয়ে বলতাম, আপনারা ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করছেন? আপনি জানেন, ছাঁটাই হলে মালিকের মুনাফা কমে যায়? কেননা, শ্রমিকের শ্রম শোষণ করেই তো মালিকের মুনাফা হয়। আপনারা দাবি তুলুন মাত্র দু'শ শ্রমিক ছাঁটাই করা চলবে না, কম করেও হাজার ছাঁটাই চাই। মালিকের মুনাফার থলি তাহলে খালি হয়ে যাবে।
এটাকে কী বলব? কাণ্ডজ্ঞানের অভাব?
এবার ন্যারেটিভ ছেড়ে ডেটায় আসা যাক।
অতিমারিতে এদেশে কি সত্যিই বেকারি বেড়েছে? মহেশ ব্যাস, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) বলছেন, গতবছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এককোটি মানুষের জীবিকা শেষ হয়ে গেছে। তার বক্তব্য ৯৭% মানুষের রোজগার কমেছে এই অতিমারি কালে। কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে অতিমারি থাবা বসিয়েছে তার বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে যান। দেখুন। https://timesofindia.indiatimes.com/readersblog/small-thoughts/impact-of-covid-19-on-employment-in-india-33336/
বেকারি যখন এইভাবে বেড়েছে, তখন দেবাশিসের তত্ত্ব অনুযায়ী পুঁজির হালও খারাপ হবার কথা, কেননা শ্রমিকের রক্ত শোষণ করার সুযোগ থেকে পুঁজি তথা কর্পোরেট সেক্টর বঞ্চিত হচ্ছে। তা কি হয়েছে? আমরা আমাদের দেশের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি।
অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে ২০২১ সালে ভারতে ৮৪% ভারতবাসীর রোজগার কমে গিয়েছে। পাশাপাশি এই অতিমারি কালে এদেশে বিলিয়নেরারে সংখ্যা ১০২ থেকে লাফিয়ে ১৪২ হয়ে গিয়েছে। সময়টা মার্চ, ২০২০~ নভেম্বর, ২০২১। বিলিয়নেয়ারদের মোট সম্পত্তি ২৩.১৪ লক্ষকোটি থেকে লাফিয়ে হয়েছে, ৫৩.১৬লক্ষকোটি। ৪,৬ কোটি ভারতীয় চূড়ান্ত দারিদ্রের সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। ভারত বিলিয়নেয়ারের সংখ্যায় বিশ্বে তৃতীয় স্থানে। এইসময়েই ভারতের প্রথম স্তরের একশজনের মোট সম্পত্তি ৫৭.৩ লক্ষকোটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। (https://indianexpress.com/article/india/oxfam-report-2021-income-households-fell-7726844/lite/)
তাহলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? কারা ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক? “দরিদ্রলোককে স্রেফ না খেয়ে বসিয়ে রেখে” “ধনীরা ধনী” হচ্ছে কীভাবে? তবে কি অক্সফ্যাম, সিএমআইইএর অর্থনীতিবিদ, সংখ্যাতত্ত্ববিদেরাও ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক? যদি হয়, তাহলে অতিদ্রুত এদের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। দেবাশিসবাবুরা সেই কাজে হাত দিন!
দেবাশিসবাবু বোকা নন। অতিমারিতে যে প্রচুর মানুষ বেকার হয়েছে তাও তিনি মানছেন। কিন্তু পুঁজির রকেট-গতিও মানতে পারছেন না। তাহলে অতিমারিসৃষ্ট দারিদ্রের গর্ত কী দিয়ে ভরাট করা যাবে?
“এবং, লকডাউনের উল্টোপিঠটাও এখানে দেখতে হয়। এতে যে শুধু প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাইই নয়, বেশ কিছু মানুষ আবার বাড়ি বসে বসে দিনের পর দিন বেতনও পেয়েছেন, সংখ্যায় অনেক অল্প হলেও।“
অর্থাৎ যারা বাড়ি বসে দিনের পর দিন বেতন পেয়েছেন, বেকারির গর্তের মাটি দিয়ে তাদের অবস্থানটাই উচু হয়েছে। হাসব, না কাঁদব?
আরও অদ্ভুতুরে তথ্য আর তত্ত্বের ফুলঝুড়ি আছে। (চলবে?;নাকি এখানেই ইতি!)
The CDC found that an unvaccinated American is 14 times more likely to die from Covid-related complications than a fully vaccinated person.
This goes up to 20 times more likely, when compared with someone who has received a booster vaccination.
আর কত দেব? হাত ব্যথা করছে।